নবমিতা পাল

 “বেইউ থেকে ভেসে আসা করোনার দুকথা”    নবমিতা পাল
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সবাই গভীর আশা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি কখন আমরা এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর কবল থেকে মুক্তি পাব। এক অচেনা ভাইরাসের আস্ফালনে স্তম্ভিত স্বাভাবিক মানবসভ্যতা।চারিদিকেঅবাক করা নীরবতার মাঝে বাজছে“বিষেরবাঁশির” হাড়হিম করা সুর। গত ২০১৯ সালের শেষের দিকে উৎপাত লক্ষ্য করা গিয়েছিল নতুন করোনা ভাইরাসের, পোশাকি নাম কোভিড-নাইনটিন। আচমকা সেই ভাইরাস প্রবলপরাক্রমে অধীনস্ত করল গোটা বিশ্বকে।প্রথম বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা এবং সরকার দিনরাত এক করে ফেলছে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করতে, তবুও আশার আলো এখনও বহুদূর। 

গত ছয় বছর যাবত আমি গবেষণা সংক্রান্ত চর্চায় আমেরিকা নিবাসী। কর্মসূত্রে আমি অধ্যাপনা করি লুইজিয়ানা (চলতি নাম বেইউ) রাজ্যের উত্তর দিকে, ছোট্ট এক মফস্বল রাষ্টনেঅবস্থিত লুইজিয়ানা টেকবিশ্ববিদ্যালয়ে, আর এখানেই আমার নিবাস। কয়েক মাস আগেও হাল্কা-চালে জীবনের আবেগী হাওয়ায় রোজকার মতো ভাসছিল এই ছোট্ট রাষ্টন। বড়শহরের যানবাহনের গাদাগাদি,হর্নের আওয়াজ, চারিদিকে গিজগিজ করা ভিড়, আশেপাশে দিকপাত না করে ব্যস্ততার সঙ্গে লোকের পথচলা, এইসব কিছুর থেকে একটু আলাদা করে রাখা ছিমছাম, অন্যরকম দৈনন্দিন জীবন।সকালে কফির দোকানে বসে বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে হাল্কা আড্ডার ফাঁকে সবুজের সমারোহ অবলোকন, সুন্দর মৃদুমন্দ তাজা হাওয়ার পরশ, মাঝেমধ্যে ইস্কুলের বাসে করে যাওয়া কচিকাঁচাদের প্রাণ ভোলানো হাসিমুখ মন এবং শরীরকে ঝরঝরে রাখতো। কখনও কখনও গিটারের সঙ্গতে আকাডিয়ান অথবা কাজুন লোকগীতি গেয়ে যাওয়া অজানা কোনও গায়কের ভেসে আসা তীক্ষ্ণ এবং অবিচলিত কণ্ঠস্বর ভুলিয়ে দিত দীর্ঘ জীবনযাত্রার বিষাদ এবং গ্লানি। রোজকার জীবন চলতো দুলকি চালে, প্রকৃতির আঁকাবাঁকা আল বেয়ে ধীমেলয়ে। প্রতিমাসের দ্বিতীয় শনি এবং রবিবার একটু জমকালো করে এখানে বসতো চাষীদের হাটবাজার যার ইংরেজি কেতাবি নাম “ফার্মার্স্ মার্কেট”।রকমারি তাজা সবজি, ফলমূল, স্থানীয় সুস্বাদু খাবার দাবার নিয়ে জমিয়ে পসার বসায়স্থানীয়রা। উঠতি স্থানীয় কিছু সঙ্গীতশিল্পী আর আবৃত্তিকাররা নিষ্ঠা সহকারে প্রদর্শন করে নিজের নিজের প্রতিভার নজির। কেউ কেউ আবার হস্তশিল্পের পসরা নিয়ে বসে গভীর আগ্রহে উৎসুক চোখে খুঁজে বেড়াত উৎসাহী কোন গ্রাহককে। বেশ জমজমাট কাটে শনিবার এবং রবিবারের সকালের হাটবার। এছাড়া সন্ধেবেলা প্রেক্ষাগৃহে বসে দলবেঁধে সিনেমা অথবা নাটক দেখা স্থানীয়দের সাপ্তাহিক আনন্দের অঙ্গ। করোনার জেরে এখনগৃহে থেকে কর্মে লিপ্ত থাকার নির্দেশ। চারিদিকে সবকিছু খাঁ খাঁ করছে, বিরাজ করছে অদ্ভুত এক শূণ্যতা। এই নতুন দৈনন্দিন জীবনের ছবি আমাদের স্থানীয় সবার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, রহস্যময়।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে বেইউতে সর্বত্র“মারডিগ্রা”নামের এক অবাধ আনন্দোৎসবের আয়োজন করা হয়, সর্বত্র ছুটির মেজাজে টইটুম্বুর থাকে সবার মন। ছোট্টমফস্বল থেকে বড় শহর সবাই সেজে ওঠে নতুন রূপে উৎসবের মেজাজে।রংবেরঙের পোশাক আশাক পরে ভ্রাম্যমাণ লোক রাস্তায় বের হয়, চলে হইহুল্লোড়, গান বাজনা আর অঢেল খাওয়া দাওয়া। এবছরের শুরুতে আমেরিকায়করোনা ভাইরাসনিয়ে চাপা ফিস্ফাস্ হলেও উৎসবেরআমেজে বূঁদ হয়ে থাকা হুল্লোড়ে স্বভাবের বেইউ এসবের তোয়াক্কা না করে মেতে ওঠে হইহই করে।লুইজিয়ানার দক্ষিণে মেক্সিকো উপসাগরের তীরে অবস্থিত বিখ্যাত নিউঅরল্যান্স্ শহর উৎসবের আমেজে তার অনন্য বাচনভঙ্গী, স্বতন্ত্র ঘরানা নিয়ে তখন হাতখুলে স্বাগত জানাচ্ছিল বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। ফরাসী স্থাপত্যের তুলিতে আঁকা, স্পেনীয় “ক্রেওল” রান্নার সুগন্ধে ভরপু্র বিখ্যাত “বারবান” স্ট্রীটের অলিগলিতে তখন উদ্দাম উল্লাসের স্পর্শ। স্বভাবতই বেইউের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও লোকজনও পাড়ি দিয়েছিল নিউ অরল্যান্সে্র উদ্দেশ্যে।মার্চ মাসের শুরুর দিকে করোনা ভাইরাস তার প্রথম থাবা বসালো বেইউতে। সেই অজানা,অদেখা হানাদারের হাতে আক্রান্ত হল প্রাণোচ্ছল নিউঅরল্যান্সে্র উদ্দাম আনন্দের বাঁধভাঙা উচ্ছাস। নয়ই মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রুগী ভর্তি হওয়ার খবর প্রকাশ পায়। চোদ্দই মার্চ খবরে আসে আইভস্ গ্রীন নামের পঞ্চাশোর্ধ এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি করোনার সঙ্গে লড়াইে প্রথম শহীদ হয়েছেনলুইজিয়ানাতে। ততদিনে বেইউতেপ্রায় মোটের ওপর একশ জনের বেশী আক্রান্ত এবং নিউঅরল্যান্স্ থেকে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের আরো বাষট্টিটি প্যরিশে (বেইউের আঞ্চলিক ইংরেজিতে প্যরিশ জেলার সমার্থক)।স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম জানাল সারা রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি হল বিশেষত নিউঅরল্যান্স্ লাগোয়া জেফারসন এবং অরল্যান্স্ প্যরিশের স্থানীয়দের চরম সর্তকতা অবলম্বন করতে বলা হল।তড়িঘড়ি করে লুইজিয়ানার রাজ্যসরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বন্ধ করলো রাজ্যব্যাপী সমস্ত সরকারি বেসরকারি অফিস-কাছারি, হোটেল, রেঁস্তোরা, প্রেক্ষাগৃহ, পর্যটনকেন্দ্র,ধর্মীয় এবংশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়। শুধুমাত্র খোলা রইল জরুরি পরিষেবা, দোকান বাজার জরুরি সীমাবদ্ধতা অবলম্বন করে, তীক্ষ্ণ নজরদারিতে। সরকারের তরফ থেকে সবাইকে আর্জি জানিয়ে বলা হল দুঃস্থ, বাচ্চা, বৃদ্ধ এবং বয়স্কদের সুরক্ষিত রাখার কথা।স্বাস্থ্য দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তিজারি করে করোনার উপসর্গের প্রাথমিক লক্ষণগুলি হিসাবেবলা হল জ্বর, কাশি আর শ্বাসপ্রশ্বাসে অস্বস্তিবোধ। ততদিনে সমগ্র আমেরিকা বিশেষত উত্তরপূর্ব অংশের নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ম্যাসাচুসেস্টস্ রাজ্যগুলি গভীরভাবে করোনা প্রভাবিত। ততক্ষণে জীবাণু-বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছেন একে অপরের থেকে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে, সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুলে, মাস্ক পরে ঘুরলে, নিজেকে পরিষ্কার রাখলে হয়তো করোনাকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে। এক থেকে দুই হপ্তার মধ্যেকরোনার তীব্র প্রকোপের জেরে তখন নিউঅরল্যান্স্ সংলগ্ন এলাকাতে স্বাস্থ্যপরিষেবা বিকল হওয়ার জোগাড়। মাত্র চারহপ্তার ব্যবধানে লুইজিয়ানাতে তখন দশ হাজারের কাছাকাছি জনগণ করোনায় কাবু।

এপ্রিলের শুরুতে আমাদের রাষ্টন সংলগ্ন ওচিতা এবং লিঙ্কন প্যারিসেও  করোনা তার মরণ কামড় বসাল। চারিদিকে গাছ ছমছমে ভাব, এইবুঝি করোনার মারণ আঁচ গায়ে এসে লাগলো। পাড়া পড়শির মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ বন্ধ, শুধু ফোনালাপ। ইন্টারনেটে তখন খবর উড়ছে এই ভাইরাস মানুষ ছাড়াও সাময়িকভাবে বায়ু দ্বারাও ছড়ায়। কাছাকাছি কারুর শরীর খারাপের খবর শুনলেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত্ করে উঠত এইভেবে, যে এইবুঝি আমার পালা। কাউকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখলেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার শোচণীয় পরিণামের কল্পনার জেরে মনের ভেতরটাকে টালমাটল করে উঠত। আচমকা, অস্বাভাবিক ভাবে মানুষ হয়ে মানুষের সংস্পর্শকে ভয় পেতে শুরু করলাম।ভেবে অবাক হলাম সারা বিশ্বের সেইসব অতিমানব এবং অতিমানবীদের কথাভেবে যারা নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে করোনায় আক্রান্তদের সারিয়ে তোলার, সেবা শুশ্রুষা করার, মানুষকে আপৎকালীন পরিষেবা দেওয়ার অবিরাম প্রয়াস করে যাচ্ছেন। বুকঠুঁকে সেলাম জানালাম তাদের দৃঢ়চেতা মানসিকতাকে, বুঝলাম বিপদের দিনেই অনুধাবন করা যায় আসল বন্ধু, ভগবান কারা। একদিকে রোজকার একঘেয়ে কাজ থেকে অনির্দিষ্ট বিরতির পেয়ে বাড়িতে থাকার আনন্দ আবার অন্যদিকে রোজকার কাজের অনুসূচির অভাববোধ, সবমিলিয়ে আকার নিল একধরণের একাকিত্বে আকস্মিক অবসাদে।এই বৈপরীত্যে ভরা দ্বিবিভাজিত অবচেতনে নতুন করে উপলব্ধি করলাম কবিগুরুর লেখা গানের কিছু অংশ “বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই বনেতে যাই দোঁহে মিলে, খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি আয়, খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।”

আমার লেখার শেষে সরকারি সূত্র অনুযায়ী বেইউতে প্রায় সাঁইত্রিশ হাজারের ওপর, প্রায় দুহাজারের বেশী লোক করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে আমেরিকার অন্যান্য প্রদেশের নিরিক্ষে বেইউের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। যদিও সারা বিশ্বে বিপদের রেশ এখনও সম্পূর্ণভাবে কাটেনি তবুওপ্রত্যাশা করি খুব জলদি আমরা এই আকস্মিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক হতে পারব। প্রার্থনা করি আমরা সবাই এই শোচণীয় পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠব। আশারাখি অবস্থার পরবর্তিতে আমরা সবাই নতুন করে বুঝবো মানুষ হয়ে জন্মানোর মানে, অনুধাবন করব সামাজিক মূল্যবোধের, ভালবাসব এবং শ্রদ্ধা করব একে অন্যের সঙ্গ আর সংস্পর্শকে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.