রসুলপুর মাঠে পল্টু স্মৃতি সঙ্ঘের পরিচালনায় পলাশপুর বিবেক সঙ্ঘের সাথে শক্তিগড় বালক সঙ্ঘের কাবাডির সেমি ফাইনাল খেলা। পাশাপাশি গ্রাম থেকে আসা দর্শকে মাঠ ভরে গেছে। খেলা আরম্ভ হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে উত্তেজনা আর হাততালিতে খেলা বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ আকাশটা কালো হয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ ডাকা, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকান আর তার সাথে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। খেলার মাঠের চার দিকে ইতস্তত কয়েকটা আম আর তেঁতুল গাছ, তারপর ধু ধু ফাঁকা মাঠ। খেলার উদ্যোক্তারা দর্শকদের উদ্দেশ্যে মাইকে বলে চলেছেন, আমরা খেলা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখলাম, বৃষ্টি থামলেই আবার খেলা শুরু হবে, আপনারা চলে যাবেন না, শান্ত হয়ে বসুন। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে কিছু লোক গাছের নীচে আশ্রয় নিল, কিছু শামিয়ানার নীচে, শামিয়ানার নীচে ভীড় বাড়তেই শামিয়ানাও ভেঙ্গে পড়ল। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানি সহ কান ফাঠানো বজ্রনাদ। মাঠের কোনের উঁচু তেঁতুল গাছটায় বাজ পড়েছে, গাছটা পুড়ে কাল হয়ে গেছে। তেঁতুল গাছটার নীচে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে তিন জন সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে, দেহগুলো পুড়ে কালো হয়ে গেছে, বজ্রাহতদের মধ্যে অনেকে ভয়ানক ভাবে অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে।
এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এই রকম বজ্রপাতে পৃথিবীর সকল দেশে প্রতি বছর বহু মানুষ ও জীবজন্তু প্রাণ হারায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় সারা বিশ্বে বজ্রাঘাতে বছরে প্রায় ২৪,০০০ ব্যক্তি মারা যায়, আর ২,৪০,০০০ জন বজ্রাঘাতে অসুস্থ বা পঙ্গু হয়ে পড়ে। ভারতের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতে বজ্রাঘাতে সব থেকে বেশি লোক মারা যায়। সারা বিশ্বে যেখানে বছরে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ দিন বাজ পড়ে, আমাদের কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বছরে গড়ে ৭০ দিন (Average Thunder Day or ATD) বাজ পড়ে। ভারতের মধ্যে বেশি বাজপ্রবণ অঞ্চল হল উত্তরপূর্ব ভারত, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা; এখানকার বার্ষিক গড় বাজদিবস ১২১ দিন। ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থাৎ ভারত ও প্রতিবেশী দেশ সমূহে প্রতি বছর ১,০০০ এর মত মানুষ বজ্রাঘাতে মারা যায়। বিদ্যুৎ চমকান, বাজ বা বজ্রপাত অর্থাৎ বাজপরা আমরা সকলেরই দেখেছি ও শুনেছি। অবশ্য যেমন পটাশিয়াম সায়ানাইড এর স্বাদ কি রকম জানার উপায় থাকে না, তেমনি যে ব্যক্তির উপর বজ্রপাত হয় তার অভিজ্ঞতা জানার কোন উপায় থাকে না।
এখন জানা যাক আমরা যে বিদ্যুৎ চমক বা অশনি, বজ্রনাদ বজ্রপাত দেখি বা শুনি আসলে সেটা কি। আকাশে গরম বাতাস যখন ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে আসার ফলে বা ঝড় তুফানের ফলে মেঘের মধ্যে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তাতে মেঘকণাদের মধ্যে ঘর্ষণের ফলে মেঘের মধ্যে স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। মেঘ বা মেঘ সমূহের মধ্যে বা মেঘ ও ভূপৃষ্ঠস্থ কোন বস্তুর মধ্যে বিপরীত বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত (opposite electrically charged) বিশাল পরিমান এই স্থির তড়িৎ এর মুক্তি বা প্রশমনের (discharge) ফলে বিদ্যুৎ চমকান বা বিদ্যুৎ চমক (lightning), বজ্রনাদ (thunder), ও বজ্রপাত (lightning strike) এর সৃষ্টি হয়। আমাদের পৃথিবীর উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চল (tropical zone), বিশেষ করে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল বজ্রগর্ভ ঝড়ের (thunder storm) একটা সক্রিয় বড় উৎপত্তিস্থল বা breeding ground. বজ্রগর্ভ ঝড়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম সক্রিয় উৎপত্তিস্থল হল হিমালায়ের পার্বত্য অঞ্চল। ভারতমহাসাগর থেকে জলীয়বাষ্প সহ উষ্ণ বাতাস এসে হিমালায়ের শুষ্ক শীতল বাতাসের সাথে সংঘাতের ফলে ওই অঞ্চলের বায়ুমন্ডলে অস্থিরতার সৃষ্টি হওয়ায় ওই অঞ্চলে বজ্রগর্ভ ঝড়ের সৃষ্টি হয়।
অশনি বা বাজ বা বিদ্যুৎ চমক প্রধাণত তিন প্রকার। একই মেঘের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সৃষ্ট বিদ্যুৎ চমক বা অশনিকে ইন্ট্রা ক্লাউড লাইটনিং বা IC lightning বলে, এক মেঘ থেকে আর এক বা একাধিক মেঘের মধ্যে সৃষ্ট অশনিকে ক্লাউড টু ক্লাউড লাইটনিং বা CC lightning বলে, আর মেঘ ও ভূপৃষ্ঠের কোন বস্তুর মধ্যে সৃষ্ট অশনিকে ক্লাউড টু গ্রাউন্ড লাইটনিং বা CG lightning বলা হয়। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৫০ থেকে ১০০ বার বিদ্যুৎ চমকায়; আর এই তিন রকম বিদ্যুৎ চমকানো বা অশনির মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ প্রথম দুই রকম অর্থাৎ IC ও CC অশনি, আর শতকরা ১০ অর্থাৎ ১০% হচ্ছে CG lightning, আর একটা হিসাবে জানা গেছে আমাদের এই পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ মিলিওন অর্থাৎ ৮০ লক্ষ বজ্রপাত হয়। যদিও প্রতিটি বিদ্যুৎ চমকের সাথে বজ্রনাদের সৃষ্টি হয়, অনেক সময় আমরা শুধু বিদ্যুতের ঝলকটাই দেখতে পাই আওয়াজ পাই না তার কারণ আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে বিদ্যুৎ ঝলক সৃষ্টি হওয়ার জন্য সৃষ্ট শব্দ আমাদের কাছে পৌঁছানোর আগেই স্তিমিত বা শেষ হয়ে যায়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকের সময় মেঘের দীর্ঘ রেখা বরাবর বিদ্যুৎ ঝলকের সঙ্গে সৃষ্ট মেঘনাদ বিভিন্ন দূরত্বস্থিত বিন্দু থেকে নির্গত হয়ে সামান্য সময়ের ব্যবধানে আমাদের কাছে আসে বলে মেঘডাক এর শব্দ গড়িয়ে (rolling sound) এসে স্তিমিত হয় মনে হয়। আর একটা জিনিস হল একই সাথে সৃষ্ট হলেও আমরা আকাশে বিদ্যুৎ ঝলক দেখার পর তার আওয়াজ শুনতে পাই, তার কারণ হল আলোর গতি শব্দের গতির চেয়ে অনেক গুণ বেশি তাই শব্দ আমাদের কানে পোঁছানোর আগেই বিদ্যুৎ চমকানোর আলো আমাদের চোখে পৌঁছে যায়। বজ্রপাতের সময় প্রায় ৩০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমানে বজ্রাঘাতের বস্তু পুড়ে যায়, ওই উচ্চ তাপে বালুকণা (সিলিকা) গলে গিয়ে কাচে পরিণত হয়। দেখা গেছে বাজের সময় অতি উচ্চ ভোল্টেজে প্রায় ১০,০০০ এ্যাম্পেয়ার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।
এতক্ষণ তো অশনি, বিদ্যুৎ চমক, বাজ বা বজ্রপাত সম্বন্ধে কিছু একটা আলোচনা করা গেল। কিন্তু বজ্রাঘাত থেকে বাঁচবার উপায় কি। বজ্রাঘাত থেকে বাঁচার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে আকাশে কাল মেঘের উদয় আর ঝড় বৃষ্টি বিদ্যুৎ চমক দেখলে বাইরে না বেরিয়ে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকা। কিন্তু যদি বাইরে থাকি তখন কি করব? বাইরে থাকা অবস্থায় হঠাৎ যদি আকাশে কাল মেঘ দেখা দিয়ে বিদ্যুৎ চমকায় আমাদের তৎক্ষণাৎ কোন নিরাপদ আশ্রয় নিতে হবে, এ ক্ষেত্রে কোন পাকা বাড়ি বা কোন মোটর গাড়ীর ভিতর আশ্রয় নেওয়া সব থেকে ভাল। মটর গাড়ী বজ্রাঘাত থেকে বাঁচার একটা নিরাপদ আশ্রয় কারণ বাজ গাড়ীর অন্দরস্থিত কাউকে স্পর্শ না করে গাড়ীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যে চলে যায়। এক্ষেত্রে গাড়ী ফ্যারাডে খাঁচা (Faraday Cage) রূপে কাজ করে। কোন ফাঁকা জায়গায় বা ছাতে থাকলে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে; কোন গাছ বিশেষ করে কোন উঁচু গাছের নীচে কোন মতেই আশ্রয় নেওয়া উচিত নয় কারণ গাছ তার আশ্রিতকে রক্ষা করতে পারবেই না বরং গাছ একটা ভাল তড়িৎ বাহক (good conductor of electricity) হওয়ার ফলে বাজকে আকর্ষণ করে আশ্রিতকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। যদি আদৌ কোন নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়া যায় তো কাছাকাছি কোন নীচু ঢালু জায়গায় দুই পা জরো করে মাথা নীচু করে দু হাতে দুকান চাপা দিয়ে শরীরটাকে গুটিয়ে মাটি স্পর্শ না করে বসে থাকতে হবে, তবে কখনই জমিতে শুয়ে পরা উচিৎ নয়। আর কখনই জল বা জলের খুব কাছাকাছি যাওয়া উচিৎ নয় কারণ জল একটা ভাল তড়িৎ বাহক হওয়ার ফলে বাজকে আকর্ষণ করে। এই সময় নদীতে, সুইমিং পুলে, বা অন্য কোন জলাসয়ে বা নৌকায় থাকলে তাড়াতাড়ি ডাঙ্গায় চলে এসে কোন নিরাপদ আশ্রয় নিতে হবে। যেখানেই থাকি যদি দেখি মাথার চুল বা শরীরের লোম হঠাৎ সোজা অর্থাৎ খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে বুঝতে হবে এক্ষুনি ওখানে বাজ পড়তে চলেছে, আমাদের তৎক্ষণাৎ পা জড় করে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা নিচু করে রেখে দু হাতে কান চাপা দিয়ে বসে পড়তে হবে। যেহেতু ধাতব বস্তু একটা খুব ভাল তড়িৎবাহি বিদ্যুৎ চমকানোর সময় জলের ধাতব পাইপ, ধাতব খুঁটি ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। মেঘডাকা বা বিদ্যুৎ চমকানোর সময় ল্যান্ড লাইনের ফোন ব্যবহার কখনই উচিৎ নয়, ফোনের তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে শরীরে প্রবেশ করার সম্ভবনা থাকে। বড় বড় বিল্ডিং এ বাজ প্রতিরোধক রড (lightning arrester) লাগান থাকে যাতে বাজের বিশাল পরিমান তড়িৎ বাড়ির কোন ক্ষতি না করে ওই রডের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ভূমিতে (ground/earth) চলে যায়।
বজ্রপাত বা বাজ পরা থেকে কি ভাবে আমরা বাঁচতে পারি সেই কথা আলোচনা করা গেল। কিন্তু কেউ বজ্রাহত হলে আমরা কি করব এবার তা দেখা যাক। দুর্ভাগ্য বশত কেউ বজ্রাহত হলে তার শরীর ভয়ানক ভাবে পুড়ে যায়, হৃদ-স্পন্দন স্তব্ধ (cardiac arrest) হয়ে যায়, শরীরের ভিতরের অঙ্গ সমূহ (organs) অচল হয়ে পরে। বাজপরার বিপদ কেটে গেলে বজ্রাহত ব্যক্তিকে প্রথমেই একটা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে হবে ও এ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে হবে। বজ্রাহত ব্যক্তিকে এমন ভাবে শোয়াতে হবে যাতে তার মাথা শরীর ও পা থেকে কিঞ্চিৎ নীচে থাকে। ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই বজ্রাহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার বিশেষ প্রয়োজন, যেমন তাদের নিশ্বাস ও নাড়ী পরীক্ষা করা (checking of breathing and pulse), মুখে মুখ দিয়ে শ্বাস পুনরুজ্জীবন (mouth to mouth resuscitation) ও কার্ডিয়াক পুনরুজ্জীবন বা রিসাসিটেসন করা। আর একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে খুব প্রয়োজন না হলে বজ্রাহত ব্যক্তির শরীর থেকে পুড়ে যাওয়া বস্ত্র সরান বা খুলে দেওয়া কখনই উচিত নয়।
Tags:
অন লাইন