- "জল খাবে কিন্তু বেশি করে।"
-"বলো? কাকে বেথি ভালোবাথো?"
- " আমার ছোট্ট বাবাটাকে.."
হাসিমুখে বাসে উঠে জানালার ধারের একটা খালি সিটে গিয়ে বসে অর্ক। রোজ এইসময়ে মা-ছেলের মধ্যে ওই একই কথোপকথন হয়।
একমিনিট পরে নীপা ছুটতে ছুটতে রৌণককে কোলে নিয়ে এসে বাসে তুলে দিয়ে হাঁফাতে থাকে। বাস রওনা দেয় স্কুলের পথে।
-"খুব দেরী হয়ে গেছে রে আজকে! আর একটু হলে বাস মিস করতাম.." হাঁফাতে হাঁফাতে বললো নীপা।
-"এখন রোজ তুই আসছিস যে? আগে তো পুলকদাই ওকে ছাড়তে আসতো!" কথাটা জিজ্ঞাসা না করে আজ আর থাকতে পারলোনা ঋতু।
-"আর বলিস না... ওর যা পরিশ্রম হচ্ছে আজকাল অফিসে! রোজ বাড়ি ফিরতে সাড়ে দশটা বাজছে। আমি ওইজন্যে আর ওকে এত সকালে ডাকিনা রে!"
-"ও.."
- "এই চলি রে.. প্রচুর কাজ এখন। পরে কথা হবে।"
-"হুম্ম.."
ঋতুও নিজের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। এইসময়ে তার নিজেরও ব্যস্ততা কম থাকেনা। বাড়ি গিয়ে ব্রেকফাস্ট রেডি করা, রূপমের টিফিন বানানো, ওর অফিসের জামাকাপড় আয়রনিং- সবই তো তাকে একা হাতে করতে হয়। কোনও ব্যাপারেই ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ভারাক্রান্ত মনটা একটু বিশ্রাম চায়।
বেশ কিছুদিন ধরে ঋতুর সব কাজকর্মে অনীহা- এটা নজর এড়ায়নি তার শাশুড়ি মায়ের। গতকাল দুপুরে এই নিয়ে তিনি ঝামেলাও কম করেন নি ঋতুর সাথে - "মনটা কোন দিকে পড়ে থাকে আজকাল তোমার বৌমা? দিনের পর দিন দেখছি খাবারে নুন কম, সবসময়ে কেমন অন্য জগতে ডুবে থাকো ! কিছু বলিনা বলে মাথায় চড়ে বসছ দিন দিন তাই না?"
চুপচাপ মাথা নামিয়ে কথাগুলো শুনছিল ঋতু.. চীৎকার করে শাশুড়ির মোকাবিলা করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা- কোনওটাই নেই তার। শেষমেষ শ্বশুড়মশাইয়ের ধমক খেয়ে থামলেন তিনি।
-"তখন থেকে বলেই চলেছ মেয়েটাকে। মুখ বুঁজে সারাদিন কাজ করে যায়! কোনওদিন তো ওকে কোনওরকম সাহায্য করতে দেখিনি তোমায়! শোনো! ও এবাড়ির লক্ষ্মী! বাড়ির ঝি নয়.."
এই একটা মানুষের জন্যে, শ্বশুড়বাড়ি নামক খাঁচাটার মধ্যে একটু নিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারে ঋতু।ছয় বছর হলো ঋতুর বিয়ে হয়েছে । বিয়ে করে আর কিছু পাক না পাক- একটা বাবা পেয়েছে সে। নিজের বাবার কাছ থেকে কোনওদিন এত ভালোবাসা পায়নি। পাঁচ বছর বয়সে মা কে হারিয়েছিল। তার দুবছরের মধ্যেই তার বাবা বিয়ে করে স্ত্রীর অভাব পূরণ করলেও, ঋতুর জীবনে আর তার মায়ের অভাব মেটেনি। ঋতুর গ্র্যাজুয়েশনের পরেই সংবাদপত্রের পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে রূপমের মত একজন ‘সুযোগ্য’ পাত্রের সন্ধান পান তার বাবা।
প্রথম দিন দেখতে এসেই ঋতুকে পছন্দ করেন রূপমের বাবা মা। রূপম যদিও সেদিন নিজের কোনওরকম মতামত জানায়নি, হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল, বাবা-মায়ের মত ই তার মত।
বিয়ের ঠিক পর থেকেই বুঝে গেছিল ঋতু, রূপম একেবারে ব্যক্তিত্বহীন। বড় থেকে ছোট- যে কোনও খুঁটিনাটি বিষয়ে মায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল সে। শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানো ছাড়া, ঋতুকে আর তার কোনও প্রয়োজন নেই। প্রথম প্রথম ঋতুর খুব খারাপ লাগতো। স্বামীকে কোনও অভাব- অভিযোগ, সমস্যার কথা জানানোর উপায় তার নেই। রূপমের মত একজন মেরুদন্ডহীন, মা-সর্বস্ব ছেলের কাছ থেকে আর কি ই বা আশা করা যায়? আস্তে আস্তে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে ঋতু।
শুধুমাত্র রূপমের বাবা পরিতোষবাবু, প্রথম দিন থেকেই পিতৃস্নেহে ঋতুকে আপন করে নিয়েছিলেন । শাশুড়ির থেকে পাওয়া সব লাঞ্ছনা আর তিরষ্কার, এই মানুষটার ভালোবাসার আড়ালে চাপা পড়ে যায়। অর্কর জন্মের পরে এক অন্য মোড় আসে জীবনে। অর্ককে আঁকড়ে ধরে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হয় ঋতুর। কিন্তু, মাঝে মাঝেই একটা অজানা অদ্ভুত মন খারাপ এসে ঘিরে ধরে তাকে... শৈশবে মা হারানোর জন্যে- নাকি মনের মতন স্বামী না পাওয়ার জন্যে... সেটা বোঝেনা ঋতু।
নীপা হয়তো এখনও বাড়ি পৌঁছায়নি। পুলককে একটা ফোন করলে কেমন হয়?
কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুলকের নাম্বারে ফোন করে ঋতু। ঘুম-জড়ানো গলায় ফোনটা রিসিভ করে পুলক।
-"গুড মর্নিং.."
- "পুলক......"
- "কি ব্যাপার? এত সকালে ফোন কেন? এনি প্রবলেম?"
- "কেন এমন করছ আমার সাথে পুলক? আমি আর পারছিনা.."
- "আবার সেই পাগলামি? অর্ককে বাসে তুলেছ? নীপা তো গেছে রুনুকে তুলতে.."
- "হুম.. বাস চলে গেছে। নীপা এইমাত্র গেল।"
- "তাহলে তো এখনই চলে আসবে। এই... এখন ছাড়ছি। পরে অফিস থেকে ফোন করবো। বাই..."
- "তুমি ফোন করবেনা আমি জানি..."
- "উফ্! বলেছি যখন করবো, নিশ্চয়ই করবো। এখন ছাড়ছি। নীপা এসে গেছে... বাই।"
ফোনটা ছাড়ার পরে বুকের মধ্যে একটা ব্যথা অনুভব করলো ঋতু। নিজের কাছে নিজে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে সে। বুঝতে পারছে ব্যাপারটা ঠিক না। কিন্তু কি যে অদ্ভুত মোহের বশে পাগলামি গুলো করে ফেলে সে!!. কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারেনা। অথচ এই পুলকই তো একদিন এগিয়ে এসে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে! ব্যাপারটা কি আদৌ ‘ভালোবাসা’ ছিল? ভালোবাসলে কি কেউ অমন করতে পারে?
অর্ক আর রৌণক একই বয়সী। দুজনকে একই স্কুলে নার্সারি তে এডমিট করা হয়েছে আট মাস আগে। স্কুল থেকে শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, স্কুলবাসে বাচ্চাদের জন্যে অ্যাটেন্ড্যান্ট থাকে। কোনও গার্ডিয়ান কে বাসে অ্যালাউ করা হবেনা।
অর্ককে স্কুলবাসে পাঠানোই সুবিধাজনক..কিন্তু অতটুকু বাচ্চাকে একা পাঠানোর ব্যাপারে বেশ চিন্তিত ছিল ঋতু। স্কুল শুরু হওয়ার প্রথম দিনে নীপা আর পুলকের সঙ্গে ঋতুর দেখা হয়। নীপা নিজেই এগিয়ে এসে আলাপ করে..-
- "কোন ক্লাস ওর? নার্সারি?"
- "হ্যাঁ।"
- "এই আমার বাচ্চাও তো নার্সারিতেই ....স্কুল বাসেই যাবে নিশ্চয়ই?"
শুনে ঋতুর উৎকন্ঠা কিছুটা দূর হয়। বেশ একটা স্বস্তি অনুভব করে সে। যাক বাবা! একই ক্লাস... একই জায়গা থেকে বাসে উঠবে... একটু ভরসা পেল এবার ঋতু।
- "আমরা আজ ওকে বাসে উঠিয়ে গাড়ি নিয়ে যাব স্কুল পর্যন্ত।তুমি যাবে আমাদের সাথে?"
- "না মানে..."
পুলক এবার মৃদু হেসে বলে...
-"আরে অত হেসিটেট কেন করছেন? বাচ্চারা প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। বাসটাকে তো একটু ফলো করা উচিত.. কোনও প্রবলেম হতে পারে তো! চলুন উঠে পড়ুন!"
পুলকের অনুরোধ টা ফেলতে পারেনি সেদিন ঋতু। গাড়িতে ওদের সাথে যেতে যেতে বেশ সহজ হয়ে যায় সম্পর্ক টা। নীপা আর পুলক- দুজনেই খুব মিশুকে।ওদেরকে দেখে বোঝাই যায়, বেশ সুখী ওরা দুজনে। কেমন একটা হিংসে হলো নীপা কে দেখে ঋতুর। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে । থাক.. ওসব আর ভেবে কি লাভ? এজন্মে তার আর সুখী হওয়া হলোনা।
-"তোমার নাম্বার টা দাও ঋতু.."
নীপার কথায় ঋতু সম্বিত ফিরে পায় ।
-"হ্যাঁ নিশ্চয়ই.. নাম্বার তো দিতেই হবে। তোমারটাও........."
- "অ্যাক্চুয়ালি, আমার ফোন টা কাল থেকে বিগড়েছে। জানিনা সারিয়ে ঠিক করতে কত সময় লাগবে। তুমি এক কাজ করো। পুলকের নাম্বার টা বলছি, তুমি আপাতত ওটাতেই মিস্ড্ কল দিয়ে দাও।"
- "আচ্ছা.. "
বাসের পেছন পেছন স্কুল পর্যন্ত গেল ওরা। বাচ্চারা কেউ কান্নাকাটি করেনি । ড্রাইভারের সাথে কথা বলে এলো পুলক। ফেরার সময়ে কোনও সমস্যা হবেনা বলে তাদের আশ্বস্ত করলো ড্রাইভার।
দ্বিতীয় দিন আবার অর্ককে বাসে তুলতে গিয়ে ঋতু দেখল, রৌণক আসেনি। অর্ক কে বাসে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ফোন বেজে উঠলো। পুলকের নাম্বার।
-"হ্যালো.."
নীপার গলা ভেসে এলো ওপার থেকে। -"হ্যালো ঋতু! দেখো না কি ঝামেলায় পড়লাম.."
- "কেন? কি হলো আবার?"
- "দেখো না! কাল স্কুল থেকে ফিরেই জ্বর এসেছে রুনুর.."
- "ওমা সেকি?"
- "ঋতু, ওকে তো কিছুদিন এখন পাঠাতে পারবোনা। স্কুলে যদি কোনও ওয়ার্কসিট কিম্বা হোমওয়ার্ক দেয়..........."
- "এটা কি তোমাকে বলে দিতে হবে নীপা? তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।আমি সব পাঠিয়ে দেব হোয়াট্সঅ্যাপ এ .. রুনুর যত্ন নাও।"
- "থ্যাঙ্কস... এই নাম্বারেই হোয়াট্সঅ্যাপ কোরো কেমন? আমার ফোন টা তো এখন......."
- "আচ্ছা.."
তিন দিন ধরে স্কুলের যাবতীয় তথ্য, হোম-টাস্ক সবকিছু পুলককে হোয়াট্সঅ্যাপ করতে থাকলো ঋতু। তার সঙ্গে চলতে থাকলো গুড মর্নিং, গুড নাইট, বিভিন্নরকম মনভোলানো জোক্স- যেগুলো পুলকই বেশি ফরোয়ার্ড করতো। ইতিমধ্যে নীপার ফোন ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও, পুলক আর ঋতুর হোয়াট্সঅ্যাপে খুনসুটি চলতেই থাকে। হঠাৎ একদিন পুলক মেসেজ করলো, ‘ওই, ডিপি টা চেঞ্জ করো প্লিজ! সেই কবেকার একটা বিয়ের ছবি ! রিসেন্ট কোনও পিক দাও।’
হেসে ফেললো ঋতু.. উত্তরে লিখল..
- ‘কেন? ছবিটা ভালোই তো!’
-‘মোটেও না। তুমি এখন অনেক বেশি সুন্দর..’
তড়িতাহত হলো ঋতু। কিন্তু তার সঙ্গে কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলো মনের ভেতর।এতটা বাড়াবাড়ি কি ঠিক হচ্ছে? মেসেজের আর কোনও উত্তর দিলো না সে।
পরের দিন অর্ককে বাসে তুলতে গিয়ে দেখা হলো পুলকের সাথে । ওই সময়টা নীপার অনেক কাজ থাকে বলে পুলক ছাড়তে আসে রৌণককে। ঋতু তাকে দেখে মুখ নামিয়ে নিলেও, পুলক একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। সেই একইরকম আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।কোনওরকম অস্বস্তি বা অপরাধবোধ নেই পুলকের মধ্যে। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলবাস চলে যাওয়ার পরে ঋতু মুখ ফিরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো পুলক।
-"ঋতু দাঁড়াও..."
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে পিছন ফিরে তাকালো ঋতু। পুলকের চোখে কী যেন একটা আছে.. চোখে চোখ রাখলেই ঋতু কেমন অপ্রতিভ বোধ করে। সেটা যাতে ধরা না পড়ে , তাই চোখটা নামিয়েই উত্তর দিল পুলককে.....
-"কি বলবেন বলুন, আমার তাড়া আছে।"
-"কালকের মেসেজটার জন্যে রাগ করেছ?"
কোনও উত্তর দেয়না ঋতু। পুলক হাসে।
-"আমি জানি.. ওটা রাগ না, ভয়।"
ঋতু এবার অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায় ..
প্রাণবন্ত, সুন্দর একটা হাসি পুলকের মুখে।
-"কিচ্ছু যায় আসে না আমার! যতই মুখ ফিরিয়ে নাও, ঐ ছবিটা আজ তুমি চেঞ্জ করবেই.. আমি কিন্তু ওয়েট করবো ঋতু।"
ঋতু এবার একটু রাগ প্রকাশ করে বললো- "আসি.."
কিন্তু ওর অভিব্যক্তি দেখেও একটুও দমে গেল না পুলক। সেই একই রকম হাসি। মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল ঋতু।
পুলকের এই নাছোড়বান্দা স্বভাবটাই প্রথম থেকে আকর্ষণ করে ঋতুকে। সে ঠিক এরকমই একজন পুরুষকে চেয়েছিল জীবনে। কেমন একটা নাম-না-জানা ভালো লাগার গন্ধ পাচ্ছে সে আজ। সারাদিন ধরে নানা কাজ আর ব্যস্ততার ফাঁকে শুধু পুলকের চিন্তাই মাথায় আসছে । বারবার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখছে .. কিন্তু না! পুলকের কোনও মেসেজ তো আজ আসছে না?
দুপুরবেলা লাঞ্চের পরে মোবাইল ঘাঁটাঘাটি করে নিজের একটা সুন্দর ছবি খুঁজে বার করে ঋতু। কিছুদিন আগে খুড়তুত ননদের বিয়েতে তোলা ছবি। হলুদ শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। ডিপি চেঞ্জ করে অপেক্ষা করতে থাকলো ঋতু। কয়েক মিনিট পরেই পুলকের মেসেজ... ‘বিউটিফুল! হলুদ রঙে দারুণ মানায় তোমাকে।’
-"ভীষণ ভীষন দুষ্টু তুমি".... আপনা আপনিই যেন ঋতুর মুখ থেকে সেদিন বেরিয়ে এসেছিল কথাটা।
আস্তে আস্তে সম্পর্ক বেশ গভীর হতে শুরু করে ওদের দুজনের । দিন দিন নিজের অজান্তেই ঋতু মনেপ্রাণে জড়িয়ে যাচ্ছিল পুলকের সঙ্গে। রোজ সকালে বাচ্চাদের স্কুলবাসে ছাড়তে গিয়ে দেখা হয় দুজনের । মাঝে মাঝে সবাইকার নজর এড়িয়ে ঋতুর হাতটা শক্ত করে ধরে পুলক। শিহরিত হয়ে যায় ঋতু। আশ্রয় খুঁজে পায় পুলকের ছোঁয়ায়।রোজ দুপুরে অফিস থেকে ফোন করে পুলক। শনি রবিবার বাচ্চাদের স্কুল ছুটি থাকে। পুলকের অফিসও। কিন্তু পুলক ঠিক ম্যানেজ করে ফোন করে ঋতুকে। একটা দিন পরস্পর কথা না বলে এখন থাকতেই পারে না ওরা। ছোট থেকে বড় , তুচ্ছাতিতুচ্ছ সমস্ত ব্যাপার একে অপরের সাথে শেয়ার করাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে ওদের দুজনের ।
পুলক মাঝে মাঝেই বলে- "আর পারছিনা সোনা, আর সহ্য হচ্ছেনা। তোমাকে নিবিড়ভাবে কাছে পেতে চাই ঋতু...”
একথার কোনওদিন কোনও জবাব ঋতু দেয়নি।
একদিন হঠাৎ ফোন করে পুলক বললো-
-"ঋতু, আজ রাতে নীপা ওর মায়ের কাছে যাবে রুনুকে নিয়ে দুদিনের জন্যে। রুনু এই দুটো দিন ওখান থেকেই স্কুল করবে।"
- "ও আচ্ছা.."
- "এই এতদিনে আমরা একটা সুযোগ পেয়েছি ঋতু। কাল আমি অফিস যাবো না। তুমি অর্ককে বাসে তুলে আমার কাছে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো.."
- " কিন্তু পুলক..."
- "না .. কোনও বাহানা নয় সোনা! কাল কোনওভাবে ম্যানেজ করো বাড়িতে । বলবে, অর্কর স্কুলে পি.টি.এম ... সময় লাগবে । একেবারে অর্ক কে নিয়েই বাড়ি ফিরবে..."
-"পুলক এমন কোরো না। কিছুকিছু ব্যাপারে নিজেরা সংযত থাকাই ভালো.."
- "এতদিন তো সংযতই ছিলাম ঋতু! আর কতদিন? আমরা তো কারোর কোনও ক্ষতি করছিনা.. একে অপরকে ভালোবাসতে পারি, আর কাছে আসতে চাইলেই দোষ? তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো ঋতু?"
ঋতু কিছুতেই বোঝাতে পারে না ওকে। ফোনটা রেখে দিয়ে ভাবতে থাকে। হ্যাঁ.. সে নিজেও চায় পুলককে নিবিড়ভাবে কাছে পেতে। নিজেকে পুলকের কাছে সঁপে দেওয়ার জন্যে মনপ্রাণ ছটফট করে তার। কিন্তু একটা অজানা অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাকে। নীপার ঐ সহজ, সুন্দর হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভাসে।ঋতুকে খুব কাছের বন্ধু বলেই জানে সে।কিন্তু তার অগোচরে এখন যেটা হয়ে চলেছে, সেটা কি প্রতারণা নয় একটা মেয়ের সাথে?
পরের দিন বাস চলে যাওয়ার পরে মিনিট দুয়েক ঋতু সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। স্টপেজ থেকে পাঁচ মিনিট দূরে নীপা-পুলকের ফ্ল্যাট। পুলক অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সেখানে দাঁড়িয়েই পুলককে কল করলে ঋতু।
- "হ্যালো.. চলে গেছে বাস? এসো ডিয়ার! ইগারলি ওয়েটিং ফর ইউ।"
- "আমি পারবো না পুলক.."
- "মানে? কাল ই তো কথা হলো .. তোমার জন্যে ছুটি নিয়েছি আজ... লাভ ইউ সোনা, এমনি করেনা... আমি অপেক্ষা করছি..."
- "ক্ষমা করে দিও পুলক, আমার পক্ষে সম্ভব না। আর কোনওদিন এই অনুরোধ করবেনা আমাকে। আমি নীপাকে ঠকাতে পারবো না.."
ফোনটা কেটে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলো ঋতু। সেদিনের পর থেকে আর একবারের জন্যেও পুলক নিজে থেকে ফোন করেনি ঋতুকে। সাতদিন কেটে গেছে। প্রথমটা ঋতুর মনে হয়েছিল, পুলকের অভিমান হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঋতু যতবার ফোন করে-পুলক হয় ফোন ধরেনা, নয়তো ভীষণভাবে উপেক্ষা করে ওকে... ঋতু বার বার আহত হয়। তারা দুজনে তো এতদিন খুব ভালো বন্ধু ছিলো। একে অপরের সাথে কথা না বলে থাকতেই পারতো না। শারীরিক সম্পর্কে ঋতু আপত্তি জানিয়েছে বলে পুলক আর সম্পর্কই রাখতে চায়না? পুলক কি তবে শুধুই শরীর চেয়েছিল? মনের যোগাযোগের কোনও দামই নেই?
#
পুলক আজ ফোন করবে বলেছে। সকালে একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল ঋতু। ঠিক দুপুর দুটোর সময়ে ফোন এলো। আগেও ঠিক এই সময়েই ফোন করতো ও। মনে একরাশ আনন্দ নিয়ে ফোনটা ধরলো ঋতু....
- "পুলক! ......"
- "হ্যাঁ বলো.. তুমি ঠিক কি চাও বলো তো ঋতু? বার বার ফোন করে আমাকে ডিসটার্ব করো কেন? জান তো আমি কতটা বিজি থাকি! "
- "মানে? এসব কি বলছ পুলক? আমরা তো আগে কত কথা বলতাম....."
- "হ্যাঁ বলতাম.. কিন্তু আমি একটা ভদ্র সুন্দর বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম ঋতু.. তুমি তো বন্ধুত্বের যোগ্যই নয় দেখছি । জানো, আজ সকালে আমাকে কল করে কতটা বিপদে ফেলে দিয়েছিলে? নীপা জিজ্ঞাসা করছিল বার বার - এত সকালে কার ফোন এসেছে.... আমরা টিনএজার প্রেমিক-প্রেমিকা নয় ঋতু, দুজনেরই স্টেবল ফ্যামিলি আছে......"
এসব কি শুনছে ঋতু ? এই পুলকই আগে কতবার সময়-অসময়ে ফোন করে বিপদে ফেলেছে ওকে! ফোন টা ছেড়ে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে সে। কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে।লজ্জায় অপমানে চারপাশটা যেন গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।
হঠাৎ মাথার ওপর আলতোভাবে একটা হাত এসে স্পর্শ করে। মুখ না তুলেই বুঝতে পারে... এই স্নেহের স্পর্শটা খুব চেনা ওর। পেছন ফিরে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ঋতু। অবাক হয়ে যান পরিতোষবাবু।
-"কি হয়েছে মা? কিসের কষ্ট? রূপম কিছু বলেছে?"
- "না বাবা! আমার কিছু ভালো লাগছে না.. আমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে বাবা?"
পরিতোষ বাবুর মুখে হাসি ফোটে। কোনওদিন এরকম আব্দার করেনি ঋতু তাঁর কাছে।
- "ও এই ব্যাপার? কোথায় যেতে চাস তুই বল..."
- "যেখানে খুশি বাবা! তোমার ইচ্ছা।"
- "বেশ.. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ব্যবস্থা করছি। তুই গোছগাছ শুরু কর।ওরা মা ছেলে যদি আপত্তি করে, তুই আমি আর দাদুভাই মিলেই চলে যাব।"
চোখের জল মুছে মাথা নেড়ে সায় দেয় ঋতু। চকিতেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। জীবনে এই দুটো মানুষকে তো পাশে পেয়েছে সে। বাবা আর অর্ক। তাদের ভালোবাসার কোনও দাম নেই নাকি? শুধুমাত্র নারী-পুরুষের প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের ব্যর্থতা একটা জীবনকে কখনই শেষ করে দিতে পারেনা।
পরের দিন বাসে ওঠার আগে সেই এক প্রশ্ন অর্কর...
-"কাকে বেথি ভালোবাথো?"
- "আমার ছোট্ট বাবা টাকে"
বাস ছেড়ে চলে যায় । মুখে হাসি নিয়ে বাড়ির রাস্তার দিকে ফিরতেই কানে এলো পুলকের গলা....
- "ঋতু....."
- "আরে তুমি?.."
- "কালকের জন্যে আমি এক্স্ট্রিমলি........"
- "এই আমার এখন প্রচুর কাজ। ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার থাকলে নীপাকে বলে দিও। ওর থেকে শুনে নেব। বাই.."
খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে ঋতু।মেজাজ বেশ ফুরফুরে আজ। অর্কর প্রশ্নের উত্তরটা পুরোপুরি দেওয়া হলোনা। তার মাম্মাম নিজেকেও ভালোবাসতে শিখেছে এখন।
সুচিন্তিত মতামত দিন