► রত্নদীপা দে ঘোষ / কী কথা তাঁহার সাথে

কী কথা তাঁহার সাথে / রত্নদীপা দে ঘোষ

সাংবাদিক ঃ 

ঈশ্বরের নিজের হাতে আঁকা উপারা নারী আপনি । চিরকালীন ম্যাগনোলিয়া । কখনো নিজের শঙ্খওড়াটি দেখেছেন ? কথা বলেছেন একার সঙ্গে ? 

মিসেস সেন ঃ 

মুখের কিন্তু নানা রকমের কেয়ারি করা দ্বীপ আছে । এই যেমন ধরো এই মুহূর্তে মুখটি লোকসঙ্গীত । একতারায় স্নান গোলা বাউল । খুব ইচ্ছে উড়ে যাই ... অনেক দূর... কুচি কুচি পান্নার চুমকি। ঢাকের শব্দ কোঁচড়ে পুরে শুধু উড়তেই চাই ... এই যে তুমি এখন আমাকে শুনছো খুব মন দিয়ে আর ফুলের কুচিপুড়িতে ভেসে আসছে তাজা গানের রক্ত । দেখেই বুঝতে পারছি তোমার পাপড়ি আর দলমণ্ডলে হইচই হচ্ছে খুব ... 

জানো, আমি যখন নিজের মুখের দিকে যখন তাকাই , সত্যি বলছি তেপান্তরের আরশি ছাড়া কিছুই দেখি না ... তুমি কি আরও কিছু দেখো , দেখতে পাও আমার মুখে? 

সাংবাদিক ঃ 

নিশ্চয়ই ... আরও অনেক কিছু দেখি । নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে নিয়ে যাই আপনার অস্ত্রাগারে । তবু আপনার সামনে আমাদের বাদ্যযন্ত্রটি কয়েক ফোঁটা সানাই মাত্র । বিবাহবাসর যেন। আবহাওয়ায় মিশে যাচ্ছে বিপন্নতা ... চন্দ্রবাতাস... আপনি কি টের পান না ? আপনার সমস্ত মন্ত্রসম্ভাবনায় আমরা লাগাতার অভিজ্ঞান হয়েই যাচ্ছি ... যদিও এখন সমুদ্র অনেক শান্ত , যদিও বকুল দেবদারু এখন জারণের তিথিময় , ধুলো ধুলো যন্ত্রণায় আমাদেরও কিন্তু অনেক অগ্রন্থিত কবিতা আছে আপনার জন্যে ... আপনি যেমন এখানে আছেন । আপনি সেখানেও থাকেন । কী মনে হয় আপনার ? ... নদীর বিশেষণে এইটুকুই আপনার নিজস্ব সর্বনাম ? 

মিসেস সেন ঃ 

এ আমার স্বপ্নভ্রমণ । সুড়ঙ্গের অগুরুচন্দন চেয়েছিলুম একদম শুরুপর্বে । তোমরা কেউ তার টুঁ শব্দটি টের পাওনি । আমি নিজেও কি সম্পূর্ণ আমার করে পেয়েছিলুম সেই জল অথবা না-জলের সারসপ্রধান এলাকা । মথসাঁতারের অদ্ভুত অনুভূতি ... জানো , এখনো সেই সমস্ত পাখিবোনা আকাশকেদারায় সময় কাটে আমার হাতে গোনা প্রজাপতি ... বাদলভিক্ষু । লালনআধুলিতে ভিজে ভিজে এই ভিক্ষাপাত্র ... 

সাংবাদিক ঃ 

এবার একটি ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করছি ... কখনো পাইনবনে লুকিয়ে শিলং পাহাড় ছুঁয়েছেন ? অথবা প্রকাশ্যে পঞ্চবটীর নাগাতরঙ্গ । উন্মাদ হাত ধরাধরি ? 

মিসেস সেন ঃ 

তুমি দেখেছ কখনো অন্ধকার রঙের রোদ ? অথবা রোদ রঙের অন্ধকার ? কখনো ভালবাসা দেখেছ , রাই থেকে রক্তাক্ত হয়ে ওঠা মাহেন্দ্রক্ষণ ? ধরো দুটি চাঁদ একটি বৃক্ষকে আশ্রয় করে রয়েছে ... আর প্রজাপতিরা গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে শিকারের উদ্দেশ্যে । বৃক্ষ বুঝে উঠতে পারছে না সে এখন কি করবে ? শরীর থেকে একটি চাঁদ ঝরিয়ে দেবে ? নাকি দুটি চাঁদের উষ্ণতায় মুখ ডুবিয়ে দেখতে পাবে সমান্তরাল আরেকটি চাঁদ ... মীনরাশিতে ঝরানো আপেলের রাতভোর গেঁথে আছে ... নাকি চাঁদের মত অন্য কেউ ... তৃতীয় রাশিতে দেওয়ালের কৃপাণ বুকে ঠেকে গেলে কেউ কি আর হাত ধরাধরি করে ? বালুকণার লাল , নীল চতুষ্কোণ । কুহকের বিরামপেন্সিলে আমি বুঝি এখনো অদৃশ্য হতে পারি নি ... 

সাংবাদিক ঃ 

আচ্ছা , এবার বলুন তো ... আপনি অন্ধকারকে ভয় পান ? না আলো ? 

মিসেস সেন ঃ 

আলো মানেই অনেক ভয় । নক্ষত্রের বাজুতে প্রহর হারানোর ভয় । চিঠিফেরত খোলা বাগানে ডাকবাক্স হারানোর ভয়। যেন আর কোনোদিন আমাকে কেউ চিঠি লিখবে না । যেন জড়োয়া বাতিস্তম্ভটি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে গেছে । যেন অস্তাচলে দাঁড়িয়ে এক বৌদ্ধভিক্ষু আমাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন । ভিড় জমে গেছে চারদিকে । পুরোহিত চিৎকার করছেন ... না না ... তোমার হাতের আষাঢ় ... তোমার বুদবুদবৃষ্টি আজ থেকে আর কেউ ছোঁবে না ... কেউ ছোঁবে না তোমার রাধাভাবের দুঃখবিলাস ...রাস্তায় থমকে যাচ্ছে ল্যাম্পপোষ্ট , সাইক্লোন ভেঙ্গে পড়ছে পিঠের ওপর ... আঙ্গুলের টরেটক্কা... 

অই যে ম্যাজিক আঁকা অ্যালবামে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে নিশিডাকের অহল্যা । সমস্ত আয়ু উথালপাতাল করে আমার থেকে আমাকেই যেন কেড়ে নিচ্ছে কেউ ... 

এবং ঘুম । ঘুম ভাঙছে আমার । আমি যেন আর শুয়ে বসে থাকতে পারছি না । মন বসে আছে তরুণ তানপুরায় । মধ্যবয়েসী এক লয়কারি আমাকে ডেকে বলছে , শোনো শোনো ... মেয়ে , তোমাকেই বলছি ... অই যে তানপুরা দেখছ। বালি কাঁকড় আর মাঠ সরিয়ে দক্ষিণঘরের দরজা ... ওর গায়ে আলো নেই এতোটুকু ... সুর আছে ... অন্ধকারের সুর । তোমার জন্যে ছটফট করছে কালো বোরখা ... আমি তাকে ছুঁয়ে ফেলেছি ততোক্ষণে । বিপুল আমোদে কেঁপে উঠছি । যন্ত্রণার ভেতরে জড়িয়ে ধরে বলছি ... সুরে সুরে কোনো অজুহাত নয় । আমিও অপেক্ষায় । অন্ধকারে কাউকে হারাবার ভয় নেই । এমনকি স্বয়ং অন্ধকারকেও নয় ... 

সাংবাদিক ঃ 

আপনি কি অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছেন ? বা অন্য কোন স্বপ্ন ... যেমন ছবি আঁকা , মৃৎ-শিল্পী অথবা ধরুন কনকাঞ্জলির বিপুল সেই বিপুল মায়ামৃগটি ? 

মিসেস সেন ঃ 

আমি তো অভিনয়কে পেশা হিসেবে বাছিনি কখনো । অভিনয় নিজেই আমাকে নেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে । অভিনয়ের কী বিধেয় হয় ? অথবা উদ্দেশ্যহীন পেশাদার ক্যামেরা ? দেখেছ কখনো ? হয়তো আমিই সেই ক্যামেরাত্রিভুজ । শেষ রাতের ফিনফিনে অভিনেত্রী । মেঘকে আঁকড়ে ধরি ... হাল্কা বাতাসে উড়ে যায় আবেশের আইলাইনার । মাস্কারায় ধোয়া আমার নিজস্ব কোন অতীতনাম ... হয়ত স্ফটিকে লেখা সেই মাধুকরী হরফ । হয়তো সেই নাম আজ অব্দি কেউ উচ্চারণই করেনি ... যার মজ্জায় আমি শুধু হেঁটেই গেছি বছরের পর বছর আর জ্বর হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়েছে রঙদার ত্রিশুলের ভুল ... তরবারির লৌকিকতা ... আমার লাজুক স্কুলপাঠ্যসূচি ... ইঞ্চিদুয়েক পাতাঝরার কাঁকনে ... 

এই যে আশ্চর্য টানা টানা চোখের চর্যাপদ ... এখানে অথচ নিজস্ব কোনো দৃষ্টি নেই আমার । যেন সেসব কবেই বিলিয়ে দিয়েছি পাড়া প্রতিবেশীর সন্ন্যাসযাত্রায় । যেন আমার নিজস্ব কোন আমিও নেই ... নাকি আছে ? তোমরা কি দেখতে পাও কখনো ... আমার দরজা খোলা ... হাট করে মেলা শবের রামধনু ... আমি ঠিক কী যে চাই ... নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে পেরেছি আদৌ ? 

খুব ইচ্ছে ছিল জানো , রবিঠাকুরের গানগুলো এক এক করে সব এঁকে ফেলি । এঁকেও ছিলুম ক’টি ... ঘোর গ্রীষ্মে একবার আঁকতে চেয়েছিলুম দারুণ অগ্নিবাণ ... কী আর বলি ... সে অবাক কাণ্ড ... যতই আমি আঁকছি আর অগ্নিবাণের ভেতরে ডুবিয়ে দিচ্ছি আগুনের কুণ্ডলী ... আগুন কোথায় ... হল্কাই বা কই । ঝিনুক উঠে আসছে শুধু ... মুক্তোর গহ্বর থেকে উঠে আসছে আমার ধনুকভাঙা ইচ্ছেঝিনুক ... এতোটুকু গরম বোধ হচ্ছে না ...... তাপ নেই ... হাজার দুয়ারের পাতালরেল নেই ... আমাকে আঁকড়ে ধরে কেদারের তালে তালে নাচছে বরফের সাপ , ব্রহ্মাণ্ডের নাকের দু’পাশে কৃষ্ণগহবর ... পোষা বিষের থলি , শেষনাগের আভাষ পাচ্ছি ... তাকে ধরি নাকি ছুঁই ...ভাবতে ভাবতে গড়িয়ে যায় বেলা ... কি করি বলো ? অরণ্যে ফেলে আসি তবে অসহ্য সিংহের কেশর আর দুর্বাসার তুলি ? 

সাংবাদিক ঃ 

এবার শেষ প্রশ্ন । আপনি মুখ না মুখোশ ? আপনি কী রঙিন কাগজে ছাপা মায়াবিনী নক্সা ?

মিসেস সেন ঃ 

বরং বলতে পারো আমি না-মানুষের প্রতিবিম্ব আর কায়া । মুখোশের তো অনেক শরীর । অনেক মন । কখনো প্রবল ক্যানসার দিয়ে তোমার গা ধুয়ে দেবে । কখনো মাথা মুছিয়ে দেবে সুখি ব্রেইল। না গো মায়াবিনী হরিণী তো দূর , আমার কাছে ফাল্গুনীরাতের সামান্য কমলহীরেও নেই ... 

বোধিগাছের কোটর খুঁড়ে পরমান্ন পাবো এমন সুজাতাই বা আমার কোথায় ? আর নক্সার কথা বলছ ? .. অই যে দ্যাখো রুলটানা পলাশের তত্ত্ব... শেকড় জড়িয়ে যাচ্ছে জালে ... অনন্ত রূপকথা কাঁধে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে মাছরাঙাদের গ্রাম্যমা । অপূর্ব সৌন্দর্যে লাল হয়ে যাচ্ছে মাধবীলতার কুসুম ...অপরূপ তার জরিবৃত্ত ... ঘূর্ণির ঘুঙ্গুরে ঘুরছে , ঘুরেই যাচ্ছে তার চুপপায়ের নূপুর । অথচ হৃদয়খানি চাকা হয়ে যাচ্ছে না ... আহা ! এমন নক্সাদার নক্সা আমি পাই কোথায় বলো ? আমি কী আর নোলকভরা সন্ধ্যাতারা ? আমার কি গা ভর্তি সোনাঝুরির লালবাঁধ ? আমি কী পূর্ণিমার ঘোরলাগা ময়ূর ... 

তুমি আমার সমস্ত রঙিন কাগজ খুলে দাও । ধূপকাঠি দেখাও বৃষ্টির ধ্রুব । বর্ষা তোমার অক্ষয়সিন্দুকের নাম বুঝি ? বেশ বেশ । পাশের জানালাটি খুলে দাও একটু । আমি শ্বাস নিই । অই রোহিণী শতভিষা , অই জারুলের মৃগশিরা । বাড়িয়ে দিয়েছে হাত ... তারায় তারায় কেটে যাচ্ছে কালপুরুষের কবজ ... আমার মৃত্যু তোমরা শুনো না কেউ ... 

এখনো কত তারা চেনা বাকি । কত ছায়াপথ । অলিগলি । সপ্তর্ষিমণ্ডল যদি চিনতে পারি এক বাক্যে ... আমাকে অহঙ্কারি ভেবো না । শয্যাটি মেলে দিও দীঘিবাতাসে ... শুকতারা কমে এলে আমি নিজেই গাল থেকে মুছে নেব ঘাম । তেলরঙে আগুন করবো নিজেকে ... 

প্রেক্ষাগৃহের কোনো অঙ্কই আমার নিজস্ব জ্যামিতি নয় ... জেনে রাখো ... 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.