পুরুষোত্তম সিনহা

পুরুষোত্তম সিনহা / শর্মিষ্ঠা ঘোষ - ১ মুঠো প্রলাপ - শব্দের মিছিল
ইনি বলেন, "জীবনের চোদ্দো আনা পড়ব, আর দুই আনা লিখব।" ইনি বলেন, "এখন লিটল ম্যাগাজিনে লিখেই আনন্দ পাই। আর সে ম্যাগাজিন যদি অনামী হয় তবে আনন্দ আরও বেশি পাই।" তাই আমার তাকে নিয়েই বলতে ইচ্ছে করছে। ইনি আদিগন্ত নম্র লো প্রোফাইলধারী ভদ্রলোক পুরুষোত্তম সিনহা। তরুণ গবেষক প্রাবন্ধিক আলোচক এবং অধ্যাপক। যুগ্ম সম্পাদক," কথাবয়ন সাহিত্য পত্রিকা " এবং" উত্তরবঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্র ও গবেষণা পরিষদ "। প্রকাশিত গ্রন্থ "রবীন্দ্রনাথ :চির চেনা চির অচেনা", "অমর মিত্রের গল্প বিশ্ব : আখ্যানের বহু মাত্রিকতা", সম্পাদিত গ্রণ্হ "উত্তরবঙ্গের কথা সাহিত্য" এবং "লেখকের মুখোমুখি"। যন্ত্রস্হ আছে একটি, বাংলা সাহিত্যের মুসলিম লেখকদের ওপর। তিনি গল্প কবিতা লেখেন না, তার আগ্রহ গল্প কবিতার বিশ্লেষণ এ। তিনি মনোযোগী পাঠক আলোচক। খুঁজে খুঁজে তুলে আনেন সেকাল একাল এর রত্ন রাজি মণি মুক্ত। প্রাঞ্জল বর্ননায় তার কলম পাঠক কে পথ দেখায়। তিনি পড়েন এবং পড়ান এমন একটা সময়ে যখন তরুণ প্রজন্মের কাছে পাঠাভ্যাস বিরল ঘটনা প্রায়। তিনি পাঠক তৈরী করেন আগ্রহ জাগান। তার পাঠ পরিধি অনন্ত। সংস্কার মুক্ত। 

শব্দের মিছিল পরিবারের পক্ষ থেকে আভূমি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। 

শর্মিষ্ঠা ঘোষ -  অধ্যাপক গবেষক প্রাবন্ধিক। এর পর কি ?

পুরুষোত্তম সিনহা - এরপর বিবাহ। এখন অবিবাহিত, এরপর এই উপমাগুলির সঙ্গে বিবাহিত যুক্ত হবে। এগুলির একটাও সম্পূর্ণ নয় সব অর্ধবৃত্ত – হাফ অধ্যাপক, হাফ গবেষক, হাফ প্রাবন্ধিক। কিছুদিন পর আবার ‘ড.’ যুক্ত হবে। আত্মপ্রত্যয়ী মধ্যবিত্তের জীবনস্বপ্নের যে চোরাবালি তা বাঁচিয়ে রাখে এই উপমাগুলি। আসলে মধ্যবিত্ত তো ভান করে বাঁচতে ভালোবাসে, তাই এই উপমাগুলির বিশেষ প্রয়োজন। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যে প্রভেদ তা নির্ণয় করে দেয় এই উপমাগুলি। লেটু রিক্সা চালায়, বৈদ্য চা বিক্রি করে, অমুক গেটম্যান, তা থেকে আমি বা আমরা ভিন্ন গোত্রের মানুষ – তা চিহ্নিত হয় এই উপমাগুলি দ্বারা। সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির পৃথক অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করিনা। এই উপমাগুলি আমি নিজে একটাও ব্যবহার করি না। কেউ কেউ ব্যবহারে তাঁদের প্রয়োজনে। বরং সামনে কেউ বললে ভীষণ লজ্জিত হই। বারবার মনে হয় কেন সে আমাকে তাঁর থেকে বিচ্যুত করে দিচ্ছে, আমি তো তাঁদেরই দলের লোক। এসব বাদ দিয়ে যেটা জরুরি তা হল লেখা। কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হল সেটা বড় কথা নয়, কী লিখলাম সেটাই জরুরি। লেখাটাই শেষ সত্য, বাকি সব মেকি। 

শর্মিষ্ঠা ঘোষ - সাহিত্যের অধ্যাপক। গবেষণার বিষয় সাহিত্য। সেই বিষয় বেছে নেবার পেছনে আর কোনো বিশেষ কারণ ?

পুরুষোত্তম সিনহা - না কোন কারণ নেই। বিষয় সাহিত্য হলেও পড়তে ভালোবাসি দর্শন ও ইতিহাস। সাহিত্য ছাড়া মানুষের বাঁচা সম্ভব কিন্তু ইতিহাস, দর্শন ছাড়া মানুষের বাঁচা সম্ভব নয়। আমার তো ভূগোল পড়ার কথা ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বাংলায় ভর্তি হলাম, প্রথম লিস্টে ভূগোলে নাম আসেনি। যোগাযোগ করলাম প্রভাস রায়চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানালেন – ‘বাংলাই পড়বে না পালাবে ?’ বললাম –বাংলাই পড়ব। প্রথম দেখাতেই কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন – উত্তর দিলাম। তখনই দুটি বই দিলেন। কিন্তু টাকা তো নিয়ে যায়নি, ফলে নিতে অস্বীকার করলাম। তখনই প্রশ্ন- ‘এখনই তো বললে বাংলা পড়বে’। ফলে বাংলা ছেড়ে আর পালাইনি। দ্বিতীয় লিস্টে ভূগোলে নাম এলেও আর যাইনি। সেই শুরু। এম.ফিল যখন ভর্তি হই তখন ঠিক ছিল কিন্তু পি.এইচ.ডি করার বিশেষ ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমার দাদার প্রবল ইচ্ছা সেটা যেন করি। তাই ভর্তি হতে বাধ্য হলাম। একটি ডিগ্রির মালা ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। এখনও মনে হয় না। 

শর্মিষ্ঠা ঘোষ -  গবেষক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের গতি প্রকৃতি কেমন ঠেকছে ?

পুরুষোত্তম সিনহা -  ভালোমন্দ উভয়ই। সাহিত্য তো ক্রমেই বাজার সর্বস্ব হয়ে উঠছে। লেখক তো ক্রমেই নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মপ্রচার পেতে চাইছে। আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মপ্রচার ঠিক আছে, কিন্তু তাঁর কাঁচামালটা যেন ঠিক হয়। তিনি যে কাঁচামাল অর্থাৎ লেখা দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছেন সেটা যেন ঠিক হয়। কিন্তু আমি সার্বজনীন পাঠক নই। আমার একটা গণ্ডি আছে, একটা বলয় আছে। সেই বলয়ের লেখকরা ভালো লেখেন। তাঁদের লেখা মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আমার সময়ের অনেক লেখকরা চমৎকার লিখছেন। নির্দিষ্ট ফর্ম ভেঙে, নতুন এক্সপেরিমেন্টে এগিয়ে যাচ্ছেন, উত্তর আধুনিক এক গল্পবলয় গড়ে তুলছেন। যা চমৎকার। আমাকে মুগ্ধ করে। এই ভূগোল থেকে সব বই যে সংগ্রহ করতে পারি তা নয়, ফলে অনেক বইই পড়া হয় না। আর অর্থও তেমন নেই। মাসের শেষে হয়ত হাজার টাকার বই কিনতে পারি। ই ম্যাগাজিনে গল্প পড়ে তেমন আনন্দ পাই না, তেমনি পত্রিকায় একটি গল্প পড়েও আনন্দিত হই না। এক লেখকের অনেকগুলি গল্প, গল্পগ্রন্থ, কাব্য, পেলে বড় সুবিধা হয়, লেখককে বোঝার পক্ষে। সেটা বড় আনন্দ দায়ক। বুদ্ধদেব বসু একবার মন্তব্য করেছিল – আমি আমার কালের শিল্পীদের প্রশংসার প্রঞ্চমুখ ছিলাম। হ্যাঁ আমার কালের লেখকরা বড় ভালো লেখে। আমি তো কান পেতে বসে থাকি একজন লেখক বা কবি তাঁর লেখা দিয়ে আমাকে মুগ্ধ করবে।

শর্মিষ্ঠা ঘোষ - অধ্যাপক হিসেবে বর্তমান যুগের ছাত্র-ছাত্রীদের সাহিত্যকৃতি কেমন মনে হয় ?

পুরুষোত্তম সিনহা -  এ এক ভয়ংকর প্রশ্ন। আমরা কোন সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি ? বালক দেবেশ রায় দশম শ্রেণির বিদায় সম্বার্ধনায় বলেছিলেন – হিন্দি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, বাংলা ভাষা, নিজের সংস্কৃতির মূল্য তুলে ধরুন। কিন্তু প্রশ্ন হল বাংলা পড়ে কি হবে ? সাহিত্য পাঠ চাকরি দেবে তো ? আমি নিজেই জানি এ পথ মেকি, ভয়ংকর ভাবে চোরাবালি ! যেনতেন প্রকারে একটা চাকরি পেতে হবে, নইলে মধ্যবিত্তের মুক্তি নেই। সব ছাত্রছাত্রীই যে আনন্দের সঙ্গে সাহিত্য পড়ে তা নয়। কিছু পড়ে। সে সংখ্যাটা বড় নগণ্য। যাঁরা পড়ে তাঁদের চিনি, এগিয়ে দেওয়ার নানা চেষ্টা করি। পাঠই পাঠোদ্ধারের শেষ পাঠ। ক্রমাগত পাঠই একজন পাঠককে, ছাত্রকে চিনিয়ে দেবে কোন লেখককে পড়তে হবে।

শর্মিষ্ঠা ঘোষ - তোমার প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন এবং সম্পাদিত গ্রন্থ কয়টি এবং কি কি ? এগুলি কোথায় পাওয়া যাবে ?

পুরুষোত্তম সিনহা -  পাঁচটি। এর মধ্যে সম্পাদিত দুটি। রবীন্দ্রনাথ চির চেনা : চির অচেনা, অমর মিত্রের গল্পবিশ্ব : আখ্যানের বহুমাত্রিকতা, উত্তরবঙ্গের কথাসাহিত্য ( যৌথ ), কী লিখি, কেন লিখি ( সম্পাদিত ), লেখকের মুখোমুখি ( সম্পাদিত )। প্রথমটি ধানসিড়ি, বাকি গুলি সোপানের। প্রথমটি আর পাওয়া যায় না, বাকিগুলি সোপান এ পাবে।

শর্মিষ্ঠা ঘোষ -  আধুনিক সাহিত্যচর্চার ধারায় কাদের পড়তে রেফার করবে ? কেন ?

পুরুষোত্তম সিনহা - এ বড় জটিল প্রশ্ন। আসলে সবার ভালোলাগা বা মন্দলাগা তো সমান নয়। কারও মদ প্রিয়, কারও সিগারেট, কারও চা, কারও মাংস। কে কেমন পড়তে চাইছে, বা রুচিটা কেমন সে সেই লেখককেই খুঁজবে। সব লেখকই পড়তে হয়। সবার সব সৃষ্টিই যে মহৎ তা নয় তবে কিছু কিছু মহৎ। অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুবিমল মিশ্র, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, দেবেশ রায়, সাধন চট্টোপাধ্যায় পড়ুন, পরের দিকে সৈকত রক্ষিত, আবুল বাশার, অমর মিত্র, নলিনী বেরা, কিন্নর রায়, আফসার আমেদ, অনিতা অগ্নিহোত্রী পড়ুন। মার্কেজ পড়ুন। আরও পরে রামকুমার মুখোপাধ্যায়, সোহারাব হোসেন, অলোক গোস্বামী, সুকান্তি দত্ত, শুভংকর গুহ, অহনা বিশ্বাস পড়ুন। তরুণ লেখকদের মধ্যে সাদিক হোসেন, শামিম আ্মেদ, অনির্বাণ বসু পড়ুন। কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি, সুনীল,বিনয়, শঙ্খ ঘোষ, ভাস্কর চক্রবর্তী বাদ দিয়েও শম্ভু রক্ষিত, রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী, বীতশোক ভট্টাচার্য, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, রাহুল পুরকায়স্থ, তুষার চৌধুরী, রণজিৎ দাশ, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, জয়দেব বসু, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, জহর সেন মজুমদার পড়ুন। ওপার বাংলার ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, মহামদুল হক, শহীদুল জহির, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, কুলদা রায় পড়ুন। আরও কিছু নাম বাদ পড়ল, দুঃখিত। প্রচলিত আখ্যানকে এঁরা ভেঙেছেন। সবাই যে ভেঙেছে তা নয়। নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আখ্যানকে সাজিয়েছেন। সাহিত্য তো যুগে যুগে কালে কালে পাল্টায়। বাংলা সাহিত্যের যুগ বিবর্তন, নতুনত্ব, নতুন সৃষ্টি আখ্যানে ও স্টাইলে এসব লেখক পড়লে বোঝা যাবে। 

শর্মিষ্ঠা ঘোষ - প্রবন্ধের বাইরে সাহিত্যের কোন ধারায় উৎসাহী ? নিয়মিত চর্চা করা হয় ?

পুরুষোত্তম সিনহা -  না আর কোন ধারা নয়। আগে কবিতা লিখতাম। এখন সচেতন ভাবেই লিখি না। গদ্যকারের পক্ষে কবিতা লেখার বিশেষ প্রয়োজন নেই। বিভূতিভূষণের গল্প উপন্যাস পড়েই কেউ আবিষ্কার করে দিতে পারেন বিভূতিভূষণ একজন বড় কবি। শুধু প্রবন্ধই লিখতে চাই। প্রবন্ধের ভাষাটাকে ভাঙতে চাই। প্রচলিত বলয়টা ভেঙে দিতে চাই। বেশ কিছু লেখায় সেটা চেষ্টা করেছি। বৈঠকি ঢঙে, গল্পের ছলে। এগুলি যে নতুন তা নয়, ছিলই। মনে দিয়ে প্রবন্ধটাই লিখতে চাই।

শর্মিষ্ঠা ঘোষ -  প্রতিষ্ঠান সমর্থক নাকি বিরোধী ? কেন ?

পুরুষোত্তম সিনহা -  প্রতিষ্ঠান বিরোধী। ক্ষমতা সাহিত্যকে নষ্ট করে দেয়। প্রলোভন লেখককে ধ্বংস যজ্ঞের দিকে নিয়ে যায়। সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিমগ্নতা বড় প্রয়োজন। ক্ষমতার দম্ভে একজন লেখক প্রকৃত সত্য ভুলে যায়, লেখকের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়। তবে আমি কিন্তু লেখক নই। পাঠক বলতে পার।

শর্মিষ্ঠা ঘোষ - সৃষ্টির জন্য স্বীকৃতি জরুরী মনে হয় ?

পুরুষোত্তম সিনহা -  না । প্রয়োজন নেই। লেখাই শেষ কথা। লেখাই উত্তরণের শেষ চাবিকাঠি, টিকে থাকার অন্তিম নিকেতন। আমরা মার্কেজ পড়ছি, শহীদুল জহির, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম পড়ছি, কই কেউ তো আমার দেশের লোক না। সৃষ্টিই শেষ কথা। রবীন্দ্রনাথ এ সত্য তো বহু আগেই বলে গিয়েছিলেন।


Previous Post Next Post