ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়  / উত্তর কলকাতা কথা
“আমি শুধোলেম দিল্লী কি? উত্তরে সেই নারী বলল,'পৃথীবী যদি দেহ হয় দিল্লী তার প্রাণ' । 
আমি আবার শুধোলেম,আর বানারস ? নারী বলল 'ছিড়ে আনা এক গোছা প্রিয় ফুল' ...... 
সবশেষে শুধোলেম আর কলকাতা ? 
সে জানাল 'সেতো নগরী নয়, সে যে নিজেই বসুন্ধরা সপ্ত বসুধা” । -- মির্জা গালিব

বলি সেই কলকাতার কথা । উত্তর কলকাতা কথা । উত্তর আছে, অতয়েব দক্ষিণও থাকবে । আর উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে মধ্যও থাকবে । আমার প্রিয় শহর, ইতিহাসের শহর কলকাতার তিন ভাগ – উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা ও মধ্য কলকাতা । পূর্ব বা পশ্চিম কলকাতা আমরা বলি না । কলকাতার বুকে একটা রেখা টানলে দেখা যাবে বাগবাজার থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত অঞ্চলটিকে চিনবো উত্তর কলকাতা বলে । শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা অঞ্চলটি মধ্য কলকাতা আর ধর্মতলার পরের অঞ্চলটি দক্ষিণ কলকাতা । তবে এখন লাগোয়া শরতলির অনেক অঞ্চল বৃহত্তর কলকাতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । সেইসব ভৌগোলিক বৃত্তান্ত এ লেখায় অপ্রাসঙ্গিক । আমি কলকাতার সামাজিক ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহী । কলকাতার সামাজিক ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহী যে কারোরই প্রথমে মনে পড়ে উত্তর কলকাতার কথা । এখন যে অঞ্চলটিকে উত্তর কলকাতা বলি নগর কলকাতার পত্তনের আগে তার পরিচয় ছিল সুতানুটি গ্রাম । আজ থেকে ৩৩০ বছর আগে ভগীরথী নতীর তীরে এই সুতানুটি গ্রামেই ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট রবিবার জোব চার্ণক নামে একজন এবং আরো ৩৭জন ইংরেজের এক বাণিজ্য তরী নোঙর ফেলেছিল । তারপর ১৩০০ টাকার বিনিময়ে সুতানুটি সহ আরো দুটি গ্রাম ডিহি কলকাতা ও গোবিন্দপুরের দখলদারি নিয়ে গড়ে উঠলো নগর কলকাতা আর কালক্রমে প্রায় মুফতেই এই বিশাল দেশটাকে দখল করে নিল ঔপনিবেশি ইংরাজ শক্তি । এসব বৃত্তান্ত আমাদের সকলেরই জানা । উত্তর কলকাতাকে বাদ দিয়ে অতয়েব কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের খোঁজ করা যায় না । কলকাতার ক্রমাগত সম্প্রসারণ , নতুন নতুন পল্লীর আবির্ভাব, আকাশছোঁয়া বহুতল আর উড়ালপুলের নির্মাণ, আধুনিক বিপণন কেন্দ্রের আবির্ভাবে উত্তর কলকাতার ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানা আজ মৃয়মান একথা সত্য । আবার একথাও সত্য যে কলকাতার সাবেকি ঐতিহ্য ও বনেদিয়ানার যাকিছু অবশেষ তা এই উত্তর কলকাতাতেই । এখনও উত্তর কলকাতার জরাজীর্ণ প্রাসাদোপম বাড়ি, স্থাপত্য, বন্ধ হয়ে যাওয়া জীর্ণ নাট্যমঞ্চ, মন্দির, জনাকীর্ণ বাজার আর অসংখ্য অপরিসর গলিতে যেন ইতিহাস থমকে আছে । আমরা তার কতটুকুই বা জানি !

উত্তর কলকাতা মানে বাগবাজার, শ্যামবাজার, হাতিবাগান, শ্যামপুকুর, হেদুয়া, সোনাগাছি, বেলগাছিয়া, দমদম শোভাবাজার, মাণিকতলা, জোড়াসাঁকো, চিৎপুর, কুমারটুলি, কাশীপুর - এইসব অঞ্চল। 

ইতিহাসের স্মৃতির সরণি মধ্য কলকাতাতেও কম নেই । বৈঠকখানা বাজার, বৌবাজার, এন্টালি, তালতলা, পার্কস্ট্রীট, জানবাজার, লালদিঘি ( এখন যে অঞ্চলকে বলি বিবাদি বাগ), কলেজ স্ট্রীট, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, চাদনীচক, লালবাজার, মল্লিক বাজার, বাবুঘাট ইত্যাদি । এখানেও ইতিহাসের স্মৃতির সরণির অনেক পৃষ্ঠা ছড়িয়ে আছে । সেইসব কথা বারান্তরে । আপাতত আমি বলি উত্তর কলকাতার কথা । 

আগেই বলেছি এখনকার উত্তর কলকাতা মানে তিনশো বছরেরও বেশি আগের সুতানুটি গ্রাম । কলকাতার ইতিহাস নাড়াচাড়া করা সকলেই জানেন শেঠ ও বসাক – এই তন্তুবায় শ্রেণীটি হল কলকাতার আদি বাসিন্দা । ইংরাজরা এদেশে আসার অনেক আগে ১৫৩০ সন থেকে হুগলী নদী সংলগ্ন সপ্তগ্রাম তখন ছিল সমৃদ্ধ বানিজ্যকেন্দ্র । ইংরেজরা কলকাতায় বানিজ্যকুঠি বানানোর পর সপ্তগ্রাম বানিজ্যকেন্দ্র মর্যাদা হারায়, শেঠ ও বসাকরা কলকাতায় চলে আসেন । শেঠ ও বসাকদের কলকাতায় আসা সম্পর্কে ভারতকোষ-২য় খন্ডে এই তথ্য রয়েছে । “ সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধশালী গোষ্ঠীর মধ্যে বসাক ও শেঠ উপাধিধারী চারটি তন্তুবায় পরিবার ছিল অন্যতম । তাহারা আদি নিবাস ত্যাগ করিয়া হুগলী নদীর দক্ষিণে চারিদিকের জঙ্গলের মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত পরিস্কার যায়গায় গোবিন্দপুর নামক এক নতুন গ্রামের পত্তন করিল এবং অপর কয়েকটি তন্তুবায় পরিবারকে আহ্বান করিয়া সেখানে এক বৃহৎ উপনিবেশ গড়িয়া তুলিল । কালক্রমে এই বসাক শেঠদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়িয়া ওঠে কলিকাতার উত্তরে সুতানুটি হাট নামে এক বৃহৎ বানিজ্যকেন্দ্র” ।

উত্তর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র রূপে যদি চিহ্নিত করি বাগবাজার-শ্যামবাজার- হাতিবাগান - বিডন স্ট্রীট - হেদুয়া এই অঞ্চলটিকে তাহলে মনে হয় বিতর্কের কোন যায়গা থাকে না । বাগবাজার নামটির উৎপত্তি কোথা থেকে তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই । অনুমান করা হয় বাগ বা বাগান থেকেই নামটিত উৎপত্তি । আবার ভাষাচার্য সুকুমার সেনের অনুমান ঐ অঞ্চলে হুগলি নদিতে একটা বড় বাঁক ছিল। সেই বাঁক সন্নিহিত বাজার থেকেই বাগবাজার কথাটির উদ্ভব । বাগবাজারে ছড়িয়ে আছে আঠেরো এবং উনিশ শতকের কত ইতিহাসের স্মৃতিকথা । বাগবাজারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত বিশিষ্ট বাঙালির নাম । নট ও নাট্যকার মহাকবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখ। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্ঘজননী সারদাদেবীর বাসভবন । এখানেই এখন উদবোধন কার্যালয় । ১৮৭৭ সালে প্রথমবার শ্রী রামকৃষ্ণ বাগবাজারে এসেছিলেন। ৪০, বোসপাড়া লেনে (বর্তমান নাম মা সারদামণি সরণি) কালীনাথ বসুর পৈত্রিক বাসভবনে তিনি আসেন। এখানেই হরিনাথ চট্টোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে স্বামী তুরীয়ানন্দ), গদাধর ঘটক (গঙ্গোপাধ্যায়) (পরবর্তীকালে স্বামী অখণ্ডানন্দ) ও বিশিষ্ট নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। আর একজনের নাম জড়িয়ে আছে বাগবাজারের সঙ্গে । তিনি উনিশ শতকের বিশিষ্ট কবিয়াল ভোলা ময়রা । বাঙালির সাধারণ রঙ্গালয়ের আঁতুড়ঘর এই বাগবাজার । ১৮৬৮তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’ । এই সংগঠনের মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির সাধারণ নাট্যশালা গঠনের বীজ । বাগবাজারের কিছু উৎসাহী যুবক – অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি, রাধামাধব কর, নগেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নাট্যদল গঠন করে অভিনয় করলেন দীনবন্ধু মিত্রর ‘সধবার একাদশী’ । ১৮৭২এর ১১ই মে তাদের দ্বিতীয় নাটক ‘লীলাবতী’ অভিনীত হয় এবং আশাতীত সাফল্য লাভ করে । লীলাবতীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের লক্ষ্যে একটি ‘সাধারণ নাট্যশালা’ প্রতিষ্ঠার কল্পনা করেন তাঁরা, যেখানে বিত্তশালীদের কৃপাপ্রার্থী না হয়ে টিকিট বিক্রয় করে সর্বসাধারণকে নাট্যাভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ করা যাবে । অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালির প্রথম রঙ্গালয় ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ । বিত্তশালী জমিদারবাবুদের প্রাঙ্গণ থেকে উদ্ধার হয়ে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল থিয়েটারের দরজা । ১৮৭২এর ৭ই ডিসেম্বর অর্ধেন্দুশেখরের পরিচালনায় দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে রচিত হল ইতিহাস । আর হ্যাঁ, বাঙালির জিভে জলআনা রসগোল্লার আঁতুড়ঘর এই বাগবাজারেই। কলকাতায় রসগোল্লার প্রবর্তক নবীনচন্দ্র দাশের মিষ্টির দোকান ছিল বাগবাজারে । বাংলা পেশাদারি থিয়েটারের আঁতুড়ঘরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গিরিশ মঞ্চ, পাশেই পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা একাডেমি । বাগবাজারেই রয়েছে বিশ্বের একমাত্র বইয়ের নামে রাস্তা ‘বিশ্বকোষ লেন’। বাগবাজার নিবাসী নগেন্দ্রনাথ বসু রচনা করেছিলেন বাইশ খন্ডের বাংলা জ্ঞানকোষ ‘বিশ্বকোষ’ বঙ্গাব্দ ১৩১৮তে । কাঁটাপুকুর বাই লেনে ছিল নগেন্দ্রনাথের নিবাস, তাঁর রাস্তাটির নামকরণ হয়েছে বিশ্বকোষ লেন । আবার বাগবাজারেই ছিল সিরাজদৌলার বিশ্বাসঘাতক পলাশীর যুদ্ধে ইংরাজ পক্ষ অবলম্বনকারী রায়দুর্লভের পুত্র রাজবল্লভের বাড়ি । রাজবল্লভের নামে একটি রাস্তা ও একটি এলাকা রাজবল্লভপাড়া নামেও খ্যাত । বাগবাজারের পরতে পরতে জুড়ে আছে বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাস, জুড়ে আছে বাঙ্গালির সাহিত্য, সংস্কৃতি আর বাঙালি প্রজন্মের ধারাবাহিকতার ইতিহাস । 

বাগবাজারের কথা বলতে গেলে ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাগবাজার ঘাটের কথা বলতেই হবে । প্যারিচাদ মিত্র বা টেকচাদ ঠাকুর তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’গ্রন্থে বাগবাজারের বর্ণনা করেছেন এইভাবে । “নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাটে আসিয়া ভিড়িল । রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে – কলুর ঘানি জুড়ে দিয়েছে, মাছের ও তরকারির বাজরা হু হু করিয়া আসিতেছে, ব্রাহ্মণ পন্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন,মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথা কহিতেছে ……”

ইংরাজ কোম্পানী আমলে প্রথম দিকের কুখ্যাত ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রর ছেলে রঘুনাথ মিত্র এইবাগবাজার ঘাট নির্মাণ করেছিলেন । এই বাগবাজারের অদূরেই ১৭৫৬ সনে নবাব সিরাজদৌলা ইংরাজ শক্তিকে পরাস্ত করে কলকাতা দখল করেন ।

বাগবাজারের লাগোয়া কুমারটুলিও সাবেক কলকাতার এক প্রাচীন অঞ্চল এবং অনেক ইতিহাসের সাক্ষি । পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেব স্থির করেন শহরে এক এক পেশার লোক সুতানুটি অঞ্চলে এক এক পল্লিতে থাকবে । সেই অনুযায়ী সৃষ্টি হল – কলুটোলা, কুমোরটুলি, দর্জিপাড়া, যোগীপাড়া, আহিরিটোলা, খালাসিটোলা ইত্যাদি । সেই তিনশো বছর ধরে কুমারটুলিতে মৃৎশিল্পী ও পটুয়াদের বাস আর বাংলার মৃতশিল্পের প্রধান কেন্দ্র ।

বাগবাজার উত্তর কলকাতার একটি প্রান্ত , শ্যামবাজার ও শোভাবাজার তা নয় । শ্যামবাজার যেন বাগবাজারের বড়ভাই – সমগ্র উত্তর কলকাতার প্রাণকেন্দ্রই শুধু নয়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার প্রবেশদ্বারও বটে । শ্যামবাজার ও সন্নিহিত অঞ্চলের পরতে পরতে কলকাতার সামাজিক ইতিহাস ও বনেদিয়ানার স্পর্শ । এখনকার শ্যামবাজারে আদিতে ছিল একটা বাজার । কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেব নাম দিয়েছিলেন চার্লস বাজার । প্রভাবশালী শোভারাম বসাকের অনুরোধে তার এক আত্মীয় শ্যামচাদ বসাকের নামে নাম হয় শ্যামবাজার আর শ্যামপুকুর স্ট্রিট । এখনকার শোভাবাজার রাজবাড়ির পূর্বদিকে ছিল শোভারামের বিরাট শাক-সবজির বাগান । সেটা পরিণত হয় বাজারে আর তা থেকেই অঞ্চলটির নাম হয় ‘শোভাবাজার’ । শোভাবাজার স্ট্রিটও সেকালের ধুরন্ধর অর্থলোভী, জালিয়াৎ শোভারাম বসাকের স্মৃতি বহন করছে । (সূত্র – ‘কলিকাতা দর্পণ’ / রথীন্দ্রনাথ মিত্র) ।আবার একটি ভিন্ন মতও আছে ১৯০১সনে দেশের প্রথম সেন্সাস রিপোর্টের অঙ্গ হিসাবে ‘কলিকাতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ নামে যে গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাতে অতুলকৃষ্ণ রায় লিখেছেন “... ইহার কিছু উত্তরে অবস্থিত সেকালের একমাত্র বাজারটির নাম ছিল সুবাহ বাজার (পরবর্তীকালে নামটি বিকৃত হইয়া দাঁড়ায় শোভা বাজার) – অর্থাৎ বাংলার সুবাহ (সরকার) বাজার । 

যাইহোক, শোভাবাজারের কথা এলেই এসে যায় মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রতিষ্ঠিত শোভাবাজার রাজবাড়ি ও নবকৃষ্ণের উত্তর পুরুষ গোপীমোহন দেব ও তাঁর পুত্র রাধাকান্ত দেব প্রমুখের কথা । শোভাবাজার ছিল উনিশশতকের বাংলা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র । সে কালীন উনিশশতকী বাবুকালচারের পৃষ্ঠপোষক ছিল শোভাবাজার রাজবাড়ি । শোভাবাজার রাজবাড়িতেই নবকৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে আয়োজিত হয় তখনকার কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা । ক্লাইভের মুন্সি ছিলেন নবকৃষ্ণ । পলাশীর যুদ্ধে ইংরাজদের বিজয়ের স্মারক হিসাবে ক্লাইভকে স্বাগত জানাতে নবকৃষ্ণ ১৭৫৭ সালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন । 

আবার কলকাতার ফুটবলের আঁতুড় ঘরও শোভাবাজার । ভারতের ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী ১৮৮৫তে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শোভাবাজার ক্লাব’। মোহনবাগান ক্লাবের জন্মও উত্তর কলকাতায় । ১ নম্বর ফড়িয়াপুকুর স্ট্রীটে শোভাবাজারের গোপীমোহন দেবের একট বাগান ছিল - নাম ‘মোহনবাগান’। সেকালের খ্যাতনামা পাট ব্যবসায়ী শ্রী কীর্তিচন্দ্র মিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে গোপীমোহনের উত্তর পুরুষদের কাছ থেকে এই মোহনবাগান কিনে নেন। প্রায় ১৩ বিঘা জমির ওপর তৈরি করেন এক শ্বেত পাথরের প্রাসাদ। নাম – মোহনবাগান ভিলা । কীর্তিচন্দ্র মিত্রর পুত্র প্রিয়নাথ মিত্রর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় মোহনবাগান ক্লাব ১৮৮৯ সনের ১৫ই অগস্ট ।

উত্তর কলকাতা যেমন বাংলার ফুটবলের আঁতুড়ঘর তেমনই বাংলা থিয়েটারেরও আঁতুড়ঘর । থিয়েটার, সিনেমা, সঙ্গীত ও ক্রীড়া জগতের কত খ্যাতকীর্তি মানুষের সৃষ্টিকর্ম বাংলার সাহিত্যসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে তার ইয়ত্তা নেই । ভারতের ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী (শোভাবাজার), টপ্পা গানের প্রবর্তক রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু (কুমারটুলি), কালিপ্রসন্ন সিংহ( জোড়াসাকো), লালচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ কুমার মল্লিক,(মাণিকতলা), ইন্দুবালা (রামবাগান), নটী বিনোদিনী (১৪৫ কর্নোয়ালিশ স্ট্রীট),সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে ও মান্না দে (মদন ঘোষ লেন, শিমলা পাড়া) বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখ সৃষ্টিশীল বাঙালি উত্তর কলকাতার মানুষ ছিলেন । ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় থাকতেন ১৩ নম্বর কর্নোয়ালিশ স্ট্রীটের একটি বাড়ির তিনতলায়, ঐ বাড়িরই দোতলায় দশ বছর ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী । পুত্র সুকুমার রায় ও কন্যা সুখলতার জন্ম এই বাড়িতেই । দেশের প্রথম মহিলা স্নাতক কামিনী রায় উত্তর কলকাতায় হেদুয়ার বেথুন কলেজে কাদম্বিনীর সহপাঠিনী ছিলেন । এবং রবীন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা স্বামী বিবেকানন্দ, বাংলার দুই শ্রেষ্ঠ সন্তানের কত স্মৃতি এই উত্তর কলকাতাতে । উনিশ ও বিশ শতকের বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেকটাই জুড়ে আছে উত্তর কলকাতা ।

এখন যেখানে শ্যামবাজার ট্রাম ডিপো, সেখানেই ছিল বাবু নবীনচন্দ্র বসুর নাট্যশালা । বাবু নবীনচন্দ্রের এই উদ্যোগ বিশেষভাবে স্মরণীয়, কারণ ১৭৯৫এ লেবেডফের বেঙ্গলি থিয়েটারের চল্লিশ বছর পরে এখানেই প্রথম বাংলা ভাষায় নাট্যাভিনয় হল সম্পূর্ণভাবে বাঙালি উদ্যোগে । ১৯৩৫এর ৬ই অক্টোবর নবীনচন্দ্রের থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয় সঙ্গীতপ্রধান ‘বিদ্যাসুন্দর’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে । আরো একটি কারণে বাবু নবীনচন্দ্রের থিয়েটার বাংলার নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে, তা হল নাটকের নারী চরিত্রে স্ত্রীলোকদের অভিনয়, যা তখনকার সমাজে তীব্র আলোড়ন তুলেছিল । লেবেদেফকে অনুসরণ করে বাবু নবীনচন্দ্রও বারাঙ্গনা পল্লী থেকেই নারী চরিত্রে অভিনেত্রী সংগ্রহ করেছিলেন । হিন্দু পাইয়োনিয়ার পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে স্ত্রীলোকদের অভিনয়ের উচ্চপ্রশংসার সাথে একথাও লিখেছিল যে “ এই অভিনয়ের দ্বারা সমাজ সংস্কারের একটি ধারা সূচিত হইতেছে” । হিন্দু পাইয়োনিয়ার লিখেছিল “ দেশব্যাপি অজ্ঞানের মধ্যে এরূপ অপ্রত্যাশিত একটি ব্যাপার ঘটিতে পারিয়াছে, তাহাতে আমরা অতিশয় আনন্দিত হইয়াছি । এই সকল বালিকাদের দেখিয়া কি দর্শকরা স্ত্রী ও কন্যাদের শিক্ষা দিবার জন্য উৎসাহিত হইবেন না ? ... এই সকল প্রশংসনীয় কিন্তু ভ্রমে পতিত স্ত্রীলোকদের চারিত্রিক উন্নতি করিবার এও প্রচেষ্টার জন্য নাট্যশালার স্বত্বাধিকারী বাবু নবীনচন্দ্র বসু ধন্যবাদের পাত্র” । 

উত্তর কলকাতার সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল এলাকা হল হাতিবাগান । এখন অবশ্য কলকাতার অন্যতম প্রাচীন অঞ্চল হাতিবাগান তার ঔজ্বল্য ও গৌরব হারিয়েছে অনেকটাই, তবুও হাতিবাগানের কথা না বললে উত্তর কলকাতা কথা সম্পূর্ণ হয় না । জনশ্রুতি ১৭৫৬ সালে নবাব শিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় তাঁর সেনাদের হাতিগুলি নাকি এই অঞ্চলে রাখা হয়েছিল । সেই থেকেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে হাতিবাগান । 

উত্তর কলকাতার অন্যতম প্রাচীন অঞ্চল হাতিবাগানের রাস্তার ধারে সারিসারি দোকানে, ফুটপাথে সস্তায় কেনাকাটার স্মৃতি অনেকেরই আছে, বছর দশেক আগেও রঙবেরঙের পাখির মেলা বসতো, বিক্রি হত । আইনী কারণে পাখি বিক্রি আর হয় না। হাতিবাগান বাজারটা দুহাজার বারোয় পুড়ে গেলেও আবার আগের অবস্থায় ফিরেছে হয়তো । সব আছে, তবু হাতিবাগানের অনেক কিছুই আজ আর নেই । সেই ‘নেই’ গুলোর স্মৃতিই আমাদের ‘নস্টালজিক’ করে তোলে । 

হাতিবাগানের অস্তিত্ব জুড়ে ছিল সিনেমা । আধ কিলোমিটারের মধ্যে এতো সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ কলকাতার আর কোথাও ছিল বা আছে এমন জানা নেই আমার । ফড়িয়াপুকুরে ইংরাজি সিনেমা দেখার ‘টকি শো হাউস’, বিধান সরণিতে পা রাখলেই রাস্তার দুধারে অনেক স্বপ্নপুরী – দর্পণা, মিত্রা, মিনার, শ্রী, উত্তরা, রাধা, রূপবাণী । কত মানুষের কত স্মৃতি, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের কত সোনালী টুকরো । রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘রূপবাণী’নামকরণও তাঁর । প্রেক্ষাগৃহে বসে সিনেমা দেখার ইতিহাসের শুরুটাও হয়েছিল হাতিবাগান থেকে । কলকাতায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পথিকৃত ম্যাডান কোম্পানী ১৯০৭এ এখানেই প্রথম দুটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন ‘কর্নওয়ালিশ থিয়েটার’ ও ‘ক্রাউন থিয়েটার’ পরে যাদের নাম হয়েছিল ‘শ্রী’ ও ‘উত্তরা’ । আর এই কর্নওয়ালিশ থিয়েটারেই (অর্থাৎ শ্রী প্রেক্ষাগৃহ) মুক্তি পেয়েছিল প্রথম বাংলা কাহিনী চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ ১৯১৯এর ৯ই নভেম্বর । আজ হাতিবাগানের সিনেমা দেখার শুধু স্মৃতিটুকুই আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে ; এখন প্রেক্ষাগৃহের জীর্ণ টিকিট কাউন্টারে কান পাতলে হয়তো শোনা যাবে ‘স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নেই, হাতিবাগানে টিমটিম করে বেঁচে আছে হিন্দি সিনেমার কল্যাণে, ‘টকি শো হাউস’ মিত্রা, দর্পনা ও মিনার । বাকিগুলি বন্ধ বহুদিন থেকে, শপিং মল বা বহুতল হওয়ার অপেক্ষায় । শ্রী ও উত্তরা ইতিমধ্যেই শপিং মল হয়ে গেছে ।

বাঙালির সিনেমা দেখার বয়স তো মাত্র একশো বছর । এর পঞ্চাশ বছর আগেই সে মজেছিল থিয়েটারে, থিয়েটারই ছিল সেকালের বাঙালির সেরা বিনোদন । আর কি আশ্চর্য, তার থিয়েটারে মজে যাওয়ার শুরুও এই হাতিবাগান থেকেই । আমাদের ব্যবসায়িক থিয়েটারের পথচলা শুরু হয়েছিল ১৮৭২এ । তারপর আমাদের ব্যবসায়িক থিয়েটারের যা কিছু ইতিহাস, তা রচিত হয়েছিল হাতিবাগান-বিডন স্ট্রীট চত্তরে । গিরিশচন্দ্র, নটী বিনোদিনী, অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, কুসুমকুমারী, শিশিরকুমার ভাডুড়ি থেকে অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, মহেন্দ্র গুপ্ত, সরযুবালা, উত্তম কুমার, বিকাশ রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, নজরুল ইসলাম এমন কত মানুষের অভিনয়, গান, নাচের স্মৃতি ধরে রেখেছে হাতিবাগানের রঙ্গালয়গুলির ইট কাঠ বালি । শুধুই স্মৃতি, সেখানে নাটক আর হয় না ।

বিধান সরনী থেকে হাতিবাগানে পা রাখলেই ১৩৫ বছরের স্মৃতি ঘেরা স্টার থিয়েটার (বলে রাখি স্টার থিয়েটার প্রথমে ছিল ৬৮ বিডন স্ট্রীটে, হাতিবাগানে নতুন ভবনে উঠে আসে ১৮৮৭তে । এখানে নটী বিনোদিনি অভিনয় করেননি, তার আগেই তিনি থিয়েটার থেকে সরে গিয়েছিলেন , তবে বিনোদিনির স্মৃতি আছে হাতিবাগানেও, তিনি থাকতেন ১৪৫ নম্বর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে) । পাশেই ‘রঙমহল’ । একটু এগিয়েই শিশিরকুমার ভাদুড়ির স্মৃতি বিজড়িত শ্রীরঙ্গম থেকে হাতবদল হওয়া বিশ্বরূপা, এবং অনেক পরে প্রতিষ্ঠিত সারকারিনা, রঙ্গনা, বিজন থিয়েটার আর অদূরে সন্নিহিত বিডন স্ট্রীটে ১২৫ বছরের স্মৃতি ঘেরা মিনার্ভা – হাতিবাগানের নাটক পাড়ায় আর নাটক হয় না । স্টার থিয়েটার ১৯৯০তে আগুনে ভস্মিভূত হওয়ার পর পুণর্নির্মিত হয়েছে শপিং মল সহ ক’বছর আগে, কিন্তু সেখানে আর থিয়েটার নয় সিনেমা হয় বাকিগুলো ভবঘুরেদের আস্তানা, কেউবা বহুতল বা শপিং মল হওয়ার অপেক্ষায় । বাংলার পেশাদারি থিয়েটারের উদ্ভব, বেড়ে ওঠা এবং বিনাশ – সবটাই দেখেছে, সাক্ষি থেকেছে হাতিবাগান । বাসের কনডাকটরকে এখন আর বলি না রাধা স্টপেজে নামবো, বলি গ্রে স্ট্রীট ক্রসিং । হাতিবাগান আছে, নেই তার ঔজ্বল্য, গৌরব ।

এখন ৩০/৪০ বছর আগেকার কলকাতাকেও যেন চেনা যায় না । শহরের গতি বেড়েছে, জনবিন্যাসেও এসেছে অনেক বদল । আকাশচুম্বি অট্টালিকা, উড়ালপুল, আলো ঝলমলে চওড়া রাস্তা,বড় বড় বিপণি খেয়ে নিয়েছে পুরন দিনের অনেক ইতিহাস, শুধু পড়ে আছে স্মৃতি । ইতিহাসের তথ্য আর স্মৃতির মিশ্রণে তৈরি এ লেখায় উত্তর কলকাতার সব কথা উঠে এসেছে এমন নয় । কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের কিছু তথ্য ঘেটে তাতে স্মৃতির মিশেল দিয়েছি এটুকুই বলার ।



Previous Post Next Post