মিত্রা বেশ কিছু দিন থেকে খেয়াল করছে শাঁওলি মন মরা হয়ে আছে। বাড়ির কারোর সাথে কোন কথা বলছে না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই রেগে যাচ্ছে। প্রতীক আসামে কোম্পানির কাজে গেছে। শাঁওলির কি হয়েছে – এটা জানতে মিত্রাই পারে। অথচ অফিসের চাপে সময় হচ্ছে না। রবিবার ননদকে ধরলো মিত্রা।
“বোনু, এত চুপচাপ?”
শাঁওলি নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলো। ফোন নিয়ে খুট খুট করছে।
“তুমিও এলে অবশেষে, প্রশ্ন বিচিত্রা নিয়ে”।
মিত্রা দরজা ভেজালো, “কী হয়েছে?”
“কিছু না”। মিত্রা পাশে শুয়ে পড়লো”। “প্রেম ট্রেম করছিস?”
“কাজ নেই তোমার? রান্না হয়ে গেছে?”
“করেই এলাম, তুই-ওতো একটু শিখতে পারিস”।
শাঁওলি বৌদিমণির দিকে ঘুরলো, “ওহ, আমাকে তোমার এখন অকর্মণ্য, বোঝা মনে হচ্ছে?”
মিত্রা অবাক হলো, “ সেটা কখন বললাম? বড় হচ্ছিস – কদিন পর বিয়ে হবে…”।
“হবে না ওসব বিয়ে টিয়ে”।
“বেশ। কিন্তু পি এইচ ডি করতেও তো বাইরে যেতে হতে পারে?”
“সে দেখা যাবে”।
“যাক। ভাবলাম বলবি পি এইচ ডি – ও করবো না”।
“নাহ, করতে হবে, এই চাকরিটা ভালো লাগছে না। ছেড়ে দেবো”।
মিত্রা ননদের গায়ে হাত রাখলো।
“স্কুলে ঝামেলা হয়েছে কোন?” “নাহ”। “তবে?”
“বললে রাগ করবে”।
“আমি? কেন রে?”
“মানা করেছিলে শুনিনি”।
মিত্রা ভাবলো, “অনিরুদ্ধদের বাড়ি যাওয়া নিয়ে কিছু হয়েছে?’
“জানোনা বৌদিমণি, কী ভয়ংকর বাজে অনিদার বৌ। সাইকিয়াস্ট্রিক পেশেন্ট, আর কী অহংকার পয়সার, রূপের, ক্লাসের ……”।
“কিছু বলেছে তোকে?”
“যা নয় তাই। ঐটুকু বাচ্চা ছেলে একটা অঙ্ক টুকতে ভুল করেছে – তার দোষ টিউটরের! ক্লাসে র্যা ঙ্ক নাকি দুই নাম্বারের জন্য কমে যাবে। অদ্ভূত”।
“যাস না আর”।
“সে উপায়ও নেই। ফাদার অগাস্টিনের অনুরোধে যেতে হচ্ছে”।
“অনিরুদ্ধকে জানিয়েছিস?”
“হ্যাঁ, অনিদাকে জানাবার পর, আর হয়নি এমন। আর মাসখানেকেরও কম যেতে হবে। তাহলেই শেষ”।
“মিটে গেলো, তাহলে মন খারাপ?”
“অপমানিত হবার জ্বালা বলতে পারো”।
“ছাড়, নিজেই তো বললি সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট”।
“ক্লাস নিয়ে, ফ্যামিলি নিয়ে কথা মানা যায়, বলো?”
“বুঝেছি, তাই বলি ওসব ছাড়, পড়ায় মন দে”।
মিত্রা উঠে পড়লেন।
“নেটটা কোয়ালিফাই কর এবারই। চাকরিটা ছাড়। দাদাভাই, আমার দুজনেরই অমত”।
“বৌদিমণি – রাগ করেছো?”
“না তো, তোর মুড খারাপ। এমন সবারই হয়”।
“না, চাকরি পেয়ে মা’কে কানের দুল দিলাম। তোমাকে কিছু দিইনি এখনো, তাই”।
“ধুর বোকা মেয়ে, আগে প্রফেসর হ, তারপর দেখা যাবে”।
মিত্রা মিষ্টি করে হাসলো।
“তাও, কিছু নাও”।
“নেবো, নেটের রেজাল্ট। ওটার ভাগ কিন্তু কাউকে দেবোনা”।
শাঁওলি হেসে ফেলে। বৌদিমণির মত করে ওকে কেউ বোঝে না।
অনিদা আজকাল এড়িয়ে যায়। বেশ বোঝে শাঁওলি। ঐ অসভ্য মহিলার চাপে পড়ে হয়তো। অনিদা কে নিয়ে যত ভাববে না ভাবে – ততই মনে পড়ে যায়। ক’দিন পর থেকে ও বাড়ি যাওয়া বন্ধ। আর দেখাটুকুও হবে না। শাঁওলির কি কষ্ট হবে? খুব,খুব কষ্ট হবে। অনিদা কি বোঝে না, শাঁওলি ওকে কতো ভালোবাসে? নাকি এখনো সেই ছোট্টটি ভাবে। কী আছে ঐ মহিলার, রূপ! রূপে কী সব হয়? মানসিক স্থিরতাই তো নেই। কী সুখ দেবে সে অনিদাকে? অনিকেত এখন খুব মামণি মামণি করে। ঐ রগচটা বাজে মহিলা রেগে গেলে অনিকেতের সাথে কী করবে ভেবেও মাঝে মাঝে ভয় পায় শাঁওলি। পরে ভাবে – করলে করবে। তার ছেলে যখন।অনিকেতও এখন মিসকে কিছু বলে না, বাড়ির ব্যাপারে। মা-বাবা কেমন, কী করছে না করছে, কেমন ব্যভার – সেসব নিয়ে মুখ খোলে না। হয়তো অনিকেতকেও মানা করে দিয়েছে অনিদার বৌ। অনিকেত খুব ইনটেলিজেন্ট। শাঁওলি ওকে ভালো করে মানুষ করতে পারতো। ঐ মহিলা পারবে না। যদি ওর জায়গাটা শাঁওলি পেতো! ভেবেই থমকে যায় শাঁওলি ওর জায়গায় মানে অনিদার বৌ হতে হতো শাঁওলিকে। সব পয়সা, সব গয়না, সব ক্লাস মুঠোর মধ্যে থাকতো তাহলে। ঐ মহিলাকেও তখন আঙ্গুল নাচিয়ে চোখ রাঙ্গাতে পারতো শাঁওলি। অনিদাও কিছু বলতো না। যদি এমনটা হতো কী ভালোই না হতো। অসুস্থ মহিলা! পাগল, মরেও তো যেতে পারে, এমন তো কতই হয়। তাহলে আর শাঁওলির পথের কাঁটা সরে যায়। ভেবেই নিজের ভাবনাতেই চমকালো শাঁওলি। এসব কী ভাবছে ও! নিজেকেও ধমকালো। কারোর মৃত্যু কামনা কী উচিৎ? না, না, একদম নয়। কিন্তু এমনটা ও ভাবলো কেন? নিজের মনের তল খুঁজে পায়না শাঁওলি। বই বন্ধ করে বসে থাকে। অদ্ভুত লাগে ওর। ভীষণ অদ্ভুত। গাছমছম করে।
পর্বঃ- ৩৬
অচ্যুত সন্ধ্যা নাগাদও লনে বসে ছিলেন। অক্টোবরের শেষের দিক, সন্ধ্যার সময়, ঠান্ডা ভাব টের পাওয়া যায়। সুহাসিনী একটা পাতলা শাল নিয়ে এলেন।
“এটা গায়ে দাও”। অচ্যুত তাকালেন, “রুদ্র কখন আসবে?”
“আসবে বলেছে এর মধ্যেই – ছটা বেজেছে?”
অচ্যুত ঘড়ি দেখলেন, “বাজতে যায়। দু মিনিট বাকি”।
অচ্যুত গায়ে শাল জড়ালেন।"
রিপোর্ট করবে না বলছিলে – দেখলে তো?” “হুম”।
“কী হুম? সব বেড়ে গেছে। ইসিজি খারাপ। টি এম টি -ও”।
“স্মোকিং করছি না তো আর”।
“সে তো সবে দু’দিন হলো। অফিস যাও একবার – আবার স্ট্রেস শুরু করে দেবে”।
অচ্যুত হাসলেন, "এই বকুনি গুলো দিলে তবেই না বৌ, বৌ লাগে?”
“যত্তসব! চা খাবে?”
“এই তো খেলাম, একটু বসো, জিরোও, সারাদিন কাজ আর কাজ”।
“ভারী চিন্তা আমার দেখছি। ছোটখোকা কোথায় গেলো?”
“ভাইপো ভাইঝিদের সাথে খেলেধুলে দোকান ছুটলো দেখলাম”।
“দোকান যাচ্ছে? বাহ!”
“তুমি যে দোকানগুলোর কথা ভাবছো সেগুলোর একটাতেও নয়। অনির দোকানে বসছে অনুপম,শিয়ালদারটায়”।
“তাই নাকি!”
“হ্যাঁ, ওর দাদাভাই ওকে বলেছে বসতে। খুব খুশি”।
“ছোটখোকা চায় আমরা সবাই এক হই – আবারো”।
“আমিও চাই, অতীনকে বোঝাও, তুমি, তোমার কথা শুনবে”।
বলতে বলতেই সামনের গেটে গাড়ির আলো দেখলেন অচ্যুত। গেটম্যান দরজা টেনে খুলে দিলো, “রুদ্র”।
“ছটা বাজে, তবে”।
সুহাসিনী ঘড়ি না দেখেই বললেন। অচ্যুত হাসলেন, “অপেক্ষা করায়নি কোনদিন, দেখা করতে গিয়ে না?”
সুহাসিনী বললেন, “না, তবে অন্য একজন অপেক্ষা করিয়েছে রাতের পর রাত। দুটো,তিনটে – কোনদিন না ফিরেও – তার বৌ এদিকে সারারাত জাগা। কোলে তিনটে বাচ্চা, খায়নি সারারাত ঘরবার করেছে, অথচ যারজন্য, সে জানতেই চায়নি”।
অচ্যুত অবাক হলেন, “খেতে না?”
“না, না, ভর পেট খেতাম। মিথ্যা বলছি এখন”।
অচ্যুত মাথা নীচু করলেন। রুদ্রদেব এসে বসলেন, “অচ্যুত,শরীর কেমন এখন?”
“অনেকটা বেটার। ওষুধ খাচ্ছি তো”।
“সুহাসিনী, সবটা নাটক ছিলো না, দেখলে তো?” রুদ্রদেব হেসে বললেন।
“চা খাবে?” সুহাসিনী বললেন।
“না, বসো দু’দন্ড। তিনজনে মুখোমুখি কতদিন পর বসছি বলো তো?”
অচ্যুত তাকালেন, “বিয়ের পর প্রথম। তাই তো?”
“হ্যাঁ, তারপর তো আমি বিলেত গেলাম”।
“পরে ফিরলেও কী আর সহজ হয়েছিলো সম্পর্কটা, রুদ্র?” অচ্যুত বললেন।
“অবশ্য হওয়াটা স্বাভাবিকও নয়। আমি জেদের বশে, জোর করে যেটা করেছি সেটা দুটো জীবন নষ্ট করে দেবার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য নিজেও কী সুখী হতে পেরেছি?”
“ওসব ছাড়, স্মোকিংটা বাদ দিয়েছিস তো?”
“পুরোপরি। ওষুধও খাচ্ছি ঘড়ি ধরে, ছোটগিন্নি, নীরা – কেউ একমিনিট এদিক ওদিক হতে দিচ্ছে না”।
“বেশ। ডাকলি কেন, বল”।
“আমি খুব চিন্তায় আছি, রুদ্র”।
রুদ্রদেব অবাক হলেন, “চিন্তায়? কী নিয়ে রে?”
“সেদিন রাতে যা দেখলাম, নিজে চোখে”।
সুহাসিনী বললেন, “রাতে ঠিক মতো ঘুমোচ্ছেও না। সব সময় চিন্তা কে কোথা থেকে কী করেছিলো, কী করতে চাইছে, কী করবে ……”।
“এটা তো আমারও চিন্তা হয়, সুহাসিনী। যদি আমি যা ভাবছি তা ঠিক হয় - তবে মারাত্মক অপরাধী সে। অথচ আমাদের সামনেই ঘুরছে”।
“সবক’টাই খুন?”
অচ্যুত বলেন, “যুক্তি তো তাই বলে”।
“গ্রামের ব্যাপারে কী জানলে তোমরা? মণিদির, নিধুদার থেকে?”
রুদ্র বললেন, “নিধু যেটা বলছে একটা ম্যালপ্র্যাক্টিসের চল গ্রামে ছিলো। কিন্তু সে আগে। এখন কেউ তেমন করে না – তাই তো?”
“হ্যাঁ, আর করলেও খুব গোপনে, নদীর ওপারের শ্মশানে গিয়ে করে”।
“নিধুদার বাড়িতে কে কে আছে”।
“নিধুর তো দুই ছেলে এক মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। বৌ-ও আছে”।
অচ্যুত বললেন।“মণিদির?”
“মণির তো বিয়ে থাওয়া হয়নি, ওর ভাই আছে, বিবাহিত। ভাই,ভাই বৌ ভাইপো ভাইঝি সব আমার জেঠাদের বাড়িরই একটা অংশে থাকে”।
“তোমাদের জেঠাদের অবস্থা কেমন এখন?”
“পড়তি, কেন?”
“না – এতগুলো আশ্রিত তো-“
“না – ও মনে হয় একটা মুদির দোকান দিয়েছে”।
“কে?”
“মণির ভাই, জেঠাদের অংশ দখল করে থাকে”।
রুদ্রদেব বললেন, “বাব্বাঃ, সরেস তো তবে। তোর জেঠার তরফে কে কে থাকে?”
“জেঠা, জেঠি মারা গেছেন অনেকদিন আগেই। তিনছেলে – একজন তো ভিক্টিম - বাকি দুজন গ্রামেই ছিলো, তেমন পড়াশোনাও করেনি। দুজনেরই তিনটে করে ছেলে মেয়ে”।
“বুঝলাম”।
“গ্রামে যদি এই প্র্যাকটিসটাই না থাকে – তবে এখানে কে করছে? যে করছে তার সাথে গ্রামের যোগ নেই ধরতে হয় তাহলে”।সুহাসিনী বললেন।
অচ্যুত বললেন, “মণি সদ্য গ্রাম থেকে ঘুরে এলো, ওকেও প্রশ্ন করেছি আমি, বললো ও ছোট বেলায় শুনেছিলো এমন কিছু হয়। এমনকী একজনকে পিটিয়ে মেরে ছিলো জেঠারা – ডাইন সন্দেহে – কিন্তু ও যখন থেকে এখানে চলে এসেছে, তারপর গ্রামে গিয়ে দেখেছে সেসব কিছু নেই”।
“পিটিয়ে মেরেছিলো! কেন! থানা পুলিশ হয়নি!”
চমকে উঠলেন সুহাসিনী। “বছর পঞ্চান্ন আগের কথা – গ্রামে জমিদারীর প্রভাবটা ছিলো তখনো”।
“কাকে মেরেছিলো – জানতে পারলি?”
“মণি তো বললো একটা চাকরকে। ঐ বাড়িরই কাজের লোক ছিলো। গুনিন গিরি করছিলো শুরুতে, পরে তন্রমন্ত্র ধরে। জেঠাদের সন্দেহ হয় সে-ই নাকি জেঠাদের বড় ছেলেটাকে ……”।
“আচ্ছা! এবার বুঝলাম। তখন তোরা চলে এসেছিস?”
“হ্যাঁ, দাদার জন্মের মাস ছয়েকের মধ্যেই চলে আসি। তখন আবার আমি নাকি মায়ের পেটে। মণির থেকে শুনেছি মণিও নাকি তখন ওর মায়ের পেটে ছিলো”।
“মণিদি তোমার সমবয়সী তবে?”
“হ্যাঁ, মাস দুয়েকের এদিক ওদিক হবে। মা বলতেন মণির মা খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন, সুন্দরীও”।
“রাঁধুনি? ওর ব্রাহ্মণ?” রুদ্রদেব বলেন।
“ব্রাহ্মণ জমিদার বাড়িতে তো ……”।
“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস। ব্রাহ্মণ মণিরা। ওর বাবা পুরোহিত ছিলেন আমাদের মন্দিরেরই। একটু আলাভোলা মতন ছিলেন শুনেছি। বইপত্র নিয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। মাঝে মধ্যেই উধাও হয়ে যেতেন সংসার ধর্মে মতি ছিলো না। আবার যখন পূজো করতেন খুব ভালো পূজো করতেন”।
“বেঁচে নেই?”
“নাহ, একবার উধাও হয়ে আর ফেরেননি। মণি বলে মণি তখন খুব ছোট আর মণির ভাই পেটে”।
“ওহ”।
“সেই জন্যই কি মণিদিকে ফাইফরমাশ খাটতে পাঠিয়ে দেয় ওনার মা?”
“মনে হয়, বাবা নিয়ে এসেছিল – এটা মনে আছে। কতই বা বয়স ওর তখন, বছর এগারো, সেই থেকে আছে”।
“বিয়ের চেষ্টা করেনি কেউ কখনো? দেখতে শুনতে তো ভালোই”, সুহাসিনী বললেন।
“মা বলতো বাবাকে। তবে ওদের বাড়ি থেকে গা করেনি। মাসে মাসে একটা মোটা টাকা গ্রামে পাঠায় মণি। বিয়ে হলে তো সেটা পাবে না। আর ওর ভাইটাও মানুষ হতো না তাহলে”।
“নিধুদাও কি ঐ সময় থেকেই আছে?”
“নিধু বছর দুয়েক পর থেকে”।
রুদ্রদেব কিছু একটা ভাবছিলেন।
“কী ভাবছিস, রুদ্র?”
“কিছু না। অঙ্কটা জটিল হয়ে গেলো। তোদের গ্রামে একবার যেতে হবে মনে হয় – গোপনে”।
“কেনরে?”
“আমরা যাদের ইন্টারভিউ করছি – তারাও কি সন্দেহের উর্ধে? আর পিটিয়ে মারার গল্পটা আমাকে ভাবাচ্ছে। একটা মানুষকে বেমালুম পিটিয়ে মেরে দিলো – তার বংশধরাও তো প্রতিশোধ নিতে পারে। অচ্যুত, তোর জ্যাঠাদের বাড়ির কারোর ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“উঁহু”।
“তাহলে তো যেতেই হবে”।
“কবে যাবি?”
“যাবি মানে? তুই যাবি নাকি এই শরীরে, অনিকে নেব”।
“আমি যাবো”।সুহাসিনী বললেন।
“না, না, অচ্যুতকে দেখবে কে? নীরা একা পারবে না”।
“একদিনের তো ব্যাপার”।
“রুদ্র, বৌ ঠিক বলেছে। ওকে নিয়ে যা, সবসময় পুরুষ মানুষের বুদ্ধিতে সব হয় না। মেয়ে মানুষের চোখ লাগে”।
“আমার সাথে ছেড়ে শান্তিতে ঘুমোতে পারবি?”
রুদ্রদেব রসিকতা করলেন। অচ্যুত সুহাসিনীর দিকে তাকালেন।
“তুলে নিয়ে চলে যাবি? বেশ তো, যা। তবে ফিরে চলে আসবে”।
“তোমাদের এটা ফালতু মস্করা করার সময়?”
সুহাসিনী রেগে গেলেন, “না, না। ঘাট হয়েছে। বলছি ছোট গিন্নী, চা হবে – এবার?”
“চিনিছাড়া, দুধছাড়া – হবে”।
অচ্যুত মুখটা পাংশুটে করলেন। “থাক”।
“দেখেছো, রুদ্র?”
“না,না– তাই আনো। বাপরে একে বৌ – এর বকুনি, তারপর ডাক্তারের – বাপরে! জল গরম করে দুটো চা দানা ফেলে আনো তাও হবে”।
সুহাসিনী হেসে চলে গেলেন।
“বাড়িতে থেকে মন ভালো লাগছে?”
রুদ্রদেব বললেন।“খুব, এতদিন থাকিনি, আফশোস হচ্ছে”।
“বৌ ডাকটা বেশ, ছোট গিন্নীটা সেকেলে”।
"ওটা আদরের ডাক, তোর যেমন সু”।
রুদ্রদেব চমকালেন, “জানিস?”
“জানি, এটাও জানি তোকে এখনো খুব ভালোবাসে, আর তুই ও”।
“কষ্ট পাস?”
“আগে পেতাম, এখন পাই না। দোষ তো আমারও। ওকে ঠিক মতো বৌ করে নেবার চেষ্টাটাই তো করিনি”।
“এখন করছিস?”
“বলতে পারিস।সময় দিচ্ছি। এক খাটে ঘুমোচ্ছি.. চৌত্রিশ বছর খাট আলাদা ছিলো”।
“বাহ”।
“গল্প করছি – এক তরফা হলেও, শুনছে, বিরক্ত হচ্ছে না। কাছে আসতে দিচ্ছে না – কিন্তু পাশে থাকতে দিচ্ছে”।
“কসবার বৌদিবাজিটা বন্ধ করেছিস তো?”রুদ্র চোখ মারলেন।
“ওরে শ্লা! এত নামী ডাক্তার হয়েও বদলাসনি?”
“তুইও তো বিজনেস ম্যান – তাও এত বড়ো – বদলেছিস? কী নাম ছিলো তার?”
“নামে কী এসে যায়, ভাই। ছেড়ে দিয়েছি, যাই না আর। বিশ্বাস কর।”
“করলাম”।
সুহাসিনী চা নিয়ে এলেন, সাথে নিধুকাকা। অনিকেতও এসেছে ঠাম্মা পায়ে পায়ে।
“আরে বাবিন যে ……”।
রুদ্রদেব হাত বাড়িয়ে ডাকলেন। কোলে বসিয়ে নিলেন।
“পড়া হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, মিস চলে গেলো। এখন অল্প ছুটি”।
“বাহ”।
“দাদুভাই, মামণি ডাকছে। তুমি বাইরে – ঠান্ডা লেগে যাবে”।
অচ্যুত হাসলেন, এই একটা নাতিই ওনাকে ঠাকুরদাদা নয়, দাদুভাই বলে। শুনতে ভালোলাগে অচ্যুতের।
“তোর মামণির সব দিকে নজর”।
“সুহাসিনী একটা কাজ ঠিক করেছে। অনির জন্য নীরাকে বেছে”।
“মাত্র একটা কাজই ঠিক করেছি জীবনে রুদ্র - এমন মনে হলো?”
সুহাসিনী রুদ্রদেবের পাশে বসতে বসতে বললেন।
“তা বলছে না রুদ্র, এই কাজটা খুব ভালো করেছো সেটা বলছে”।
“থাক, শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল”।
“শুঁড়ি কে ঠাম্মা?”
সুহাসিনী হেসে ফেললেন, “পাকা ছেলে, মামণি এমনি বকে না”।
রুদ্রদেব বললেন, “সুহাসিনী, জানার আগ্রহ ভালো, শুঁড়ি মানে যে মদ বেঁচে। আর মাতাল মানে ………”।
“যে মদ খায়?”
“এইতো, জানিস”।
“বড় হয়ে ডাক্তার হবে বলেছে, তোর মতো”।অচ্যুত বলেন।
“হবেই তো, দাদুভাই – এর নাতি বলে কথা”।
“চলো, চলো, দাদুভাই – মামণি বকবে”।
অচ্যুত বললেন, “দাঁড়াও দাদুভাই, চা টা খেয়ে নিই। যাচ্ছি”।
“তারপর বকুনি খেলে আমাকে বলো না”।
“বলবো না, ছোটগিন্নী – অনির ছেলে বেলার মতোই না, অনেকটা?”
“একদম, তবে দুরন্তপনাটা এর একটু কম”।
নীরা দেরি দেখে নীচে চলে এসেছিলো,
“তোকে দাদুভাইকে ডাকতে বললাম – তুই বসে গল্প করছি?”
অনিকেত কাঁচুমাচু হয়ে গেলো।
“নীরা, বকোনা বুড়োটারই দোষ। তোমার কাকাই যেতে চাইছেন না – চা না খেয়ে”।
নীরা বুঝলো গল্প জমেছে তিন বন্ধুতে। নীরা বললেন,
“কাকার ঠান্ডা লাগলে – অনি বকবে আমায়”।
অচ্যুত বললেন, “নীরা, তুমিও পাশে বসো মা, চা খেয়েই যাচ্ছি”।
নীরা বসতে গিয়েও চমকে উঠলো।
“কাকিমণি, আমি গেলাম। আমার পরীটা একা উপরে”। বলেই দৌড়লো উর্দ্ধশ্বাসে।সুহাসিনী, রুদ্রদেব মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।অচ্যুত বললেন,"পরীকে ভালোবাসে খুব মেয়েটা।"
সুহাসিনী বললেন, “বসবে না? ওরই তো মেয়ে”।
অনিকেত শুনেও কিছু বললো না। মামণি তো একা ওর মামণি। বোনের তো জেঠিমণি, তাও মা? মামণিকে জিজ্ঞাসা করবে এটা? যদি বকে? তাও জিজ্ঞাসা করাই উচিৎ।
“মামণি ………”।নীরা
শোবার আগে চুল আঁচড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। বহুদিন পর আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখছিলো আজ। অনেক রোগা হয়ে গেছে। এটা না খাওয়ার ফল। দিনের পর দিন না খেয়েই থাকতো। মাথায় চুল পাতলা হয়েছে কিছুটা। গায়ের রং – ও চেপে গেছে। তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই নীরার, কষ্ট নেই। ছেলে মেয়ে দুটো মানুষ হলেই হবে। অনিরুদ্ধ এখন ষ্টাডিতে, কাজ করছে। পরী ঠাম্মা দাদুভাই এর সাথে শুয়ে পড়েছে। অনিকেতের ডাক শুনে তাকালো নীরা।
“বল”।
“বড় কাকামণি বোনের বাপি?”
নীরা এবার ঘুরে তাকালো, “বোন বললো?”
“না, না, বাপিকে জেঠুমণি বলে তো। আর ছোট কাকামণিকে কাকামণি”।
“হ্যাঁ, বোনের বাপি বড় কাকামণি”।
“বড় কাকিমণি তবে মামণি?”
নীরা ছেলের প্রশ্নটা আন্দাজ করতে পেরেছে এতক্ষণে। ওর পাশে খাটে বসলো।
“হ্যাঁ”। নীরা লুকাতে চায় না কিছু। জানাতেই চায় সব।
“তুমি তাহলে বোনের জেঠিমণি”।
নীরা বললো, “ঠিক”।
“তাহলে বোনকে যে তোমার মেয়ে বললো দাদুভাই?”
নীরা অনিকেতকে কাছে টেনে নিলো।
“মেয়েই তো, বোন কী তোর বোন নয়?”
অনিকেত মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ তো”।
“আমার তো মেয়ে নেই। বাপিরও মেয়ে নেই। তাই বোনই আমাদের মেয়ে।
“ওহ, আচ্ছা, তুমি শুধু আমার ;মামণি, তাই না?”
নীরা বুঝলো মা’কে নিয়ে পজেসিভলেস এসেছে ছেলের মনে।
“না, দাদারও মামণি ছিলে, বলো?”
নীরার কষ্ট হলেও উফ করলো না।
“হ্যাঁ, ছিলাম, এখন শুধু তোরই মামণি। তবে বোনও আমার মেয়ে। মামণি ডাকলেই তো মা হয় না শুধু। যেমন ধর বাপি ঠাম্মাকে কাকিমণি বলে – কিন্ত বাপির মা তো কাকিমণিই। ভালোবাসাটাই আসল”।
নীরার কথায় খুশি হয় অনিকেত।
“বোনকে আমি নিজের বোনই ভাবি মামণি। হিংসে করিনা”।
“জানি তো, এরকমভাবেই বোনকে সবসময় ভালোবাসবে আগলে রাখবে”।
নীরা অনিকেতকে আদর করে।
“মামণি – তুমি কাঁদছো?”
“না তো”। নীরা চোখ মোছে। “চোখে কিছু একটা পড়েছিলো”।
“ও”।
অনিরুদ্ধ আসে তখনই, “বাবিন, জেগে এখনো? কাল স্কুল যে বাবা”।
“ঘুমোচ্ছি বাপি”।
“নীরা কী হয়েছে চোখে জল কেন?”
“কিছু না”।
“বাবিন – মা’কে কাঁদিয়েছো?”
“না, বাপি, এমনি। দাদার কথা বলে ফেলেছিলাম”।
অনিরুদ্ধ নীরার দিকে তাকায়। বোঝে ওর কতটা কষ্ট হচ্ছে।
“থাক, বাবিন, যে নেই তার কথা বলতে হবে না”।
অনিরুদ্ধ অনিকেতকে শুইয়ে দেয়। নীরাও শুয়ে পড়ে। অনিকেত ঘুমোলে অনিরুদ্ধ বলে।
“সরি”।
“কেন?”
“ছেলে পুরনো কথা বলে ফেলেছে”।
“তাতে তুমি সরি কেন? ও কি তোমার একার?”
“নীরা – মানো তো ওকে?”
“মানি, কারোর জায়গায় নয়, নিজের জায়গাতে রেখেই মানি, ও আমারই”।
“ও এসে তোমার কষ্ট কমেছে অনেক, তাই না?”
"তোমারও তো”।
“অনুপমের মধ্যেও একটা চেঞ্জ এসেছে, দেখেছো?”
“দোকানে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, মন দিয়ে কাজও করছে”।
“ছোট ঠাকুরপোর খুব একসাথে থাকার ইচ্ছে”।
“অতীনের সেটা নেই, নীরা”।
“তবুও সবাই তো চাইছে, তুমি একবার কাকা কাকিমণিকে বলো”।
“তুমিও চাও?”
“কেন নয়? তুমি?”
“চাই, আবার ঠিক চাই ও না”।
“কেন?”
“আবার কম্পিটিশন ঘটি বাটি ঠোকাঠুকি ………”।
“বুঝলাম, ভাইয়ে ভাইয়ে?”
“না, বৌয়ে বৌয়ে। অতীনের বৌ তেমন ভালো নয় জানোই তো, আর তোমার উপর কোন ষ্ট্রেস কোন চাপ, চাই না। তার থেকে এভাবেই ভালো। কাকা, কাকিমণি এখানেই থাকুক। ওদের তাতে মাথাব্যথা হবে না”।
নীরা হেসে ফেলে।
“ধুর বোকা, ওদের মা – বাবা – ওদের চিন্তা হবে না? নিজের পছন্দ মতো সব সাজিয়ে নিলেই হবে অনি?”
“হতে হবে”।
“তুমি তোমার বাঁদরটার মতো পজেসিভ। মা’কে নিয়ে”।
“কেন, কী বলে সে?”
“একা ওরই মামণি তো আমি? বোনের জেঠিমণিই তো?”
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে, “বোনকে হিংসে!”
“না.পরে বলে যে বোনকে খুব ভালোবাসে, হিংসে করে না। কিন্তু আমি কেবল ওর মমণি”।
“বেশ, আমার পাওনাটা মনে আছে তো?”
“আছে, তবে সব ঠিক হোক আগে তারপর। আর তোমার ছেলে ঘুম যা পাতলা ………”।
“ঠাম্মা দাদুভাই এর ঘর আছে তো!”
অনিরুদ্ধ মজা করে বললো। নীরা মাথা নাড়লো।
“কোথাও না, শুধু আমার কাছে, আমার চোখের বাইরে একদম না”।
অনিরুদ্ধ কিছু বললো না। এরকম আর একজনকে চেনে ও।
ষ্পষ্ট শুনতে পেলো।
“অনি – কোথায় চললি?”
“ঠাম্মা ডাকছে কাকিমণি – ঠাম্মার ঘরে শোব?”
“একদম না, যেখানে শোও সেখানেই শোবে”।
“ভাই গেলো তো”।
“ভাই যাক, ছোটন তো শুয়েছে এখানে, একদিনের সোহাগ।শোবার দরকার নেই”।
ঠাম্মা গল্প বলার লোভ দেখিয়েই ডাকতো ওকে আর অতীনকে। ভালো গল্প বলতো ঠাম্মা। কিন্তু এখানে শুলে গল্প দূরে থাক শুয়ে ঘুমোতে দেরি হলেও দু চার ঘা জুটে যেতো।
“কি রে? কথা কানে গেলো না? নাকি সেদিনের মতো গরুপেটা করতে হবে রাত দুপুরে?”
অনিরুদ্ধর আর কিছু বলার সাহস হতো না। গরুপেটার মর্ম ও হাড়ে হাড়ে বোঝে। যেদিন গরুপেটা হয় তারপর দিন পনেরো ব্যথা থাকে সারা গায়ে। ছলছল চোখ নিয়ে শুয়ে পড়ে তো ছোটনের পাশে। কাকিমণি ওর পাশেই শুত।
কাকা সব দেখে ওই খাট থেকে বলতো।
“ছোটগিন্নী – গল্প শুনতে মন হচ্ছে বাবুর, যাক না”।
কাকিমণি চোখ মুছিয়ে দিতো ওর।
“গল্প আমিও বলতে পারি। তুমি ঘুমোও, এর মধ্যে পড়ো না। তোমার বাবুকে আর লাই দিতে হবে না”।
কাকিমণি শুয়ে বলতো, “আয় – গল্প বলছি”।
“ঘুমোবো”।
“অভিমান?”
“না কাকিমণি, ঘুমাই, স্কুল আছে”।
“বেশ, ঘুমো”।
অনিরুদ্ধ শুয়ে শুয়ে ফোঁপাতো। কাকিমণি কানে কানে বলতো,
“বেশ, এবার থেকে তাহলে ঠাম্মার সাথেই শুবি। ভাইরা আমার কাছে”।
ফোঁপাতে থাকা ছোট্ট অনিরুদ্ধ ঘরে আঁকড়ে ধরতো কাকিমণিকে।
“কী হলো?”
“রোজ বলেছি? আজ বলেছিলুম তো”।
“আমার যে অনিকে পাশে না পেলে ঘুমই আসবে না – তার বেলা?”
“কষ্ট হবে তোমার?”
“খু-ব”।
“আচ্ছা, গল্প বলো, ঘুমিয়ে যাই”।
কাকিমণি চুমু খেতো দুগালে ঘুম আসতে আসতে শুনতো,
কাকা জল খেতে উঠে বলছে, “ঘুমিয়েছে তোমার ছেলে?”
“হ্যাঁ”।
“একটু তো ছাড়তে হয়”।
“জানোইতো – ছাড়তে ভয় পাই”।
কাকা আর কিছু বলতো না। নিজের খাটে শুয়ে পড়তো। নীরার মধ্যে কাকিমণিকেই দেখলো অনিরুদ্ধ, আবারো।
পর্ব – ৩৭
ফাদার অগাষ্টিনের রুমে বসে থাকা অনুপমকে দেখে শাঁওলি বললো, “আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?”
অনুপম বাবিনকে নিতে এসেছিলো, দাদাভাই পাঠিয়েছে। বাবিনকে নিয়ে বৌদিমণির কাছে দিয়ে আসবে ও – তারপর দোকান যাবে।
আজ বাবিনদের লাঞ্চে ছুটি।
“মুখার্জী বাড়িতে”।
অনুপম চিনেছে। বাবিনের মিস।
“ও, হ্যাঁ, আপনি অনিকেতের …”।
“ছোটকাকা”।
“ওহ”।
শাঁওলি বসে।
“আমি অনিকেতকে পড়াতে যাই।
“জানি”
ঘড়ি দেখে অনুপম, বিরক্ত লাগছে। বড্ড গায়ে পড়া মেয়ে।
“আচ্ছা একটা কথা বলুন – অনিকেত ওখানে প্রপার কেয়ার পাচ্ছে তো?”
“মানে?”
“মানে এখনো অ্যাডপশন লিগালি কমপ্লিট হয়নি। অবজারভেশন চলছে দু’মাসের। যদি প্রপার কেয়ার না পায় তবে ………”।
“আপনি তো যান – বোঝেন না?”
“আমি তো দু’ঘন্টার অতিথি। আপনার বৌদি ঠিকঠাক বিহেভ করেন তো? উনি তো আবার সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট ………”।
“কেন করবে না? বাবিনের তো মা, বৌদিমণি”।
শাঁওলি বুঝলো কোন খবর বা বেফাস কথা এখান থেকে পাওয়া যাবে না।
“আজ ওদের লাঞ্চে ছুটি। ওয়েট করুন আর পাঁচ মিনিট”।
অনুপম ঘড়ি দেখলো। পাঁচ মিনিট তাড়াতাড়ি কাটলে বাঁচে ও ।
“ছোটকাকামণির সাথে চলে এলি?”
নীরা অনুপমের কোল থেকে বাবিনকে কোলে নিলো।
“বাবিনের লাঞ্চে ছুটি, দাদাভাই বললো আনতে যেতে – চলে গেলাম”।
“বাহ। লাঞ্চ করবে তো ঠাকুরপো?”
“না, দোকান যেতে হবে”।
নীরা ছেলেকে চেয়ারে বসালো। পিঠের ব্যাগ খুলে জুতো মোজা খুলে দিলো।
“একটু খেয়ে যাও”।
“বেশ, তুমি বাবিনকে তো খাওয়াবেই। আমাকেও দিও – অল্প করে”।
নীরা ছেলেকে চেঞ্জ করাতে ঘরে ঢুকলো, অনুপমও গেলো পিছন পিছন সোফায় বসালো।
“বৌদিমণি, বাবিনের মিসটা ঠিকঠাক নয়”।
নীরা থমকালো, “কেন?”
“বড্ড কৌতুহলী। গোয়েন্দাগিরি করে একেবারে”।
“ওকে ঐ জন্যই রেখেছেন ফাদার, আর দিন পনেরো আসবে”।
“তারপর মিস আর আসবে না মামণি?”
নীরা বলে, “না, আমাদের কাছে পড়বি, তাহলেই হবে”।
“আচ্ছা”।
“কটকটে কথা সবসময় বাঁদরটার, নে চেঞ্জ করাবো”।
“কাকামণি ………”।
অনিকেত ইশারা করে।
“তাতে কী? কাকামণিই তো, এইটুকু পুঁচকের লজ্জা আবার”।
“মেয়েটা গায়ে পড়া বড্ড বুঝলে? খুব আনইউজুয়ালি ভিতরে ঢুকতে চায়, সবকিছুর”।
“আমারো অপছন্দ, নেহাৎ তোমার দাদাভাই এর কথায় ……”।
“নিছক গোয়েন্দাগিরি নাকি আর কিছু কে জানে। দেখে মনে হয় টিপিক্যাল গোল্ডডিগার, খুব উচ্চাকাঙ্খী, কিন্তু সোজা পথে না”।
নীরা অনিকেতকে জামা প্যান্ট চেঞ্জ করাতে থাকে। টাওয়াল ধরায় ছেলের হাতে।
“বাবিনের ডান থাইয়ের উপরের দিকে তিল?” অনুপম বলে।
“হ্যাঁ”।
তোয়ালে পরিয়ে দেয় নীরা।
“স্নান করবি?”
“না”।
“বেশ। দাঁড়া ভালো জামা পরিয়ে দিই”।
অনুপম বলে, “বৌদিমণি, আমাকে একটু যেতে হবে গো”।
“কেন?”
“একটা কাজ মনে পড়ে গেলো”।
“খাবে না?”
“না, থাক, আসছি”।
নীরা অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না।
“কিরে ভাই, সবাই চলে গেলো – তুই ফিরবি না?
অনুপমকে দোকানের ব্যাক অফিসে দেখে বলে অনিরুদ্ধ।
“হ্যাঁ, যাবো ……”।
“মেশিন বন্ধ কর, অনেক কাজ করেছিস, চল”।
অনুপম কম্পিউটার শাটডাউন করে কেবিন লক করে এগোলো।
“চুপচাপ কেন ছোটন?”
“কিছু না দাদাভাই”।
“কোথায় যাবি এখন?”
“একটু সল্টলেক যাবো ভাবছিলাম। অবিনটাকে অনেকদিন দেখিনি। ছোটটাও তো বড় হলো ক’দিনে”।
“সেকি! যাস না! কেন রে? ঝগড়া করেছিস বৌমার সাথে?”
“নাহ, এমনিই যেতাম না। আজ থেকে রোজ যাবো”।
“বাহ, এক কাজ কর। তুই অডিটা নিয়ে চলে যা”।
“আচ্ছা, দাদাভাই। দাদাভাই – আমাদের ফ্যামিলির সবকটা বাচ্চার মধ্যে বাবিন কিন্তু সবার বেশি ভালোবাসা ডিজার্ভ করে, তাই না? এতদিন পায়নি যে …”।
“পাচ্ছে তো, আজীবন পাবেও”।
“তোমার আর বৌদিমণির উপর ভরসা আছে আমার”।
“নিজের উপর নেই? তুই-ও তো ওর নিকটজন, কাকামণি”।
অনুপম হাসে, “আমার নিজের উপর নিজেরই ভরসা কোথায় দাদাভাই। ভরসার যোগ্য আর আমি? না গো, বরং সবার সব লজ্জা সব কষ্ট – আমার জন্য”।
“তাই! কার কার শুনি?”
“মায়ের, তোমার বৌমার, বাচ্চাদের ……”।
“ধুর বোকা, তুই তো এখন বদলাচ্ছিস”।
“চেষ্টা করছিলাম দাদাভাই। কিন্তু যত উঠতে চাই – পারিনা। নিজের চোখে নিজেই নেমে যাই”।
“বাজে না বকে সল্টলেক যা। ড্রাইভার দিচ্ছি, ট্র্যাক করবো, কোন বারে নামবি না মাঝপথে”।
অনুপম দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে।
“কী হলো?”
“আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো,দাদাভাই, মন ভালো নেই”।
অনিরুদ্ধ হাসে, “চল। আমার সাথে যাবি, একগাড়িতে”।
“কাল? নারে কাল হবে না”।
অনিরুদ্ধকে টেক্সট করেছিলো শাঁওলি। কাল মিট করার জন্য।
“কেন?”
“মিটিং”।
“একদিন বাদ দাও”।
“কী বলছিস!”
“হ্যাঁ, আমার জন্য এটুকু পারবে না?”
“এ আবার কেমন কথা?”
“বাব্বাঃ অনিদা, তুমি এই ক’দিনেই এত বদলে গেছো! তোমার মনেই পড়ে না আমাকে। এদিকে অনিকেতকে পেয়েছো – সেটাও আমার জন্য”।
অনিরুদ্ধ বুঝলো এড়াতে গেলে অভিমান হবে। তার ফল ভালো নাও হতে পারে।
“কাল কী আছে?”
“ফেসবুকে নোটিফিকেশন আসবে, দেখে নিও”।
“ওহ, তোর জন্মদিন”।
“এভাবে শুকনো মুখে বললে হবে? জন্মদিনের লাঞ্চ তোমার সাথে করবো”।
“বেশ, ঘন্টা খানেক কিন্তু। মিটিং – এর আগে”।
“হবে, তাই হবে”।
“কোথায় আসবো বল”।
“বাড়ি থেকে তুলে নিও। কাল স্কুল যাবো না”।
অনিরুদ্ধ উত্তর দিলো না কোন। শাঁওলি বেশ জোর খাটাচ্ছে, অনিকেতকে ওর মাধ্যমে পেয়েছে বলেই ওর এই জোর যতদিন কাগজে কলমে অ্যাডপশন না হয় – সমস্যাটা থেকেই যাবে। শাঁওলি এই জোর দেখানো কি নিছক ছেলেমানুষি? নাকি ওর ক্রাশ শব্দটা অতটাও হাল্কা নয়। গভীর ভাবে ভাবলে অন্য রকম কিছুর সম্ভবনাই মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধর। নীরা অপছন্দ করে। এই ব্যাপারে সন্দেহও করে। কিন্তু অনিরুদ্ধ শাঁওলিকে ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ভেবে সেসব ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। এখন মনে হচ্ছে না এনে ভুল করেছে। আনতে হতো। কাল দেখা হলে শাঁওলিকে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেবে অনিরুদ্ধ, শাঁওলির প্রতি কোন সফট কর্নার নেই ওর। তাতে একদিন দুদিন কষ্ট পাবে। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখনই না আটকালে ভুল ধারণা মনের মধ্যে বসে গেলে সমস্যা। এটাকে মেটাতে হবে। কালই।
পর্ব – ৩৮
“গ্রামে যেতে বলছো?”
রুদ্রদেবের কথায় অবাক হয় অনিরুদ্ধ।
“হ্যাঁ, সত্যিটা খুঁজতে যেতে হবে”।
“কে কে?”
“আমি, তুই, তোর কাকিমণি”।
“নীরা, বাচ্চারা?”
“এখানে থাকবে, অচ্যুত থাকবে তো”।
“তাও – আমরা তিনজন চলে গেলে ………”।
রুদ্র আর অনিরুদ্ধ লনে বসেছিলেন। সকালে এখন। রুদ্রদেব সকাল সকালই এসেছেন, কথাটা বলতে, দেরি করতে চান না উনি।
“চিন্তা করিস না। ভোরে বেরোবো, রাতে ফিরে যাবো”।
“কবে? আর এতে লাভ হবে কিছু?”
“এই ডাকিনী বিদ্যা চর্চার কোন উৎস সন্ধান তো করা যেতেই পারে”।
“দেখো – যা ভালো বোঝ!”।
“তোর মা ঘুমোচ্ছে?”
রুদ্রদেব ইচ্ছা করেই বললেন। অনিরুদ্ধ বুঝেই বললো,
“মা?মা উঠে গেছে। বাবিনকে স্কুলের জন্য রেডি করছে”।
“আর বাবিনের মা?”
“সে খাবার তৈরী করছে। ব্রেকফাস্ট”।
“তুই দিয়ে আসবি?”
“অনুপম আসছে, ওই দেওয়া নেওয়া করছে এখন”।
“দুইভাই বোনকেই?”
“না, বাবিনকে।পরীকে আমি স্কুলে দিয়ে অফিসে যাই। ফেরে গাড়িতে”।
“অনুপম তাহলে শুধরাচ্ছে?”
“বলতে পারো”।
“আমাকে অপছন্দ করে, তাই না?”
“ও ছেলেমানুষ এখনো কাকাবাবু, ওর কথা ধরলে হবে না”।
“ছেলে মানুষ আর কোথায় – দুই ছেলের বাবা”।
অনিরুদ্ধ ইশারা করলো, অনুপম আসছে।
“হাত কেটেছে কী করে?”
সুহাসিনী লনে চা দিয়ে এসে অনুপমের হাত খেয়াল করলেন।
“ও কিছু না”, অনিরুদ্ধ বলল।
“কিছু না, মানে?”
মণিপিসি ব্রেকফাস্ট ট্রলি নিয়ে এলো। নিধু কাকা সার্ভ করছিলো।
“এমনি কেটে গেছে”।
“কোথায় মারামারি করেছিস?”
“ওহ দাদাভাই, বাদ দাও না”।
“বাদ মানে? হাত ওভাবে কেটেছে মানে কোথাও গিয়ে ঝগড়া ঝামেলা করেছিলি আবার”।
অনুপম চায়ে চুমুক দিলো।
“বলবো, বাইরের লোকেদের সামনে নয়”।
রুদ্রদেব অপ্রস্তুত হলেন।
“অনি, উঠিরে, চেম্বার আছে”।
“কাকাবাবু, ব্রেকফাস্ট করে যাও। আর ছোটন, এখানে বাইরের কেউ নেই। বল এবার”।
সুহাসিনী বললেন, “ও আর কী বলবে, পেপারে দেখো”।
“পেপারে”!
অনিরুদ্ধ পেপার নিলো।
“ছোটন – মুখার্জী বাড়ির ছেলে হয়ে এভাবে লোকের বাড়ি চড়াও হয়ে মারপিট, থানা পুলিশ! কে ছাড়ালো?”
“তোমার ভাই”।
“অতীন! আমাদের ডাকেওনি তো! কিন্তু এসব কী!”
“মেরে ফেলিনি এই অনেক”।
অনুপম ভাবলেশহীন গলায় বলে।
সুহাসিনী বলেন, “শুনলি অনি, কোন আপ উত্তাপই নেই”।
রুদ্রদেব না বলে পারলেন না,
“এই মেয়েটি কে? একে মেরেছ – এর স্বামীকেও …… কারা এরা?”
“মিথ্যা কথা বলেছিলো মেরেছি”।
“মিথ্যা, কিসের মিথ্যা?” অনিরুদ্ধ বলে।
“অনেক গভীর মিথ্যা।
ষড়যন্ত্র বলা যায় বা পাপ। ছাড়ো – বাবিন রেডি? ওকে দিয়ে আসি”।
“এই হাত নিয়ে ড্রাইভ করতে হবে না, আমি দিয়ে আসছি”।
“চলো, আমিও যাবো”।
দুই ভাইয়ে ব্রেকফ্রাস্ট করে উঠে গেলে রুদ্রদেব বললেন, “বুঝলে কিছু!”
সুহাসিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
“নির্ঘাৎ প্রাক্তন প্রেমিকা”।
“সে তো বটেই, তবে মিথ্যাটা কি আঁচ করলে?”
“কী করে করবো বলো”।
“মেয়েটা বলেছে বহুকাল আগে সম্পর্ক ছিলো বছর সাতেক আগে, এবার?”
“সাত বছর আগের কথা এখন হঠাৎ করে উঠছেই বা কেন?”
রুদ্রদেব হাসলেন, “গভীর ষড়যন্ত্র – শুনলে না?”
“মানে?”
“না।কিছু না।পরে বলবো।যদি আমার অঙ্ক ঠিক হয় তবে তকটা মিরাক্যাল অন্তত বাধলো হিসাবের খাতা থেকে”।
“কী যে বলো তুমি,বুঝি না”। সুহাসিনী রাগ দেখালেন।
“অচ্যুতের সাথে যে মেয়ে মানুষটার সম্পর্ক ছিলো – চেনো তাকে?”
“কী করে চিনবো? দেখেছি নাকি?”
“কসবায় বাড়ি, চিনি আমি, বিবাহিত”।
“ছেলে মেয়ে?”
"এক ছেলে এক মেয়ে”।
“অচ্যুতের কী কেউ আছে?”
“না মনে হয়। ও স্বীকার করেছে?”
“না, বলেতো নেই”।
“কে জানে, তবে মুখার্জীদের মেয়েদের ব্যাপারে বদনাম – প্রজন্ম ধরেই চলে আসছে। তোমার শ্বশুরেরও কিন্তু কলকাতার বাজারে সুনাম ছিলো না”।
“এ প্রজন্মে অনুপম হলো”।
“দেখছি তো, তবে অনি, অতীন ভালো। ওয়ান উওম্যান ম্যান। লাইক মি। অমিতদাও তেমনি ছিলেন”।
সুহাসিনী প্রসঙ্গ ঘোরালেন, “অনিকে বলছো, গ্রামে যাবে?”
“বললাম”।
“কী বলল?”
“যাবে, তবে গিয়ে কতটা লাভ হবে, কনফিডেন্ট নয়”।
“তুমি কনফিডেন্ট তো!”
“আমার মন বলছে – ওখানেই সূত্র আছে”।
“চলো তবে”।
“যাবো,
তবে কবে সেটা কাউকে বলবে না, হুট করেই যেতে হবে”।
“বেশ”। সুহাসিনী অমত করেন না।
“রুদ্র –“
অচ্যুত খবরের কাগজটা পড়েই রুদ্রদেবকেই ফোন করলেন। “বল”।
“চেম্বারে, ভাই?”
“হ্যাঁ, বল, শুনছি”।
“কাগজ পড়েছিস?”
“অনুপমের খবরটা তো?”
“হ্যাঁ”।
“পড়েছি, বুঝেওছি। অনুপমের মুখ থেকেও শুনলাম”।
“কী বললো?”
“মেয়েটি মিথ্যা বলেছে তাই মেরেছে নাকি, মেয়েটির গোপন গভীর ষড়যন্ত্র এটা, পাপ”।
অচ্যুত চুপ করে থাকলেন।
“বছর সতেক আগে সম্পর্ক ছিলো, তাই না?”
কিছুক্ষণ পর বললেন অচ্যুত, “হ্যাঁ”।
“মানেটা ছোটগিন্নী বুঝেছে?”
“এটা সুহাসিনী বুঝবে বলে মনে হয় তোর? আমি বুঝেছি। তুইও বুঝেছিস, জানি”।
“ছোট বৌমা এত ভালো, এত ভদ্র-“
“এটা বিয়ের আগের ঘটনা। অনুপম বংশের ধারা রাখলো তবে”।
“ঠুকলি ভালোই, সুযোগ পেয়ে”।
“হ্যাঁ, ঠুকলাম! লজ্জা করেনা তোর? ঘরে অমন বৌ থাকতে কসবার মেয়ে মানুষটার সাথে – ছি!”
“বৌ – এর মন তো পাইনি কোনদিন রুদ্র, বৌ তো –“, অচ্যুত কোন ক্রমে বলেন।
“চেষ্টা করেছিস কখনো? আর বৌ তো – কী? আমাকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ”।
“বাসলেও কোনদিন তার পদস্খলন হয়েছে – নাকি আমার? ত্রিশ বছর তাকে ছুঁয়ে দেখিসনা – একদিনও আমার হাত ধরেছে? অথচ সুযোগ তো কম ছিলো না”।
“তোরা সৎ, ভালো – আমি মন্দ”।
“ভালো হ – কে মানা করেছে? থাক – বাদ দে”।
“আজকাল ভালোলাগে খুব, জানিস?”
“কেন?”
“তুই আবার সেই আগের মতো খেয়াল রাখিস – ভুল ধরিয়ে দিস – বকাবকি করিস”।
রুদ্রদেব বন্ধুর কথায় হেসে ফেললেন।
“বেশ, দোষটা তবে আমারই। মাঝের বছর গুলো এগুলো করিনি বলে আমার প্রিয় বন্ধুটি বিগড়ে গেছিলো”।
অচ্যুতও হেসে ফেলেন এবার।
“তুই বিলাতে গিয়েও কোন মেমসাহেব পেলি না! কেমন বোকা ভাব”।
“সেই তো, আমি বোকা, ধজ – আর কি?”
“ধজ? মনে হয় না”।
“শালা! এই ব্যাপারেও সন্দেহ করিস?”
অচ্যুত বলেন, “ইয়ার্কি করলাম রে, রুদ্র। ছোটগিন্নীকে বলিস না অনুপমের কথাটা, মরমে মরে যাবে”।
“সে জ্ঞান বুদ্ধি আমার আছে। তুই পেট পাতলা – তুই চেপে রাখিস”।
“ঐ জন্যই এত মিল, রুদ্র?”
“থাক, এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো। যেটুকু জানলাম, বুঝলাম – থাক সেটুকুই। একটা সত্যি অনেকগুলো জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট করতে পারে, মনে রাখিস”।
অচ্যুত বুঝলেন, “আমার এই বন্দী দশা, আর ক’দিন?”
“সবটা মিটুক, তুই বাড়ি থাকলে ভরসা পাই। নীরা, পরী, বাবিন – সবাইকে রেখেও যেতে পারি তাহলে”।
“পাহারাদার?”
“একদম, বাড়ির কর্তা সবচেয়ে বড় পাহারাদার, জানিস না?”
“বেশ, এই রুদ্র, বৌ আসছে – রাখি”।
“ভয় পাস?”
“তুই পাস না?”
রুদ্রদেব ভাবলেন একটু, “পাই না বললে ভুল হবে”।
“তাহলে?”
“ফোনটা রাখ, বকুনি যাবি এবার”।
অচ্যুত ফোন রেখে দিলেন।
শাওলিকে বড্ড কড়া ভাষায় কথাগুলো বলা হয়ে গেল কি? বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফাবছিলো অনিরুদ্ধ। ও-ই ফাইনাল রিপোর্ট দেবে ফাদার অগাস্টিনকে। যদি নাকচ করে দেন ফাদার – ওর নেগেটিভ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে? বুঝতে পারছে না অনিরুদ্ধ। তবে না বলেও উপায় ছিলো না। নীরাকে নিয়ে আপত্তিকর কথা গুলো যখন বলে ফেললো শাঁওলি হিসাবি অনিরুদ্ধও রাগ ধরে রাখতে পারে। নীরা মানসিক রোগী। নীরা নর্মাল লাইফ লিড করার জন্য ফিট নয়। নীরার জন্য অনিরুদ্ধ বাবিন দুজনেই সাফায় করবে – এতটুকু পুচকে মেয়ের এসব বলার সাহস হয় কী করে! প্রতীকের বোন, বাচ্চা মেয়ে বলে অনিরুদ্ধ স্নেহ করতো, প্রশয় দিতো – তা বলে এরকম ভাবে ইন্টারফেয়ার করার সাহস হয় কী করে কে জানে! নীরাই ঠিক বলেছিল, মেয়েটা ঠিক নয়। নীরার মেয়েলি ঈর্ষা ভেবে গুরুত্ব দেয়নি অনিরুদ্ধ কিন্তু ভুল করেছিলো – এখন মনে হচ্ছে। ফাদারকে কি একবার বলবে এ ব্যাপারে, নাকি প্রতীককে? নাহ রাগের মাথায় কিছু করাটা ঠিক হবে না। বাড়ি পৌঁছে – ঠান্ডা মাথায় যা ডিসিশন নেবার, নিয়ে হবে।
পর্ব – ৩৯
আজ স্কুলেও বকুনি খেয়েছে অনিকেত, মিসের কাছে। ওর খাতা দেখে সিদ্ধার্থ লিখছিলো। মিস ওকেই বকে কমপ্লেন ডায়েরিতে কত কী লিখে দিলো। মিস অন্যদিন কত ভালো করে কথা বলে। টিফিনে বিস্কিট, চকোলেট, কেক দেয় – আজ কিছু দেয়ওনি। মামণিকে লুকিয়ে অনিকেত খায় সেসব। মিস কষ্ট পাবে নইলে। অনিকেত জানে না মিস এত রেগে আছে কেন? আজ পড়াতে এসে মামণিকে সব বলে দেবে? তাহলে তো বিপদ। অবশ্য স্কুল থেকে ফিরেই কমপ্লেন ডায়েরিটা দেখাতে হবে। ছোট কাকামণির সাথে ফিরছিলো অনিকেত। কাকামণি আজ চুপচাপ ছিলো, মন ভালো নয় যেন।
“কাকামণি?”
“হ্যাঁ, বাবিন”।
“তুমি ভাইদের দেখালেই না”।
অনুপম বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরলো অনিকেতকে, ডান হাতে ব্যথা এখন।
“দেখাবো। ওরা বাড়ি ফিরুক”।
“তোমার হাতে লেগেছে?’
অনুপম থমকালো, “হ্যাঁ”।
“মারামারি করেছো?”
অনুপম চুপ করে থাকলো।
“কাকে মারলে?”
অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর উত্তর ওর কাছে নেই।
“মারামারি করা ভালো না”।
“করব না, আর”।
“তুমি খাচ্ছো কী করে? ডান হাত ব্যথা”।
“বাঁ হাতে”।
“এমা! দাঁড়াও – তুমি বাড়ি চলো – আমি খাইয়ে দেবো তোমায়”।
অনুপমের চোখে জল চলে আসে,
“দিবি বাবা, সত্যি?”
“দেবো তো, বাড়ি চলো”
অনুপম চুমু খায় অনিকেতকে। একসাথে অনেকগুলো।
“তুমি কাঁদছো, কাকামণি?”
অনুপম চোখ মুছলো, “একটু”।
“কেন?”
“কেউ আমাকে কখনো খাইয়ে দেবে বলেনি যে”।
“ঠাম্মা?”
“ঠাম্মা দিতো, খুব ছোট বেলায়। তারপর থেকে নিজে। কেউ খাইয়ে দিক পছন্দ ছিলো না। সব কাজ নিজে করে চটপট বড় হতে চাইতাম”।
“এমা, বাপিকে তো ঠাম্মা কত্ত বড় অবদি খাইয়ে দিতো শুনেছি”।
“দাদাভাই যে তোর ঠাম্মার সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে আদরের ছেলে”।
“বাপিও ভালো, তুমিও ভালো”।
অনুপম অনিকেতকে কোলে তুলে নিলো, এক হাতেই, “সত্যি?”
“কত্ত খেলো, কত্ত ঘোরাও …”।
অনুপম বললো, “আমাকে কেউ এই প্রথম ভালোও বললো”।
“তুমি তো ভালোই, আমার ভালো কাকামণি”।
অনিকেত কাকামণির গলা জড়িয়ে ধরলো। অনুপমের মন কানায় কানায় ভরে গেলো যেন।
“কমপ্লেন ডায়েরিতে কী লেখা এটা?”
নীরা ডায়েরিটা পেয়েই রেগে গেলো।
“আমি দেখিনি কারোর থেকে মামণি – ওরা দেখছিলো ……”।
“ওরা?”
“সিদ্ধার্থরা …”।
নীরা, অনিকেত স্কুল থেকে ফিরলেই কমপ্লেন ডায়েরি, হোমওয়ার্কের খাতা, টেস্টের রেজাল্ট দেখে নেয়।
“তুই ঢেকে লিখতে পারিস না?’
“লিখেছি …… ওরা উঁকি মারে”।
“কেয়ারলেস, আনটাইডি – বাহ। কত ভালো ভালো এডজেকটিভ।"নীরা ছেলের কান ভালো করে মুলে দিলো।
“কমপ্লেন ডায়েরিতে আর কোনদিন কিছু লেখা এলে তোর কী হয়, দেখিস”।
নীরা কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, অনিকেত চুপ করে ছিলো। চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো শুধু।
নীরা বলল, “আবার কান্না! চোখ মোছ! মার খেতে যদি না চাস”।
অনিকেত চোখ মুছে ফেললো। নীরা কান ধরে ডাইনিং থেকে টানতে টানতে ঘরে আনলো, চেঞ্জ করাবে।
“অসভ্য, বাঁদর ছেলে হচ্ছিস দিনে দিনে। ক্লাসে প্রপারলি বিহেভ করছিস না”।
নীরা রাগে গজগজ করছিলো।
“ওষুধটা বন্ধ হোক, তোর স্কুলে যাবো আমি। সবটা আমাকেই দেখতে হবে”।
অনিকেত ভয় পাচ্ছিলো খুব। নীরা চেঞ্জ করালো। তারপর বলল, “খাবি চল”।
অনিকেত চুপ করে থাকলো, “কী হলো?”
“আমাকে এট্টু কোলে নেবে, মামণি?”
নীরার মন এই একটা কথাতেই ভিজে গেলো। ছেলেটা এমন আবদার তো কোনদিন করেনি। এক মুহুর্ত দেরি না করেই কাছে নিলো।
“মন খারাপ?”
“মিস খুব বকেছে স্কুলে তুমিও ………”
নীরা কোলে তুলে নিলো। চুমু খেলো দুগালে।
“আর বকছি না”।
অনিকেত মামণিকে জড়িয়ে ধরলো। শাসনের সাথে সাথে কখনো আদরেরও প্রয়োজন থাকে। নীরা ভালোই বোঝে সেটা এখন। একতরফা কোন কিছুই ভালো নয়।
“কাকামণিকে বাবিন খাইয়ে দেবে?”
সুহাসিনী অনিকেতের কথা শুনে হেসে ফেললেন।
নীরা বললো, “ঠাকুরপো, হাতে লাগিয়ে ভালোই হয়েছে তাহলে। এমন সুন্দর প্রস্তাব পেলে”।অনুপম হাসলো,"ভাবো তো,
ও কতটা ভেবেছে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছো! ডানহাতে ব্যথা – কী করে খাবে – ঐটুকু ছেলে এতটা ভেবেছে এই অনেক”।
“বাবিন- খাইয়ে দে তবে কাকামণিকে”।
পরীরও ঘুম ভেঙ্গে পিয়েছিলো।
“আমিও দেব, জেঠিমণি”।
সুহাসিনী বললেন, “বাবার সাথে সাথে মা-ও চলে এসেছে খাওয়াতে”।
অনুপম হাসলো, “তাই তো দেখছি। পরী, আয় কোলে বস কাকামণির”।
মণিপিসি এলেন, “মণি, ছোটখোকা খাবে”।
“খাবার আনবো, ছোটবৌদি?”
“আনো, ছোটখোকা – তুই তোর ছোট্ট মা-বাবা দুজনকেই কোলে নিয়ে বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি”।
“তুমি!” অনুপম অবাক হয়।
“কেন? ছোটবেলায় খাওয়াতো কে?”
“বেশ, খাওয়াও, হাতে চোট লেগে ভালোই হয়েছে তবে”।
“তুই তো নিজেই ছোট থেকে খেতে চাইতিস না। জানো নীরা,ছোট থেকেই সব একা করবেন উনি। দাদাভাই, দাদা-এরা সব আমার হাতে ছাড়া খেতো না – উনি ছোট থেকেই একা”।
“ঠাকুরপো, কী শুনছি সব?”
“বৌদিমণি, আমি একটু অদ্ভুত, এই নিয়ে মায়ের চিন্তার অন্ত ছিলো না – এখনো নেই। তবে এখন বদলাতে চাইছি। সেটা বুঝেই মনে হয় খাইয়ে দিচ্ছে”।
মণিপিসি খাবার প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলে সুহাসিনী খাওয়াতে শুরু করলেন।
“ছোট ছেলেটা হয়ে দায়িত্ববোধটা এসেছে, বুঝলে নীরা?”
অনুপম বললো, “নাহ, দাদাভাইকে দেখে। দাদাভাই সবার দায়িত্ব কেমন নিজের কাঁধে নিয়ে চলেছে দেখছি। তাই ভাই হয়ে এটুকু সাহায্য করতে চাইছি”।
সুহাসিনী কিছু বললেন না আর।ওনার অনির মতোই বাকি ছেলেরাও হোক,এটাই চেয়েছেন বরাবর।নীরা মনে মনে খুব খুশি হলো।
পর্ব – ৪০
ভোরে উঠেই নীরা জানলো আজ অনিরা গ্রামে যাচ্ছে। অনি, ডাক্তারকাকা, কাকিমণি। কাকাও উঠে পড়েছেন। উনি বাড়িতেই থাকবেন। ছোট ঠাকুরপো কাল রাতে এখানেই ছিলো। ঠাকুরপোও সবসময় বাড়িতে থাকবে। পরীকে,অনিকেতকে নীরাকে পাহারা দিতে। হঠাৎ বেড়িয়ে যাচ্ছে জরুরি কাজে এমন ভাব করেই বেরোচ্ছে সবাই। অনিকেত, পরী যেমন স্কুলে যায় – যাবে। কোন অস্বাভাবিকতা, উদ্বেগ আচরণে প্রকাশ পেলে চলবে না। কোথায় গেছে অনিরা, সেটা জানানো যাবে না – কাউকেই। নীরার একটু ভয় করলেও মনকে শক্ত করলো। এতে যদি বাবিনের খুনি ধরা পড়ে তাহলে তার থেকে ভালো কোন কিছুই হবে না। ডাক্তারকাকা বুদ্ধিমান মানুষ উনি যদি মনে করেন – রহস্যর উৎসস্থল গ্রাম – তবে তাই হবে। অনিরুদ্ধ যাবার আগে পই পই করে বলে গেছে – যদি কিছু মাত্র সন্দেহ হয় কারোর চলচলনে, সাথে সাথে ফোন করে জানাতে। ওরা রাত সাতটা থেকে আটটায় মধ্যে চলে আসবে তার বেশি দেরি করবে না।
অনিকেত স্কুলে যাবার সময় রেডি হতে হতে মামণিকে বললো।
“মামণি -বাপি, ঠাম্মা কই?”
“একটু বাইরে গেছে”।
“বাইরে কোথায়?”
ব্রেকফার্স্ট টেবিলে সার্ভ করেছিলো নীরা। কাকা, ছোট ঠাকুরপো খাচ্ছেন। পরী ঘুমচ্ছে এখন, ছেলেকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসালো নীরা। মণি পিসি চা করবেন, রান্নাঘরে।
“কোথায় গেছে?”
“ঠাম্মার বাপের বাড়ি”।
নীরা কিছু বলার আগেই অচ্যুত বললেন।
“কোথায় সেটা?”
“নর্থে, ঠাম্মার খুড়তুতো ভাই খুব অসুস্থ তো, দাদুভাই, তাই গেছে”।
“আচ্ছা, দাদুভাই, তুমি গেলে না? তুমি অসুস্থ, তাই?"
“ঠিক বলেছিস, তুই স্কুল থেকে ঘুরে আয়। আমি গল্প বলবো তখন – ঠাম্মার বাপের বাড়ির”।
“ঠাম্মার বাপের বাড়ি মানে তোমার শ্বশুর বাড়ি?”
অনুপম হেসে ফেললো। নীরা বললো, “ঠাকুরপো – দেখলে তো কেমন পাকা?”
“দেখছি তো তাই বৌদিমণি”।
অচ্যুত বললেন, “সমঝদার ছেলে আমার দাদুভাই। অনিও এমন ছিলো ছোট বেলায়”।
“বৌদিমণি – এটা মা, বাবার পছন্দের টপিক, তাদের অনি। আর তার ছোটবেলা, মাঝে যে বারো-তেরো বছর আলাদা ছিলাম – তখনও কথায় কথায় এই কথাটা শুনতেই হতো”।
অচ্যুত বললেন, “সে তো শুনতেই হবে, যে ভালো তার কথা মনে থাকে সবসময়। সে কাছে থাকুক আর দূরে থাকুক। বিলেতে গেছে পড়তে আমাদের বাবু, সে নিয়েও তোর মা কম চিন্তা করতো?”
“সত্যি, জেঠিমণিকে কোনদিন এত চিন্তা করতে দেখিনি, দাদাভাইকে নিয়ে”।
বলেই অনুপম বৌদিমণির দিকে তাকালো। কথাটা বৌদিমণি কীভাবে নেবে ……।
“ছোটখোকা, বৌদির আর ছোটগিন্নীর ব্যাপারটা পুরোই আলাদা। এই তো – মণিই দেখেছে ওর দুই বৌদিকে। মণি বল?”
মণিপিসি বললেন, “হ্যাঁ, তাছাড়া বড়বৌদি খোকন মারা যাবার পর থেকেই একটু কেমনতর হয়ে গিয়েছিলেন। সবসময় বাইরে বাইরে মন। অনিরও যত্ন নিতেন না। সব মা ঠাকুরুণ এর উপর ছিলো। ছোটবৌদি বিয়ে হয়ে না এলে অনিটার যে কী হতো ………”।
অচ্যুত মুচকি হাসলেন, “শুনলে, নীরা?”
“জানি তো, অনি এটা সবসময়ই বলে”।
অচ্যুত বললেন, “বিয়ের পরেই মা তোমার কাকিমণির কোলে অনিকে দিলেন। ব্যাস, ওখানেই অনির মা হয়ে গেল সে”।
অনুপম বললো, “দাদাভাইকে তুমিও কম ভালোবাসো না, বাবা। কেও না জানুক, আমি জানি”।
অচ্যুত হেসে উঠলেন, “সে বাসলেও – বাপেরা কবে নাম পেয়েছে? যত সুনাম তো মায়ে রাই নিয়ে নেয়”।
নীরা অনিকেতকে বললো, “ব্যাগ ঠিকঠাক গুছিয়েছিস তো?”
“হ্যাঁ, মামণি”
“চল, খাওয়া শেষ। কাকামণির সাথে স্কুল যা। আমি বোনকে তুলে পড়িয়ে নিই। তারপর রেডি করে স্কুলে পাঠাই”।
অনিকেত উঠে হঠাৎ অচ্যুতকে প্রণাম করলো, তারপর মামণিকে, কাকামণিকে করতে যাবে –
অনুপম বলল, “প্রণাম কেন বাবু?”
“মর্যামল সায়েন্স বলেছে বড়দের প্রণাম করতে হয় সকালে উঠে”।
“বড়দের?”
“না – গুরুজনদের”।
অনুপম বলল, “বৌদিমণি , তোমার এই ছেলে একদিন বাড়ির সবচেয়ে ভালো ছেলে হবে, দেখো, দাদাভাই – এর মতো ওরও উদাহরণ দেবে – সবাই”।
নীরা বলল, “তাই যেন হয়, ঠাকুরপো”।
নীরার বুক গর্বে ভরে গেলো।
পর্ব – ৪১
পরশু বিকাল থেকে অনেক ভেবেছে শাঁওলি। অনিদার কথাগুলো নিয়ে। এখনো কথা গুলো কানে বাজছে। ঐ বৌকে নিয়ে এত সেন্সিটিভ অনিদা! বাপরে! কী এমন খারাপ বলেছে শাঁওলি! মানসিক রগীকে মানসিক রুগী বলবে না তো কী বলবে? যে মহিলার নিজের আচরণ সংযত নয় সে অনিকেতকে মানুষ করবে কী করে? ফাদারকে একবার পুরো বিষয়টা আবার জানাবে ভেবেছিলো শাঁওলি। কিন্তু যদি অনিদা ফাদারকে অন্যভাবে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখে! পরশু থেকে তো অনিদার কাছে স্পষ্ট শাঁওলির দুর্বলতা। এসব নিয়েই ফাদারকে যদি কিছু বলে রাখে তবে এখন মুখ খুলতে গেলেই শাঁওলির বিপদ।অ্যাডপশন তো ক্যানসেল হবেই না – বরং শাঁওলির চাকরি যেতে পারে। অনিদা দাদাভাইকে বলবে ভেবেছিলো শাঁওলি। সেটাও বলেনি। তবে কি উপরে উপরে রাগ দেখাচ্ছে আর তলায় তলায় অনুরাগ? পুরুষ মানুষ নারকেলের মতো নয়। মা,বড়মা, বৌদিমণি সবাই বলে, উপরটা কঠিন-ভিতর নরম। অনিদার মনে ঠিক কি আছে। জানতে গেলে আরো কাছে যেতে হবে শাঁওলিকে। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন নীরা নামের ভদ্র মহিলা চিরতরে সরে যাবে। কিন্তু কী করে?
ভাবতেই চিঠিটার কথা মনে পড়ে শাঁওলির। দিন পনেরো আগেই অনিকেতকে পড়িয়ে ফিরে একটা চিঠি পেয়েছিলো শাঁওলি। ওর ব্যাগে ঢোকানো। সাথে একটা প্যাকেট, আগাছালো হাতের লেখায় চিঠিতে লেখা আছে – “অনিরুদ্ধ পেতে গেলে নীরাকে সরাতে হবে। নীরা তখনি সরবে যখন বাবিনের ক্ষতি হবে আর নীরা হবে খারাপ। ক্ষতি করতে প্যাকেট দেখো। বাবিনকে খাওয়াবে। বড় ক্ষতি হবে না। কিন্তু নীরার এ বাড়িতে থাকা শেষ হয়ে যাবে”। প্যাকেট খুলে দুটো লজেন্স পেয়েছিল নীরা মোড়কে মোড়া। তার মধ্যে কী আছে তা নিয়ে তখন মাথা ঘামায়নি। কারোর মস্করা ভেবেছিলো এটাকে। অথচ কাউকে বলেওনি। আজ ভাবছে শাঁওলি। মন দিয়েই ভাবছে। যে লিখেছে তার যুক্তির অভাব নেই। অনিদার আগের বাচ্চাটা মারা গেছিলো বলে নীরার এই অবস্থা, এবার তাই অনিকেতকে কারোর কাছে ঘেষতেই দে না। সর্বক্ষণ আড়াল করে রাখে। তার মধ্যেই যদি অনিকেতের কিছু হয় – তবে নীরার নজরদারিরই দোষ হবে। মহিলার অহংকার, দম্ভ ভাঙ্গবে, পাগল মহিলা তবে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে আসবে এসাইল্যামই যাবে। শাঁওলি সেই জায়গায় নিজেকে বসাতে পারবে, সহজেই।
লজেন্স দুটো স্কুলে আজ নিয়ে এসেছে শাঁওলি। টিফিনে অনিকেতকে পেস্ট্রি, চকোলেট, কেক খাওয়ায় ও। শুধু কালকেই রাগ করে খাওয়ায় নি। বকেওছে। আজো তাই মিসকে দেখে জড়োসড়ো হতে নিয়ে দেখলো শাঁওলি। বড়ো কোন ক্ষতি হবে না লিখছে, যদি মরে যায়? না, না, সেরকম কিছু হবে না। তবে কি একটা লজেন্স খাওয়াবে? অনিকেতকে শাঁওলিও ভালোবাসে। বড় ক্ষতি হোক চায় না। শুধু এটা চায় ঐ মহিলার অপদার্থতা ধরা পড়ুক। ছেলে মাত্র দুনম্বর কম পাওয়াতে ঐরকম অপমান করেছিলো মহিলা। এবার নিজে অপমানিত হোক। আগলে, দেখে না রাখতে পারার অপরাধে।অনিদার কলজের টুকরো এই ছেলে। এর কিছু হলে অনিদা কাউকে ছাড়বে না কাউকে না। সেই সুযোগে সুহানুভুতি দেখিয়ে মুখার্জী বাড়িতে ঢুকবে শাঁওলি, বৌ হয়েই ঢুকবে, এতো কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি সামনে পড়ে থাকতে নেট দিয়ে প্রফেসর হবে শাঁওলি। হা!হা! বৌদিমণি ও ভালো বলে। প্রফেসরির সামান্য টাকায় শাঁওলির উচ্চাকাঙ্খা মেটার নয়। ও যা চায় তা একমাত্র হতে পারে মিসেস শাঁওলি অনিরুদ্ধ মুখার্জী হলে, তবেই। মোবাইলে অনিদার ছবির ফোল্ডারটা খুললো শাঁওলি। চুমু খেলো ছবিতে অনেক করে, অদ্ভুত ভালো লাগছিলো ওর, অদ্ভুত।
“কাল টিফিনে ডাকোনি”।
অনিকেত এসে প্রথমেই এই কথাটি বললো। শাঁওলি কান ধরলো।
“সরি”।
“এমা! তুমি তো বড় – মিস”।
“বড়রাও ভুল করে, তো”।
“কী এনেছো আজ?”
“আজ – কেক, লজেন্স দুটোই আছে। কোনটা আগে খাবি”।
“কেক”।
“তোর টিফিন?”
“ক্লাসে ভাগ করে খেয়ে নিয়েছি”।
“গুড বয়, এখন কেকটা খেয়ে না দেখি”।
অনিকেত খেয়ে নিলো।
“কাল ডায়েরির লেখা দেখে বাড়িতে কি বললো?”
“মামণি কানমলা দিয়েছে। বলেছে আর এমন হলে মারবে”।
শাঁওলি হাসলো।“তোমার জন্য কানমলা খেলাম আর তুমি হাসছো?”
শাঁওলি অনিকেতকে চুমু খেলো, দুগালে।
“লজেন্স?”
“দিচ্ছি”। শাঁওলি একটা লজেন্স দিলো, অনিকেত খেয়ে নিলো।
“কেমন খেতে?”
“ভালোই তো অন্যরকম। আর আছে গো?”
শাঁওলি একবার দেবে ভাবলো – তারপর বললো। “না, কাল দেবো”।
“আচ্ছা”। “ক্লাসে যা”
“ওকে মিস”। “বাই”। “বাই”।
পর্ব – ৪২
বাগদেবীপুর গ্রামে এসে রুদ্র, অনি, সুহাসিনি বুঝেছিলেন – খবর একদমই সঠিক। মুখার্জীদের বড় তরফের অবস্থা পড়তির দিকেই। ভাঙাচোরা পলেস্তরা খসা বাড়িতেই থাকে সবাই – অচ্যুতের জেঠার দুই ছেলে, সুপরিবারে। দুই জনেরই দুটো করে ছেলে,একটা করে মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেদেরও। পরের প্রজন্মের চারছেলের মধ্যে বড় তরফের দুজনের মেয়ে, একটা করে, ছোট তরফের একজনের মেয়ে, ছোট জনের ছেলে। মাস সাতেকের। বাড়িতে দূর্গা দালান আছে। অনিদের বিক্রি করে যাওয়া অংশটা জরাজীর্ণ। জঙ্গল গজিয়ে গেছে। বহুদিন এরা হাত দেয় না। ভিতরে সাপখোপ থাকবেই। সদর ফটকের ডান ধারেই চাকরবাকরদের ঘর ছিল।এখন সেখানকার পুরোটাই দখল করে থাকে মণিপিসির ভাই বিপ্লব আর বৌ ছেলে মেয়ে। গ্রামের বাজারে মুদির দোকানও করেছে সে। গ্রামের বাজার থেকে বাড়ি অবধি পথ দেখিয়ে সে-ই নিয়ে এলো। অনিদের এই গ্রামে যা কিছু জমি এই বিপ্লবই দেখে রাখে।
অনিদের হঠাৎ আসতে দেখে ওরা অবাক। তবুও আপ্যায়ন করেছে।সকালে জলখাবার, দুপুরে মাছ ভাত, গ্রাম ঘুরিয়ে দেখালো, নদীর ধার, পুকুর পাড়, জমিজমা – সবই ঘুরিয়েছে বড়তরফের ছোট ছেলে অসীম। অনিদের জমি জিরেতও দেখিয়েছে। বিপ্লব ওখানে চাষ করে। অসীমেরর দাদা অসিত গ্রামের স্কুলেই প্যারাটিচার। তাকে স্কুলে যেতে হলো। ছোট তরফের দুই জনের বড় একজন মালদা থাকে। ওখানে বিডিও অফিসে কাজ করে। আর ছোটজনের চানাচুর কারখানা। সদ্য শুরু করেছে। ওরই যা দুপয়সা হচ্ছে। সংসার এখনো যৌথ। অসীমই জমি জিয়েত, পুকুর দেখাশোনা করে, বাকি অসিত, অভিজিৎ, অনিল নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। বৌ, ঝিরা সবাই বাড়িতেই থাকে। তারা গ্রাম্য, শহুরে সুহাসিনীকে দেখে তাদের পলক পড়ছিলো না। অসিত, অসীমের বাবা অক্ষয় অচ্যুতেরই বয়সী। ছোটজন অবিনাশ বছর দুয়েকের ছোট। অক্ষয় তো বলেই ফেললেন,
“তোমরা এখানে এসেছ, একসাথে বসে গল্প করছো, খাচ্ছো – ভাবতেই পারছি না। মায়ের মুখে শুনেছি আমাদের ছোটকাকা অমিতদা ছোট থাকতেই সেই যে চলে গেলেন ………”।
অমিত অনিরুদ্ধর বাবার নাম।
“হ্যাঁ, কলকাতায় ব্যবসা জমে গেলো ঠাকুরদার … আর বসবাস করতে এখানে ফেরেননি”।
“শুধু ব্যবসা নয় – অভিশাপের ভয়ও। শুনেছি আমাদের বড়দার মারা যাওয়াটা কাকাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। অভিশাপটার সামনে নিজের সন্তানদের ফেলতে চাননি”।
“অভিশাপ? কিসের অভিশাপ?”
রুদ্রদেব জেনেও না জানার ভান করলেন।
“ঐ একটা গ্রাম্য বিশ্বাস, এক তান্ত্রিক নাকি আমার ঠাকুরদার বাবাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন – প্রজন্মের প্রথম পুত্র সন্তান – মারা যাবে, কিছুটা বড় হয়েই। মুখে রক্ত উঠে নাকি সেই মৃত্যু হবে। দাদার পর যদিও এমন মৃত্যু আর হয়নি এখানে – তার না?”
অবিনাশ বললেন, “না, তা হয়নি”।
সুহাসিনী বললেন, “শুধু কী অভিশাপ, নাকি তন্ত্রমন্ত্র এসবও?”
“তখন এরকম একটা কানাঘুঁষো ছিলো যে ডাইনে মেরেছে। এই গ্রামে ডাইন চর্চাও হতো তখন,কিন্তু …”, বলেই থমকালেন অক্ষয়।
দরজার দিকে দেখলেন।
“কিন্তু?”
“মন্দিরের পুরোহিত মানে বিপ্লবের বাবা উধাও হয়ে যেতেই তন্ত্র চর্চার আর প্রমাণ পাওয়া যায় না গ্রামে”।
অনিরুদ্ধ বললো, “মানে মণিপিসির বাবা? উনি তন্ত্র করতেন নাকি?”
“ঠিক ঠিক। মণির বাবা। মণি তো সেই ছোট থেকেই তোমাদের ওখানে থাকে। মাঝে মাঝে এখানে আসে ন মাসে ছ মাসে”।
“উনি তন্ত্র করতেন?”
“শোনা কথা, তন্ত্র না, ডাইন চার্চা, তোমার ডাকিনী বিদ্যা বল যাকে। সেই পাগল পুরোহিত উধাও হয়ে যাবার পর – আর ডাইন চর্চা হয় না এখানে”।
সুহাসিনী বললেন, “কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল কি – ডাইন সন্দেহে?”
অক্ষয় অবিনাশ দুজনেরই মুখের রং বদলে গেল।
“কে বলেছে?”
“আমরাও শুনেছি – শাশুড়ির মুখেই”।
ইচ্ছা করেই মণির কথাটা বললো না সুহাসিনী।
“না, না – অপবাদ ওটা”, অক্ষয় বললেন।
“ওহ”।
“মণির মা রাধুনী বামণী ওর বাবাকে খুঁজে না পেয়ে রটিয়েছিলো যে পুরোহিতকে আমার বাবা লেঠেল দিয়ে মেরে দিয়েছেন – ডাইন অপবাদ দিয়ে। দাদাকে ওর বাবাই তন্ত্র করে মেরেছিলো এটা আমার বাবা সন্দেহ করেছিলেন বটে, তবে আমরা সেসব মানি না। পরে কোন প্রমাণ উদ্ধারও হয়নি। পুরোহিত এখনো পুলিশের খাতায় নিখোঁজ”। "বাবা তো বটেই আমরাও এখন মানি পুরোহিতের সাথে সেই তান্ত্রিকের শিষ্যপরম্পরায় কোন যোগ ছিল নিশ্চয়। ওই তান্ত্রিকের ডাকেই চলে গেছে”।
সুহাসিনী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রুদ্রদেব থামালেন।
“থাক। অত পুরনো কথা ঘেঁটে কী হবে”।
“ঠিক তাই, বরং অসীমের সাথে নদীর ধারটা ঘুরে এসো। থাকবে তো আজ সবাই?”
“না, না, ফিরতে হবে”।
“আচ্ছা, তা হলে বিকাল বিকাল রওনা দেওয়াই ভালো”।
“একদম”। অনি উঠে দাঁড়ালো।
“আচ্ছা কাকা, আমার ঠাকুরদা কি কখনোই ফেরেননি এখানে?”
“এক দুবার এসেছিলো। মণিকে নিতে একবার, মনে আছে”।
“ঠাকুমা আস্তে চাইতেন – ঠাকুরদা আসতেন না। আমাদের বাবা, কাকাকে, আমাকে আসতে দেননি ………”।
অবিনাশ বললেন, “লোকে বলে,কাকার নাকি মেয়ে ছেলে নিয়ে সমস্যা হয়ে ছিলো একটা, গ্রামেই। অভিশাপের ভয়ে না – কোন মেয়ে মানুষের পেট বেঁধে গেছলো বলেই ………”।
অনিরুদ্ধর কান লাল হয়ে গেলো।
“মেয়ে মানুষ কে? কোন গ্রামের মেয়ে,নাকি চাকরানী?” রুদ্রদেব জিজ্ঞাসা করলেন।
“অমূল্য মুখার্জীর কেচ্ছা তো পুরো বাগদেবীপুর নয়, পুরো বীরভূম জানে”।
অক্ষয় বললেন, “তোমার ঠাকুরদা, কি আর বলি। তবে শুনেছি মেয়ে মানুষ পটাতে সময় লাগতো না একদমই”।
সুহাসিনী বুঝলেন কেন শাশুড়ীমা অনুপমকে অপছন্দ করতেন। ঠাকুরদার মতো দেখতে আর স্বাভাব – প্রায়ই বলতেন।
“দশ বিশ গ্রামে এমন কোন সুন্দরী মেয়ে ছিলো না যাকে অমূল্য পেয়ে ছাড়েননি”। অক্ষয় হাসলেন।
“আমার বাবা অখিল মুখার্জী অবশ্য অন্য ধরণের ছিলেন। মেয়েছেলেতে ……”।
“তোমার বাবারও তো শুনেছি রাঁধুনি বামণির সাথে……”।
অক্ষয়ের বৌ মুখ খুললেন।
“আঃ ওসব রটনা, ঘর দখলের জন্য। রাঁধুনি বামনি তো এই করেই পুরো চাকর মহলটা দখল করে নিলে! ”।
“রাঁধুনি বামনি মানে মণিপিসির মা?”
“হ্যাঁ – বর নিরুদ্দেশ, দুশ্চরিত্র মেয়েছেলে আমার বাবার নামে অপবাদ দিয়ে ………”।
রুদ্র বুঝলেন আর কথা বাড়ানো ঠিক নয়।
“তাহলে নদীর ধারেই যাই, নাকি”।
“একদম”।
চারটে নাগাদ নীরার ফোন পেয়ে অস্থির হলো অনিরুদ্ধ, বাবিনের পেট খারাপ? জ্বর এসেছে? বার বার পায়খানা করছে? পেট ব্যথাও ……”।
রুদ্র ফোনটা চাইলেন, “নীরা – কী হয়েছে?”
“কাকাবাবু স্কুল থেকে এসেই ছেলেটা পেট ব্যথা বলছিলো, এখন তিনবার পটি গেলো। খুব গন্ধ, জ্বরও এসেছে। মাথাব্যথা নাকি”।
রুদ্র বললেন, “নীরা – যা বলছি শোনো, এক্ষুনি আমি একটা নাম্বার দিচ্ছি। আমার বন্ধু প্রদীপ্তর। নামী পিডায়াট্রিশিয়ান। ওর ঠিকানাটাও আমি তোমাকে দিচ্ছি। ফোন করে চলে যাও বাবিনকে নিয়ে এখনি”।
“এখনি?”
“হ্যাঁ এখনি, একমুহুর্তও দেরি করবে না। আমি ফোন করে দিচ্ছি”।
ফোন কেটে ফোনটা অনিরুদ্ধকে দিয়ে নিজের ফোন থেকে ডায়াল করা শুরু করলেন।
“রুদ্র, কী হয়েছে। বাবিনের কি হয়েছে?” সুহাসিনী অস্থির হলেন।
“হ্যালো, প্রদীপ্ত, তুই ক্লিনিকে তো? ওকে, আমার নাতিকে নিয়ে যাছে আমার বৌমা – হ্যাঁ অ্যাবডোমিন্যাল ক্র্যাম্প, ডায়েরিয়া, হেড এক – হুম …… তোকে তো বলে রেখেছি আমার সন্দেহটা – হ্যাঁ – ইমিডিয়েটলি ল্যাভাজ করে অ্যান্টিডোট দে ………। হ্যাঁ আমি শিওর – তাও তুই দেখে নে”।
“কাকাবাবু – কী হলো ………।“
“অনি, যেতে যেতে বলছি – ফিরতে হবে আমাদের, এখনি”।
অসীম অবাক হচ্ছিলো, “চা না খেয়েই”।
“হ্যাঁ, অসীম তুমি ছুটে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে দাও”।
গাড়িতে উঠে কিছুটা গেছে ওরা, হঠাৎ সামনে বিপ্লব পড়ল। সাইকেলে আছে সে। অনিরুদ্ধ খেয়াল করলো ও হাত নেড়ে জানলা নামতে বলছে”।
“বলো……”।
“চলে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ”।
“কী বললো ওনারা?”
“কীসের কী?”
“ওদের বাপ সাধুপুরুষ তাই না? আর আমার মা বেবুশ্যে। তাই তো?”
“কী বলতে চান?”
“বলতে চাই – ওদের বাপ আর আমার বাপ এক – তাই থাকতে দিয়েছে – অংশও দিয়েছে”।
চমকে ওঠে অনিরুদ্ধ, খেয়াল করে বিপ্লবের শার্টের ফাঁক দিয়ে গলার রুদ্রাক্ষর মালা দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো টকটকে লাল, মদ খেয়েছে? নাকি ও – ও কি তন্ত্র সাধনা করে!
“মণিপিসির বাবা তবে হারিয়ে যায়নি ?”
বিপ্লব হো হো করে হাসে।
“মণিপিসির বাবা! ভালো বললেন তো! মণিপিসির বাবা কে? যাক গে – আমার মায়ের বর – রাধুনী বামনীর বর হারিয়ে যায়নি। পিটিয়ে মেরে দিয়েছিলো এরা, ডাইন অপবাদে। বড় কর্তার বড় ছেলেকে মেরে ফেলার অপবাদে। অথচ রাগটার কারণ অন্য ছিলো। পুরোহিত লোকটা আলা ভোলা হলেও জেনে গেয়েছিল বড়কর্তা আমার মা’কে জোর করে ভোগ করার ফল আমি – আর পোয়াতি মা’কে সে জমিদারের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে গ্রামের লোকের সামনে নিয়ে যাবে ঠিক করেছিল – আর আগের তিনমাস তো লোকটা বাড়িই ছিলো না – উধাও ছিলো – আর মা তিনমাসেরই পোয়াতি ……… জমিদারবাবু এক মানসম্মানের ভয়েই পিটিয়ে মেরে দেয় লোকটাকে, লেঠেল দিয়ে। আর রটিয়ে দেয় যে লোকটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে”।
“তোমাদের মারলো না কেন? বাঁচিয়ে রাখলো যে?” রুদ্রদেব বলেন।
“রাধুনি বামনীর রুপের জোলুস বড়কর্তার চোখে লেগেছিল যে”।
বিপ্লব অদ্ভুতভাবে হাসলো।
“পিটিয়ে মেরেছিলো? ঠিক জানো?”
বিপ্লব কাশলো, “আমি তো পেটে তখন তবে সাক্ষী আছে, নিজে চোখে দেখা সাক্ষী। সে জীবিত আছে। আমার মা নয়, সে মরেছে, আরো একজন আছে”।
“কে সে?”
বিপ্লব হাসলো, “সব আমি বলে দিলে আপনারা কী খুঁজবেন – ডাক্তারবাবু? বাড়ি যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন – যান। এখানে আর ফিরবেন না কোনদিন। চেষ্টাও করবেন না”।
বিপ্লবের কথায় এমন কিছু ছিলো গাড়ির সবাই চুপ হয়ে গেলো।
পর্ব – ৪৩
নীরা নার্সিংহোমে নিয়ে পৌছলো অনিকেতকে। ডাক্তার প্রদীপ্ত ভর্তি হতে বলেছে। ইমিডিয়েটলি। অনিদের ফিরতে ঘন্টা তিনেক এখনো। ছেলের পেট ব্যথা, পায়খানা থামছেই না। অনুপম গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে। চালিয়ে না – উড়িয়েই বলা যায়। সাথে কাকাও আছেন। পরীকে কাকা কোলে করে রেখেছেন। বাড়ির দোতলার কোলাপসিবল লক করে এসেছে সবাই। এতো জল বেরিয়ে যেতে নেতিয়ে পড়েছে ছেলেটা। কষ্ট পাচ্ছে। ভর্তি হয়ে গেলো অনিকেত। ডাক্তার কাকার রেকমেন্ডম্পন ছিলো। কেবিনে দিয়ে দিলো। নীরা জুনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারবাবুকে বললো,“কী হয়েছে – ডাক্তারবাবু? ওষুধে থামছে না কেন?”
“দেখছি”।
“প্লিজ দেখুন”।
“চিন্তা করবেন না মিসেস মুখার্জী। সবরকম চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছি আমরা”।
“আমি থাকবো তো? ওর পাশে?”
“হ্যাঁ – অবশ্যই, আপনি তো মা – থাকবেন তো বটেই”।
“ডাক্তারবাবু – আমি একটা ছেলেকে হারিয়েছি। হারিয়ে ওকে পেয়েছি। ওকে হারাতে চাই না। কোন মুল্যেই নয়”। নীরা বললো।
অনুপম বৌদিমণিকে দেখছিলো। বৌদিমণি বাবিনের সময় কান্নাকাটি করছিলো খুব। সামলানো যাচ্ছিলো না। আজ বৌদিমণিকে খুব শান্ত মনে হচ্ছে। খুব ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। অনুপম এতো ঠাণ্ডা থাকতে পারছে না। যদি কিছু হয়ে যায় ছেলেটার নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে অনুপম? ওর অপরাধ কী ক্ষমা করার মতো?
“কী নাম আপনার ছেলের?" ডাক্তার বললেন।
অনুপম তাকালো নীরার দিকে। বৌদিমণিই একমাত্র যে অনিকেত বলে। বাবিন শব্দটা ব্যবহার করে না,এখনো। এখন কী বলে সেটা শুনতে চায়।
“মামণি………।“। অনিকেত ক্ষীন কন্ঠে ডাকলো।
নীরা ওদিকে ঝুকলো,
“হ্যাঁ, বাবিন, বলো। পেট ব্যথা করছে বাবা?”
“বাবিন বলল, মামণি?”
অনুপম ছেলেটার চোখে এতো কষ্টের মধ্যেও আনন্দ দেখে।
“তুই-ই তো বাবিন, আর কেউ না তো”।
“বৌদিমণি”! অনুপম অবাক হয়। অনিকেত কষ্টের গলায় বলে, “দাদা…”।
“না, তুই-ই বাবিন, আমার সোনা, আমার সব ………”।
“টয়লেট ……”।
নীরা বললো, “ডক্তারবাবু?”
“নিয়ে যান …………”।
টয়লেটে নিয়ে গিয়েই চিৎকার করে উঠলো নীরা।
“ঠাকুরপো!”
অনুপম ছুটে গেলো। “কী হয়েছে বৌদিমণি?”
“রক্ত – রক্ত বেরোচ্ছে ……….।। আবার রক্ত বেরোচ্ছে ………”।
নীরা আর পারলো না, কেঁদে ফেললো এবার। আর পারলো না ও।অনুপম দেখলো, হ্যাঁ, ইউরিনের সাথে রক্ত বেরোচ্ছে। বাবিন – বাবিনেরও তো – পড়ে যেতে যাওয়া নীরাকে একহাতে আঁকড়ে ধরলো অনুপম …… আর ভাবতে পারলো না।
“আর কতক্ষণ?”, অনিরুদ্ধ ড্রাইভারকে বললো।
“জ্যাম না থাকলে মিনিট চল্লিশ স্যার”।
“কাকাবাবু ………”।
“বল”।
“খোঁজ নিলে?”
“হ্যাঁ, ভর্তি হয়েছে, স্যালাইন চলছে। স্টমাক ওয়াশ হয়েছে ওষধ চলছে। আন্টিডোট – ও পড়েছে বিষের”।
“বিষ!”। সুহাসিনী বললেন।
“হ্যাঁ, আর্সেনিক, যাকে তোমরা সেঁকো বিষ বলো”।
“কী বলছো – রুদ্র?”
সুহাসিনি রুদ্রদেবের হাত আঁকড়ে ধরলেন।
“উতলা হয়ো না, আমি জানতাম – এটাই দেবে – এবারো”।
“কে দেবে? এবারো মানে?”
“মানে আগের দুবারো এই বিষই দিয়েছে খুনী”।
“অনির দাদা আর বাবিন?”
“হ্যাঁ’।
“কে দিলো?”
“দেয়নি, তার এবার দেবার উপায় নেই। দিইয়েছে কাউকে দিয়ে”।
“উপায় নেই? কেন?”
“কারণ সে বাড়িতে, বাড়িতে বাবিন নীরার হাতেই খেয়েছে। আর কারোর হাতে নয়”।
“তাহলে?”
“যাতায়াতের পথে বা স্কুল”।
“অনুপম ছিলো যাতায়াতের পথে”।
অনিরুদ্ধ বললো, “ঠিক। তাই যাতাযাতের পথ বাদ”।
“অনুপমকে সন্দেহ করছো না?”, সুহাসিনী বললেন। সুহাসিনির কথায় রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন।
“নাহ, ও দুষ্টু।খুনী নয়। আর বাবিনের কোন ক্ষতিও করবে না, নিশ্চিত থাকো”।
“নীরা ফোন করছে কাকাবাবু একটু দাঁড়াও”।
“কথা বলে নে”।
“বলো – ব্লাড আসছে না আর ইউরিনে? আচ্ছা। পায়খানাও একটু ধরেছে? নাকে নল দিয়ে ওয়াশ করেছে এসেই – আর সেটা টেষ্টে পাঠিয়েছে?ব্লাড স্যাম্পেলও নিয়েছে? ওহ, বাবিন কষ্ট পেয়েছে ওয়াশ করতে গিয়ে? কেঁদো না নীরা …… এটা ওর ভালোর জন্যই। ওষুধ পড়েছে। আমরা আসছি সোনা, তুমি ছেলের কাছে থাকো। তোমার বাবিন ক্লান্ত খুব? ঘুমোচ্ছে? আচ্ছা – তুমি বাবিনের পাশে বসো। আমি আসছি। কিছু হবে না আমাদের বাবিনের। আসছি আমি”।
অনিরুদ্ধ ফোন রেখে চোখ মুছলো।
“অনি – শক্ত হ বাবা”।
“কাকিমণি – একজনকে হারিয়েছি, এই ছেলেটাকে নিজেদের সুবিধার জন্য তুলে নিয়ে এসেছি।নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া আমার দায়।আমার উপর রাগের জন্য,মুখার্জী বংশের উপর রাগের জন্য যদি এই নিরপরাধ ছেলেটা বলি হয় ……………”।
“ও মুখার্জী বাড়ির ছেলে, অনি। তোর ছেলে। অন্যরকম কিছু ভাবিস না। দায় দিস না নিজেকে। ওকে অপরের ভাবিস না”। রুদ্রদেব বললেন।
“আমি ওভাবে বলত চাইনি কাকাবাবু। যা অভিশাপ, যা পাপ আমার উপর দিয়েই যাক না । উৎসবের উপর একবার – অনিকেতের উপর একবার”।
“উৎসবকে এই অভিশাপের হাত থেকে বাঁচাতেই অচ্যুত নামের আদ্যাক্ষর পাল্টেছিলো মনে হয়”। রুদ্রদেব বলেন।
সুহাসিনী বললেন, “হতে পারে। গ্রামে গিয়ে যা দেখলাম – শুনলাম ………”।
ইশারায় ড্রাইভারকে দেখালেন রুদ্রদেব। সুহাসিনী থামলেন।
“তখন থেকে ছেলেকে লুকিইয়ে চোখের জল ফেলছ। এসো – একটু কাঁধে মাথা রেখে শোও। ল্যাভাজ, আই মিন ওয়াশ হয়ে গেছে। ব্লিডিং থেকেছে – চিন্তা নেই আর”।
সুহাসিনী রুদ্রদেবের শার্ট দুহাতে আঁকড়ে ধরলেন।
“ঠিক বলেছো তো , রুদ্র?”
“হ্যাঁ, ভরসা করো তো আমায়? তাহলে চুপ করে বিশ্রাম নাও। কাঁধে মাথা রাখো”। সুহাসিনী রাখলেন।
“অনি…”।
“হ্যাঁ, কাকাবাবু?”
“কিছু হবে না, কাঁদিস না বাবা, ধৈর্য্য রাখ”।
অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো,
“মা – তুমি কেঁদো না। শুয়ে পড়ো”।
সুহাসিনী রুদ্রদেবের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলেন।
পর্ব – ৪৪
ঘুম ভেঙ্গে, চোখে খুলে তাকাতেই অনিকেত দেখলো, মামণি ওর মাথার কাছে বসে আছে। বাপি ঘরে কোণায় সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। পাশে ঠাম্মা। ডাক্তার দাদুভাই ঘরে পায়চারি করছে। আর ছোট কাকামণি দরজার পাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কটা বাজে, ঘড়ি দেখতে চাইলো অনিকেত – বাইরে রোদ, নাকি? সকাল হয়ে গেছে – নাকি বিকাল ………”।
“মামণি……”। কোন ক্রমে বলে উঠলো অনিকেত ।
“বাবিন ……… অনি, কাকিমণি, কাকাবাবু ……… জ্ঞান এসেছে …………”।
“ক’টা বাজে?”
“বিকাল চারটে ………”, রুদ্রদেব বললেন।
“বাবিন – তুই অত ভাবিস না সোনা ……… ডাক্তারকাকা, ও কিছু খাবে এখন?”
“এখন না নীরা, ডাক্তার দেখুক, তারপর”।
“আউট অফ ডেঞ্জার তো?”
অনিরুদ্ধ বললো, “মনে হয়। দাঁড়া, ডাক্তার ডেকে আনি”।
ডাক্তার প্রদীপ্তর কেবিনে ছিলেন সুহাসিনী,অনিরুদ্ধ, অনুপম। রুদ্রদেব আছেন। অচ্যুত গেলেন। অতীন এসেছে। অতীন আর অতীনের বৌ জিনা পরীকে নিয়ে নীরার কাছে আছে।
“তুই ঠিক ছিলি রুদ্র। আর্সেনিক পয়জনিং”।
“রিপোর্ট এসেছে?”
“হ্যাঁ, এই দেখ। খাবারের সাথেই”।
“স্ট্রেঞ্জ”!অনুপম বললো”।
“কাল সকালে বাবিন বৌদিমণির নিজের হাতের রান্না বৌদিমণির হাতে খেয়েই স্কুলে গেছে”।
“অত সকালে নয়, ইনজেশন হয়েছে সকাল দশটা নাগাদ”।
অনিরুদ্ধ বললো, “মাই গুডনেস!স্কুলে তাহলে। স্কুলে পয়জনিং?”
“টিফিন?”
“টিফিনও নীরার আই মিন ওর মামণিরই বানানো ছিলো – তাই তো অনুপম?”
“হ্যাঁ, স্কুলে আর কিছু খায়নি তো? কারোর থেকে?”
সুহাসিনী বললো, “ওর মামণির তো মানা করা আছে – কারোর থেকে কিছু না খেতে”।
“তাও তো, বাচ্চা ছেলে – খেয়ে ফেলতেই পারে”।
“আগেও সুস্থ হোক, রুদ্র, তারপর জিজ্ঞাসা করা যাবে”, সুহাসিননী বললেন।
এখন আর পেট ব্যথা নেই, পটিও হচ্ছে না তেমন। সন্ধ্যা থেকে দু’বার গেছে অনিকেত। পুরো সেরে গেলে তবেই নাকি খেতে দেবে। নতুন ডক্তার দাদুটা বলেছে।মামণি ঠায় বসে আছে, কিছু খাচ্ছে না। ও খেলে তবেই খাবে, ঠাম্মা বলে বলেও খাওয়াতে পারেনি। বাপি সোফায় বসে আছে। চুপচাপ।
বোনটা ঠাম্মার কোলে ঘুমোচ্ছে। ওর মা বাবা ওকে নিয়ে যাবে বলছিলো কত করে! গেলই না। সারাক্ষণ দাদাভাই, দাদাভাই করে ফোঁপাচ্ছে। দাদাভাইকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। বোনটার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেরে উঠে বোনকে অনেক করে আদর করে দেবে অনিকেত। দাদুভাইওকে নিয়ে ডাক্তারদাদু বাড়ি গেলো। দাদুভাই অসুস্থ তো তাই। ডাক্তারদাদুর বাড়ি, কাছেই ওটা। দাদুভাইকে রেখে নাকি আবার আসবে ডাক্তারদাদু। কাকামণিও সেই থেকে অন্য একটা সোফায় বসে কী সব ভাবছে। ওর ফামিলিতে সবাই খুব ভালো। ওকে কত ভালোবাসে। মামণিও ওকে বাবিন বলেছে। কাল থেকে বলছে। এত কষ্টের মধ্যেও অনিকেতের আর কোন কষ্ট নেই তাই।
“বাবিন…”। মামণির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো অনিকেতের।
“সোনা – ডাবের জল এনেছে বাপি – খাও”।
“খাওয়া যাবে?”
“যাবে, ডাক্তারদাদুই বলল খেতে”।
অনিকেতকে উঠে বসতে সাহায্য করে নীরা।
“মামণি – তুমি খাও আগে”।
“কেন, পাগল?”
“তুমিও তো না খেয়ে আছে, আমার জন্য”।
নীরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। অনিরুদ্ধ নীরার মাথায় হাত দেয়।
“কেঁদো না। তোমার বাবিন তোমায় কত ভালোবাসে দেখেছো?তুমি একটু খাও। ও পুরোটা খেয়ে নেবে”।
“আমি অন্যায় করেছি অনি ………… এতদিন ……… ওকে বাবিন না মেনে ………”।
“ওসব থাক। বাবিন – এইতো, মামণি খেলো ……… এবার তুই -ও যা”।
ডাবের জল খেতে থাকলো অনিকেত।
“সেদিন টিফিনে কী খেয়েছিলি সোনা?, নীরা বললো?
“টিফিনটাই তো, মামণি”।
“আর?”
অনিকেত ভাবলো “আর …… ও হ্যাঁ-মিস কেক দিলো ………”।
“কেক?”
অনিরুদ্ধ বলে। “সে ও আগেও খেয়েছে শাঁওলির থেকে “।
নীরা বললো, “আর কিছু, বাবিন?”
“হ্যাঁ, মামণি, লজেন্স একটা। ভারী অন্য রকম খেতে”।
নীরা অনিরুদ্ধ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। “অন্যরকম – কেমন?”
“জানি না, দুটো ছিলো। আর একটা পরদিন দেবে বলেছিলো”।
অনিরুদ্ধর বোঝা হয়ে গিয়েছিলো যা বোঝার। শাঁওলির হাত দিয়েই বিষটা দেওয়া হয়েছে – কিন্তু কে দিয়েছে? কাকাবাবু বলতে হবে, কথাটা।
“এত জটিলতা!” অচ্যুত মাথা ধরে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ।
“হ্যাঁ, তোর জেঠার অবৈধ সন্তান বিপ্লব। আর তার মায়ের স্বামীই হল সেই ডাইন অপবাদ প্রাপ্ত পুরোহিত। যে তোর জেঠার ছেলেদের ভাষায় নিখোঁজ। বা বিপ্লবের মতে যাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে”।
“সাক্ষী?”
“জীবিত সাক্ষী আছে – বললো তো”।
“কে?”
রুদ্রদেব হাসলেন, “কার মুখে প্রথম এই ডাইন সন্দেহে পিটিয়ে চাকর মারার কথা শুনিস?”
“মণি”।
“হ্যাঁ, তার তিন-চার বছর বয়স তখন। কিন্তু আস্ত মানুষকে পিটিয়ে মারার মত বীভৎসতা দেখলে মনে থাকার কথা”।
“তাহলে বাবা না বলে চাকর বললো যে!”।
“কারণ ওর বাবা ডাইন ছিলো সেটা জানতে দিতে চায়নি”।
“কেন?”
“তাতে ওর ডাইন বিদ্যার উত্তরাধিকারটা প্রকাশ পেয়ে যেতো অচ্যুত”।
“কী বলছিস!! মণি!”
“হ্যাঁ, তুই জানলা দিয়ে রাতে যাকে দেখেছিলি – সে মণিই”।
“বাবিন যাকে দেখে ভয় পেয়েছিলো সে-ও?”
“হ্যাঁ”।
“কিন্তু কাকাবাবু, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। বাবিন যেদিন এভিল দেখে মণিপিসি সেদিন বিকালেই গ্রামে যায়”।
রুদ্রদেব হাসেন, “অনি-বিকালে যায়নি। আমি গ্রামে গিয়ে বিপ্লবের বৌ – এর থেকে জেনে নিয়েছি তার ননদ শেষ কবে এসেছিলো – সে বলেছে মাস দেড়েক আগে। সন্ধ্যাবেলায় কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলো না – সকাল বেলায়।যাওয়াটা চোখে ধুলো ছিলো। বিকালে বেরিয়ে রাতে পিছনের পাঁচিলের ঝোপের পিছনে ডেকে রাখা ভাঙা অংশ দিয়ে ঢোকে, মণি।এই ঢুকতে গিয়েই ওর পায়ে কাঁটা ফোটে। যার ফলে পা টেনে টেনে হেঁটে ছিলো সেদিন। ভেবেছিলো সেদিন ওর ঐ রূপ দেখে ভয়েই বাচ্চাটা মরে যাবে বা না মরলেও ও নিশ্চিত হবে যে বাচ্চাটা আদৌ বাবিন কিনা। দুটোর একটাও হয়নি। সম্ভবত পরদিন ও গ্রামে চলে যায়। বাবিন ফিরে এসেছে ধরেই বিষ জোগাড় করে আবার গ্রামে থেকে ফিরে এসে ও দেখে একা সুহাসিনী নয় নীরা, তুই, আমি, অচ্যুত, অনুপম সবাই বাবিনকে পাহারা দিচ্ছি। বাবিনকে ও একদমই খাওয়াতে পারছে না”।
“আবার চেঞ্জ করাবার বাহানায় থাইয়ের তিলটা দেখে নিশ্চিতও হতে পারছে না যে সেই বাবিনই ফিরেছে কিনা – তাইতো কাকাবাবু?”, অনি যোগ করে।
“দুজনের এক জায়গাতেই তিল?” রুদ্রদেব অবাক হন।
“হ্যাঁ, এটাও সমাপতন”।
“এটা সমাপতন নাও হতে পারে। ছাড় ওসব। তবে ওর সন্দেহ ঘনায় যে এই বাবিনই সেই বাবিন, এবং একে মারার জন্য দূঢ়চিত্ত হয়, যদি আলাদাও হয় – তবুও বংশের প্রথম সন্তানের নাম নেবে – তাই তাকে মারাও ওর কর্তব্য”।
“এই কর্তব্যটা কেন রুদ্র! নেহাৎ ডাইনি বিদ্যার প্রয়োগ?”
“কোনো বিদ্যা টিদ্যা নয়। দিচ্ছে তো বিষ। এটা শুধু প্রতিশোধের খেলা। আর কিছু নয়”।
“প্রতিশোধ কিসের? প্রতিশোধ হলে তো বড় তরফকে নিতে হতো। ওরা ওর বাবাকে পিটিয়ে মেরেছে”। অচ্যুত বললেন।
রুদ্রদেব হাসলেন, “রাঁধুনী বামনী ছিল রানী মৌমাছি, অচ্যুত।অখিল মুখার্জী ওর ছেলের বাবা ঠিকই। সেটা ভাঙ্গিয়েই বসত ভিটে জোগাড় করেছে। অমূল্য মুখার্জী ওর মেয়ের বাবা”।
“কী!”
চমকে উঠলো অচ্যুত।
“কী যা তা বলছিস!”
“অনি নিজে কানে শুনে এসেছে। অমূল্য মুখার্জি গ্রামেরই কোন মেয়ে মানুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয় আর সে প্রেগনেন্ট হলে গ্রাম থেকে চলে যায়, সেই মেয়ে মানুষ কে এমন হতে পারে যে গর্ভবতী হলে গ্রাম থেকে চলেই যেতে হবে! বড়তরফের ছেলে মরার পরও এতো ভয় কিসের যে, ডাইন আবার এসে ওনার ক্ষতি করবে?”
“প্রেগনেন্ট ছিলো রাঁধুনি বামনী? মণি তাহলে ………”।
“হ্যাঁ, মণি তোর বোন। না হলে অমূল্যবাবু গ্রামে এক দুবারই গেছিলেন পরে – তার একবার মণিকে আনতে কেন? কেননা রাঁধুনি বামনির ছেলের ভার অখিল নিয়ে ছিলেন, ছেলে অখিলের। মেয়ে যার তার হাত দিয়ে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তোদের গ্রামে এখন বেশ কিছুটা জমি আছে। সব মণির বকলমে বিপ্লবের ভোগে লাগছে”।
“মণি জানে এসব?”
“আলবাৎ জানে। তোর বাবার উপর রাগেই ও দুটো খুন করেছে আর তৃতীয়টা করাতে যাচ্ছিলো”।
“একটা প্রশ্ন আছে”, অনিরুদ্ধ বললো।
“বল”।
“পায়ে কাঁটার চোট তো গ্রাম থেকে ফিরে আসার সময় সেরে যাবার কথা – দিন সাতেকের ব্যবধান – তাহলে কাকাও যে দেখল পা টেনে টেনে চলতে?”
“বৃষ্টি হচ্ছিলো তো সেদিন। মনে হয় পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছিল আবার। ওটা নতুন পা টানা।আমি অনিকেত আর অচ্যুত দুজনের থেকেই হাঁটার অনুকরণ দেখেছি।দুজনে দুই পায়ে দেখিয়েছে।”
“আর শ্বাসের শব্দ? মণিপিসির তো হাঁফানি নেই?”
রুদ্রদেব হাসলেন, “ওটা ডাইন চর্চার ঘোর। ভর, বলে যাকে”।
“মণির মাত্র তিন বছরে তো পুরোহিত মারাই গেলো। তাহলে ডাইন বিদ্যা ও শিখলো কোথায়!"
“বিপ্লবকে তুই দেখিসনি অচ্যুত। ও তো পুরোহিতকে দেখেইনি। তাও ওকে দেখলেই বোঝা যায় ডাইন চর্চার করে। মনে হয় রাঁধুনি বামনীও এসব চর্চা করতো। অক্ষয় তো বললো পুরোহিত নাকি ঐ তান্ত্রিকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ছিলো। পুঁথিপত্রও থাকতে পারে এসবের ওদের কাছে”।
“তাহলে কর্তব্য?” অচ্যুত বললেন।
“পুলিশে জানা, তবে পুলিশ তাকে আর তোদের বাড়িতে পাবে না। সে জেনে গেছে বাবিন বেঁচে – আর অপেক্ষা করবে না বাড়িতে। সাথে নিধুকেও পাবি না"।
“নিধু কাকা!”
“হ্যাঁ, মণি বাড়ির পিছনের ভাঙা ঘরে ডাইন চর্চা করতো, সেটা বাড়ির সামনের দিকের সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে দেখা যায় না, ঠিকই, কিন্তু একতলার মাঠের দিককার ঘর থেকে দেখতে পাবার কথা। আর ওদিকেই মণির ঘর,নিধুরও ঘর। নিধুর মাধ্যমেই মণি অনিকেতের সেই রাতে একা শোবার খবর পায় আর ডাইন মুর্তিতে নিধুর সাহায্যেই দোতালায় ওঠে”।
অনিরুদ্ধ কপালে হাত দেয়। "নিধুকাকা এমন করবে কেন? মোটিভ?”
রুদ্রদেব হাসলেন, “মণি বিয়ে করেনি কেন?”
“নিধু আর মণি!!!! দেখে তো বোঝা যেতো না?”
“দেখে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। মণি, নিধুকেও আর বাড়িতে পাবিনা তোরা। সেদিন অনি আর নিধুর ঘর সার্চের সময় নিধুর ঘরেই ডাইনি লুকিয়ে ছিলো”।
“ওরা তবে গ্রামে?”
“হ্যাঁ, অনি – এতে তোর বন্ধুর বোন শাঁওলিও ধরা পড়বে – কিন্তু”।
“কাকাবাবু, তুমি জানলে কী করে – আমি তো এটা বলতেই এখানে এলাম!! ”।
“বিলেত ফেরৎ ডাক্তার বলে তোর কাকা সবসময়। একটু মান রাখলাম। স্কুলে আর কে খাওয়াবে বিষ বল? শাঁওলি ছাড়া কার মোটিভ আছে? শাঁওলির তোর প্রতি ক্রাশ নয়, অবসেশন আছে – তার সাথে নীরার কড়া ব্যবহার। ভেবেছিলো বাবিনের কিছু হলে নীরা ফ্যাসাদে পড়বে আর তুই ওর হবি”।
“একি ছেলে মানুষি?”
“ভুল গুলো তো এভাবেই হয়, অনি”।
“রুদ্র, ক্রাশ না কি – ওসব তুই জানলি কি করে?”
“তুই ফেসবুক করিস, গাধা? অনির প্রোফাইলে আমিও আছি। শাঁওলির সব কমেন্ট দেখেছি ……”।
“ওহ, ফেসবুক, তাই না? ছোটগিন্নী আছে, তোর প্রোফাইলে?”
অচ্যুতের কথায় রুদ্রদেব হেসে ফেললেন হো হো করে।
“তোর এই মুহুর্তেও ঐ একই চিন্তা! হ্যাঁ রে, গাধা?”” অনিরুদ্ধ কিছু বললো না। দুই বন্ধুর রসিকতা চলতে থাকলো।
পর্ব – ৪৫
দিন সাতেক পর ছেলেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে বাড়ি ফিরেছিলো নীরা। ভাবতে পারেনি এই সৌভাগ্য ওর হবে। বাবিনকে একবার হারিয়ে ছিলো আর একবারও হারাতে বসেছিলো। নেহাৎ কাকাবাবুর বিচক্ষণতা ওদের বাঁচিয়েছে। মণিপিসি! যে মণিপিসির হাতে নির্দ্বিধায় ওর বাবিনকে ছেড়েছিলো নীরা, দিনের পর দিন খাইয়েছে বাবিনকে, স্নান করিয়েছে - সেই! ভাবতেও শিউরে উঠলো নীরা। ভাগ্যিস কাকিমণি এবার প্রথম থেকেই আটকে ছিলেন এগুলো না হলে তো ঐ শয়তান মেয়ে শাঁওলি অবধি যেতে হতো না। মণিপিসি নিজেই হাতের নাগালে পেয়ে যেত বাবিনকে। আর দোষ হতো অভিশাপের।
শাঁওলি গ্রেপ্তার হয়েছে। ওর কাছে আরো একটা লজেন্স ছিলো। ওকে দুটো একসাথেই দিতে বলেছিলো মণিপিসি, চিঠিতে। ও কোন কারণে সেটার সাহস পায়নি। ও বাবিনকে মারতে চায়নি। অল্প অসুস্থ করে নীরা সরাতে চেয়েছিলো। ভাগ্যিস দুটো লজেন্স দেয়নি। না হলে কী হতো ভাবতেই কেঁপে ওঠে নীরা। শাঁওলির দাদা, বৌদি অনিকে অনেক করে রিকোয়েষ্ট করেছিলো – ছাড়াবার জন্য। কিন্তু না, অনি গলেনি। ওর শান্তি ওকে পেতেই হবে।
মণিপিসিকে পুলিশ গ্রামেই পেয়েছিলো। ঠিক গ্রামে নয়। গ্রামের নদীর অন্য পারে। শ্মশানে, ডাকিনী চর্চারত অবস্থায়। সাথে বিপ্লবও ছিলো। বাবিনকে বিষ দিয়ে মারতে না পেরে বাণ মেরে মারার যজ্ঞ চলছিল তখন। মণিপিসি গ্রেপ্তার হয়, বিপ্লবও। সেঁকো বিষ ও-ই জোগাড় করে দিতো ওর দিদিকে। দুই ভাইবোনই মানসিক ভাবে অসুস্থ। এমনটা বলেছে মিডিয়া। নিধুকাকার কোন খোঁজ মেলেনি। এখনো চ্যানেলে চ্যানেলে এই ঘটনাটা নিয়ে চর্চা হচ্ছে। নীরা কোথাও সাক্ষাৎকার দেয়নি। ও প্রচার নয়, শান্তি চায়।
কাকা এখন অনেকটা সুস্থ। এই বাড়িতেই আছে। কাকিমণি একা হাতেই বাড়ির কাজ করে যাচ্ছেন। নীরা সারাক্ষণ ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। পরীটা বুঝদার খুব। জেঠিমণি দাদাভাইকে নিয়ে ব্যস্ত দেখেও কোন অভিমান নেই। ঠাম্মা, দাদুভাই, কাকামণি, জেঠুমণির কাছেই থাকছে। ডাক্তারকাকাও পরীর মন ভুলিয়ে রাখছে। পরীকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বলে ডাকছেন। মজা পাচ্ছে পরী। নীরা বোঝে এটা কেন বলছেন কাকাবাবু। পরীকে অনেকটাই কাকিমণির মতো দেখতে। কাকাবাবু আর কাকিমণির গল্প প্রমাণ করে ভালোবাসায় কোন ক্ষয় হয় না।
অনি রাতে শুতে এলো।
“বাবিন ঘুমিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, পরী?”
“ঘুম পাড়িয়ে এলাম”।
“অতীনরা আর নিতে চাইছে না তো!”
অনিরুদ্ধ ঝুঁকে নীরাকে চুমু খেলো, “কেউ নেবে না তোমার মেয়ে কে। আর পরী যেতে চাইলে তো!”
“ছোট ঠাকুরপো কোথায়?”
“ওঘ রে ঘুমোচ্ছে। অনুপমটাও কিন্তু খুব খাটল এই ক’দিন আমাদের সাথে”।
“হ্যাঁ, তুমি শুয়ে পরো”।
“এখনি?”
“কেন?”
“আমার পাওনাটা? বাবিন ফিরে এলে দেবে বলেছিলে?”।
নীরা হাসলো, “ছেলে জেগে যাবে”।
“ওহ, তাহলে?”
“কাগজ সই হোক – তারপরে”।
“অ্যাডপশন পেপারস এর মধ্যেই সই হয়ে যাবে”।
“বললাম তো, তারপরে”।
অনিরুদ্ধ নীরাকে আদর করে, “বেশ, ছেলের পাশে শুতে দাও তবে”।
“যাও না – তোমারই তো ছেলে”।
অনিরুদ্ধ গিয়ে শুয়ে পড়লো। নীরাও শুলো, অন্যপাশে”।
“আমার বাবিন”। নীরা বললো।
“ফিরিয়ে আনতে পারলাম তো, সোনা?”
“পেরেছো”।
“তোমার বাবিন তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে আমার কত আনন্দ – বুঝতে পারবো না”।
নীরা অনিকেতকে আরো আদর করলো।
“সরি ……”।
“কেন?”
“প্রথমে বুঝিনি যে?”
“এখন তো বুঝছো”।
“খুব করে বুঝছি। অনি,ছেলে সারুক,তারপর আমি কোর্টে যাবো”।
“যেও”।
“ওষুধ বন্ধ করে দেবো”।
“দিও”।
“কাকিমণি, কাকা, কাকাবাবু ঠাকুরপো সব্বাইকে নিয়ে থাকবো”।
“অবশ্যই। আর কিছু?”
“যদি আর কোন জন্ম থাকে তুমি আমারই হয়ো, হবে তো”?
অনিরুদ্ধর চোখে জল চলে এলো, নীরারও। অনিকেতকে মাঝে রেখে আদর করতে করতে ওরা রাত কাটিয়ে দিলো।
পুজা মৈত্র
Tags:
উপন্যাস