মাধবীলতা

বাঙ্গালী_ও_লোকাল_ট্রেন

দৃশ্যটি খুবই পরিচিত। লোকাল ট্রেনের কামরার সিটে বসে আছেন কয়েকজন ডেইলি প্যাসেঞ্জার। ট্রেনে ভিড় খুব বেশী না হলেও কিছু লোক বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এদিক ওদিক। ট্রেন সশব্দে ছুটছে গন্তব্য অভিমুখে। বেশ হাল্কা কোলাহলের টুকরো টুকরো কথায় আচ্ছন্ন কামরার ভেতরটা।

নানা মানুষ, নানা বিষয়, বক্তব্য, তর্কযুদ্ধ — কোনওটা হঠাৎ শুরু হয়েই শেষ হয়ে যায়। কোনওটা আবার চলতেই থাকে।
এই যেমন এখনই... শুরু হলো আহার প্রসঙ্গ।

ব্যক্তি ১- “উফ্! কাল কতদিন বাদে আমার মায়ের হাতের সুক্তো খেলাম... মা যা রাঁধে!! কেউ একবার খেলে আর ভুলতে পারবে না....”

ব্যক্তি ২- (ভ্রু কুঁচকে)”রান্নার কী বোঝেন মশাই? সুক্তো খেতে চাইলে আমাদের বর্ধমানের বাড়িতে চলুন। গোটা এলাকায় বিখ্যাত আমাদের ঐ মুখুজ্জে বাড়ির রান্না। না না,, আমি মাসীমাকে- মানে আপনার মাকে ছোট করছিনা। কিন্তু যারা যে বিষয়ে স্পেশালিস্ট আর কী! আমার কাছে কেউ খাবারের বড়াই করতে এলে আমি বাপু অত সহজে মেনে নিই না...”

ব্যক্তি ১- “আপনি এভাবে বলতে পারেন না। আমার মায়ের মতন রান্না...”

ব্যক্তি ৩-“আরে থামুন থামুন... এসব খাবার দাবার নিয়ে আর ঝগড়া বাড়িয়ে লাভ নেই... আপনাদের কথা শুনে মনে পড়ে গেল। সুক্তো আমার বউও দারুণ রাঁধে। তবে সবথেকে ভালো করে ওই ... আমসত্ব চাটনি। আহা!! খেয়ে জিভটা জুড়িয়ে যায়।”

ব্যক্তি ২- “হা হা হা হা!... আপনারা আসলে চাটনি কী জিনিস জানেন না। চলুন একদিন সবাই মিলে আমাদের বর্ধমানের বাড়িতে। আমার মা পিসির হাতের চাটনি না খেলে বুঝবেনই না....,”

ব্যক্তি ৩- “মানে? আমার স্ত্রী’র রান্না না খেয়েই আপনি যা তা বলছেন যে?”

ব্যক্তি ১- “কী ভাবেনটা কী আপনি? সমস্ত খাবার দাবারের ওপর কেবল আপনাদের মুখুজ্জে বাড়িরই একচ্ছত্র অধিকার?”

ব্যক্তি ২- “ শুনুন শুনুন, আপনারা আসলে জানেন না যে আমাদের বাড়িতে রান্নাটা ঠিক কতটা যত্ন করে করা হয়...”

ব্যক্তি ৩- “সে আমাদের ​ বাড়িতেও করা হয়...”

ব্যক্তি ২- “ধুর!! আপনারা সেরকম খাবার খেয়ে অভ্যস্ত হলে আপনাদের চেহারাতেই সেটা ধরা পড়তো। আপনাদের মুখে সবসময় কেমন যেন একটা অতৃপ্তি লেগে থাকে! আমাকে ভুল বুঝবেন না... আমি একটু স্পষ্ট কথায় বিশ্বাসী।”

ব্যক্তি ৩- “ তাই? তা আপনার চেহারায় কী এমন পরিতৃপ্তি লেগে আছে শুনি?”

ব্যক্তি ১- “ওই তো দেখতে! কোলা ব্যাঙের মতন মুখ! ভ্রু দুটো সবসময় কুঁচকেই আছে...”

ঝগড়া বাড়তেই থাকলো। সহযাত্রীরা রোজকার অভ্যেসমত মত নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে মজা নিতে শুরু করলেন।​

বিপদ বুঝে ট্রেন তার গতি বেশ বাড়িয়ে দিলো যেন! আগের স্টেশন থেকে আরও ছয় সাতজন প্যাসেঞ্জার উঠে ভিড় একটু বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই ট্রেন বস্তুটিকে মোটেও নির্জীব বলে মনে করবেন না কিন্তু... তার একটি সুবিবেচক ও বুদ্ধিদীপ্ত হৃদয় আছে— যা সবসময় যাত্রীদের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখলেই সে গর্জে ওঠে।

এহেন অবস্থায় বিকট হর্ণের আওয়াজে কানে তালা লেগে যায় সকলের। চলতে থাকা ঝগড়া ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ভাঙা খন্ডগুলো ছুটন্ত জানলার বাইরে বেরিয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ে পার্শ্বস্থ কোনও পুরনো বটগাছের ধুলোমাখা পাতার মধ্যে, কিম্বা অনতিদূরের কোনও এক দোতলা বাড়ির ছাদে জলের ট্যাঙ্কের গায়ে।​

​#
সেই একই ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্ট। সকালবেলার এই নির্দিষ্ট ট্রেনই প্রত্যেকের নিজের নিজের গন্তব্যে পৌঁছানোর রথ।​
মোটামুটি সকলেই একে অপরের পরিচিত।​

মহিলাদের আলাপচারিতা একটু অন্যরকম হয়ে থাকে। একটু আস্তে, ফিসফিসিয়ে, আড়াল করে, মুচকি হেসে...
এখানে কেউ পছন্দমত সিট পেয়ে বসে সোয়েটার বুনছেন, কেউ বা জানলার ধারের এককোণে গুটিশুটি মেরে প্রিয় ম্যাগাজিন নিয়ে ব্যস্ত।​

এখানেও হরেক রঙের বিবিধ আলোচনা চলতে থাকে। তবে একটু অন্যভাবে। একই কামরায় ছোট বড় অনেকগুলো বৃত্তের সৃষ্টি হয়। এক এক বৃত্তের এক এক প্রসঙ্গ।​

এই যেমন, কোণের দিকের ছোট্ট একটা বৃত্তে এই মুহূর্তে——

মহিলা ১- “উফ্ফ! আমার ছেলেটা যা দুরন্ত, কী বলি তোমায়!! কালকেও একটা কাঁচের গ্লাস ভাঙলো।”

মহিলা ২- “এই তোমার ছেলে দুরন্ত কোথায় গো? কত শান্ত তো! জন্মদিনে দেখলাম তো গিয়ে... কী সুন্দর চুপটি করে বসেছিলো! আমার মেয়ে হলে ওরকম বসতোই না! বাব্বা আমার মেয়ে যা!! একটা সেকেন্ড বসতে জানেনা...”

মহিলা ১- “তুমি কোনও ভুল করছো! আমার ছেলেকে তুমি দেখেছ কতক্ষণ? ওর মত চঞ্চল বাচ্চা আর দু’টো দেখা যায়না। তোমার মেয়েই বরঞ্চ শান্ত অনেক।”

মহিলা ২- “কী যে বলো!! আমার মেয়ে দেওয়াল বেয়ে মাকড়সার মত ঘরের ছাদে উঠে পড়ে। তোমার ছেলে দেখে ভয় পেয়ে যাবে...”

মহিলা ১- “হু! তোমার মেয়ে শুধু ওঠে? আমার ছেলে তো হাতুড়ি পিটিয়ে দেওয়াল ফুটো করে দেয়।”

তৃতীয় মহিলা পাশে বসে এতক্ষণ কমলালেবুর ঈষৎ মিষ্টি কোয়া মুখে পুরতে পুরতে বেশ তর্কাতর্কি উপভোগ করছিলেন। এবার তিনিও শান্তভাবে মুখ খুললেন—
“বাপরে! আমার ছেলে বাবা সে তুলনায় খুবই শান্ত।”

মহিলা ২- “তাই? খুব ভালো গো... হ্যাঁ সেদিন তোমার ফোনে ওর ছবি দেখছিলাম। দেখেই বুঝেছি... কী শান্ত কী শান্ত!”

মহিলা ১- “যাক তুমি বেঁচে গেছো!”

মহিলা ৩- “হ্যাঁ গো। ও খুব শান্ত। তার সাথে বেশ ইন্টালিজেন্টও। রেজাল্ট খুব ভালো করে প্রতিবার... বলতে পারো ওকে নিয়ে আমাদের কোনও জ্বালা নেই।”

মহিলা ১- “মানে? শান্তরা আবার ইন্টালিজেন্ট হয় নাকি?”

মহিলা ২- “তাই তো! শান্ত বাচ্চারা বোকাসোকা হয়। যে বাচ্চা যত দুরন্ত, তারা তত বুদ্ধিমান আর স্মার্ট। আমার মেয়ের মতন...”

মহিলা ৩- “আমি এসব মানিনা...”

মহিলা ১- “মানিনা বললে তো আর হবেনা? তোমার বাচ্চা ভালো রেজাল্ট করে, তার কারণ ওই স্কুলটার পড়াশোনা তেমন কঠিন না।”

মহিলা ২- “আমি সহমত। ওদের কারিকুলাম তো খুব সোজা!”

ছুটন্ত ট্রেন আবার আগুনের আঁচ উপলব্ধি করলো।ফের ধমক দেওয়ার সময় এসেছে।আর বাড়তে দেওয়া যাবেনা। ফের সেই বিকট হর্ণের আওয়াজ, ঘটলো ঝগড়ার অবসান। মহিলা ১ ও ২ চমকে উঠে কান চাপা দিলেন। মহিলা ৩-এর হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল কমলালেবু।​

হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে সেটাকে ছোঁ মেরে কুড়িয়ে নিলো বছর সাতেকের এক ছোট্ট হাসিমুখ। কিছুক্ষণ আগেই ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছিলো কামরার এধার ওধার। জট পড়া তামাটে চুল, নাকে সিকনি, সারা গায়ে ধুলো মাখামাখি, পরনে একটা ময়লা ছেঁড়া ফ্রক- যেটার রঙ ঠিকমত অনুমান করা যাচ্ছেনা নোংরা আচ্ছাদন ভেদ করে।​

তিন মহিলা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তাদের সন্তানদের বয়সীই হবে মেয়েটা। তবে এ শিশুটি শান্ত না চঞ্চল, বুদ্ধিমান না বোকাসোকা- তা নিয়ে চিন্তাভাবনার কোনও জায়গা নেই এখানে। চোখে পড়ছে শুধু ওই প্রাণখোলা হাসিটা। ফ্রক তুলে প্যান্টের ইলাস্টিকে গুঁজে রাখা কাপড়ের থলিটা বের করে, জমিয়ে রাখা খাবারের মধ্যে আধখাওয়া কমলালেবুটাও ঢুকিয়ে রাখলো মেয়েটা।

আবার হর্ণের শব্দে সম্বিত ফিরলো সকলের। আর মিনিট দুই পরেই লাস্ট স্টেশন— তাদের গন্তব্য। ট্রেনের গতি কমে আসছে। যাত্রীরা সব নামবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.