জানলার সিল্যুয়েটে যে উদাসী মুখ আমার ফোনের ওয়ালপেপার হয়ে আছে, তাকে বলেছিলাম। ওইসব ধুলোখেলা মিটে গেলে অন্তরবাক্সে যাবো। শুনে নেবো নদী, কী কথা রেখেছ তুমি শাব্দিক সংরক্ষণে। জানা কথা, ওইটুকু দেরি করে শোনা তাই। কতদিন পরে চেনা শ্বাস! কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তবু তো চেনা স্বর! আসলে দ্বিধার কোনো দোষ নেই। দ্বিধারা চিরকাল অপরাধবোধ আড়ালের চেষ্টা করে, এবং ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থ আড়ালকে শুনতে-শুনতে দু-লাইনে লিখতে চাইছিলাম অপারগতা। কিন্তু একটা মলিন সকাল মনে পড়লো। কেলোখুড়োর সঙ্গতে উগ্র কটূক্তিতে মেতে ওঠা নদীর সকাল। অথচ 'অপরাধ' বলতে ছিল শুধু একটা ডিসক্লেইমার। মিথ্যা দোষারোপের সবচেয়ে নিরীহ প্রতিবাদ যেটুকু! যে-কোনো জবাব যদি আবার তেমন মজার উপকরণ হয়ে ওঠে আজ? অতএব নীরবতা ভালো।
কিন্তু নীরবতায় অকথিত থেকে যায় নদীকে বলার কয়েকটি জরুরি। সময়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে, তাদের কোথাও লিখে রাখতে হয়! অনাহূত হয়ে কোনো দরজায় আমি কখনও যাইনি। সে আমার স্বভাববিরুদ্ধ। তবুও যাকে দেখিয়ে-দেখিয়ে একটা করে দরজা বন্ধ করেছ রোজ, তাকে আর কোনো সমাগমে ডাকতে নেই। এখন চারের ঘরের নামতা পড়ছ তুমিও। এখন কি আর গোপন দেওয়াল, লুকোনো সংখ্যা মানায়? এখন তোমার, জান-এ-বাহার, অবাধ্য চুলের স্রোতে রুপোলি ঝিলিক লুকোনোর সময়। ভাঙন দিয়েছ তুমি। কিন্তু নদীতীরে যার যাপন, তার পরিণতি দেখেছ? যার ছাদ গেল, চাঁদ গেল; দেখেছ? পায়ের নিচে যার নিদারুণ ধস? একান্ত আশ্রয়ে যার অকরুণ তালা? তাকে কিন্তু আর কোনোমতেই 'ভালো থেকো' বলা যায় না। বললে, উপহাস করা হয়। নির্মম ঠাট্টা করা হয়। ঠিক যেমন, হত্যাকারী কখনও চাইতে পারে না নিহতের দীর্ঘায়ু। উইলফ্রেড আওয়েন লিখেছিলেন,"আই অ্যাম দি এনিমি ইউ কিল্ড, মাই ফ্রেন্ড"; অনেকটা তেমন! সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আমাকে কবিতা পড়তে বলছ তুমি?
নদীকে বলা হয় না, এক্ষেত্রে আমি একটু ওল্ড স্কুল। সৃষ্টির কোনো প্রকাশ-ব্যাকুলতা আমার নেই। আবেগের লুন্ঠন আমি কখনও ভুলি না। গভীরের নাব্যতা যেখানে চুরি করে নেওয়া হলো একদিন, সেখানে জুড়তে আমার আপত্তি আছে। যেন কিছুই ঘটেনি! যেন সব ক্ষত, সব আঘাত, সব অশ্রুপতন, সব রক্তক্ষরণ মিথ্যে! জীবনের উপর দিয়ে যে-ভাঙন যায়, সেখানে নিজের অবস্থান সাময়িক ভুলে যাবো? আমার আপত্তি আছে। এই আপত্তির কাছে কোনো মুদ্রিত অথবা দৃশ্যায়িত আয়োজনের বিরাট আয়তনও শূন্যের বেশি কিছু নয়। তাতে নদীর কিছু আসে-যায় না। কিন্তু নিজেকে অনেকটা দেওয়া হয় আমার। একেও কি ইগো বলে, ঈশ্বরী? তাহলে তাকে আকাশচুম্বী জেনো। আমি বরং দূর থেকে দেখি, একদা যাদের নিয়ে নিত্য-রসিকতায় মেতে উঠতো নদী; ওই কাতারে তাদেরও সামিল করেছে আজ! তাদের প্রশংসায়, প্রত্যুত্তরের 'শ্রদ্ধা'য়, একটুও গিল্ট-ফিলিং হয়? একদিন নদীর গায়ে যারা ছুঁড়ে দিয়েছিল ক্লেদ; কোনো এক রসায়নে সব মিটমাট করে, তারাও এসেছে আজ অম্লানবদনে! নদীর এই ইনক্লুসিভনেস দেখতে আমার বেশ লাগে। ওই ভিড় থেকে দূরত্ব রাখতে পারায় ভালো লাগে আরও বেশি।
তবে কি নদীর ডাকে স্তব্ধ থেকে আমি খুশি হই খুব? নদীতীরের মগ্ন বাসিন্দা আমি। তার কথা না-রাখা আমার আজীবন কল্পনাতীত। কিন্তু ওই যে, এভরিথিং ইজ নট ওয়েল বিটুইন আস। সামথিং ইজ ভেরি রং বিটুইন আস। একথা নিজেকে মনে করাতে হয় রোজ! না-হলে, কে জানে কখন, চার অক্ষরের নদীটিকে আদরের অভ্যাসে তিন অক্ষরে ডেকে ফেলি! যে-নামে ডাকা আমার বারণ এখন। অথবা দুই অক্ষরের একটি য-ফলায়! তখন কি আবার অভিযুক্ত হবো নতুন অপরাধে? আমার ছোটোখাটো আয়োজনে তাকে কখনও ডাকি না তাই। তবে একদিন নিজের জোরে এসে পড়ুক সে, এটা খুব করে চাই। নেপথ্যে বেজে উঠুক কাতিল শিফাই। "তেরে দর পর সনম চলে আয়ে, তু না আয়া তো হম চলে আয়ে"। একমুহূর্তে ভালোবাসার শ্রাবণ ধুয়ে দেবে যাবতীয় তিক্ত বিভাব। পরিত্যক্ত খাতে নদী কি কখনও আসে না? মনে-মনে তাকে বলি, এসো। না-হলে, ওই সেন্স অফ নাথিংনেস তোমাকেও ঠিক গিলে নেবে একদিন।
নদীর না-আসা নিয়ে আমি অনেক গল্প শুনেছি। দূর থেকে এসে বলে যাওয়া গল্প। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দুষ্টুমিষ্টি ভাইয়েরা রাজধানীতে গিয়ে ছড়িয়ে এসেছিল একাদশ অশ্বারোহীর কাহিনি। সেইসব সরস গল্প নাগরিক হাওয়ায় উড়তে-উড়তে এসেছিল আমার কাছেও। আমি খুব হেসেছিলাম। তারপরে এই সেদিন, কিছুটা যেচেই, সপ্তরথীর উল্লেখ করলো নদী নিজে। আমি অশ্রুময় হেসেছিলাম। এদের কথা তো আমি জানি! কিন্তু এইসব জেনে কী করবো! সাধনায় যূথচারীদের কোনো গুরুত্ব নেই। প্রার্থনায় যুদ্ধের কোনো স্থান নেই। আমার ফাইটিং স্পিরিট দেখানোর জন্য সারা পৃথিবী পড়ে আছে। একমাত্র নদীর সঙ্গেই আমার কোনো লড়াই নেই। থাকলে, বেঘর হওয়ার পরেই রণসাজ নেওয়া যেত। তেমন অজস্র উপায় ছিল, উপকরণও। কিন্তু সমর্পণে যে কোনো যুদ্ধ থাকে না, ঈশ্বরী!
তবুও দূরত্বের কথা মানেই এইসব বিষণ্ণতা নয়। আমি মনে রাখি, একটু ছোঁয়ার জন্য তিনশো কিলোমিটার ছুটে আসতে চাওয়া নদীকে। অন্য সময়ের মতো ঘনিষ্ঠ নিভৃতি পাবো না জেনেও তো আসতে চেয়েছিল সে! নদী তখন শারীরিক ঘোলাজলে বিপন্ন। স্বভাবজাত উৎকণ্ঠায় বিরত করলাম তাকে। তবুও তো চেয়েছিল! সেকথা ভুলবো কী করে? অথবা বালুকাবেলার পথে যে-বার এক ভোরে নদীর হঠাৎ-ডাকে বদলে গেল আমার অভিমুখ? তারপরে উজানে গিয়ে একসাথে মোহনার দিকে। সে-সব তো ভোলা যাবে না! এই বধ্যভূমিতে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পরেও আমি এগুলোই মনে রাখতে চাই। নদীর একদা চলনকে ধরে রাখতে একটা পাতার জন্ম হয়েছে তাই। সেখানে কোনো অহেতুক গোপনীয়তা নেই। পাতার একটা নাম দিতে হতো। নদীর নিজের বেছে নেওয়া নাম ছাড়া আর কী দিতে পারতাম? একথা ভাবছিলাম যখন, কোনো নোটিফিকেশন এল। ফোনের স্ক্রিনে আলো। সিল্যুয়েটে নদী। তার আধখোলা ঠোঁটে আলতো আঙুল রেখে বললাম, সে তোমার পরিত্যক্ত ছদ্মনাম।
সুচিন্তিত মতামত দিন