সৌমিতা চট্টরাজ / বর্ষাজাতক

"বর্ষাজাতক" / সৌমিতা চট্টরাজ
এই যে, শুনছ! হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকেই চাই। মিনিট দশেক সময় দেবে প্লিজ ! বলছি, তোমারও কি এমন হয়! রোজনামচার কথা না হয় বাদই দিলাম ; ইয়ে মানে বোঝোই তো, ওই কালেভদ্রে! কদাচিৎ! কখনোসখনো! যেমন ধরো , কোনো এক বন্যা মুখর বর্ষা বিকেলে তোমার নাক বরাবর সটান এসে ধাক্কা দিলো এক শিশি শুকনো খরার গন্ধ! ইরানী পারফিউম? টিংচার-আয়োডিন ? দেশী বাংলা? উফফফফ! অসহ্য। আবার সেই পুরনো মাইগ্রেইন। কাঁচ ভাঙার বিকট কোনো শব্দও যায়নি কানে। অথচ দেখছ, ঘরময় কে যেন যত্নসহকারে ছিটিয়ে রেখেছে বিশ্বস্ত আয়নাটার অবিশ্বাস্য কৃতঘ্নতা। হাতের তালুতে চুবচুবে তাজা রক্ত। কব্জি দুটো অক্ষত আছে যদিও। ব্যথা নেই। কাটাছেঁড়া নেই। রহস্য নেই, ক্লু নেই, কিনারাও নেই। বিস্ময় যন্ত্রণা দিচ্ছে কেবল। গন্ধে গন্ধে ঘুরপাক খাচ্ছে কুণ্ডলীকৃত ভেজা কুকুরের লোলুপ জিজ্ঞাসা --- "ওগো গৃহবাসী, রক্তকুমুদের মালিকানা তবে কার?" উত্তর জানো না। প্রশ্নটা থেকে থেকেই টুঁটি চেপে ধরছে তোমার। মেজাজ চটকে গেছে পুরো, ভ্যাপসা-গুমোট-অস্বস্তি। কি করা যায়! কি করা যায়! অমনি কালুয়ার কোমরে সজোরে একখানা লাথি। ছিটকে দরজার বাইরে। " আমায় কৈফিয়ৎ চাওয়ার তুই কে রে নেমকহারাম ? শালা, কুত্তার বাচ্চা। " কাঁইইইই কাঁইইইইই কাঁইইইইইইই----- মাজা ঘষটে ঘষটে বিপজ্জনক ইউটার্ণ কাটিয়ে জানপ্রাণ নিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কালো পুঁটুলির কালুয়া, ট্যাঁরা বাঁকা লেজ, লোমশ আনুগত্য, চতুষ্পদী বিপন্নতা ---- অবলা এবার ছুট লাগাবেই মনুষ্যমেধের উদ্দেশ্যে। চিনে নাও। এইতো সেই গন্ধ, খোলস বন্দী ক্ষত্রিয় ক্ষুধা।

বিশ্বাস করো বা নাই করো , আমার কিন্তু প্রায়শই এমন হয়, এক্কেবারে এমনটাইইই। কালুয়া নিরুদ্দেশ। ঘন্টাখানেক তো হবেই। বিছানা থেকে চৌমাথার মোড় ঠিকঠাক ঠাওর করা যায় না। ঘর ফেলে উঠে আসি রাস্তায়। ডাক পাড়ি, কালুউউউউউউউ, ওরে ও কালুউউউউউউ- সাড়া নেই। ছোপ ছোপ হলুদের কোপে পড়েছে। ক্লান্তি লাগে। ফুটপাতে হেলেদুলে হাঁটতে থাকি। গতি নেই , তাড়া নেই, যাওয়া আসা নেই। শরীরের তুলনাতে ছায়া বড়ো হয়। অন্ধকার সেজে ওঠে। বিধবার সাদা থান মুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে বুভুক্ষু ল্যাম্পপোষ্ট। জিভে তার টসটসে আমিষের স্বাদ । ঝাঁক ঝাঁক উইপোকা। তিরতিরে কচি কচি পাখা। নিমিষে আলাদা হয়ে দুদিকে কাতরাতে থাকে। তবুও আলোর মোহ, ফেরোমন, পিছুটান। জানো, ভীষণ ইচ্ছে করে তক্ষুনি বাড়ি গিয়ে মা'কে বুকে জড়িয়ে খুব করে চুমু খাই। বাবার পা ধরে একবার অন্তত বলি, " বেঁচে ওঠো, কথা বলো একবার! আমি দেখে এলাম মৃত্যু কতটা ভয়ঙ্কর, তারচেয়েও ভয়াবহ এই বাঁচা বাঁচা খেলা"।

কালু আসে না। একা ফিরে আসি। ঘরে ঢুকি। জল খাই। সেইইইই গন্ধ। সেইইইই কাঁচ। সেইইইই রক্তকুমুদ। নাক মুখ জ্বালা করে ওঠে। শুয়ে পড়ি। আকাশে ধারালো চাঁদ, নীলচে পৃথিবী, ঘোলাটে সূর্য কেউই সমান্তরাল নয়, প্রত্যেকে সমকোণে। গ্রীক পুরাণের প্রতিচ্ছবি। এথিনার দম্ভ, পোসাইডনের পৌরুষ, মেডুসার বলিদান। মা সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে এগিয়ে আসে। আহহহহহহ! এই তো, আমার ছোট্ট ঘরটা কেমন যেন মহমহ করে মা- মা নির্যাসে। আঁচলের আবডালে জুলু জুলু চোখে হামা দেয় কালু। ফিরে এসেছিস! কুত্তার বাচ্চা! নেমকহারাম! শীত শীত করে, চাদর টা টেনে নিয়ে ওপাশে ফিরি , চোখ বুজে আসে। জানলাতে ঝরে চলে নাছোড় শ্রাবণ। কাঁপা কাঁপা ছাতিমের পাতা। ঠোঁট নড়ে ওঠে। "মা, বলো না গো, বাবা এসেছিলো?" জলপটি তুলে নেয় মা। হেসে বলে, " এসছিলো তো, ছুঁয়ে দিয়ে গেলো তোর জ্বরের কপাল।" এই যে, শুনছ? সত্যি সত্যি বলবে কিন্তু এবার! তোমারও কি এমন হয়? কালেভদ্রে? কদাচিৎ? কখনো সখনো? নাকি সমস্ত কিছু আগাগোড়া মিছে? হয়তো বা পুরোটাই ভুল, একটানা রোগের খেয়াল। 


Previous Post Next Post