সুমনা সাহা

টান /সুমনা সাহা

শহরের এই দিকটা এখনও গ্রামের গন্ধ বুকে মেখে আছে। লেবুফুলের গন্ধে বাতাস বিভোর। কুয়োতলায় দিন-দুপুরেও ঝিঁঝিঁর ডাক। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ! উঠোনের সজনে গাছের ডালে বসে একটা পাখি তখন থেকে ‘পিক’ ‘পিক’ করে তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে চলেছে। ঘরকুনো একটা বিড়াল পড়ন্ত রোদের তাপ গায়ে মেখে শুয়ে আছে টেবিলের তলায় পাপোশের উপরে। চারিদিকে অদ্ভুত শান্তি। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে চা-পাতার সুগন্ধ। দেবুর কেমন তন্দ্রা আসে—সময়ের হিসেব হারিয়ে যায়। সমস্ত পরিবেশটা মনে হয় যেন ফ্রেমে বাঁধানো একটা স্থির চিত্র। 

তেরো বছরের ফ্রক পরা কুসুম যখন রাজাকার বাহিনীর কাছে ধর্ষিতা হওয়ার আতঙ্ক থেকে বাঁচতে পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় তার বড়দির সংসারে আসে, তখন দেবু চার বছরের ছোট্ট খোকন। সবে টলমল করে হাঁটতে শিখেছে। আধো আধো বুলির ফুলঝুরি নিয়ে সে কিশোরী নতুন মাসির ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। যত দিন যায়, পদ্মের কুঁড়ির মতো প্রস্ফুটিত হতে থাকে কুসুমের রূপ-যৌবন। দেবুর মা, সবিতা মহা ভাবিত হ’ন—‘এমন আগুন আমি সামলাই কী ভাবে?’ অবশেষে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে অধিক রোজগেরে, ভোলেভালা দেওরের সঙ্গে কুসুমের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। দেওর মহেশ তখন বেঙ্গল পুলিশে সদ্য নিযুক্ত কনস্টেবল। সে সপ্তাহে একবার বাড়ি আসে। মাইনের সব টাকাটাই তুলে দেয় বৌদির হাতে। মা-হারা দেওরের প্রতি সবিতার সন্তানসম স্নেহ। কুসুম তো আশ্রয়দাত্রী দিদির প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়েই আছে। সুতরাং পাড়াপড়শির মুখ বন্ধ করতে আর উঠতি ছোকড়াদের ছোকছোকানি থেকে কুসুমকে রক্ষা করার এর চেয়ে ভালো উপায় আর সবিতা খুঁজে পায় না। নিতান্ত অনাড়ম্বর ভাবে মহেশ আর কুসুমের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের চার বছর পরেও কুসুমের কোল শূন্যই থেকে গেল। কুসুমের সবটুকু আদরের একমাত্র ভাগীদার খোকন। মহেশ খোকনের কাকু হলেও বিয়ের পরেও কুসুম কাকিমা নয়, মাসিই থেকে যায়। ইতিমধ্যে সবিতার কোলে এসেছে আরও দুই নতুন অতিথি। ঘরের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংসার খরচও বেড়ে চলেছে। কিন্তু খোকনের যত্নে কোনও কার্পণ্য মহেশ বা কুসুম দ পছন্দ নয়। তাই ঘরে মাসির কাছে যতটা স্নেহ, কাকুর প্রশ্রয়ও ততোধিক। প্রত্যেক সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরার সময় খোকনের জন্য অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো স্পেশাল জামা-প্যান্ট, দামী দামী ফল-মিষ্টি নিয়ে আসে মহেশ। মহেশের দাদা রমেশ অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর দিল্লীতে একটা ভালো কাজের সুযোগ পায়। সেই সময় দেবু বেঁকে বসে। মাসিকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। অগত্যা বাধ্য হয়ে সবিতা বোনকে বলে, ‘ভগবান তো তোর কোলে একটা দিলেন না! আমাদের তো আরো দুটো আছে, তুই কি নিয়ে থাকবি? দেবু বরং তোর কাছেই মানুষ হোক। মা-মাসি আলাদা নাকি?’ সেই থেকে দেবু মাসির কাছে সেই বারাসাতের বাড়িতে রয়ে গেল। সেসব কতদিনের কথা।

এখন দেবু মুম্বাইতে সেটলড। অনেক বছর পর বারাসাতের বাড়িতে এসেছে মাসিকে বিজয়ার প্রণাম করতে। এখনও সেই পুরনো বাড়িতেই থাকে মাসি। এখানেই দেবুর স্কুল ও কলেজ লাইফ কেটেছে। তারপর ম্যানেজমেন্ট পড়তে বম্বে যাওয়া, সেখানেই চাকরি, বিয়ে। আসাই হয় না কলকাতায়। অথচ এই মাসি ছিল দেবুর প্রাণ! 

চায়ের ট্রে-তে চা-বিস্কুট-চানাচুর আর নারকোল নাড়ু সাজিয়ে মাসি ঘরে ঢোকে। বলে, ‘ও খোকন, সন্ধ্যের সময় ঘুমোস না।’ আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে দেবু। শরীরে-মনে একটা পূর্ণ শান্তির অনুভব। এটা কি মাসির জপ-তপের প্রভাব? মনে হচ্ছে তার যেন কোথাও যাবার তাড়া নেই, জগতে তার কোন কাজই নেই। পৃথিবীর এই একান্ত নিশ্চুপ কোণটা যেন আহ্নিক গতি ভুলে স্থির হয়ে রয়েছে। চায়ের কাপে আরাম করে চুমুক দিয়ে পাপোশে সুখনিদ্রারত বিড়ালের দিকে চোখের ইশারা করে দেবু বলে, ‘মাসি, এটার নাম কি গো?’ খাবার পর বেড়ালের জন্য ভাত, মাছের টুকরো রেখে দেওয়া মাসির বহু বছরের অভ্যেস। আর বিড়ালও মাসির প্রশ্রয় পেয়ে কত পুরুষ ধরে যে এখানে ঘাঁটি গেড়েছে তা কে জানে! মাসি ঠাকুরের নামে ওদের নাম রাখে। পরমেশ্বর, মহেশ্বর, নাগেশ্বর, সুরেশ্বর—এইরকম বংশপরম্পরায় চলে আসছে। মাসি হেসে বলে, ‘ও যজ্ঞেশ্বর!’ দেবু যখন ছোট ছিল, ভাবত, এইভাবে সব ‘ঈশ্বর’ শেষ হয়ে গেলে তখন কি মাসি পটলেশ্বর, বেগুনেশ্বর এইসব নাম রাখবে? 

চা খেতে খেতে মাসিকে লক্ষ্য করে দেবু। কী ভাবে মানুষটা একলা এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল! তার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। ছেলেবেলার কত স্মৃতি ভীড় করে আসে মনে। মাসির শরীর ভালো নেই। বয়স হয়েছে। কখন কি অঘটন ঘটে যায়! মাসিকে এইভাবে একলা ফেলে রাখা চলে না। এ এক মস্ত যুগব্যাধিই বলা যায়। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার বৃত্তে, ব্যস্ত জীবন ও নিউক্লিয়াস পরিবারের মধ্যে পরিবারের প্রবীণ সদস্যেরা যেন আর খাপ খায় না। ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রম, নয় নির্জন গৃহে অশক্ত দেহে একাকীত্ব সঙ্গী করে বেঁচে থাকা। 

ধীরেসুস্থে দেবু কথাটা একসময় তোলে— ‘মাসি, অনেক বছর তো হল! এবার আমার কাছে মুম্বাই গিয়ে থাকবে চল। দেখবে গিয়ে, তোমার খোকন কেমন সংসার করছে!’

মাসি দেবুর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এখানে আমার গোপাল আছে, আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে?’ 

দেবু হেসে বলে, ‘আরে, তুমি গেলে তোমার গোপালও যাবে। তোমার সঙ্গে মুম্বাই বেড়াতে যাবে।’

মাসি শুধু ম্লান হাসে। দেবু বলে, ‘এবার তো ফ্লাইটের আপ-ডাউন টিকিট করেই এসেছি। তবে ভাবছি কিছুদিন পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। কি, যাবে তো আমার সঙ্গে?’ মাসি আবারও হাসে। 

দেবু শুয়ে শুয়ে হিসাব করে, তার বয়স এখন তিপ্পান্ন। মাসির তাহলে বাষট্টি। এখনো টুকটুক করে অল্পস্বল্প রেঁধে বেড়ে নিতে পারে। যমুনা মাসি এখন আর কাজ করে না। ওর ছেলের বৌ ময়না আসে। ঘরদোর মুছে, বাসন মেজে দিয়ে যায় একবেলা। কাকুর বন্ধু, পাশের বাড়ির জীবন কাকু মাসির ওষুধ-পত্র লাগলে কিনে দেন, বাজার টাজারও করে দেন। পোস্টাফিসের এম আই এসের টাকা তুলে আনে জীবন কাকুর ছেলে মৃণাল। কিন্তু এভাবে পরের ভরসায় আর কদিন ফেলে রাখা যায় মাসিকে? মাসির যে দেবু ছাড়া আর কেউ নেই! এইসব কথা দেবু যে আগে ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু রুমির ভয়ে বম্বের ফ্ল্যাটে মাসিকে রাখার কথা উত্থাপন করতে পারেনি। তাদের টু-বেডরুমের ফ্ল্যাটের একটায় সে আর রুমি, অন্যটা পাবলোর। তাদের একমাত্র সন্তান। বম্বের নামী স্কুলে পড়ে। পড়াশোনা, ছবি আঁকা, কম্প্যুটার নিয়ে তার নিজস্ব এক জগৎ। মাসিকে সেখানে কী ভাবে ‘ফিট’ করাবে ভেবে পায় না দেবু। কিন্তু যা হওয়ার হবে। এবার গিয়ে রুমিকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তার জীবনের পঁচিশ বছর যে মাসিই আগলেছে! মাসি একাধারে মা, বাবা, ভাই, বন্ধু সব। তার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের সবটা জুড়ে মাসি। ছেলেবেলার হাজার বায়না, বয়ঃসন্ধির নানা প্রশ্নের মীমাংসা, যৌবনের প্রেম-অপ্রেম, হতাশা-উচ্ছ্বাস—সবই মাসির স্নেহে-শাসনে-প্রশ্রয়ে পল্লবিত হয়েছে। এখন এই শেষবেলায় ভগবানের ভরসায় তাঁকে ফেলে রাখা চরম অমানবিকতা। 

বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে। এক শান্ত, গভীর সন্ধ্যা নামছে। কাছে-দূরে কয়েকটি বাড়ির শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে। আকাশে গুটিগুটি দু’চারটে তারা ফুটছে। ভারি মনোরম বিষণ্ণতায় ঘেরা শৈশব-স্মৃতিমেদুর এক আবেশে দেবু চুপ করে থাকে। মাসি বলে, ‘দেবু, তুই একটু বিশ্রাম নে, আমি উঠি, সন্ধ্যা দিই।’ 

অবিশ্রান্ত বৃষ্টির যেন বিরাম নেই। একটানা মুষলধারে ঝরে চলেছে সেই দুপুর থেকে। রাত এখন এগারোটা। কাকু আসেনি বলে মাসি খায়নি। খোকনও ‘কাকু এলে একসাথে খাব’ বলে অপেক্ষা করে করে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। আধো ঘুমে মাসির রাগত স্বর শুনে তন্দ্রা ভেঙে যায়। দেখে, কাকু সলজ্জ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কলাপাতায় জড়ানো একটা মাঝারি মাপের ইলিশ আর পুঁটুলির মতো করে রুমালে গিঁট বাঁধা চারটে গন্ধরাজ লেবু। কাকুর মাথা বেয়ে, সারা গা বেয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছে। মাসি গামছা দিয়ে কাকুর মাথা মোছাচ্ছে আর গজগজ করছে—‘কোনদিন আক্কেল হবে না লোকটার! এত রাতে ভিজে পুড়ে গোটা ইলিশ নিয়ে এল! কে এখন মাছ কাটবে? বাজার করার শখেই জীবন গেল!’ কাকু নিশ্চুপ। অপরাধীর মতো মুখ। আস্তে আস্তে বলছে, ‘সস্তায় পেয়ে গেলাম...শিয়ালদায় ট্রেন লেট ছিল...একটু বাজারে ঢুকলাম। দেখি ইলিশ সস্তা। তা কেটে দিল না! লেবুগুলোর কী সুন্দর গন্ধ, দেখো!’ এই বলে মাসির নাকের সামনে রুমাল উঁচু করে ধরতে যাচ্ছে, মাসি ‘আঃ, দেখি, এদিকে মাথা ঘোরাও’ বলে ঘাড়টা উঁচু করে কি এক অপার্থিব ঔদাসীন্য দেখিয়ে কাকুর মাথা মোছাতে থাকে। খোকন একলাফে উঠে আসে বিছানা ছেড়ে। কাকুর কোমর সমান তার মাথা, কলাপাতায় মোড়া ইলিশ মাছের গায়ে আঙুল দিয়ে টিপে দেখে। অত রাতে মাসি মাছ কুটে, ধুয়ে, হলুদ-নুন মেখে সরষে বেটে ভাতের হাঁড়ির উপর ছোট কাঁসিতে করে কাঁচা মাছ, সরষে বাটা, লংকা আর সরষের তেল দিয়ে ভাপিয়ে কাকুকে আর দেবুকে খেতে দেয়। ঝাল ঝাল আর দারুণ ঝাঁঝালো সেই মাছের গন্ধে পাড়া ম ম করে। পাতের পাশে বেড়াল ডাকে ‘ম্যাও’। বেড়ালের ডাকে তন্দ্রা ভেঙে দেবু দেখে স্বল্প আলোর বাল্বের নীচে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে পুরুষ্টু কালো গোঁফ আর উজ্জ্বল একজোড়া চোখ নিয়ে কাকু চেয়ে আছে তার দিকে। দেবুর বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। পিঠ যতদূর সাধ্য বেঁকিয়ে পাশের ঘরে দৃষ্টি চালিয়ে মাসিকে খোঁজে। আধো খোলা দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মাসির হাতের ঝুলিতে মালা ঘুরছে নির্দিষ্ট ছন্দে, মাসির দেহ নিস্পন্দ, পা মেলে বসে একমনে জপ করছে। প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় মাসির মুখে এক অপূর্ব সুষমা! যেন কী এক আনন্দে বিভোর হয়ে আছে! তবে কি বহু বছর একাগ্র ভাবে জপ-ধ্যান-ঠাকুরসেবা করার ফলে মাসির অন্তর্জগতে বিরাট কোন পরিবর্তন এসেছে? অন্য কোনও আনন্দের সন্ধান পেয়েছে মাসি? তা না হলে এতগুলো বছর একা একা থাকে কিভাবে? কারো প্রতি কোনও অভিযোগও তো নেই! 

রান্নাঘরের দরজার সামনে ছোট টুল নিয়ে বসে দেবু মাসির সঙ্গে গল্প করে। গ্যাসে একদিকে ভাত বসিয়ে দিয়ে মাসি পাশের ওভেনে কড়াইতে তেলে কালোজিরে, শুকনো লংকা ফোঁড়ন দিয়েছে, শাপলা ভাজা হবে। দেবু শাপলা ভাজা খেতে খুব ভালবাসে। মাসি বলে, ‘তোর আবার লংকার ঝাঁঝে হাঁচি হবে। উঠে যা।’ দেবু ওঠে না। দুপুরে ময়নাদি চিংড়িমাছ ছাড়িয়ে রেখে গেছে। মাসি কড়াইতে শাপলা ছেড়ে এখন চিংড়িমাছে নুন আর লেবুর রস মাখায়। এরপর আদা বাটা, থেতো করা রসুন আর নারকোল কোড়া দিয়ে নেড়েচেড়ে ঐ চিংড়িমাছ ছোট টিফিন বাটিতে ভরে মাসি ভাতের হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেবে। গরম গরম ভাতের সঙ্গে খেতে কেমন লাগবে ভাবতেই দেবুর জিভে জল আসে। দেবু লক্ষ্য করেছে, মাসি কথা বলা খুব কমিয়ে দিয়েছে। সবই হয়তো একলা থাকার ফলে গড়ে ওঠা অভ্যেস। ‘মাসি, এইভাবে একা একা থাকাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না’—কথাটা আলতো ভাবে আবার উত্থাপন করে দেবু। মাসি হঠাৎ পিছন ফিরে দেবুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘মানুষ কি মানুষকে দেখে রে? দেখে এক ভগবান! আমি একা কই? আমার গোপাল আছে!’ আগুনের লাল আভায় মাসির মুখ অন্যরকম লাগে। মাসি যেন এই পৃথিবীর মানুষ না, আরেক জগৎ থেকে কথা বলছে। দেবুর এরকম কেন মনে হল, গুছিয়ে বলতে পারবে না, কিন্তু মাসির কথাটার মধ্যে ভীষণ জোর ছিল। এমনি বলার জন্য বলা না। আরও কয়েকবার দেবু নানা প্রসঙ্গ ওঠায়। মাসি হুঁ হাঁ দিয়ে দায় সারা গোছের উত্তর দেয়। দেবু চিন্তা করে, ‘তবে কি থেকে মাসির ব্যবহারে এই পরিবর্তনের কারণ ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ? নিঃসন্তান কুসুম শিশু দেবুকে প্রবল ভালবাসা দিয়ে লতার মতো জড়িয়ে ধরে বেঁচে ছিল, অকাল বৈধব্যের পর কিশোর দেবুকে বড় করে তোলার স্বপ্নে নিজের শোক ভুলেছিল। অথচ দেবু যখন নিজের ভাললাগা, মন্দলাগা নিয়ে মশগুল হয়ে গেল, পরিস্থিতি কি তখন মাসিকে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ একা করে শূন্যতার এক গহ্বরের দিকে ঠেলে দিয়েছে? মাসির মানসিকতার নাগাল পাওয়ার কোন চেষ্টাই দেবু কোনদিন করেনি! দেবু নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, মাসিকে এবার সে নিজের কাছেই নিয়ে যাবে।

গভীর রাত্রে ফুলের সুগন্ধে ঘুম ভেঙে যায়। দেবু বিছানায় উঠে বসে। ঘুমের ঘোরে ঠাহর হয় না, বম্বে কি বারাসাত! হঠাৎ তার সমস্ত শরীরে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে যায়। ঘরময় একটা ছোট ছেলে নুপূর পড়ে ঝুমঝুম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেবু যদিও দেখতে পায় না, কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে সে মাসির ঘরের দিকে পা চালায়। দরজা অল্প ফাঁক, ঘরের ভিতর আশ্চর্য মায়াবী এক আলো। মাসি বিছানায় বসে আছে সোজা হয়ে, দুচোখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে, এমন ভাবে ঘাড় কাৎ করে আছে যেন কেউ মাসির গলা জড়িয়ে ধরে আদর করছে! মাসির মুখে অপার্থিব হাসি। দেবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আবার যন্ত্রচালিতবৎ সে নিজের বিছানায় ফিরে আসে। সে কি স্বপ্ন দেখল? সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে!

সকালে মাসি এসে দেবুকে ডেকে তোলে। ফ্লাইট ধরতে হলে বেরোতে হবে এখনই। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দেবু মাসির মুখের দিকে তাকায়। শান্ত স্বাভাবিক সেই মুখে রাত্রের ঘটনার কোন ছাপই নেই। বলে, ‘মাসি, এখন আসি। তবে আমি খুব শিগগীর আবার আসব। তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব।’ মাসি স্মিত হেসে বলে, ‘তুই ভাবিস না মিছিমিছি। আমার কোনও কষ্ট নেই রে খোকন! তবে তোর সংসারটা একবার নিশ্চয় দেখে আসব। কে জানে, কদিন আছি!’ মায়াভরা চোখে মাসিকে দেখতে দেখতে দেবু মনে মনে বলে, ‘আরও অনেকদিন বাঁচবে তুমি!’ 

কলকাতা থেকে বম্বে ফেরা মাত্র ওঁৎ পেতে থাকা সবগুলো কাজ যেন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেবুর নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই। দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন চলে গেল। এরই মধ্যে একদিন ভোররাত্রে স্বপ্ন দেখল, মাসি এসেছে তার ঘরে। ছোটবেলাকার মতো ডেকে তুলে বলল, ‘ওরে, ভোরের এই সময়টায় ঠাকুর-দেবতারা চলে বেড়ান। এই সময় ঘুমোতে আছে? চল্ আমার সঙ্গে বাগানে ফুল তুলতে যাবি।’ দেবু একলাফে উঠে বসে। ঘড়ির দিকে চোখ যায়। ভোর চারটে। বুকের মধ্যে কি এক অব্যক্ত ব্যথা—যেন বেড়াল আঁচড়াচ্ছে! ভাবে, ‘আর দেরী নয়, এবারই মাসিকে নিয়ে আসব। আর একা থাকতে দেব না।’ একটা মোবাইল ফোনও নেই মাসির। ল্যান্ডলাইনটাও হামেশাই খারাপ থাকে। মনে সারাদিন অস্বস্তি চেপে যন্ত্রের মতো হাতের কাজ শেষ করে দেবু। এজেন্ট মারফৎ পরের দিনের কলকাতা ফ্লাইটের টিকিট কাটায়। একটা মুম্বাই টু কলকাতা, দুটো কলকাতা টু মুম্বাই। বারাসাতে মাসির বাড়ির সামনে পৌঁছতেই বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। দরজা হাট করে খোলা। ট্যাক্সির শব্দে ঘরের মধ্যে থেকে জীবন কাকু বেরিয়ে আসেন, বলেন, ‘তুমি এসেছ? হঠাৎ করেই সব হয়ে গেল! আগেভাগে সেভাবে টেরই পাইনি! আরেকটু আগে যদি আসতে! তোমার সঙ্গে কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারলাম না। মৃণালই মুখাগ্নি করেছে। তোমার অশৌচ পালন করতে হবে। ঠাকুরমশাই আসবেন একটু পরে, খবর দিয়েছি। শ্রাদ্ধশান্তির কাজকর্ম আছে, তোমাকে কদিন ছুটি নিতে হবে বাবা! যাওয়ার আগে তোমার নাম করছিলেন, খুব ভালবাসতেন কি না!’ 

দেবু রুদ্ধশ্বাসে কেবল জিজ্ঞাসা করে, ‘কখন হল?’

‘পরশু ভোররাতে, ঠিক চারটের সময়!’

দেবু কোনও কথা বলতে পারে না, পরশু ভোররাত্রের স্বপ্নের কথা ভেবে নিঃস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.