► স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক / নিখিলেশ, আমরা এইরকম ভাবে বেঁচে আছি

স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক / নিখিলেশ, আমরা এইরকম  ভাবে বেঁচে আছি
নয় নয় করে মাসখানেক কেটে গেল। অবশ্য তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই আমরা ঘরে থাকা অভ্যেস করেছি। রাজ্য সরকারের লকডাউন মেনেছি, মেনেছি জনতা কারফিউও। এত কিছু মেনেছি শুধু ভয়ে, আতঙ্কে। নাহলে এতটাও সহজ ছিল না সদা বারমুখী ‘সামাজিক’ প্রাণীদের এভাবে আটকে রাখা। সব মিলিয়ে ধরলাম ৪০-৪৫ দিন। কেউ কেউ তারও বেশী। যাদের প্রয়োজন পড়েনি তারা বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করেছেন আগেই। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চাকরি বা পেশার প্রয়োজনে যাদের বেরোতে হয়েছে তারা তারও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সাবধানী, সতর্ক। অফিসের মিটিংগুলো চেষ্টা করা হচ্ছিল বড় ঘরে করতে, যাতে দূরত্ব রাখা যায়। খুব প্রয়োজন ছাড়া একে অপরের কিউবিকলের ধার মাড়াচ্ছিলেন না। কাজের বিরতিতে চায়ের আড্ডাগুলোও একটু দূরত্ব রেখেই হচ্ছিল। এখন যেন মনে হয় কতকাল হলো থেমে গেছে সিগারেটের কাউন্টার নেওয়া, একই কাপ থেকে চা খাওয়া, কাউকে ডেকে জোর করে একটা কাপ ধরিয়ে দেওয়া, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া। এই সবকিছুকে এড়িয়ে যেতে শিখে গেছি আমরা। আড্ডার বিষয় যদিও সেই একই। এর বাইরে কেউ আর কিছু ভাবতে পারছে না। ক্লায়েন্ট বিদেশী হোক বা স্বদেশী, সচেতন হয়ে গেছিলাম আমরা, হাত মেলাবো না। প্রয়োজনে ভারতীয় পদ্ধতিতে নমস্কার জানাতে পারি, কিন্তু হাত মেলানো চলবে না। আগে যাদের সঙ্গে দেখা হলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতাম, তাদের কি আর সেভাবে কাছে টানতে পারবো কোনদিনই? উত্তর জানা নেই। মানুষের ইতিহাস আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা শুধু অনুমান করতে শিখছি এখন। 

গত মাস দুয়েক হলো আমাদের ওঠা হাঁটা খাওয়া পরা, সবকিছু পাল্টে গেছে। বদলে নিয়েছি অভ্যেস। নিজের ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে, পাশের বাড়ি থেকে, পাড়া থেকে, শহর থেকে, রাজ্য থেকে, দেশ থেকে, সমগ্র বিশ্ব থেকে আলাদা করে নিয়েছি নিজেকে। এ বড় সহজ কথা নয়। তিন মাস আগেও এই পরিস্থিতি কল্পনা করিনি। ভাবতেও পারিনি এভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায়। সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে একে অপরের সঙ্গে, কীভাবে আলাদা করা যাবে? এসব ভেবেছি আর নিজেদের মধ্যে আতঙ্ক ভাগ করে নিয়েছি। “সাবধানে থেকো, বারে বারে হাত ধোও” বলেছি একে অপরকে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চায়না হয়ে, ইতালি হয়ে, স্পেন হয়ে, আমেরিকা হয়ে আতঙ্ক থাবা বসিয়েছে আমার ঘরেও। ফল, পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সর্বস্তরে, সে এমন পরিবর্তন যার জন্য দলাদলি করতে হয়নি, কেউ হেসে উঠে তাকে তুচ্ছ করার সাহস দেখায়নি। যে জাতটা ছোট থেকে নিজেদের অবাধ্যতার কারণে বাহাদুরি দেখিয়ে বেড়ায়, শিশুপাঠ্য বইতে এত করে বলা সত্বেও গোপাল নয়, বরং রাখাল হয়ে ওঠাকেই সে নিজের লক্ষ্য বলে ধরে নেয়, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার চেয়েও দাবী দাওয়া আন্দোলন ঘিরে সোচ্চার হওয়াকে যে জীবনের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে তারাও কেমন যেন নিয়ম মানা বাধ্য নাগরিক হয়ে উঠেছে। কিছুতেই লাইনে দাঁড়াবে না বলে যার আজীবন ধনুকভাঙা পণ ছিল, রেলওয়ে টিকিটের লাইন থেকে ডাক্তারের ক্লিনিকে গিয়েও যে “আমার বেশিক্ষণ লাগবে না” বলে কাজ হাসিল করার ফন্দিফিকির খোঁজে সেই সব বীর বাঙালিকে হঠাৎ করেই লাইনে দাঁড়াতে শিখিয়ে দিয়েছে গত কয়েকটা দিন। আর এই এতবড় বিপ্লবটা হয়ে গেল প্রায় নীরবে। কাউকে ডেকে আনতে হয়নি সমাজ পরিবর্তনের এই বিপ্লব যজ্ঞে। বরং বলা ভাল ডেকে না আনাটাই এই যজ্ঞের মূল মন্ত্র। অথচ একটা বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেল গোটা পৃথিবীতে। মৃত্যুভয় এত ভয়ঙ্কর! 

ক’দিন আগে একটা কথা খুব ঘুরছিল, ‘ঘরে বসে দেশ সেবার এমন সুযোগ আর পাবেন না।’ ইতিহাস বলছে দেশ সেবা করতে মানুষকে পথে নামতে হয়েছে, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যোগ্যতা। সে সব কিছুই না করে শুধু ঘরে বসে ডাল ভাত আলুসেদ্ধ খেয়ে আমরা প্রত্যেকে দেশপ্রেমিক বনে গেলাম! এ তো শুধু নিজের বাঁচা নয়। এ হলো আশেপাশের সকলের সুস্থতার দায়িত্ব নেওয়া। তা আমরা অধিকাংশ মানুষই নিয়েছি। কেউ কেউ হয়তো শুনছেন না। নিজেকে ঘরে আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাদের বোঝাতে বাড়ির অন্য লোকের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। পুলিশকে লাঠি চালাতে হচ্ছে। কি ভয়ানক দিন এলো! মানুষকে নিজের বাড়িতে রাখার জন্য পুলিশকে আজ অস্ত্র ধরতে হচ্ছে! সারা জীবনে কোন অপরাধ করেনি যারা তারাও বাজারের থলি কিংবা প্রেসক্রিপশন হাতে কাঁচুমাচু মুখে পুলিশকে বাইরে বেরোবার কারণ দর্শাচ্ছে। পুলিশও নিরুপায়। কোথায় দাগী আসামী, ভয়ঙ্কর সব দুষ্কৃতীদের কড়কে দিয়ে হাতের সুখ করবে, তা না, খামোখা নিরীহ গৃহস্থ পিটিয়ে, মাস্ক বিলিয়ে, কুকুর বিড়ালকে খাইয়ে, গান গেয়ে এক অন্য গ্রহের বাসিন্দা বনে গেছেন তারাও। তবু এ বাজারে প্রাণ হাতে করে লড়ে যাচ্ছেন তারাই, যাদের নিন্দে করে আমরা অদ্ভুত এক সুখ পাই সারাবছর। নিন্দে করা সবচেয়ে সহজ হয়ে যায় পিছনে দাঁড়িয়ে করলে, এ তো সবাই জানে। আর লড়ছেন ডাক্তাররা। যাদেরকে পেটানো সহজ, যখন তখন যাদের নামে অভিশাপ দেওয়া যায় সেই তারাই একদম সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন। ভরসা ওই মাস্ক আর স্যানিটাইজার। আজ যুদ্ধের সময় ওরাই আমাদের সেনাপতি। দেশের জরুরি অবস্থায় লড়েন আর্মির জওয়ান, পুলিশ, ডাক্তার আর সাংবাদিকরা। আর আমরা যারা নিতান্ত সাধারণ নাগরিক? আমরা এদের দেওয়া সমস্ত সুবিধা নিয়ে তারপর এদের সমালোচনা করে যাই। কিন্তু এই প্রথমবার বোধহয় আমরা নাগরিকরাও একটু বেকায়দায়। কেমন করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনটাও যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। 

কেমন ছিল মহামারীর পূর্ববর্তী জীবন? সকালে উঠেই ব্যস্ততা, অফিসের তাড়া, কাজের তাড়া, রান্নার তাড়া, স্কুলের টিফিন, জলখাবার, চান, রেডি হওয়া সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা চলতো। অভ্যস্ত ছিলাম আমরা সবাই এই সব নিয়েই। তার মধ্যেই গল্প আড্ডা বিনোদন কেনাকাটা সবই করেছি সকলে। অনেক কেঁদে ককিয়ে আজ সোমবার, আজ মঙ্গলবার করে দিন গুনে তবে আসতো সপ্তাহের শেষ দুটো দিন। কারোর আবার শুধু একটাই দিন। সে দিনটা বিছানায় একটু আলসেমি, নিজেকে একটু প্রশ্রয় দেওয়া, ইচ্ছেমতো হেলেদুলে প্রাতরাশ বানানো, তারপর পা ছড়িয়ে আর এক কাপ চা আর খবরের কাগজ ঘেঁটে তারপর রান্নায় হাত। আর এখন যেন প্রায় প্রতিদিনই রবিবার হয়ে গেছে। কাজ যে নেই তা নয়। অনেককেই বাড়িতে বসেও অফিসের চাপ সামলাতে হচ্ছে। গৃহিণীদের সারতে হচ্ছে বাড়ির উনকোটি চৌষট্টি কাজ, তার সঙ্গে যাদের অফিসের কাজও করতে হচ্ছে তাদের দশা আরো করুণ। তবু কেমন যেন একটা ছুটির মেজাজ। তাড়াটা অনেক কম। মাঝখান থেকে কেমন যেন সেই সত্তরের দশকের দিনগুলো ফিরে এসেছে। সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ির সকলে এক ছাদের তলায়। সকলে একসঙ্গে টিভিতে পুরোনো অনুষ্ঠান দেখা, কখনো লুডো তাস কিংবা গান শোনা, গল্প করা। মাঝে মাঝে চটজলদি অল্প যোগাড়ে সান্ধ্য জলখাবার আর চা। তবে সর্বত্র হয়তো এত সুখের ছবি নয়। শোনা গেছে দিনের পর দিন একসঙ্গে গৃহবন্দী থাকার কারণে নাকি ডিভোর্সের হার বেড়ে গেছে। বেড়েছে সাংসারিক হিংসার ঘটনাও। কিন্তু সেটা প্রাথমিক ধাক্কায় হবারই ছিল। সম্পর্কের লিটমাস টেস্টে কে পাশ করবে আর কে করবে না সে তো আগে থেকে জানা যায় না। 

কিন্তু যদি লকডাউন বাড়ে? দুই বা আড়াই মাস? কী হবে তখন? কিংবা হয়তো এমন হবে জরুরি পরিষেবা ছাড়া বাকি সমস্ত কাজ বাড়ি থেকেই করতে হবে অনন্তকাল ধরে। ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে, কিন্তু এও তো ঠিক, বাড়ি থেকে না বেরিয়েও যে কাজকর্ম করা যায়, দৈনন্দিন জীবনে বাঁচা যায় তা আমরা আদৌ জানতামই না। জেনেছি এই গত কয়েকদিনে। এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় চিন্তা দেশের নিম্নবিত্তদের নিয়ে। দরিদ্র মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা কী তা আমরা সকলেই জানি। অজস্র পরিবার রোজের খাবারটুকু পাচ্ছে না। তবে এও ঠিক যে এই চরম কন্ট্রাস্ট ছাড়া মানব সভ্যতা হয় না। তবু বহু মানুষ এগিয়ে আসছেন নিজেদের সাধ্যমতো সহায়তা করতে। এই দিন না এলে এই ছবিও তো দেখতে পেতাম না। ধর্ম আর ইশ্বরের মাহাত্ম্য প্রচারের কেন্দ্রগুলোয় তালা পড়েছে, ভেসে উঠছে মানুষের মুখ। যদি এভাবেই চলে আগামী দিনগুলো? যদি অসহায় মানুষের অন্ন সংস্থান করা যায়, তাদের প্রাথমিক সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রের তরফ থেকে সুনিশ্চিত করা যায় তাহলে বাকি দেশটা কি এভাবে চলতে পারবে মাসের পর মাস? ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সত্যি যদি সেই দিন দেখতে হয়, খুব খারাপ হবে কি? তবে সব পেশায় ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয় এও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমাদের কাছে। সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থার হাল দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকছে। ঘরে বাইরে সমূহ বিপদ। কাজে বেরোতেই হবে, নাহলে পেট চালানো সম্ভব নয়। তবু কিছু যদির প্রশ্ন উঠে আসে মাথায়। কারণও আছে তার। এই পরিস্থিতি না এলে কি আমরা জানতাম এতগুলো দিন ধরে রাজনীতি, অপরাধ, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, পরিবেশদূষণ, অব্যবস্থা, দুর্নীতি নিয়ে একটাও খবর ছাড়া সংবাদপত্র চলতে পারে? যে দেশে গত মাসেও রাজনীতির কচকচিতে টিভিতে কান পাতা দায় হয়েছিল সেখানে এখন সব বাড়ি থেকে পুরোনো ধারাবাহিক আর গানের শব্দ ভেসে আসছে। সংবাদ চ্যানেলগুলো ব্যস্ত সারা দেশের চিকিৎসা আর ডাক্তারদের খবর নিয়ে। মানুষের অসুস্থতা কাম্য নয়। কিন্তু ওইটুকু বাদ দিলে হঠাৎ করেই চরাচরব্যাপী যে অপার শান্তি নেমে এসেছে তা আমরা কল্পনাও করিনি এত বছরে। 

মানুষের যাতায়াতের ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ সত্যিই বেদনাদায়ক, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ অনেকেই একা রয়েছেন, অনেকে বাড়ি ফিরতে পারেননি, এ অবস্থায় দিনের পর দিন কাটালে ধীরে ধীরে আরো অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবে। কিন্তু যদি এমন হতো একদিন পৃথিবীটা এমনভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেল, ইন্টারনেট ছাড়া কারোর সঙ্গে কারোর কোন যোগাযোগ থাকলো না, কেউ কোনদিন কোন সভা সমিতি মিছিল আড্ডায় কোথাও জমায়েত হলাম না। অথচ সবই থাকলো, প্রতিবাদ প্রতিরোধ অবরোধ আড্ডা অনুষ্ঠান। তবে মুখোমুখি হয়ে নয়, ভার্চুয়ালি। কেমন হতো সে দিন? শান্তি নেমে আসতো কি? অপরাধ মুছে যেত পৃথিবী থেকে? জানা নেই। তবু দূষণমুক্ত এই পৃথিবী, ঘন নীল আকাশ, নদীতে স্বচ্ছ জল, শহরের ঝিলে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক, সমুদ্রের জলে ডলফিন, পরিষ্কার রাস্তাঘাট এসবও তো এক অদেখা দিন দেখালো আমাদের। এমন দিন দেখবো কেউ তো ভাবিনি। নিখিলেশের সঙ্গে জীবন বদল করে কবির হয়তো কোন লাভ হয়নি, কিন্তু এই অন্যরকম বদলও এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে। ২০২০ সালটা বিষাক্ত অভিজ্ঞতা দিলেও ভোলা যাবে না এই বছরটাকে, মনে থেকে যাবে। 



Previous Post Next Post