► সুশান্ত কুমার রায় / লোকসংস্কৃতি বিশারদ হরিশ্চন্দ্রপাল ও তাঁর কর্মময় জীবন

সুশান্ত কুমার রায় /  লোকসংস্কৃতি বিশারদ হরিশ্চন্দ্রপাল ও তাঁর কর্মময় জীবন
একটি জাতির আত্মপরিচয় তার লোকসংস্কৃতি৷যা সাধারণ মানুষের ভাষা,জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য,পেশা অর্থাৎ লোক-সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, জীবন-যাপন প্রণালী,কার্যকলাপ এবং চিত্তবিনোদনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি তাদের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তা-ই লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। লোকসংস্কৃতিতে কোনো কৃত্রিমতা থাকে না, থাকে সহজিয়া সুর৷প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত অক্ষরজ্ঞানহীন ও ঐতিহ্যানুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনসমষ্টিকে ‘লোক’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রকৃতিনির্ভর গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা প্রধানত ঐতিহ্যমুখী, গতানুগতিক ও মন্থর। গ্রামবাসীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তেমন একটা পায় না। তারা পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ধর্মকর্ম, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাকে অবলম্বন করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে।সরলতা, সজীবতা ও অকৃত্রিমতা লোকসংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

নদীর মতো প্রবাহমান লোকসংস্কৃতি।নদী যেমন অসংখ্য বাঁক নেয় গতিপথে, তেমনিভাবে কর্মযোগী হরিশ্চন্দ্র পালের জীবন-গাঁথা বিবিধতায় পরিপূর্ণ,লোকসংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা, বিচিত্র রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ ও কীর্তিময় তাঁর জীবন।বাংলার লোক-ঐতিহ্য ও ভাষা-সংস্কৃতি গবেষণায় নিরলসভাবে কাজ করে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হরিশ্চন্দ্র পাল।কোচবিহার জেলার নাট্য ও সংগীত জগতে এক অনন্য নাম হরিশ্চন্দ্র পাল।যিনি তাঁর নিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে উত্তরবঙ্গের পল্লীগীতির অক্ষয় ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন, বহুধা বিস্তৃত গ্রাম্য পরিবেশে অবহেলার অন্ধকার হতে তিনি সেই রত্নগুলিকে আহরণ করেছেন সারা জীবন ধরে। হরিশচন্দ্র যে সময় সেগুলি সংগ্রহ করেছিলেন তখন গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের তেমন কোন সুব্যবস্থা ছিলো না, যার দরুন অধিকাংশ সংগ্রহ তিঁনি পায়ে হেঁটেই করতেন।কখনোবা দিনে ষোল-সতের কিলোমিটারেরও অধিক পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে। পথ বলতে মুখ্যত মেঠোপথ ও আলপথ। যেখানে নদী সেখানে আবার নৌকাযোগে নদী পার হতে হতো এক বা একাধিক বার।সংগ্রহের মাধ্যম ছিলো হাতে লিখে নোট করা, পরে বাড়িতে এসে আবার চলতো সাজিয়ে লেখার কাজ।হরিশ্চন্দ্র পাল তৎকালীন রাজন্য-শাসিত কুচবিহারের দিনহাটা শহরের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ও জোতদার পরিবারে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে (৮ই আশ্বিন, ১৩২২ বঙ্গাব্দ)জন্ম গ্রহন করেন। লোকসাহিত্য থেকে লোকগীতি, সংগীত, নাটক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সংগ্রাহক হিসেবে সর্বত্রই ছিলো তাঁর অবাধ বিচরণ। হরিশ্চন্দ্র পাল ছিলেন শশীভূষণ ও জ্ঞানদা সুন্দরীর চতুর্থ পুত্র।হরিশ্চন্দ্র পালের পিতা শশীভূষণ পাল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) পাবনা জেলার শালগাড়িয়া অঞ্চল থেকে দিনহাটায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।কর্মজীবনের প্রথম দিকে দারিদ্রতার চরম কষাঘাতে জর্জরিত থাকলেও নিজের নিরলস প্রচেষ্টা, সততা ও দক্ষতার মাধ্যমে ব্যবসায় ক্রমশ উন্নতি লাভ করে সফলতা লাভ করেন।

মাতা জ্ঞানদা সুন্দরী অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা ছিলেন।প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত না হয়েও নিজেদের জ্ঞান ও কর্মগুণে তাঁদের প্রত্যেকটি সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন।তাঁর পরিবারের সমস্ত পরিচয়কে অতিক্রম করে মানব হৃদয়ে যে পরিচয়টি অধিকতর উজ্জ্বলতর হয়ে ফুটে উঠে সেটি হলো লোকসংস্কৃতির দিকপাল হরিশ্চন্দ্রের প্রতিভা মানসের পরিচয়।পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহুকুমার দিনহাটা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন।সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যেরে বিষয় হলেও সত্য যে উক্ত কলেজে পরবর্তীতে স্নাতক স্তরে ভর্তি হলেও বছর খানেক পড়াশোনা করার পর পারিবারিক সমস্যার কারণে মাঝ পথেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় ।হরিশ্চন্দ্র পাল ছাত্রাবস্থা থেকেই পড়াশোনার ফাঁকে সময় পেলে পিতার সম্মতিতেই ব্যবসা দেখাশোনা করতেন।কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর পৈতৃক ব্যবসায় নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করেন এবং তাঁরই ফলশ্রুতিতে পরবরর্তীতে একজন স্বনামধন্য সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে সকলের নিকট পরিচিত হয়ে ওঠেন।তাঁর মানসে থাকা সংস্কৃতির বীজ অঙ্কুরিত হতে সাহায্য করেছিলো বাড়ির কর্মপরিবেশ ও শিক্ষার আলো, যা পরবরর্তীকালে তাঁকে এক মহীরুহ বৃক্ষে পরিণত করে।বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ, বিভিন্ন পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা এবং তৎকালীন দিনহাটার অনুকুল পরিবেশও এর জন্য অনেকটাই দায়ী বলে অনেকে ধারণা করেন। সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন লোকসংস্কৃতি বিশারদ হরিশ্চন্দ্র পাল।

তাঁর লেখা কিছু দিনলিপি থেকে জানা যায়, হরিশচন্দ্র পাল তাঁর বন্ধুদের সাথে নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা করতেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাগসঙ্গীতে শিক্ষা নেন ও তা নিয়মিত চর্চা করেন। যাঁর ফলশ্রুতিতে মালসী গানগুলিতে রাগ সঙ্গীতের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত গানগুলির সব’কটিই তাঁর পরিচালনায় রেকর্ডবন্দী হয়েছিল এবং বহু গানের গীতিকার এবং সুরস্রষ্টা তিনি নিজেই। তৎকালীন সময়ে যে সমস্ত শিল্পীরা রেকর্ডগুলিতে গান গেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কেশব বর্মন, নায়েব আলী(টেপু),প্যারীমোহন দাস, বিরজাপ্রসন্ন সেন(মাঝু), গঙ্গাঁচরণ বিশ্বাস , কেদার চক্রবর্তী, গঙ্গাঁধর দাস, গোপালচন্দ্র দে, নরেন পাল, সুনীল দাস, ধনেশ্বর রায়, নগেনশীল শর্মা, অভয় রায়, অনিল রায়, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতশ্রী স্মৃতি বসু, মীনা দত্ত(সেন), শেফালী সরকার(বসু),দময়ন্তী রায়(বর্মন), আয়েষা সরকার, অনীতা সাহা প্রমুখের নাম উল্লেখ্য।বিভিন্ন রকমের সংগীত বাদ্যযন্ত্র যেমন- ঢোল, তবলা, পাখোয়াজ, দোতরা, বেহালা, এসরাজ ইত্যাদি ছাঁড়াও বাঁশি, পিক্কালো(এক ধরনের বাঁশি বিশেষ),হারমোনিয়াম, ম্যন্ডোলিন প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র তিনি অনায়াসে বাজাতে পারতেন এবং সেগুলোতে সুরের মুর্ছণা সৃষ্টি করে নিজে উৎফুল্ল থাকতেন এবং অন্যকে ক্ষণিকের তরে হলেও মোহিত করতেন।এছাড়াও নাটকের রিহার্সলের পাশাপাশি ও ফুটবল খেলায় তাঁর মনোযোগ ও মনোনিবেশ ছিলো।ফরওয়ার্ড ব্লক ক্লাব যাঁর পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় পাইওনিয়ার ক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দিনহাটার সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমী ও ক্রীড়ামোদীরা একটা মঞ্চ পেয়ে তাঁদের প্রতিভা বিকাশের একটা সুযোগ সৃষ্টির প্রয়াস লাভ করেন ১৯৩৭ থ্রিষ্টাব্দে।কলেজ জীবনের পর থেকে তিনি নাটক ও সংগীত রচনা শুরু করেন। হরিশচন্দ্র বরাবরই মানুষ হিসেবে একজন নাট্য-প্রাণ ছিলেন।দিনহাটার পাইওনিয়ার ক্লাবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতে থাকে একের পর এক নাটক। 

হরিশচন্দ্র পাল নিয়মিতভাবে সে নাটকগুলিতে শুধু অভিনয়ই করতেন না, দিক নির্দেশনা প্রদান এবং কলকাতার বিখ্যাত থিয়েটারগুলির অনুকরণে মঞ্চ তৈরি, কুশি-লবদের সাজ-সজ্জা বিন্যাস অর্থাৎ মেকআপ আর্টিস্ট এর ভূমিকা পালন করে নাটকগুলো নিজে পরিচালনা করে দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে তুলতেন। কিছু নাটকে তিনি অভিনয়ও করেন, যেমন- লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকে রাবণ, মধুমালা নাটকে মদন কুমার ও রাজকুমার, দুবলা বালী নাটকে চাঁদমল, কানাই ধামালী নাটকে কৃষ্ণের ভুমিকায়।তবে নানাবিধ কারণে হরিশচন্দ্র পাল পরবর্তী জীবনে নাট্যজগৎ থেকে তিনি দূরে সরে যান বলে জানা যায়।তাঁর নাট্য প্রতিভার কথা প্রসঙ্গে ড. আর্য্য চৌধুরী লিখেন- ”দিনহাটার প্রখ্যাত প্রবীণ ভাওয়াইয়া শিল্পী সুনীল দাসের কাছে জানতে পেরেছিলাম হরিশদা’র নাট্য প্রতিভা সম্পর্কে- “কি নির্দেশনায় কি অভিনয়ে, কি সাজ-সজ্জায় ও মেক-আপে তাঁর ভূমিকা ছিলো অসামান্য ”। উত্তরবঙ্গের গৌরবদীপ্ত দু’জন বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী সুধাংশুশেখর মুস্তোফী(পাগলা) ও ক্ষিতিশচন্দ্র ঘোষ তাঁদের স্মৃতিচারণায় হরিশচন্দ্র পালকে তাঁদের “নাট্যজীবনের প্রথম গুরু” ও “নাট্যচার্য” রূপে অভিহিত করেন।পাইওনিয়ার ক্লাবে নাটকে অভিনয়কালে হরিশচন্দ্র পাল নিজে যে কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন সেগুলির মধ্যে ‘এক রাত্রির ঘটনা’ ও ‘ব্ল্যাক মার্কেট’ নাটক দুটি সর্বজন প্রশংসিত হয় এবং প্রকাশিত ‘দুটি নাটক’ গ্রন্থে স্থান পায় ।

গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে হরিশচন্দ্র পালের লোকসংস্কৃতি জগতে পদার্পন ঘটে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর জীবনে স্মরণীয় দিন,স্মরণীয় ঘটনা বলা যায়।ওই বছরই তিনি করম্বিয়া গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া থেকে মিষ্টার কুকম্যান এর সহযোগিতায় তাঁর পরিচালিত প্রথম লোকগীতিটি রেকর্ডবন্দী করেন।পরে দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া লিমিটেড অর্থাৎ হিজ মাস্টারস ভয়েস (এইচ.এম.ভি.) থেকে তাঁর পরিচালিত প্রথম রেকর্ডটির আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দে। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত হরিশচন্দ্র পাল লোকগীতি রেকর্ডবন্দী করে গিয়েছেন।এই সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে ভাওয়াইয়া ও চটকা ছাড়াও কয়েকটি ভাটিয়ালী, মালসী(খেমটা জাতীয়)ও সারি গানের তিনি মোট চুরানব্বইটি পঁচাত্তুর আর.পি.এম (রেভ্যুলেশন পার মিনিট)এবং সতেরটি আর.পি.এম (রেভ্যুলেশন পার মিনিট) এর রেকর্ডবন্দী করেন কলম্বিয়া, হিজ মাষ্টারস ভয়েজ ও হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে। দরদী কণ্ঠস্বরের অধিকারিনী শিল্পী আয়েষা সরকারকে দিয়ে তিনি দুটি গান গাইয়েছিলেন পরীক্ষামূলক ভাবেই। “বড় ঘরের কইনা কোনা/পিটি হাতে চুল” এবং “আইজ পুতুলের অধিবাস/কাল পুতুলের বিয়া”- বলাবাহুল্য যে, লোকসংগীত শিল্পী আয়েষা সরকারের কন্ঠেগীত গান দুটি বিপুলভাবে সমাদর লাভ করে। শিল্পী দময়ন্তী রায় হরিশ্চন্দ্র পাল এর জীবনের রেকর্ডিং ইতিহাসের প্রায় অন্তিমলগ্নে যে সমস্ত গান রেকর্ডবন্দী করেছিলেন তার মধ্যে কিছু চটকা গান-আরে ও ওরে রিক্সা আলা বন্ধু(মিশ্র চটকা; কথা ও সুর: গঙ্গাচরণ বিশ্বাস), ভাওয়াইয়া গান-দুথের নদীর জল(কথা:প্রচলিত,সংগ্রহ: রাধাকান্ত বর্মণ), তুই কেনে ডাকিলু নিশা(প্রচলিত: মালসী গান-ভালোবাসার কথা ভালত লাগেনা(কথা:হরিশ্চন্দ্র পাল, সুর: গঙ্গাচরণ বিশ্বাস) উল্লেখযোগ্য।এক সময় উত্তরবাংলার লোকগীতিগুলি সাধারণত পল্লীর শিল্পীদের মুখে মুখেই প্রচলিত ছিলো। হরিশচন্দ্র পাল লক্ষ্য করেন উত্তরের অন্যতম এই সম্পদ ভাওয়াইয়া গান দিনের পর দিন তার স্বকীয়তা ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে।

এ হেন পরিস্থিতিতে ভাওয়াইয়া ও উত্তরের অনান্য লোকগীতিগুলিকে রক্ষা করার প্রয়াসে অর্থাৎ অরিজিনালিটি ধরে রাখার জন্য উপায় নির্ধারণ করে গানগুলির মুল উচ্চারণ ও সুর ঠিক রেখে সেগুলির মুদ্রণ ও স্বরলিপি তৈরির কাজে হাত দিলেন।যাতে করে গানগুলির সুর এবং বৈশিষ্ট্য হারিয়ে না যায়।তাঁর নিজের কিছু সংগৃহিত ভাওয়াইয়া ও চটকা গানের সম্ভার নিয়ে প্রকাশ করেন উত্তরবাংলার পল্লীগীতি- ভাওয়াইয়া খন্ড(১৩৮০ বঙ্গাব্দ) এবং চটকা খন্ড(১৩৮২ বঙ্গাব্দ)।বাংলার লোকসংগীত ইতিহাসে এ গ্রন্থদ্বয়ের প্রয়োজনীয়তা সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে আজও সুবিদিত। পল্লীগীতির আকর গ্রন্থ দুটিতে আকার মাত্রিক স্বরলিপি নির্দেশ, আঞ্চলিক উপভাষার উপর কিছু পাদটীকাসহ ভাওয়াইয়া ও চটকা গান নিয়ে শিল্পীদের সচিত্র সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়েছে।চটকা খন্ডটি প্রকাশের সময় দি গ্রামাফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া লিমিটেড এর প্রচার সম্পাদক সন্তোষ কুমার দে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ পরিচিতিতে লিখেছেন- ”বনস্পতির শাখায় শাখায় পত্র-পুষ্পের এত যে বৈচিত্র্য, তার মূল আছে মাটির গভীরে, সেখান থেকে সে তার প্রাণরস আহরণ করে বলেই বাইরে তার সৌন্দর্যের বিকাশ উচ্ছ্বসিত হতে পারে..”।হরিশচন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত পল্লীগীতির এই যুগলগ্রন্থ আকর গ্রন্থরূপে সংগীত পিপাসুদের নিকট আজও সমাদৃত।‘ভাওয়াইয়া খন্ড’ যখন তিনি প্রকাশ করেন তখন সারাদেশ তাঁকে সংবর্ধনা জানায়। পণ্ডিত মহল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, প্রবীণ সাংবাদিক অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক তুষার কান্তি ঘোষের হাত দিয়ে তখনকার স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ত্রিবৃত্ত’ তাঁকে তাম্রপত্র দিয়ে সম্মানিত করে। দীর্ঘ তেত্রিশ বছর পর ২৬তম রাজ্য ভাওয়াইয়া সঙ্গীত প্রতিযোগিতার(২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত)অনুষ্ঠানে তিঁনি রাজ্য সরকার কর্তৃক মরণোত্তর সম্মানে সম্মানিত হন ।

হরিশচন্দ্র তাঁর উত্তর বাংলার পল্লীগীতি(ভাওয়াইয়া খন্ড)গ্রন্থে পরবর্তীকালে দেহতত্ব, ছড়াগান, নামকীর্তন ইত্যাদি গানের সঙ্কলন প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন কিন্তু পরবর্তীতে তা আর বাস্তবায়িত হয়ে উঠেনি, নিয়তির সেই অমোঘ নিয়মেই তিঁনি লোকান্তরিত হয়েছেন। তাঁর সংগ্রহের অনেক কিছুই অপ্রকাশিত যা পরে আর আলোর মুখ দেখেনি, যার মধ্যে চারযুগের গান, মনশিক্ষার গান, মালসী গান, ফুল সিজ্জার গান(পূজার গান, চোরচুরনীর(কালী পুজো’র গান), গোরক্ষনাথ পূজোর গান এমনকি কিছু হিন্দী লোকগীতিও রয়েছে। এগুলির মধ্যে চারযুগের গানগুলি ‘তিস্তা তোর্ষা সমাচার’ পত্রিকার সম্পাদক তরুণ দাশ বিগত ২০০৮-২০০৯ ইং সালে অনুষ্ঠিত বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশ করেন বলে জানা যায়। উত্তর বাংলার পালানাটক বা পালাটিয়া গানগুলির প্রতি হরিশচন্দ্র পালের প্রবল আকর্ষণ ছিলো। উত্তরবাংলার মানুষের কৃষ্টির নিরিখে এক অনন্য সৃষ্টি এই পালানাটক। সাধরণত ধর্মীয় কোনো ঘটনা বা গ্রামীণ সমাজের মানুষের আনন্দ-বিরহ-বেদনার চিত্র নাটকগুলির বিষয়বস্তু। দিনহাটার পাইওনীয়ার ক্লাব এর সহযোগিতায় হরিশচন্দ্র পাল হিজ মাস্টারস ভয়েস ও কলম্বিয়া থেকে মোট ৯টি পালা নাটক রেকর্ডবন্দী করেন, বিষহরি (বেহুলা),পাঁচ কণ্যা ভাগ্যধর, লক্ষণের শক্তিশেল (কুষাণ),মধুমালা, সন্ধ্যাবতীর বনবাস (পীড়ান গান),দুবলা বালী বা কাঁচা পাকা পীড়িত, কদমতলা(কৃষ্ণলীলা),দানরাজা (হরিশচন্দ্র), কানাই ধামালী(জাগ গান), সব’কটিই পঁচাত্তুর আর.পি.এম (রেভ্যুলেশন পার মিনিট)এর রেকর্ড। পালা নাটক গুলির সব’কটিই হরিশচন্দ্র পরিচালনা করেন।এছাড়াও হরিশচন্দ্র পাল বহু পরিশ্রমে ও কষ্টে উত্তরবাংলার ও নিম্ন-আসামের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্রতকথা, উপকথা, প্রবাদ-প্রবচন(ছিল্কা), চুটকি, রঙ্গরসকথা, মন্ত্র-তন্ত্র, আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ করেন। অন্তেস্বরী দেবী’র সহায়তায় সংগৃহীত ব্রতকথাগুলি তিঁনি ‘উত্তরবাংলার লৌকিক ব্রতকথা’ গ্রন্থে সঙ্কলন ও প্রকাশ করেন। সঙ্কলনটির মৌলিকতা তার একটি প্রধান গুণ । প্রত্যেকটি ব্রতকথাই এখানে সম্পূর্ণ নূতন এবং মৌলিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা-সাহিত্য গবেষণার প্রখ্যাত অধ্যক্ষ ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ব্রতকথা বইটির ভূমিকা অংশে লিখেন-“সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের ব্রতকথাই সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল এবং সেজন্য তার মধ্যে জাতীয় সংস্কৃতির বহু প্রাচীন উপকরণ বিধৃত আছে। ব্রতকথা গ্রাম্য নিরক্ষর মেয়েলী সমাজের মধ্যে তাদের নিজস্ব একান্ত আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত। শ্রীযুক্ত পাল যথাসম্ভব মেয়েলী ভাষায় সেই আঞ্চলিক উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে ব্রতকথাগুলি প্রকাশ করেছেন”। তাতে বাংলার সামাজিক এবং সংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় যাঁরা প্রয়াস পেয়ে থাকেন, তাঁরা তাঁর সঙ্কলনটিকে একটি নির্ভরযোগ্য আকর-গ্রন্থ রুপে ব্যবহার করতে পারেন। ‘উত্তরবঙ্গের লৌকিক ব্রতকথা’ বহু নির্ভরযোগ্য নৃতাত্ত্বিক, সমাজ-তাত্ত্বিক, জাতি-তাত্ত্বিক তথ্যে পরিপূর্ণ। লোকসংগীতের এই দিকপাল তাঁর দীর্ঘ কর্ম ও কীর্তিময় জীবনে অনেক বিশিষ্টজন ও স্বনামধন্য ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেছেন।তাঁদের মধ্যে বাংলার লোকসংগীত ভূবনের অনন্য পুরুষ ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, হরিশ্চন্দ্র পালের মেজ দাদার বন্ধু কবি শৈলেন রায়,শাস্ত্রীয়সঙ্গীত এর উজ্জল ব্যক্তিত্ব দীনেশচন্দ্র চন্দ, ওস্তাদ আমির খাঁ , ওস্তাদ নগেন্দ্রনাথ দত্ত, পরমহংস নীলকণ্ঠানন্দ ও অতুল দাশগুপ্ত প্রমুখ অন্যতম।সংগীতের ক্ষেত্রে সহপাঠী ছিলেন মেজর দীনেশ চন্দ(পুটু)ও বীরেন দাশগুপ্ত। তিনি সংগীতকে শুধু উত্তর বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে লোক-লোকালয়কে ডিঙ্গিয়ে বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষাভাষী বিশ্ব চরাচরে।কর্মময় জীবনের ফাঁকে ফাঁকে হরিশচন্দ্র পাল সময় বাঁচিয়ে যে বিরাট রত্নভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন কেবলমাত্র সকলের সাথে সেগুলি ভাগ করে নেওয়ার তাগিদে, তাঁর জন্য কখনও তিঁনি কোনোরুপ প্রতিদান প্রত্যাশা করেননি। অতীতে আমরা এমন কিছু মহৎ মানুষকে দেখেছি, যাঁরা মানুষকে ভালোবেসে, নিজের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচারকে ভালোবেসে বাংলার লোকগাথা, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সংগ্রহ করেছেন। আমরা দীনেশচন্দ্র সেনের কথা জানি, যিনি বাংলার হারানো লোকগাঁথা, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহ করেছেন। হরিশচন্দ্র পাল আমাদের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ। লোক-সংস্কৃতির এই বিশারদ হরিশচন্দ্র পাল ২৩ মার্চ, ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে (৮ই চৈত্র, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ ) শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করে চলে যান অসীম অনন্তলোকে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.