► জিনাত রেহানা ইসলাম / গণতন্ত্র ও গোপনীয়তা

জিনাত রেহানা ইসলাম / গণতন্ত্র ও  গোপনীয়তা
গণতন্ত্রের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। পায়ে পায়ে গোপনীয়তার বৃত্তে উঁকি দিচ্ছে রাষ্ট্র। দেশে চালু হয়ে গেছে অটোমেটেড ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম বা এ এফ আর এস বা স্বয়ংক্রিয় মুখ স্বীকৃতি পদ্ধতি । বেশ কিছু চিহ্নিত রাজ্যের কাছে চাওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট দিনের সি ডি আর বা কল ডাটা রেকর্ডস।আমজনতার স্বেছায় শেয়ার করা তথ্য চাওয়া হলে নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতায় কি হস্তক্ষেপ নয়? এ নিয়ে চর্চা অব্যাহত। গোপনীয়তা আংশিকভাবে সুরক্ষা এবং জনস্বার্থ ও সম্প্রীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লে তবেই তথ্যের যথাযথ ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্র। জানা গেছে, সরকার মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ট্র্যাক করার জন্য একটি স্বয়ং-আপডেট, অনুসন্ধানযোগ্য তথ্যশালা তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নাগরিকের ধর্ম, বর্ণ, আয়, সম্পত্তি, শিক্ষা, বৈবাহিক অবস্থা, কর্মসংস্থান, শারীরিক সক্ষমতা এবং প্রতিটি একক নাগরিকের পরিবার-বৃক্ষের ডেটা থাকবে এখানে। তবে সাধারণ মানুষের ব্যক্তি পরিসরে সরাসরি ঢুকে পড়ার অধিকার সরকারের কতখানি কাম্য এবং সরকার নাগরিকের গোপনীয়তায় অযৌক্তিক আগ্রাসন চালাতে পারে কিনা বিতর্ক তাই নিয়ে। 

স্বয়ংক্রিয় মুখ স্বীকৃতি পদ্ধতিতে নিজের মুখই হবে নিজের বিরুদ্ধে হাতিয়ার। এই পদ্ধতি মেক –আপ,প্লাস্টিক সার্জারি বার্ধক্য এমন কি স্কেচের বিরুদ্ধেও কাজ করে। প্রাথমিকভাবে এটি অপরাধ ও অপরাধ অনুসরণকরণ অন্তর্জাল ও তথ্যশালা হিসেবে কাজ করবে এমনটাই ছিল স্বারাষ্ট্রদপ্তরের বয়ান। তথ্যশালায় থাকবে অভিযুক্ত,কয়েদি,হারানো খুঁজে পাওয়া ব্যক্তি, নাম – ঠিকানাহীন ব্যক্তি,বাচ্চা ও অপরিচিত মৃত ব্যক্তি। এটিকে সংহত ফৌজদারি বিচার, বিদেশী নিবন্ধকরণ ও অনুসরণকরণ এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অসম্পূর্ণতা ও বৈষম্য। এসেক্স বিশ্ববিদ্যালযয়ের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে পদ্ধতিটি ৮১% ক্ষেত্রে ভুল ফলাফল দিয়েছে। এর ফলে এমনটা ঘটতেই পারে যে, একজন নির্দোষ অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত হলেন এবং বন্দি হলেন। চিহ্নিত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সুবাদে অনেক নিরীহ মানুষ অহেতুক সন্দেহের তালিকায় চলে এলেন। 

স্বয়ংক্রিয় মুখ স্বীকৃতি পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোনও ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আইন প্রয়োগকারীদের কাছে নিজেকে বিপণন করতে গিয়ে এক সংস্থা বলেছিল যে, তারা তাদের সফ্টওয়্যারটির পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা বা গবেষণা করেনি। আরও যুক্ত করেছিল যে, প্রযুক্তির বর্তমান সীমাবদ্ধতাগুলির সঙ্গে সঙ্গে সফ্টওয়্যারটির কিছু ত্বকের রঙ সনাক্ত করা নিয়ে ধন্ধ আছে। খুব কালো ত্বকের ব্যক্তিদের মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে উচ্চ তাৎপর্য্য সহকারে সনাক্ত করা শক্ত। এমনকি খুব ফ্যাকাশে ত্বকযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একইরকমভাবে কঠিন। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মহিলাদের মুখের তুলনায় পুরুষদের মুখের উপর এই পদ্ধতি ভাল কাজ করে। এক নামী সংস্থার প্রেসিডেন্ট এ প্রসঙ্গে তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন যে, গণ নজরদারি করার জন্য মুখের স্বীকৃতি পদ্ধতির প্রযুক্তির ব্যবহার গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দখল করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এই প্রযুক্তিকে অন্ধকার এবং চকচকে সানগ্লাস পরে ধোঁকা দেওয়া যেতে পারে । জাপানের জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইনফ্রা-রেড এলইডি দেওয়া চশমা নিয়ে এসেছে যা স্বয়ংক্রিয় মুখ স্বীকৃতি পদ্ধতিকে ব্যর্থ করে দেয়। 

বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই আশঙ্কা করছেন যে নতুন প্রযুক্তিটি যে সম্প্রদায়গুলিকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করছে বলে দাবি করছে বাস্তবে তাদের ক্ষতি করতে পারে । এটিকে একটি অসম্পূর্ণ বায়োমেট্রিক পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করা যুক্তিযুক্ত। লন্ডন পুলিশ এই পদ্ধতি প্রয়োগের পরে বৈষম্য ও অসঙ্গতির শিকার হয়েছে। সান ফ্রান্সিসকো এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করেছে। অনান্যদের এমন অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর বদলে এই বিতর্কিত ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হয়েছে সাম্প্রতিককালের দিল্লীর দাঙ্গায়। উদ্বেগের কারণ এই যে, সেই সময় রাস্তা জুড়ে পীড়িত মানুষের ভিড় ছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে মুখ স্বীকৃতির ব্যবস্থা কতখানি নিশ্চিত করবে জনগণের সুবিচারের পাওয়ার অধিকার। 

কেন্দ্রীয় তথ্যশালা তৈরির ক্ষেত্রে সমস্যা হল যে বিভিন্ন ডাটা থেকে তথ্য একীকরনের মাধ্যমে সংহত করা হয় সেগুলি নির্ভুল নাও হতে পারে। কি কারণে সেগুলি একত্রিত করে কার্যকর করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য নিয়ে নাগরিককে অন্ধকারে রাখা। তথ্যশালার আওতায় আসা ব্যক্তির হাতে আমেরিকার মত গোপনীয়তা ও তথ্যশালায় সংযুক্তিকরণের সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত হাতিয়ার নেই। সেক্ষেত্রে সে রাষ্ট্রের সামনে অসহায়। 

প্রায় দুই দশক পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন নজরদারি পদ্ধতিকে কোভিড-মারীতে ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছেন। চীন ইটালি,দক্ষিন কোরিয়ার পর এবার ভারতও আনছে কোভিড মোকাবিলার অ্যাপ। অবস্থান নির্ণয়ের প্রযুক্তি ভাইরাস চিহ্নিতকরণে ও স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিকল্পনা রুপায়নে ভূমিকা নেবে। স্বয়ংক্রিয় মুখ স্বীকৃতি পদ্ধতি নিয়ে আসা দিল্লির সেই সংস্থাই নিয়ে আসছে আনমেজ অ্যাপ।এর সাহায্যে চিহ্নিত হবেন কোয়ারিন্টাইন অমান্যকারীরা। আনমেজ সহ কবচ ও কোইন-২০ অ্যাপ ব্যক্তির অবস্থান নিরবচ্ছিন্নভাবে অনসরণকরণের মধ্যে দিয়ে সফলভাবে কাজ করবে। সমস্যা সেখানেই। এ মুহূর্তে এই অ্যাপগুলি কি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আনবে ভাইরাস সংক্রমণে সেই বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা ও যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয় বলে প্রকাশ করেছে এক প্রযুক্তি সংস্থা । একমাত্র দক্ষিন কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলির পরিচালক জানিয়েছেন যে, মানবাধিকার ও গোপনীয়তা রক্ষার মান এবং সংক্রমণ রোধে জনস্বার্থকে সমর্থন করার মানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে তারা চলবে। 

নাগরিক স্বাধীনতা বিশেষজ্ঞরা আগেই হুশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এই ডিজিট্যাল অনুশীলনগুলিকে চ্যলেঞ্জ জানাতে নাগরিকের কাছে উপায় সীমিত। অন্যদিকে স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার। মানবাধিকারের যাত্রা শুরু এখান থেকেই। একবার এই পদ্ধতির আওতায় এসে পড়লে ব্যক্তি অজান্তেই রাষ্ট্রীয় নজরদারীর আওতায় পড়ে যায়। এই নজরদারি কতদিন কিভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ে ওয়াকিবহাল হওয়ার কোনও উপায় থাকে না। সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্ত ব্যক্তিরও গোপনীয়তায় চলতে থাকে ছানবিন। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি খুঁজতে রাষট্রযন্ত্র নাগরিকের অন্য একটি অধিকার অস্বীকার করে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করছে। গোপনীয়তা ও জাতীয় সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চাবিকাঠি তথ্যের প্রাচুর্য নয়, তথ্যের প্রকৃতি। তাই তথ্য সংগ্রহের অধিকার ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার দিক নিয়ে আলোচনা খুব জরুরি। ব্যক্তির তথ্য ও জীবনের অধিকার নিয়ে সরকারী অপব্যবহার থেকে নাগরিককে রক্ষা করার দায় সরকারের। তথ্য সংগ্রহের দক্ষতার চেয়ে তথ্য বিশ্লেষণের সরঞ্জাম বেশি প্রয়োজন। মারি,দাঙ্গা ও সংকট মিটে গেলেও নজরদারির আতঙ্ক পিছু ছাড়বে না নাগরিকের। মানুষের জীবন ও গোপনীয়তার অধিকার রক্ষার কাজ গনতান্ত্রিকতাবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেশের জন্য। আর দেশে মানুষের জন্য। মানুষের স্বস্তি ও বিশ্বাস অর্জন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এক সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য। তাই ডিজিট্যাল নজরদারির প্রযুক্তি সম্প্রসারণের এক নির্দিষ্ট গাইডলাইনও আবশ্যক। রাষ্ট্র ও নাগরিকের যৌথ সম্মতির সিলমোহর তাতে থাকা দরকার। 


Previous Post Next Post