দিনলিপির ভাষা খুঁজে কেটে যাচ্ছে দিন। কী লিখি, কী যে লিখি! অথচ এতকিছু যে লিখি; কবিতার ঘ্রাণ অথবা মুক্তগদ্যের শরীর; দিনলিপি লেখার মনপসন্দ ভাষাটা খুঁজে পাই না! লকডাউনের ডায়েরি আমি লিখতে চাইনি কোনোদিন। তাহলে তো শুরুতেই লিখতে পারতাম! ফেসবুকের সীমাহীন পাতা খোলা পড়ে আছে। কিন্তু আমি একটা অন্য দিনলিপি লিখতে চাই। এবং কাগজে-কলমে। লিখতে গিয়ে বুঝি, অ্যান্ড্রয়েডের কিপ্যাডে যেভাবে মানুষের আশা-নিরাশার অক্ষর পাঠাই সুদূর দক্ষিণে, কলম থেকে কাগজের উপরে সেই ভাষা উঠে আসছে অবিকল! দিনলিপি লেখার সময়ে আমি ওই ভাষা থেকে পরিত্রাণ চাই।
আমাদের মূঢ়তার সুযোগে কে যেন কবে বাংলা বছরের গায়ে সেঁটে দিয়েছিল তারিখ-ই-ইলাহির স্টিকার! সেও এক আগ্রাসন, আপাতনিরীহ। সেকথা বলার থেকে অনেক জরুরি এখন অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই। তবে এমন ছোটোখাটো চারাগাছ অজান্তে এক-একটি বিষবৃক্ষ হয়, সেকথা জমায়েত বড়ো হলে বোঝা যায়। জমায়েতের অন্ধতা আমাদেরও অন্ধ করে দিতে চায়। যে-কোনো অন্ধকারের স্বভাবই তাই। কৃষ্ণগহ্বরে টেনে নিয়ে মুছে দিতে চায় যাবতীয় আলো। অথচ আমাদের গেরুয়া গোধূলি ছিল। শেষবিকেলের কমলারঙা আকাশ। তার পাশে আদিগন্ত বনভূমির সবুজ কী অপরূপ সঙ্গত, অন্ধ জমায়েত সেই খবর রাখেনি কোনোদিন। আমাকে দিয়ে ওই অন্ধকার হয়তো একদিন লিখিয়ে নেবে লকডাউনের ডায়েরি। স্পিটিং কোবরার মতো এভাবেই সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে বিষ।
এখন বহুতলের ছাদে হাঁটলে রাতের আকাশ খুব কাছের মনে হয়। সে-আকাশের নিজস্ব একটা আলো থাকে। চাঁদ থাকে না যখন, তখনও থাকে। একটু দূরে থাকে রামেন্দ্রসুন্দর সেতুর আলোটাও। আসলে ঠিক আলো নয়, শতাব্দীপ্রাচীন গাছপালার আড়ালে তার আভা। অথবা হঠাৎ হাওয়ার দোলায় একটা লোডেড ট্রাকের চকিত হেডলাইট। আমার ওই ব্রিজ পেরিয়ে আবার কাঙ্ক্ষিত উত্তরে যেতে ইচ্ছে করে। বনদুর্গার চাতাল, দেবীবরণের দুপুরের মধ্যে ফিরতে ইচ্ছে করে। তারপরে মনে পড়ে, বিষের বাঁশিতে ভুলে অন্যদিকে বাঁক নেওয়া এক নদী। অথচ আজও তার দোষারোপে বিনিদ্র রাত পুড়ে আছে! এখন আমাকে উত্তরণের গদ্য লিখতে বলছে কেউ। কলমের শরীর থেকে তবু আমি কালি মুছে রাখছি সময়ের কোলে।
এমন বেভুল সময়ের ছবিতে আমি আলিনগরের অন্ধগলি দেখি। সে আমার জন্মের মাটি। অথচ তাকে পুরো চেনা হলো কই! যেমন, এই ধাত্রীশহর। তাকেও তো জানা হলো না ঠিকঠাক! থিতু হওয়া হলো না কোথাও। বায়োলাইনে যথার্থ লেখা রইলো, 'অ্যান আউটসাইডার ইন এভরি সেন্স'। নিজেকে বহিরাগত বলে চিহ্নিত হতে দেখেছিলাম প্রথম যেদিন, কেউ বলেছিল "মুছে দাও! আমি কি নেই নাকি?" সেকথায় প্রাণ ছিল এত, মুছতে মুহূর্ত লাগেনি! ওই প্রাণই আমাকে মেরেছে সর্বত্র। অথচ এমন তো অদেখা ছিল না অতীতে। সকল মুখোশই খুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আন্তরিক। শুধু উষ্ণতার রকমফের থাকে। তবে কি তোমার উষ্ণতায় ঘ্রাণের প্রাবল্যই মুখোশের মুখ ভুলিয়ে রেখেছিল, মৌতাত? ছিঁড়ে যাওয়া সুতোগুলো জুড়ে-জুড়ে বোঝার চেষ্টায় রত আছি বহুদিন।
দাক্ষিণাত্যে বেঁধে দেওয়া শব্দসীমা গুনতে আর ঝকঝকে ছবি বাছতে বসে, আমি কবিতার ভাষা ভুলে যাচ্ছি ইদানীং। অথচ চেপে দেওয়া কত জরুরি সংবাদ মূলত কাব্যের মতো অমোঘ ছিল, সেকথা তারাও খুব ভালো করে জানে। সেখানে তাই স্বীকৃতি আছে। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় এই মধ্যভূমিতে, বৃদ্ধ সরীসৃপের দংশনে আহত হওয়ার যন্ত্রণা অসীম। বিশেষত সে যদি বাস্তুসাপ হয়। এমন মুহূর্তে একটা প্রেমের চাদর আশ্চর্য উপশম দিতে পারে। বস্তুত এখানে প্রেমের আনাগোনার কমতি কোনোদিন নেই। আমি না-চাইতেই তারা বরাবর আসে। এমনকি, এই দুঃসময়েও! তোমার ফেলে দেওয়া বই, আঠা দিয়ে ছেঁড়া-ফাটা জুড়ে শেল্ফে রাখতে চাইছে কেউ। অবিশ্বাস্য হলেও অসম্ভব তো নয়!
প্রেম আমাকে এখনও খুব ছোঁয়। কিন্তু অধিকার করতে পারে না আর। আমি তার পেয়ালায় ঠিক চুমুক দেবো একদিন, এই কথা দিয়েও সে-নেশার জন্য উতলা হই না তাই। আমার শুধু মনে পড়ে, কী অনায়াস ঘোষণায় বহুবল্লভা হয়েছে মৌতাত! আমি তাকে ঘৃণা করতে চাইছি তুমুল। আর ঘৃণা করতে গিয়ে দেখছি, করুণা জেগে উঠছে শুধু! অথচ ঘৃণাকে আমি ভালোবাসার মতোই লালন করেছি প্রাবল্যে। প্রতিটি মুখোশধারীকে উপহার দিতে পেরেছি তার সর্বোচ্চ মাত্রা। তোমাকে চূড়ান্ত প্রেমের মতো, ঘৃণারও সবটুকু উজাড় করে দেওয়ার কথা ছিল। ব্যর্থ হয়ে মনে পড়লো, আকুতি এমন তীব্র ছিল না অন্য কোথাও! এখানে রাখা আলোর কাছে যাবতীয় অন্ধকার চাপা পড়ে যাচ্ছে তাই।
অথচ ঘৃণা করতে পারা জরুরি ছিল ভীষণ! সেকথা এই অন্তরীণে ফুটে উঠলো আবার। প্রথমে অক্ষরে, তারপর ছবিতে। ঠিক যেমন লকডাউনের ডায়েরি লেখা জরুরি এখন। কিন্তু লেখা হয় না। মানুষের সব দুর্যোগের কথা সংবাদ হয়ে যাচ্ছে। তবুও কত উপাদান চারদিকে, এই বন্দিদশায়। শহরের বারান্দায় কতদিন পরে ঘুঘু-ডাকা উদাসী দুপুর। অথবা তীব্র নীলের গায়ে লালচে-কমলা রঙের বিকেল। ঠিক এমন আকাশ আমি কতদিন দেখিনি! পুরোনো ঘরবাড়ির কার্নিশ হয়ে ইদানীং সন্ধ্যায় বেরিয়ে আসছে গন্ধগোকুল। মানুষ প্রকৃতির কাছে ফিরছে, নাকি প্রকৃতি মানুষের? অবরোধ উঠে গেলে আমিও হয়তো অভিসারী হবো। দেখে নিতে চাইবো, কোন আহ্বানে কতটা টান। শঙ্খমালা-ঘরে তালা পড়ে গেলে, প্রেমিকের মৃত্যু ঘটে পৃথিবীর অজান্তেই। নিজের শরীরে তার লাশ বয়ে নিয়ে ঘুরেছি অজস্র দুর্গাদেউল। সরহদ-পার থেকে গান হয়ে ভেসে আসছে আমারই কাহিনি। "মুঝে রানঝা বনা দো হীরজি, মুঝে রানঝা বনা দো"। সে তো আমারই আকুতি, তোমাকে আরও নিবিড়ে ছোঁয়ার! তোমাকে কোনোদিন ঘৃণা করতে পারলে মৃন্ময়ী, ভিতরের এমন আকুতি বাঁচিয়ে রাখবো না আর!
আসলে অন্ধ দিনলিপিই লিখে যাওয়া ছিল ভালো। তারপরে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেওয়া যেত হাওয়ায়। সময়ের মতোই যে-হাওয়া এখন অচেনা।এপ্রিল শেষ করেও তার শরীর আশ্চর্য নাজুক। তার পরিচিত হলকা নেই। জলছোঁয়া নরম সান্নিধ্য আছে।সান্ধ্য-আকাশ থেকে আজ সাদা বিদ্যুতের মতো নেমে এসে নিশ্চিন্তে ছাদে বসলো একটা লক্ষ্মীপেঁচা। সেরিকালচার ফার্মের মাঠ থেকে ভেসে এল খয়েরি শিয়ালের দলবদ্ধ ডাক। প্রকৃতি কি পাল্টে যাচ্ছে সত্যিই? সদ্য-অচেনা প্রেয়সীর মতো? এই দুঃস্বপ্নময়তার শেষ হলে, আমি ভিতরের বাক্সটা খুলবো। ওখানে প্রিয় নদীটির পাঠানো বার্তা আছে।আমি তা খুলেও দেখিনি! যদিও ওখানে কী বলা আছে, আমি জানি। ওইসব 'আমাকে দেখুন' পর্ব শেষ হলে, একবার মিলিয়ে দেখে নেবো ঠিক জানি কিনা!
সুচিন্তিত মতামত দিন