◆ স্বপন পাল / সংক্রমণ যখন সমাজে ও মনে ।

 স্বপন পাল / সংক্রমণ যখন সমাজে ও মনে ।

সমগ্র বিশ্ব বর্তমানে এক অতিমারীর দ্বারা পীড়িত। এতটাই সেই পীড়া যে সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, জীবনবোধ সব কিছুই পিছোতে পিছোতে মানবকুল আজ যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুহার অন্ধকারকে আশ্রয় করেছে বাধ্য হয়ে। ভয় মানুষের বিশ্বাসের ভিতটুকু টলিয়ে দিয়েছে। এমনকি মনুষ্যেতর প্রাণীকুলের সচ্ছন্দ জৈবিক জীবনকেও সে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। মানুষ কি এর আগে মহামারী দেখেনি? স্প্যানিশ-ফ্লু, প্লেগ, ইবোলা জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাবে বিনষ্ট হয়েছে অগনিত মানুষের জীবন। আর রোগকে প্রতিরোধ করার অস্ত্র ভ্যাকসিন তো সব সময় রোগের আবির্ভাবের পরেই হয়ে থাকে। ক্ষয় ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায় আগেই, নিবারণ করা কতটা যায় সে পরিসংখ্যান বলবে, তবে সেই রোগের পুনরায় আগমন ঘটলে তা যাতে আবার মহামারী বা অতিমারী সৃষ্টি না করে তা নিশ্চিত করতে ওই ভ্যাকসিন কাজে লাগে।
​ ​ ​ ​ ​ 
কোভিড-১৯ একটি ভাইরাস, যা বর্তমান পৃথিবীতে এবং ভারতে অতিমারীর সৃষ্টি করেছে। অনেকে দেখছি একে জীবাণু বলছেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া দেখা যায়না এমন জীবকে জীবাণু বলে। ভাইরাসের জীবন নেই। সেই অর্থে এটি জড় পদার্থ। একে বলা যেতে পারে বীজাণু। এরা জৈব জড় পদার্থ যা জীবিতের শরীরে তার শরীরের কোষের নানা বিপাকীয় বা শারীরবৃত্তিয় পদ্ধতির মাধ্যমে ঢুকে যায় ও কোষ তার নিজের অজান্তেই ওই বাইরে থেকে আসা জৈব অণুটিকে কপি
করে যেতে থাকে। এভাবেই প্রচুর অনুকৃতি তৈরি হয় ওই বীজাণুটির। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি। স্বাভাবিক ভাবে কপি করতে যে মাল মশলা লাগবে তা ঐ কোষটিই যোগান দেবে। এভাবেই অতিমাত্রায় কপি হয়ে যাওয়া বীজাণুর ঠাসাঠাসি চাপে কোষটি যাবে ফেটে ও ধ্বংস হয়ে। একটি কোষ নয়, এই প্রক্রিয়ায় লাখে লাখে দেহ কোষ ধ্বংস হবে। তাহলে আমাদের শরীরের যে কমব্যাট ফোর্স আছে আমাদের রক্তে, শ্বেত- রক্তকণিকা তারা কি করছে এই সময় ? বাইরে থেকে জীবাণু হোক বা বীজাণু তারা টের পেলো না ? তারা অবশ্যই টের পেয়েছে, যে মূহুর্তে একটা বাইরের প্রোটিন-কণা শরীরে প্রবেশ করে আমাদের শ্বেত-রক্তকণা খবর পেয়ে যায়, তারা ছুটে এসে ওই ভিনদেশী কণাটিকে যাচাইয়ের কাজে নেমে পড়ে। আমাদের রক্তে
শ্বেতকণিকা পাঁচ প্রকারের। মোনোসাইট, লিম্ফোসাইট, নিউট্রোফিল, ব্যাসোফিল ও ইয়োসিনোফিল। এদের সব কাজ শরীরের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত। মোনোসাইট ব্যাকটিরিয়া ধ্বংস করে, লিম্ফোসাইট অ্যান্টিবডি তৈরি করে ব্যাটিরিয়া, ভাইরাস প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের অনুপ্রবেশকারীকে আক্রমণ করে ও বিনষ্ট করে, নিউট্রোফিল হলো প্রথম সারির সৈনিক, ওরা ব্যাক্টিরিয়া, ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে ও তাদের খেয়ে হজম করে ফেলে। ব্যাসোফিলকে বলা যেতে পারে হুইসেল ব্লোয়ার, এরা সবার আগে টের পায় কিছু একটা ক্ষতিকর বস্তু বাইরের থেকে শরীরে ঢুকে পড়েছে। এরা হিস্টামিন জাতীয় রাসায়নিক নিঃসরণের দ্বারা অ্যালার্জীর সৃষ্টি করে ও শরীরের অন্যান্য প্রতিরক্ষা বিভাগকে সতর্ক করে।ইয়োসিনোফিল অ্যালার্জীর সংবেদনে সহায়তা দেয় ও বিভিন্ন প্যারাসাইট এবং ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করে। এখন স্বাভাবিক ভাবে একজন মানুষ বেশিরভাগ সময়
বুঝতেই পারেনা যে তার শরীর নানা প্রকারের ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইট বা ফাঙ্গাসের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে বা হয়েছে। তার শরীরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সৈনিকরা সুস্থ-সবল ও সঠিক সংখ্যায় থাকলে আক্রান্ত মানুষ টেরও পাবেনা আক্রান্ত হওয়ার কথা। কখনো শ্বেত রক্তকণার দৌড়াদৌড়িতে শরীরের একটু তাপমাত্রা বাড়লো। বোঝা গেল জ্বর। বিশ্রাম ও অল্প সল্প জ্বর কমানোর ওষুধে সেরেও গেল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যদি এই প্রতিরক্ষা বাহিনী দুর্বল হয়, অর্থাৎ তারা নিজেরাই সুস্থ-সবল নয়, তারা সংখ্যায় কম বা তাদের বেশিরভাগ শরীরের অন্য ফ্রন্টে লড়ছে তখনই হয় মুশকিল। চিনে ওঠা ক্ষতিকর অনুপ্রবেশকারীকে তারা আক্রমণ তো করে কিন্তু ধ্বংস করতে পারেনা বদলে নিজেরাই মারা পরে তাদের ক্ষতিকর প্রভাবে। তখন শরীর বেদম অসুস্থ হয়ে পড়ে।আর এই ঘটনা ঘটে নানা কারণে।
​ ​ ​ ​ ​ ​ 
শরীরে দীর্ঘদিন কোন রোগব্যাধি কেউ বয়ে বেড়াচ্ছেন, যেমন ডায়াবেটিস, কিডনির অসুখ, ফুসফুসের ব্যাধি, ক্যানসার ইত্যাদি মানুষটিকে আগেই ঘায়েল করে রেখেছে। তার ইমিউনিটি সিস্টেম আগের থেকেই দুর্বল, তার প্রতিরক্ষা বাহিনীর বেশিটাই আগে থেকে জেঁকে বসা অসুখটির ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।আর শ্বেতকণা তৈরির আঁতুরঘর যে অস্থিমজ্জা তার পক্ষেও দিবারাত্রি শিফট চালিয়েও পর্যাপ্ত পরিমান শ্বেতকণা সাপ্লাই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তখন শরীর চলে যায় অনুপ্রবেশকারীর দখলে। হাসপাতাল, ডাক্তার, আই সি ইউ, ভেন্টিলেটর এইসব তখন লড়াইয়ের মাঠে নামে। টিকে থাকা নির্ভর করে তখন ক্ষতির পরিমানের উপর। এছাড়া কোন মানুষের যদি জন্মগত ভাবে বা অন্য কোন কারণে রক্তের শ্বেতকণিকা ত্রুটিযুক্ত হয় তাহলেও তার শরীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাবে। যদি কারো কোন কারণে ঘুম ও বিশ্রামের যথেষ্ট অভাব হয় তাহলেও প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে। কারণ বিশ্রামের সময় শরীরের অস্থিমজ্জায় সুস্থ উৎপাদন হয়ে থাকে। আরো একটা ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো বিভিন্ন ধরণের ওষুধ যা বিভিন্ন সময়ে আমরা নানা কারণে ডাক্তারের নির্দেশে বা নিজেরাই ডাক্তারি করে গ্রহণ করে থাকি। আমরা জানিও না ওই ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আর এভাবেই ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ভাইরাসের মতো একটা অতিপ্রাচীন আণুবীক্ষিক জৈব জড় প্রোটিনকণার কাছেও আমাদের এতো উন্নত মানব শরীর হার মেনে নেয়। এই লড়াইয়ে দৈনন্দিন জীবনের লাগাম ছাড়া উদ্বেগ একটি বড় ঘর-শত্রু বিভীষণ। তার কারণে বহু ব্যাধি শরীরে অনায়াসে বাসা বাঁধে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়।
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ 
আজকের পৃথিবীতে মানবজাতি চিকিৎসা বিজ্ঞানে যথেষ্ট উন্নত। কিন্তুএকটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রোটিন কণা যা নির্জীব ও আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় তার প্রভাবে পুরো মানব প্রজাতি অতিষ্ট, ভীত এবং অসহায় হয়ে পড়েছে। মানব শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও তার অকৃতকার্য হওয়ার নানা কারণগুলি পূর্বেই আলোচনা করেছি। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো মেডিকেশন, অর্থাৎ ওষুধের প্রয়োগ। ওষুধ সর্বক্ষেত্রেই বলা যায় বিষ। কিন্তু রোগ উপশমের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করতেই হয়। এই মাত্রাটি ঠিক করেন ডাক্তার। ওষুধ তৈরী করে ওষুধ কোম্পানিগুলি যা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নামে একদল এজেন্টের মাধ্যমে ওষুধের দোকানে এসে পৌঁছায়, তবে তারও আগে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ পৌঁছে যান ডাক্তারদের নিভৃত চেম্বারে, যেখানে তাঁরা ওষুধের গুণাগুণ ও সেই ওষুধের অধিকমাত্রায় বিক্রি করাতে পারলে ডাক্তারের কি কি লাভ হবে তা বিশদে বুঝিয়ে দেন। এরপর বিবেচনা ডাক্তারের। বিভিন্ন রোগীর প্রেসক্রিপশন ভরে উঠতেই পারে ওই ওষুধের রেকমেন্ডেশনে। রোগীও পরম বিশ্বাসে ওষুধের ব্যবহারে সুস্থ হন আপাতভাবে কিন্তু অসুস্থ হন অন্যভাবে। কারণ অনেক বাতিল বা উপযুক্ত ভাবে পরীক্ষিত নয় এমন ওষুধ এইভাবে মেডিক্যাল রিপ্রজেন্টেটিভের চাতুরী বা পরোক্ষে ওষুধ কোম্পানির অসততায় বাজারে রমরমিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগে ও ব্যবহারে মানব শরীর অনেক ক্ষেত্রেই হারাচ্ছে তার ইমিউনিটি, কমে যাচ্ছে প্রত্যক্ষ ভাবে কখনো বা পরোক্ষ ভাবে শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষার ক্ষমতা। সেই ছিদ্রপথেই লোহার বাসর ঘরে ঢুকে পড়েছে করোনার কালনাগিনী। বলছিনা এটাই একমাত্র পথ, এটাও একটা পথ। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল ও নানা
ধরণের নার্সিংহোম খুব সহজে একজন সাধারণ সর্দি-কাশির রোগীকে অ্যাজমার রোগী বানিয়ে দিতে পারে, বাতের ব্যথায় কাতর মানুষের হাঁটুর অপারেশন করিয়ে
কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপনে বাধ্য করতে পারে, নানা উপসর্গ নিয়ে হাজির মানুষের বাইপাস সার্জারি, স্টেন্ট বসানো সবই করতে পারে কারণ মানুষের ডাক্তারকে বিশ্বাস না করে উপায় নেই আর সেই বিশ্বাসের ফায়দা তুলে ডাক্তার, ফার্মেসি, এক্স-রে, স্ক্যান, এম আর আই, রক্ত ও অন্যান্য দেহজ বস্তু পরীক্ষার ল্যাবরেটারী সবাই মিলে এক ভয়ঙ্কর অলাতচক্র গড়ে ঘিরে রেখেছে মানব
সমাজকে। প্রসুতির বাচ্চা স্বাভাবিক ভাবে হবার জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত অধিক খরচের সিজারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। কিন্তু পোস্ট অপারেটিভ ওষুধগুলোর
কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই ? এভাবেও শরীরে নষ্ট হয় প্রতিরোধ ক্ষমতা। লাভ ও লোভ ধ্বংস করে সভ্যতার বুনিয়াদ। সমাজের শরীরে এই সংক্রমণ তো বহু পূর্বেই সমাজকে বিশ্বাসের ভিত থেকেই নড়িয়ে রেখেছে।
​ ​ ​ ​ ​ ​ 
খুব গরীব যে মানুষগুলো তারা তো অপুষ্টির কারণেই হারায় তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতা। তবু তারা প্রকৃতির সাথে, মাটি, ময়লা, অপরিশোধিত জলের সাথে দিন কাটিয়ে এক স্বাভাবিক ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা পেয়ে থাকে শরীরে। কিন্তু সেই হতদরিদ্র মানুষেরা যখন দিনের পর দিন রোদের প্রখর তাপে না খেয়ে এমনকি তৃষ্ণার জলটুকু না পেয়ে হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটতে থাকে তখন তার শরীরে আর কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে পারে ? সব থেকে বড় ভয়ঙ্কর বস্তু হলো উদ্বেগ। যা শরীর মন সব কিছুকেই তছনছ করে দেয়।

উদ্বেগ যে কোন অসুখকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে শরীরে। একদিকে তাদের কাজ হারানোর দুঃচিন্তা, আজ কি খাবো, কি খাওয়াবো বাচ্চা বা তার উপর অতিনির্ভরশীল যারা তাদের, সেই সাথে কোথায় সরকারী নির্দেশে পুলিশ বাহিনী দাঁড়িয়ে আছে পথ আটকানোর জন্য এই সব আতঙ্কে মানুষগুলো আগেই তো আধমরা হয়ে হাঁটছিল। ভাইরাস হোক বা যে কোন রোগ-ব্যাধি কবে আর ধনী দরিদ্র বাছিয়া বাছিয়া খায় ?
​ ​ ​ ​ ​ ​ 
ভাইরাস এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের বহু লক্ষ বছর পূর্বের থেকে আছে। আর ভাইরাসও বহু সহস্র প্রকারের, যাদের সঙ্গে নিয়েই আমরা বসবাস করি। ভাইরাস সাধারণত দুই ধরণের হয়। আর এন এ ভাইরাস আর ডি এন এ ভাইরাস। রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড এর প্রাথমিক গঠন হিসেবে অবস্থান করে। এটি ফিতের আকারে একপ্রকার প্রোটিন তৈরীর সংকেতবাহী উপাদান। এটি আর একটি প্রোটিন খোলায় আবদ্ধ থাকে যার বাইরে থাকতে পারে আর এক প্রোটিন ও ফ্যাটের আবরণ। ভিতরে রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের একটি প্যাঁচালো ফিতে থাকলে তারা আর এন এ ভাইরাস যেমন নানা ফ্লুয়ের ভাইরাস আর রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের দুটো ফিতে
থাকলে তারা ডি এন এ ভাইরাস যেমন কিছু ক্যানসারের ভাইরাস। যদিও যেমন বলা হলো ভাইরাস চরিত্র ততোটাও সরল নয়। এটা একটা সাধারণ জ্ঞান। ভাইরাসের আণবিক শরীরে কোন শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা নেই। তাদের না আছে হাত, পা, ডানা বা লেজ যা দিয়ে তারা নিজেদের সঞ্চালিত করবে বা এখান থেকে ওখানে যাবে। পোষকের শরীর ছাড়া তাদের এক থেকে দুই হবারও উপায় নেই। পোষককে হতে হবে জীবন্ত কোষযুক্ত জীব অর্থাৎ প্রাণী বা উদ্ভিদ, যেখানে ভাইরাসের কণাটি পেয়ে যাবে শক্তির উৎস, নতুন প্রোটিন এবং কিছু প্রয়োজনীয় এনজাইম বা উৎসেচক। এগুলির সাহায্য পেলে ওই ভাইরাসের রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের সঙ্গে থাকা সংকেত বা কোড ডিকোড হয়ে যায়। জীবিত পোষক-কোষ পড়ে ফেলে ভাইরাসের শরীরের অনুরূপ অনুকৃতি বা কপি তৈরী করতে হবে। ব্যস আর যায় কোথা, শুরু হয়ে যায় বোকার মতো কপি করার কাজ। যেন নিজের বাড়ির ভিতর থেকে মাটি তুলে তুলে মূর্তি গড়ে যাওয়ার কাজ। শেষে যেমন বাড়িটি ধ্বসে পড়বে তেমনি কোষটির অভ্যন্তরে বহু ভাইরাস তৈরী হয়ে কোষটিকে ধ্বংস করবে ও পরবর্তী কোষে সেই একই কাণ্ড ঘটতে থাকবে। প্রতিরক্ষার কাজ ঠিকঠাক হলে তেমন কিছু টের পাওয়া যাবে না। কিন্তু তা না হলেই বিপদ।
​ ​ ​ ​ ​ ​ 
ভাইরাস একটি জীবিত কোষের কাছাকাছি এলেও যদি ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি ও নির্দিষ্ট মাত্রার জিঙ্কের অভাব শরীরে না থাকে তবে ওই কোষের রিসেপ্টার
ভাইরাসটিকে কোষের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেবেনা। অর্থাৎ দোর গোড়াতেই ভাইরাস আটকে যাবে এবং তার রেপ্লিকেশন অর্থাৎ অনুকৃতি হওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি ও জিঙ্ক ইমিউন সিস্টেমকে আরো মজবুত করে তোলে।

কোভিড-১৯ ভাইরাস একটি আর এন এ ভাইরাস। পোষকের শরীরের জীবিত কোষ এদের কোটি কোটি অনুকরণ বানিয়ে নিজের শরীরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে যদি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দুর্বলতা থাকে। এখন প্রতিরোধের কিছু বাহ্যিক বিধি ব্যবস্থা রয়েছে, যেগুলি মেনে চললে অবশ্যই রোগ বা ভাইরাসের এক পোষকের শরীর থেকে অপর মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া আটকানো যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে স্থুল এই পদ্ধতি কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। কার শরীরে ইমিউনিটি কত শক্তিশালী তা যেমন প্রতিনিয়ত মাপা সম্ভব নয় তেমনই একই পরিবারের বা কাছাকাছি থাকতে বাধ্য এমন সব মানুষের ইমিউনিটি একরকম সুস্থ-সবল হবে তার সম্ভাবনাই বা কোথায় ? কাজেই সর্বত্র সামাজিক দূরত্ব বা দৈহিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দূর ভ্রমণ, সমাবেশ বা জমায়েত, উৎসব আয়োজন ইত্যাদি যার মাধ্যমে মনে করা যেতে পারে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে অনেকের মধ্যে, তা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। একত্র কাজের স্থানগুলিও সাময়িক বন্ধ করতে বলা হয়। মানুষজনকে নিজের নিজের ঘরে বা আশ্রয়ে প্রায় বন্দীত্ব মেনে চলতে হয়। যেখানে সে সব মানতে চায়না মানুষ, সেখানে কার্ফু জাতীয় সামরিক আইনও কাজে লাগাতে হয়। এই জরুরী ব্যবস্থাকে লকডাউন নামে অভিহিত করা হয়।
​ ​ ​ ​ ​ ​ 
এই পৃথিবীতে যুগে যুগে বিভিন্ন প্রকার রোগ বহুবার মহামারীর আকার নিয়েছে। সভ্যতা সর্বকালে তৎকালীন জ্ঞান ও সাধ্য অনুসারে ব্যবস্থাও নিয়েছে। ধারণা করা হয় আমাদের পূর্ববর্তী কোন কোন সভ্যতা মহামারীর কারণে পুরোপুরি ধ্বংসও হয়ে গিয়েছে। রোগ মানব সভ্যতার অগ্রগতির এক চরম বাধা হয়েছে বহুবার। তবু মানুষ হেরে গিয়ে হাল ছেড়ে দেয়নি। যা পেয়েছে, যা বেঁচেছে তাই নিয়েই আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, চলতে শুরু করেছে। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ। একক শক্তি যত অপ্রতুল হোক বহুর হাত একজোট হয়ে উত্তরণ ঘটিয়েছে। তবে সে তো চূড়ান্ত বেলায়। আপাত অবস্থায় মানুষের মধ্যে বেপরোয়া ভাব যেমন প্রকট তেমনই অতিরক্ষণশীল মানুষেরও অভাব নেই। আজ বা আগামীকাল না হলেও কয়েকদিন পর একটু একটু করে সব কিছু চালু হবে। হতে বাধ্য হবে। কল-কারখানা, ব্যবসা-বানিজ্য, দোকান, শপিংমল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, খেলাধুলা, দূর ভ্রমণ মায় নাইট-ক্লাব সবই চালু হয়ে যাবে। হবে রাজনৈতিক জমায়েতও। এতসবের পরও মানুষের মনের ভীতি কি আলোয় আলোয় ধুয়ে মুছে যাবে ? বোধহয় যাবেনা। এখনো বহুকাল ওই ভয়ের সাথেই বাস করতে হবে সকলকে। কেউ হাঁচলো বা কাশলো, তাকে এড়িয়ে যাবে পাশের জন, কাছের জন। ছয় ঋতুর দেশ আমাদের, ঋতু পরিবর্তনে, বৃষ্টিতে ভিজে হাঁচি কাশি কবে না হয়েছে ? রোদে ঘুরে এসে জল খেয়ে সর্দি-গর্মি বাধিয়ে জ্বর কাশি এ তো আকছার ঘরে ঘরে। কিন্তু ভয় তো অতো সহজে
যাবেনা। সে ঠিক মনের অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এসে ভাইরাল হবে। কি জানি, মোবাইলের আন্তরিকতা আর বসার ঘরের আন্তরিকতায় কতটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবেকে জানে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.