পৃথিবী আজ যন্ত্রণায় অস্থির। এক অচেনা ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। আর্তনাদ করছে মানুষ। খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রেখেছে ভাইরাস। বেরোলেই ছোবল দেবে মৃত্যু। একান্ত নিজের, আপনজন জড়িয়ে ধরা তো দূর, স্পর্শ করা যাচ্ছেনা আঙ্গুলটুকু। ধনকুবের বৃদ্ধ পথে ঘাটে ছড়িয়ে দিচ্ছে সম্পদ। বন্ধ হয়ে আছে, বিলাসবহুল হোটেল। ক্লাব। মূল্যবান বিপণী ঠাসা বাজার।
পরস্পরের দিকে সহানুভূতি নয়, তাকাচ্ছে সন্দেহের দৃষ্টিতে। মৃত্যুতে রেহাই মিলছে না মানুষের। দাহ হচ্ছে না, দফন হচ্ছে না... ভাইরাস হতে দিচ্ছে না। দর্পিত কণ্ঠে বলছে: হে অহঙ্কারী মানব। উপড়ে ফেলেছিলে নিজের অস্তিত্বের শিকড়? মনে করেছিলে তুমি স্বয়ং ঈশ্বর? আজ দেখো। তোমার মত তুচ্ছ আর কেউ নেই। শেখো, পররাষ্ট্র দখল করার চাইতে, অকারণ প্রাণ বিনষ্ট করার চাইতে অনেক মহান কাজ প্রাণ রক্ষা করা।
প্রাণ নেওয়া যায়, কিন্তু প্রাণ দিতে পারবে তুমি? আজকের সর্বনাশের মূল কারণ তোমার মূঢ়তা!
সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকুক: এই শ্লোগান দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্র প্রমাণ করতে চাইছে, মারণঘাতি ভাইরাস আক্রমণ ঠেকাতে মরিয়া তারা। কিন্তু করবে কী পরিযায়ী শ্রমিক? মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরবে না পরস্পরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে? তাদের গায়ে স্প্রে করা হচ্ছে কীটনাশক! আগামীদিনে ধসে পড়বে অর্থনৈতিক অবস্থা। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স এর হিসাব অনুযায়ী, ভারত পুষ্টির দিক থেকে ১০১ টি দেশের থেকে পিছিয়ে আছে।
বিপন্ন মানবজাতি। বিপন্ন মানবতা। অথচ প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখতে পাবো, সে সেজে উঠেছে খুশিতে। তাকে বিরক্ত করছে না কেউ। মনের খুশিতে ফুল ফুটছে। পাখি গান গাইছে। আকাশে উঠেছে রামধনু। নদীতে খেলে বেড়াচ্ছে মাছ। সমুদ্রের জলজ প্রাণী ফেলছে শান্তির নিশ্বাস। তারা খুঁজে পাচ্ছে তাদের হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী।
ঘরবন্দী। শব্দটা শুনে এসেছি এতকাল, বাস্তব পরিচয় হল এখন। এ যেন নির্বাসন। সমস্ত অভ্যস্ত পরিচিত অভ্যাস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চলে এসেছি আদিম যুগে।
মানুষ দিনে দিনে পরিণত হচ্ছিল স্বার্থপর দানবে। পৃথিবীর জমি, জল, আকাশ __হয়ে উঠছিল বেচাকেনার বাজার। বসুন্ধরার কান্না ধীরে ধীরে রূপ নিল ক্রোধে। আজ আলো নিভে গেছে। আজ বাতাসে ভেসে বেড়ায় অসুখ। আজ কাঁদে মানব।
এইরকম অদ্ভুত অস্থির সময়... ঘন কুয়াশার মত গ্রাস করে হতাশা। ডিপ্রেসন। হতাশার চাইতে বড় শত্রু আর কেউ নেই। পরিস্থিতির চাপে নষ্ট হচ্ছে ভিতরের স্থিতি। টালমাটাল বাইরের সংসার। তার ঝাপটায় ভেঙ্গে চুরমার মনের ভিতরের শান্তি। এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ ক্ষেত্রে এটাই হয়। গভীর অনুভব থেকে বুঝি, বাহ্যিক শরীর ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে পারবে, যদি মন শক্ত থাকে। কিন্তু, মন দুর্বল হলে, শরীর আর সঙ্গে থাকে না।
আমরা ঘোরতর সংসারী মানুষ। সারাদিন খুঁটে খুঁটে জোগাড় করতে ব্যস্ত। স্থূল জগতের , দৃশ্য জগতের যা কিছু দেখি, মনে করি , সুখ লুকিয়ে আছে সেখানেই। আজ মৃত্যু এসে দাঁড়ায় খলখল হেসে। দেখিয়ে দিল আঙ্গুল দিয়ে , যা নিয়ে এত অহংকার, তার মূল্য আসলে কানাকড়ি না।
শাস্ত্রে বলেছে:
লোক এব বিষয়ানুরঞ্জন দুঃখগর্ভমপি মন্যতে সুখম।
আমিষ বডিশর্ভমপ্যহো মহোতো গ্ৰসিত যদ্বদন্ডজঃ।।
অর্থাৎ: মাছ যেমন শুধু চারাকেই দেখতে পায় কিন্তু তার নিচে লুকিয়ে থাকা বড়শিকে দেখতে পায়না। সংসারী ব্যক্তি তেমনি সংসারিক বিষয়ের আকর্ষণ দেখে। বিষয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত কি হবে, সেটা ভাবে না। তার ফলে, তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ জন্মাতে থাকে। মনে করি, সুখ বুঝি আছে ওই বস্তুর মধ্যে!
নাহ্। প্রকৃত সুখ বস্তুর মধ্যে না। আছে মনের শান্তির মধ্যে। মনে যদি দাবানল জ্বলে তবে বস্তুর ইঁট কাঠ পুড়ে যাবেই।
সংকট সময় সঙ্গে আছে বিজ্ঞান। উচ্চ ধরণের গবেষনায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে, মারণ ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র। সেই সঙ্গে এই মুহূর্তে জরুরি হল মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া। শরীরকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতে দিতে , নিজেকে শরীর বলেই ভেবে নিতে নিতে ভুলেই যাই, নিজের অন্তর চেতনার কথা। ভুলে যাই, এ শরীর কেবল বাইরের আবরণ মাত্র। এর সৌন্দর্যময় চাকচিক্য দেবে ক্ষণিকের শান্তি। অথচ কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি এলে, সবচেয়ে আগে ভীত হয় শরীর।
এইখানে একটু অনুশীলনের প্রয়োজন আছে। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা তখন করা যায়, যখন মনের স্থিতি ঠিক থাকে। পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীর তো সুস্থ থাকল কিন্তু মন? সে কি করে স্থির থাকবে?
এই সময় এক রকম কিছু বাক্য উচ্চারিত হয় বারংবার। মূলত হতাশা কেন্দ্রিক সে বাক্য গুলি ফিরে ফিরে আসে হতাশা বহন করে।। এই সময় হতে হবে মনের অভিভাবক। পরীক্ষা করে দেখা যাবে, ইতিবাচক বাক্য উচ্চারণ করার মধ্যে ধাক্কা দেবে ইতিবাচক শক্তি। পুষ্টিকর বাক্য পুষ্ট করবে , চিন্তার ক্ষুধার চাপে বিব্রত রুগ্ন মনকে।
কথায় বলে, চিন্তা বিষ। মনের বাঘ খেয়ে ফেলে মানুষকে। দিশাহারা অবস্থা হলে লাভ হবে না কিছু। তবে? উপায়?
লগ ডাউনের সময় বরং একটু নিজেকে নিয়ে বসি। অসহায় মনের অভিবাবক হই। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করি শক্ত কমান্ডো। যে কোনো পরিস্থিতিতে সে তৈরি থাকবে মোকাবিলা করার জন্য।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ অনিবার্য। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। আমাদের প্রাণের কবি। আলোর কবি। উত্তরণের কবি। তাই তিনি যেমন বলেন: আমি ভয় করব না ভাই করব না / দু বেলা মরার আগে মরব না , ভাই মরব না। অথবা - আলোকের ওই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও...
তাই হোক। অন্ধকার উপত্যকার উপর নেমে আসুক আলো। থাকুক মৃত্যু, থাকুক বিষাদ__তবুও ভিজে উঠুক প্রাণ শান্তির বৃষ্টি ধারায়।
জয়তী রায় ( মুনিয়া)
Tags:
সম্পাদকীয়