মৌ দাশগুপ্ত

শব্দযাপন -   প্রাণের ঠাকুর ও আমি - mou dasgupta

শব্দযাপন - 
প্রাণের ঠাকুর ও আমি

(১)

পর্দা ঢাকা একচিলতে ঘরের আলো আঁধারিতেও
বড় উজ্জ্বল উপস্থিতি তাঁর,
একলা রাতে ঘুম না এলে
মনে হয়, একা নই,
আরো কেউ জেগে আছে সাথে,
ব্যাথার গভীরেও যে ব্যাথা লুকিয়ে থাকে
তাকে সুরে সুরে ছড়িয়ে দেওয়া
অথবা
সময়ের যে অযাচিত ঋণটুকু পড়ে আছে সাঁঝপ্রদীপের আলোয়,
তাকে গুছিয়ে রাখা শব্দের আখরে,
এই নিয়েই প্রতিমুহূর্তের যাপন আমার।
প্রতিদিনের এই স্ব-মন্থন শেষে আরো তীব্রতর দহন চাইলেই শুনি তাঁর অমৃতবাণী-
আমি  অমৃতস্য পুত্রী হয়ে উঠি...

"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। "

(২)

গোড়াতেই ছিল চিরপ্রেমিক নামের অলীক শিকল–
শুরু থেকেই আলাপের উদারা মুদারায়
আশাবরী থেকে বেহাগ, খাম্বাজ থেকে মালকোষ।
শুধুই সুরেলা সফরের হাতছানি।
সম্বল যা কিছু, পিছুটানে জড়াই নি,
ভালোবেসে লালমাটি পথে হেঁটে গেছি খোয়াইয়ের পাশাপাশি
গন্তব্য আসলে ডেকে দিও কবি,
এক নির্জন গোধুলিতে তোমার সাথে একান্তে সুর্যাস্ত দেখা বাকি রয়ে গেছে।

"আমার দিন ফুরালো...."

(৩)

আর  একবার ফিরে তাকিও–
শেষবার ঘরে ফেরার আগে যেভাবে তাকিয়েছিলে,
আবার দেখা করার ইচ্ছেটাকে চোখের পাতায় লুকিয়ে নিয়ে...

দেখো,
অপেক্ষায় অপেক্ষায় কত বলিরেখা জমেছে!
কত নিস্তেজ হয়েছে চোখের দৃষ্টি...
শুধু কানে কানে জমা আছে
ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি,

ফিরে তাকালেই জানি,
একলা গোধুলী জুড়ে ছড়িয়ে পড়বেন আমার প্রাণের ঠাকুর...

"আমি কান পেতে রই...."

(৪)

অপেক্ষার সময়টুকু পার হয়ে এলেই
তোমার চোখে
যে সমস্ত ছাপার অক্ষর ফুটে ওঠে;
লাগামহীন প্রলাপ, শুধু বলে যাওয়া
অথবা নীরবে শুনে নেওয়া...
শব্দের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগ, শঙ্কা,
কথার পরতে-পরতে ভালোবাসা..
তাকে নিয়েই লিখে ফেলি আমার বারোমাস্যা জীবনের উপক্রমনিকা।
চিরাচরিত  অভ্যাসমত আমাদের দ্বৈতযাপনটুকুই অনুচ্চারিত থেকে যায়...
আমার অপরাধী চোখের দিকে তাকিয়ে তুমি গুনগুনিয়ে ওঠো,

"তোমার হল শুরু আমার হল সারা। "

(৫)

তোমার কাছে গচ্ছিত রেখেছি
যত সোনালী দুপুর
আর মন কেমনের সাঁঝ।
যতবার পিছনে তাকাই, - দেখি,
একাকী তুমি
কি এক অপুর্ব মায়ায় ভরে দিচ্ছ
আমার সব চাওয়া,  না-চাওয়া।
তারপরেও যেটুকু সুখ পড়ে থাকে
তাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেই
তোমার গীতিসুধায়, শব্দবিলাসে, অক্ষর সম্পদে
ভরে ওঠে আমার একলা যাযাবরী জীবন।
ফিরে যাওয়া কঠিন নয়,
ফিরে পাওয়াটাই অসমাপ্ত থেকে গেছে।

"আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
    তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে॥"

(৬)

এত ভীড় তবু একলামন।
এত আলো তবু মনখারাপের মেঘে বর্ণহীন তোমার মুখ।
বারবার ভুল শিখছি আমার নিজস্ব পরিচয়,
নাকি আমার নামের বানানটুকুই শুধু!
একদিন তোমার অফুরান শব্দভান্ডার থেকে
যে নামটুকু ভিক্ষা করে এনেছিলেন মা।
দ্বিধা আছে, আছে সংশয় এবং ঈর্ষা,
আমি অনুসুয়া নই, নই অনভিমানী।
শুধু জানি,
কান্না পেলেই
আজও তোমার গানেই ভরে ওঠে আমার অপুর্ণ নীরবতা।

"তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা"...



(অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরী)।


পঞ্চসতী

(১)
অহল্যার প্রেম চিনে নিতে ভুল হয়েছিল উভয়েরই,
সকাম দৃষ্টি,যৌনসুখ
অথবা নিছকই ভালোলাগা...
মুখ ফুটে বলা হয়নি কোনদিন,
জানতে চেয়েছিলেন মহর্ষি গৌতম?
অথবা নারীসঙ্গলোভী সুরশ্রেষ্ঠ?
পাষাণপ্রতিমা উত্তর দেয়নি কোনো....

(২)

শরীর তো এক্টাই।
তবু পাঁচ পুরুষের রমনভোগ্যা,কর্ষনক্লান্ত।
আর মন?
সেও সমান পাঁচভাগে ভাগ হয়েছিল কি?
বলার আগেই
আষাঢ়সন্ধ্যার মতো মেঘলা রহস্য নিয়ে
স্মিত হাসি ফুটে ওঠে পাঞ্চালীর
বহুচুম্বনক্ষত ঠোঁটে।

 (৩)

নিস্পাপ ষোড়শীর  কাছে নারীত্বের উপাচার চেয়েছিল স্বয়ং, সুর্য্য
সে গল্প তো আজ অজানা নয়।
তারপর পান্ডুজায়ার বংশরক্ষার অজুহাতে, অথবা,
নিছকই যৌনাকাঙখার কাজলসুখে সঙ্গ দেন
একে একে ধর্মরাজ, বায়ু, দেবরাজ...
তারপর থেকেই আমাদের পারস্পরিক সন্দেহবাতিকে
নীল হয়ে আছে আদর কাঙাল চাঁদ।

 (৪)

আচমকা মৃত্যুশোক আর অযাচিত শুন্যতা
বদলে দেয় সময়ের যতিচিহ্ন,
বালী থেকে সুগ্রীব, সম্পর্কের বিধিবদ্ধতা
মুছে দেয় উদ্বিগ্ন  কিছু শব্দ..বাক্য..
রাজনীতির কুটচালে বলিদত্ত তারার
ভবিষ্যৎকে অভিশাপ আর অপেক্ষা ছাড়া  কিছুই যে দেওয়ার ছিল না।

(৫)

একক দাম্পত্যের অধিকার আবদার করেনি কখনো,
ধুপের মত পুড়েও
অন্যায়ের প্রতিবাদকে গয়নার মত জড়িয়ে নিয়েছিল কোমল অঙ্গে
সিঁদুরে লাল রঙকে জেনেবুঝে মুছে দিয়েছিল
কান্নার জলছাপ দাগে,
সুখী কে?
দশাননঘরণী নাকি বিভীষণপত্নী,
মন্দীদরীর মন পড়ার দুঃসাহস বাল্মিকীও করেন নি।

(৬)
পুরুষালী অধিকার নয়,
নয় সিঁদুর দাগের অনতিক্রমনীয়তা,
মনকে যতই চোখ রাঙানো হোক,
যুগে যুগে পাঁচ মেয়ের বুকভরা সুখটুকুই আমাদের কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা---


Previous Post Next Post