বিশেষ কোন শব্দ যতটা না অশ্লীল, তার থেকেও অনেক বেশি অশ্লীল হতে পারে, তার প্রয়োগের ধরণ। বস্তুত যে কোন শব্দেরই অশ্লীল প্রয়োগ সম্ভব। অশ্লীলতা সেই অর্থে শব্দ বা বাক্যের উপর নির্ভর করে না। করে তার প্রয়োগের উপরেই। অশ্লীলতা একটি মানসিক রোগ। একমাত্র এই রোগে রোগগ্রস্ত মানুষই অশ্লীল অর্থে অশ্লীল ভাবে অশ্লীলতার চর্চায় উপযুক্ত শব্দ বাক্য ভাষা নির্বাচন করে নেয়। আর ভুল বশত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা সেই নির্বাচিত শব্দ বাক্য ভাষাকেই অশ্লীল বলে চিহ্নিত করে দিই। পৃথিবীতে কোন ভাষাই অশ্লীল নয়। কিন্তু যে কোন ভাষাকেই অশ্লীল ভাবে ব্যবহার করতে পারে মানুষ। যদি তার মানসিকতায় অশ্লীলতার রোগ সজীব হয়ে ওঠে। সক্রিয় হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন এটা হতে পারে, কেন এই অশ্লীলতার রোগ ব্যক্তি বিশেষকে সংক্রমিত করে। সেটি হয়ত মনস্তাত্বিক বিশেষজ্ঞদের আলোচনার ও গবেষণার বিষয়। তবুও সাধারণ ভাবে এটা মনে হওয়াই সঙ্গত, প্রকৃত শিক্ষার অভাব যত বেশি প্রকট ও নির্ণায়ক হয়ে ওঠে, ততই এই অশ্লীলতার রোগে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এখানে প্রকৃত শিক্ষা বলতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপের কথা বলছি না। অনেক বড়ো বড়ো ডিগ্রীধারীরাও প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যায় আজীবন। বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর আর প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে কোন বিরোধও যেমন নাই, তেমনই এই দুইটি বিষয় পরস্পর নির্ভরশীলও নয়। আমাদের দেশে বহু মানুষই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত হস্ত দূরে থেকেও প্রকৃত শিক্ষায় দীক্ষিত। আবার উল্টো নিদর্শনও রয়েছে ভুরিভুরি।
এখন যে বিষয়টি অধিকাংশ মানুষকে বিচলিত করতে পারে, সেটি হলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভিতর যদি এই অশ্লীলতার ব্যাধি সংক্রমক হয়ে দেখা দেয় তবে সামগ্রিক ভাবে দেশের জনসমাজের উপরেও এর একটি প্রভাব পড়তে পারে। কিংবা অনেকে এর বিপরীতে এই কথাও মনে করতে পারেন যে, সমাজের কুপ্রভাবগুলিই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও গ্রাস করে ফেলছে। তাই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। যে দিক দিয়েই হোক না কেন, বিষয়টি সমাজের সামগ্রিক বেআব্রু চেহাড়াটিকেই আবার আমাদের চোখের সমানে স্পষ্ট করে তুলে ধরলো।
সমাজের পরতে পরতে অনেকগুলি শ্রেণীভেদ বর্তমান। তার ভিতর খুব নির্ণায়ক একটি শ্রেণীভেদ হলো, শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত শ্রেণী আর শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্ত শ্রেণী। ভারতবর্ষের সনাতন ইতিহাস থেকে শুরু করে এই শ্রেণীভেদটিই সমাজের মূল নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ক্রিয়াশীল রয়েছে। চিরকালই এই শ্রেণীভেদের সুযোগ নিয়ে এসেছে শাসক শ্রেণী। তাই সব কালেই সব ধরণের শাসক শ্রেণীর কাছেই সমাজে বেশি সংক্ষক মানুষকে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত শ্রেণীর গণ্ডীতে আটকিয়ে রাখতে পারাই বেশি কাম্য। কিন্তু কালের নিয়মে সেই সংখ্যাকে কাম্য মাত্রায় ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্ত শ্রেণীর গণ্ডীতে পৌঁছাতেই মানুষের একটি স্বাভাবিক তাগিদ থাকেই। কারণ দুই শ্রেণীর ভিতর বর্তমান অর্থনৈতিক সামর্থ্যের পার্থক্যই মানুষের ভিতর সেই তাগিদ তৈরী করে। ফলে খুব বেশিদিন ব্যক্তিবিশেষের সেই তাগিদকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা শাসক শ্রেণীর পক্ষে মুশকিলের হয়ে দাঁড়ায়। তখনই শাসক শ্রেণী নানান ধরণের ছলচাতুরীর উপায় অবলম্বন করে সেই তাগিদ থেকে মানুষকে দূরবর্তী রাখায় স্বচেষ্ট হয়ে ওঠে। এরই গালভরা নাম রাজনীতি বলা যেতে পারে। আর ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এই কাজে শাসকের প্রধান হাতিয়ার হয়ে দেখা দেয়। সে অন্য প্রসঙ্গ।
ফলে সামগ্রিক এই সমাজবাস্তবতায় শাসক শ্রেণী যখন লক্ষ্য করে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত শ্রেণীর ভিতর বেশি সংক্ষক মানুষকে আর আটকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তখন তারা দিনে দিনে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতেই ঘূণ ধরানোর কাজ শুরু করে দেয়। আর সেই কাজটা শুরু করা হয় শিক্ষার ভিতের একেবারে গোড়া থেকেই। শিক্ষার ভিত থেকে মনুষত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটুকু দিনে দিনে ছেঁটে ফেলা হতে থাকে। সেটি করা হয় শিক্ষার ভিতর থেকে নৈতিক শিক্ষাদীক্ষার আলোকে ক্রমাগত অপসারণ করতে করতেই। শিক্ষাকে পরীক্ষার বৈতরণী পার করিয়ে কাগুজে ডিগ্রী অধিকারের পথ বলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে সমাজের পরতে পরতে নৈতিক অধঃপতনের সংস্কৃতিকে এমন ভাবে বপন করা হতে থাকে, যে নৈতিকতা জীবনে সাফল্য লাভের অন্যতম অন্তরায় বলে সত্য হয়ে ওঠে মানুষের চেতনায়। এই কাজের সাফল্যের হাত ধরেই সামাজিক পরিসরে রুচিহীনতার চর্চাকে নানান পথে নানান ভঙ্গিমায় তুলে ধরা হতে থাকে। সামাজিক পরিসরে বিকৃত রুচির চর্চা অব্যাহত ভাবে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে আসা মানুষের নৈতিক চরিত্রকে একবার ধ্বংস করে দিতে পারলেই, তার কাছ থেকে শাসক শ্রেণীর আর ভয় পাওয়ার কোন ঝুঁকি থাকে না। উল্টে বরং তাকে দিয়েই শোষণ কর্ম অবাধে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়। সেও শাসকের শোষণযন্ত্রের নাটবল্টু হয়ে উঠতে পারে। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে শাসক শ্রেণী ঠিক এইভাবেই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করে আসছে স্বাধীনতার পরদিন থেকে। অত্যন্ত নিপুন ভাবে। এর বিরুদ্ধে বরাবরই সমাজে একটা অসম লড়াই চলতে থাকে তলায় তলায়। সেই লড়াই সমাজিক পরিসরে সাংস্কৃতিক দিগন্ত থেকে শুরু করে বৌদ্ধিক চর্চায় জারি থাকে। কিন্তু শাসক শ্রেণী যে সেই বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন থাকে, তাও নয়। তারা বরং জল মাপতে থাকে। কতটা অসম লড়াই তাদের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু যে মুহূর্তে শাসক শ্রেণী দেখবে যে অসম লড়াই দিনে দিনে শক্তি বৃদ্ধির দিকে এগোতে চাইছে, তখনই তারা আরও বেশি করে সাবধান হয়ে যাবে। সমাজের পরতে পরতে অবক্ষয়ের বীজ বপন করার নানান ধরনের কার্যক্রমগুলিকে তার আরও বেশি করে তখন সক্রিয় করে তুলতে থাকে। এর ফল ফলতে বাধ্য হাতে নাতে। তলায় তলায় চলতে থাকা সেই অসম লড়াই তখন আরও বেশি অসম হয়ে দাঁড়ায়। শাসক শ্রেণীকে স্বস্তি দিয়ে।
ভারতবর্ষের সমাজ ও রাজনীতি এই চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকেই। একুশ শতকে এসে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সামজিক অবক্ষয়কে সর্বব্যাপি সর্বাত্মক করে তোলার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। এখন এই তৃতীয় দশকে সেই কাজের সাফল্যের প্রভাব পড়তে শুরু করে দিয়েছে। এই দশকে শাসকের লক্ষ্য থাকবে সেই প্রভাবকে নিরঙ্কুশ ভাবে সক্রিয় করে রাখা। তাহলেই শাসকের পক্ষে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা মাখনের ভিতর ছুরি চালানোর মতো সহজ হয়ে দাঁড়াবে।
হ্যাঁ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের একটা বড়ো অংশের ভিতর এই অবক্ষয়ের যে প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তার নেপথ্যে এত কিছু ঘটনার সংঘটন বিদ্যমান। ফলে শিক্ষার্থীদের কার কার পিঠে অশ্লীলতার ছাপ পড়েছে, সেটি কোন প্রাসঙ্গিক বিষয়ই নয়। প্রাসঙ্গিক বিষয় অনেক বেশি গভীরে শিকড় বিস্তার করে বসে আছে। অনেক বেশি অঞ্চল অধিকার করে সক্রিয় রয়েছে। সেখানে পৌঁছাতে না পারলে, শুধুই কয়েকটি কথাকে অশ্লীল মনে করে কয়েকটি শিক্ষার্থীকে অশ্লীল বলে দেগে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধন করতে হলে আমাদের অনেক বেশি সততার সাথে প্রজ্ঞার সাথে এগোতে হবে রোগের উৎসমূলের দিকে। উৎসমূলের দিকে না এগোতে পারলে আমরা সমাজ থেকে অশ্লীলতার এই মানসিক ব্যাধিকেও প্রতিরোধ করতে পারবো না কিছুতেই। উল্টে অশ্লীলতার এই মনোবিকার আরও বেশি সংক্রমক হয়ে উঠে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাতে শাসক শ্রেণীর পৌষমাস কিন্তু দেশের ও জাতির সর্বনাশ।
সুচিন্তিত মতামত দিন