সন্ধ্যাবেলাটা আমার খুব প্রিয় । প্রিয় বলতে আমি প্রতিদিনই এই সন্ধ্যেবেলার অপেক্ষায় থাকি । মাঝে মাঝে মনে হয় আজ বুঝি সন্ধ্যা হবে না । দুপুরের পর হঠাৎ করে বিকেল গড়িয়ে সোজা রাত নেমে আসবে ।
কি যে উদ্ভট সব কথা বলো না তুমি?
সুষ্মিতা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল । সন্ধ্যা গভীর হয়নি এখনও । হিমেল বাতাস বইছে । এই বাতাসের অনুভূতি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে আলাদা । শরীরটা কেমন যেন হয়ে যায় । বাতাসের নির্মল প্রবাহটা যেন সরাসরি হৃদয়ে পৌছে যায় । অথবা হৃদয় ভেদ করে এমন এক অলঙ্ঘ্য গহ্বরে চলে যায় যে হৃদয় তা টের ও পায় না ।
সুষ্মিতা, তোমার এই সময়ে একটু হাটা দরকার । এসব চিন্তাও বাদ দেয়া দরকার । ফিজিক্যাল এন্ড মেন্টাল স্ট্রেন্থ দুটোই খুব দরকার এখন । চলো উঠবে, একটু হাটতে হবে ।
তোমার কি মনে হয় আমি থেমে আছি? তোমার কি এটাও মনে হচ্ছে যে আমি মানষিক ভাবে শক্ত নই?
এসময় এমন কথা না বললে হয় না? তাছাড়া এটাতো শুধু তোমার একার ব্যাপার না । তোমার বাচ্চাটার কথাও তো ভাবতে হবে!
হাটবখন! তুমি বসো । পাশে বসো ।
আচ্ছা । বসেছি । আমি একটা জিনিস ভেবে রেখেছি । শুনবে?
বলো!
আমাদের মেয়েটার একটা নাম ভেবে রেখেছি ।
কি নাম?
সন্ধ্যা । খুশি হবে না তুমি?
নাহ । শুষ্মিতা তাঁর স্বামীর দিকে তাকাল । প্রকৃতির অপার নিঃস্বার্থ যে অনুভূতি এই সন্ধ্যায় পাওয়া যায় , সেই সন্ধ্যা’র কোন মানুষের নাম হওয়া উচিত না । আচ্ছা বেশ । তোমার ছোট বেলার কথা গুলো কি মনে আছে?
হুম, মনে আছে । এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই দিনগুলো । আমাদের বাসা ছিল গভর্মেন্ট কোয়ার্টারে । কি সুন্দর পরিপাটি ছিল জায়গাটা । একবার ওই এলাকায় ঢুকলে মনে হত যেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে এসেছি । আমাদের বাসার সামনেই ছিল কালজীর্ণ একটা কাঠাল গাছ । গাছ বরাবর ছিল আমার পড়ার টেবিল । পড়ার টেবিলটা সবসময় গুছিয়ে রাখতাম । প্রতিদিন ওখানে পড়তে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম । বিকেল বেলায় ওগাছে নিয়ম করে চড়ুই পাখি বসত ।
হুম । জানো, জায়গাটা এখন আর আগের মত নেই ! চারপাশে আরও বিল্ডিং গজিয়েছে । ফাঁকা জায়গা বলতে নেই ।আমি একটা কাজে গিয়েছিলাম ওখানে । চলো একদিন, দেখে আসবে ।
না ।
কেন?
ওই যে বললে, আগের মত নেই জায়গাটা ।
তো? সব কিছু কি আর চিরদিন একরকম থাকে?
কিছু জিনিসকে এক রকমই থাকতে হয়, তন্ময় । যেভাবে দেখা হয় ঠিক তেমনই গুছিয়ে রাখতে হয় চিরকাল ।
আচ্ছা, যেতে হবে না । যা বলছিলে , বলো ।
সে আর এমন কি । ওই বাসায় আমরা থেকেছি দীর্ঘ দিন । আমি, তনয় ভাইয়া, দাদী আর বাবা-মা । আমি বিকেলে খুব একটা খেলতাম না । তনয় ভাইয়া খুব খেলত । আমি আর দাদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম । বলতে পারো আমি সবসময় দাদির সাথেই থাকতাম । গল্প করতাম ।
অনেক দিন ধরেই গুঞ্জন শুনছিলাম, কিন্তু ওসব কি আর তখন বুঝেছি? ভাইয়ার বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । শুধু ভাইয়া না, মাঠে আর কেউই খেলতে আসত না । আমাদের স্কুল ও হঠৎ বন্ধ হয়ে গেল । আমাদের পাশের বাসার ঝুমা আন্টি ওনাদেরও অফিস বন্ধ হয়ে গেল ।
আমাদের পড়াতেন তখন রবিন স্যার । মুখভরা রবি ঠাকুরের মত দাড়ি । নামি ভার্সিটিতে পড়তেন । চোখে মুখে প্রবল বিদ্যান বিদ্যান একটা ভাব । আমাদের সাথে স্যারের খুব জমত । পড়ার ফাকে ফাকে বেশ আড্ডা দিতাম । হঠাৎ সেই রবিন স্যারও আসা বন্ধ করে দিল । বন্ধ বলতে বাবাই তাঁকে কিছু দিনের জন্য আসতে নিষেধ করে দিল ।
কি যে এলমেল অবস্থা তখন । আমাদের বাসায় কাজ করত ময়না খালা, তাকেও আসতে বারন করে দেয়া হল । মা রোজ সকালে হাটতে বেরুতেন । বাবা ও সন্ধ্যার পর ক্লাবে যেতেন । তনয় ভাইয়া তায়কোয়ান্দো প্র্যাকটিসে যেত বিকেলে । সবই বন্ধ হয়ে গেল ।
বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করতাম । কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে? আপরাধটা কি আমাদের নাকি অন্য কারো? বাবা যে কি সব বোঝাতো তখন বুঝতাম না । বারবার বলতেন হাত ধুতে । আমরাও হাত ধুতাম । বলতেন হাঁচি আসলে কনুই ভাজ করে হাঁচি দিতে, আমরাও তাই করতাম । হাঁচি না আসলেও মিথ্যে মিথ্যে হাঁচি দিতাম । কারনে অকারনে হাত ধুতাম । বাবা-মা কেউই এত অপচয়েও আপত্তি করতেন না ।
ঘরে আবদ্ধ হয়ে রইলাম আমরা । আমার অবশ্য দাদির সাথে গল্পে গল্পে দিনগুলো খারাপ যাচ্ছিল না । দাদি বলতেন, বাও বাতাস আইছেরে বুবু । এ খুব ভয়ঙ্কর। গেরামে আইসত আগে। একের পর এক গেরাম খালি কোইরে দিয়ে যাইত।
বাতাসেরও যে ডান বাম হয় সেই প্রথম শুনলাম । বাতাস গায়ে লাগলেই তখন ভয় পেতাম । ভাবতাম বাও বাতাস আসল বুঝি । দাদি পানমাখা মুখে এক গাল হেসে অভয় দিতেন । বুকে মুখে ফু দিয়ে দিতেন ।
অন্যদিকে বাবা-মা কয়েক দিন ধরে কি যে শুরু করেছে । দুজন বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল একেবারে । আমিও বাবাকে তাই বলতাম । সবার অফিস ছুটি, তাহলে তোমার অফিস ছুটি হবে না কেন? বাবা মাথায় হাত রেখে বলতেন, ডাক্তার দের ছুটি হয় নাকিরে মা? বাবা বীরদর্পে বলতেন আর মা রান্না ঘর থেকে চেচিয়ে উঠতেন, জগতে তো তুমিই একমাত্র ডাক্তার । একাই সব উদ্ধার করে ফেলবে ।
বাবা, মাকে শান্ত করতেন । বলতেন, বোকামি করোনাতো । আমি কি বলেছি কোন নিরাপত্তা ছাড়াই আমাদেরকে যেতে হবে ? সরকার আমাদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা করলেই আমরা যাব ।
বাবা দিনভর এই নিয়ে অফিস কলিগদের সাথে আলাপও করলেন ।
দিনে দিনে অবস্থাযে কোন দিকে যাচ্ছে আমরা তা কিছুই জানতাম না । আমরা আমাদের মত খেলছি । সারা ঘর ওলট পালট অবস্থা । মা একদিকে যেমন গুচ্ছাচ্ছেন আর আমরা তেমন নোংড়া করছি ।
আমাদের আলো বাতাসে তখন বসন্তের মোহমুগ্ধ সচ্ছল সুবাতাস থাকার কথা । আমাদের প্রাচীরদেয়ালের ঘা ঘেষে একটা শিমুল গাছ । সেই গাছে লাল লাল ফুল ফোটার কথা । ফুটেছেও । আগের চেয়েও অনেক বেশী । প্রতিদিন বিকেলে আগে আমি ওই ফুল কুড়োতাম । মুঠি ভরে সেই ফুল নিয়ে এসে জমিয়ে রাখতাম বারান্দার এক কোনে। কিন্তু এবার আর সেই সুযোগ নেই । চারপাশ কেমন যেন গোপন অহঙ্কারে চুপ হয়ে আছে । শিমুল ফুলগুলোও যেন গোপনে ফুটছে, আবার ঝড়ছেও নিশ্বব্দে ।
পরের দিন সকালে ঢাকা মেডিকেলের বড় সাদা রঙের একটা গাড়ি এল । ওর ভিতরে আরও মানুষ আছে । বাবার বন্ধু ডাক্তার আঙ্কেলরাও বসে আছেন কয়েকজন । মায়া,ভালবাসা,প্রেম কিংবা ভয় , যা কিছু মানুষকে দুর্বল করে তাঁর সব কিছুই ঢাকার অপচেষ্টা করছেন বাবা , তার চোখ আর মুখের আনাড়ি অভিনয়ে । দাদী বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন । শারীর আচলটা মুখে গুজে চাপাস্বরে বাবাকে বললেন , সাবধানে থাকিস !
মা নেই আশে পাশে । মা বরাবরই এরকম । বাবার কোন কাজই তাঁর পছন্দ হয় না । রাত দিন কারনে অকারনে বাবাকে জব্দ না করলে তাঁর বোধয় তৃপ্তি হয় না । গত ঈদে, বাবা সবে ঈদের নামাজ পড়ে এসেছেন । আমাদের তখন ঘুড়তে যাবার কথা । আচমকা মেডিকেল থেকে বাবার ফোনে কল এল । বাবার একজন রোগী হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । সে অবস্থায় বাবা না গেলে রোগিটার কিছু একটা হয়ে যেতে পারত । কিন্তু মা এসব বুঝতে চাইতেন না। সারা দিন মুখ ফুলিয়ে বসে থেকে শেষ বিকেলে এসে তাঁর মান ভাঙল । ততক্ষণে আমাদের ঈদ সমস্তই মাটি হয়ে গেছে । মা সব সময় ভাবেন বাবা যেন আজীবন একটা বোকা সোকা মানুষ ।
আমি হন্যে হয়ে মাকে খুজতে লাগলাম । বাবা গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মায়ের জন্য । রুমের দরজা আটকে বসে আছেন মা । বাবা হাত ঘড়ি দেখছেন আর পায়চারি করছেন । আমরা মা কে অনেক ডাকাডাকি করলাম । বাবা আমাকে আর তনয় ভাইয়াকে ডাকলেন । বাবা বলনেন, তোমরা ঘরের বাইরে যেও না, বার বার হাত ধুয়ে নিও আর মা কে বিরক্ত করবে না ।
বাবার কথায় মাথা নারালাম আমরা । মনে মনে শপথ করলাম, বাবার কথা মত চলব । বাবা ফিরে এলে আমাদের সবকিছু শুনে অনেক খুশি হবেন নিশ্চয় ।
তখনো মায়ের কোন খোজ নেই । গাড়ি স্টার্ট হলো । গাড়ির কালো কাচ সরিয়ে বাবা আমাদের দেখছেন । আমাদের মাঝে মাকে না পেয়ে বারবার মায়ের ফোনে কল দিচ্ছিলেন । অনেক দূর পর্যন্ত বাবা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ।
মায়ের এমন বারাবারিতে আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম । মায়ের উগ্র মেজেজটা জন্ম সূত্রে আমিও পেয়েছিলাম কিছু । কিন্তু এগিয়ে যেতেই সেই রাগ যেন পাথর গলা ঝরনার শীতল পানির মত নিত্যানন্দে ঝরে পরে গেল । মা ঘরের জানালা দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছেন মূল সড়কের দিকে । যেই রাস্তা ধরে বাবার গাড়ীটা মাত্রই বেড়িয়ে গেল । মায়ের আচলে মুখ আড়াল করে দাড়ালাম ।
বাবা মাঝেমাঝেই কল দিতেন । বেশির ভাগ সময়েই খুব ব্যস্ত থাকতেন । চার পাঁচ মিনিটের বেশী কথা বলার সুযোগ হত না । এই কদিনে মায়ের মুখ শুকিয়ে গেছে । দাদি সারাদিন জায়নামাজে বসে থাকতেন । ভাইয়া অবশ্য আগের মতই ভাঙচুর মারকাটারি অবস্থায় আছে । মাঝে মাঝে টিভি দেখছে,খেলছে, বই নিয়ে টেবিলে বসছে আবার মাঝে মাঝে অকারন লাফা লাফি করছে ।
সন্ধ্যার পর টেলিভিশনে খবর দেখছিলেন মা । টেলিভিশনেও সবাই বার বার হাত ধুতে বলছে । বাইরে বের হতে নিষেধ করছে । একটা খবর দেখতে দেখতে মায়ের মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল ।চীন , ইটালি , স্পেন , ইংল্যান্ড , আমেরিকাতে সাধারন মানুষের বাইরে কর্তব্যরত অনেক ডাক্তারও মারা গেছেন । প্রচুর সংখ্যক ডাক্তার , নার্স করোনা ভাইরাসে আক্রান্তও হয়েছেন । মায়ের চোখে মুখে শঙ্কার ছাপ । মায়ের ঘুম হয়না । কাজে কর্মেও মন নেই তেমন । প্রার্থনারত দুটি হাত উচু করে মা এই সব কিছুর অবসান কামনা করছেন ।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল এভাবে । আমরা টিভির সামনে বসে আছি । ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডের মত মৃতের সংখ্যা দেখাচ্ছে । নিরন্ন অভাবি মানুষের কান্নার দৃশ্য দেখাচ্ছে । টিভি দেখতেও কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে । টিভিতে অন্যরকম ভাল খবরও দেখাচ্ছে । কেউ হাসছেন, মানুষকে স্বাভাবিক রাখার জন্য নিজেদের কষ্টগুলো চাপা দিয়ে রাখছেন ।
তারপরের কয়েকদিনে বাবাকে অনেকবার আসতে বলা হল। আমি,দাদি, তনয় ভাইয়া সবাই অনেক রিকোয়েস্ট করলাম । কিন্তু বাবা এ অবস্থায় মোটেই আসতে পারবেন না । কোন ভাবেই পারবেন না ।
এমন অবস্থায় মা নিজেই সিদ্ধান্ত নিল বাবার কাছে যাওয়ার । বাবাও তাতে সম্মতি দিয়েছেন । তাঁর কিছু কলিগের পরিবার থেকে অন্তত একজন এসে দেখা করে গেছেন এবং তারা কিছু খাবার-দাবার ও দিয়ে গেছেন । কতৃপক্ষও ব্যাপারটাতে আপত্তি তুলছেন না । কারন এতে করে স্বাস্থ্যকর্মীদের অবষাদ কিছুটা হলেও কমবে । কিন্তু পুরো কাজটা করতে হবে খুব সাবধানতার সাথে । নিয়ম মেনে । মায়ের তাতে মোটেও আপত্তি নেই । আমরাও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না । তাছাড়া বাবা আমাদের বলেছে , কয়েক দিনের মধ্যেই সে ফিরে আসবে । তখন দেশের সবাই নাকি বাবাকে বীরখোচিত সংবর্ধনা দেবে । পুরো বসন্ত জুড়ে যে গাছের ফুল হেলায় ঝড়ে পরেছে সেই ফুলহীন শহরে বাবাকে বরণ করা হবে শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় । প্রধানমন্ত্রী ইতমধ্যেই ডাক্তার , নার্স তথা স্বাস্থকর্মীদের নতুন দিনের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষনা করে দিয়েছেন ।
#
সকাল সকাল মা সব কিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছেন । মা, বেগুনি রঙের শাড়িটা পড়লেন । কপালে ছোট টিপ পড়তেন মা । কপাল ছুইয়েও কি ভেবে টিপটা আয়নার দেয়ালে রেখে দিলেন । টিপ পড়লেন না । পরিস্থিতিটা ঠিক টিপ পড়ার মত নয় । দীঘল চুলে মা কোন রকমে খোপা তুলে বেরিয়ে পড়লেন ।
বাবার বরফি খুব পছন্দ । মা মাঝ রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বানিয়েছেন । মাংস,পোলাও, মাছ তরকারি রান্না করেছেন । ইচ্ছে করেই সব বাড়িয়ে নিচ্ছেন যাতে বাবার কলিগরাও কিছু খেতে পারে । কিন্তু বরফিটা একটু আলাদা করে দিয়েছেন । সম্ভবত এই বরফি গুলো বাবা একা খেলেই মা খুশি হবেন ।
মা বেড়িয়ে পড়লেন । এগারটার দিকেই মা পৌঁছে গেলেন রমনা পার্কে । রমনা পার্কটাই এখন অস্থায়ী হাসপাতাল । সাদা সাদা ত্রিপলীর ছাউনিতে নিবির ছায়াঘেরা অস্থায়ী হাসপাতাল । মা তাঁর পরিচয় দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন । বাবা খবর পেয়েই ছুটে আসলেন । মা, অসার জীবন্ত মূর্তির মত উন্মীলন চোখে দাঁড়িয়ে আছেন । চোখের পানিতে ভিজে গেছে তাঁর ফেইস মাস্ক । কে বুঝত - মা, বাবাকে এত ভালবাসে ?
মা যেন হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলেছেন । বাবা, মাকে থামতে বললেন । এই দিকে এসো না । ওখানেই দাঁড়াও । বাবা একটু এগিয়ে এসে মাকে বললেন, কেমন আছো?
ভাল ।
বাচ্চারা কেমন আছে? আম্মা কেমন আছে?
মা আবার মাথা নেড়ে বললেন, সবাই ভাল আছে । তোমার জন্য সবার অনেক চিন্তা হচ্ছে । এখানে আর কতদিন থাকতে হবে?
এইত, আর চিন্তা নেই । আর কয়েকদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে ।
বাবার মুখ শুকিয়ে গেছে । সমস্ত শরীরে বিরামহীন ক্লান্তীর ছাপ । অক্ষিকোঠর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । চোখের জলে গগলসের স্বচ্ছ গ্লাস ঝাপসা হয়ে গেছে । মা গগলস খুলে বাবাকে প্রাণ ভরে দেখতে চাইলেন ।
একি, কি করছো তুমি? চশমাটা পড়ে নাও । এবার যেতে হবে । সুযোগ করে কল দিব । আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো প্লিজ!
চোখের অবারিত জলের প্রবাহকে থামাতে মা বার বার চোখ মুছছেন । আত্বভোলাআবেগ, উদবেলিত কান্না, একবুক হাহাকারকে দমিয়ে রাখতে গিয়ে মা বোধয় সাবধানতার বোধ টকুনও হারিয়ে ফেলেছিলেন ।মা যখন ফিরে আসলেন, মায়ের মুখটা কেমন যেন মূর্ছে পড়া বকুলের মত ছোপ ছোপ গ্লানীমায় ঢেকে গেছে ।
আকষ্মাত বাতাস ওঠে । থেমে থেমে ঘুড়ে ফিরে আসে । বাও বাতাস, ডান বাতাস সবই আসে । এই করুন পরিবেশটার সাথেও আমরা কেমন মানিয়ে নিয়েছি । রোগ, শোক আর মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা । আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছিল । মহামারিতে আক্রান্তের সংখ্যাও পড়তির দিকে ।
একদিন ভোরে আমরা দাদীকে পেলাম অসুস্থ অবস্থায় । অনবরত কাশি দিচ্ছেন । প্রতিটা কাশিতে যেন জীবনক্ষয় হচ্ছে। মা কাছে গিয়েও যেতে পারলেন না । হ্যান্ডগ্লাভস, মাস্ক পড়ে দাদির কাছে গেলেন । ভীষন জ্বরে দাদি কাপছেন । মা খুব দ্রুত বাবাকে ফোন দিলেন ।
দুপুরের অনেক আগেই বাবা একটি এম্বুলেন্স নিয়ে ছুটে আসলেন । মনে হচ্ছিল বাবা কোন মহাজাগতিক ভ্রমন শেষে বাড়ি ফিরলেন । বাবা দাদিকে নিয়ে চলে গেলেন । মা কে বলে গেলেন আমাদেরকে আরও খেয়াল নিতে । যতদূর সম্ভব নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রাখতে । আমাদের শরীরের তাপমাত্রা, শ্বাশ প্রশ্বাসের খেয়াল নিতে ।
মাঝ রাতে খবর এল দাদি করোনা পজিটিভ । মায়ের মুখে দুনিয়ার দুশ্চিন্তা নেমে আসল । দাদি তো বাসার বাইরে কোথাও যাননি । জায়নামাজ আর তাঁর ঘরের বাইরে কোথাও না । বাচ্চারাও তো কোথাও যায় নি?
তাহলে কি তিনিই মৃত্যুদূতকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এসেছেন? মা ফোন করে সমস্ত কিছু বাবাকে খুলে বললেন । এত এত দুশ্চিন্তা আর অনাহারে এই কয়েক দিনে মায়ের স্বাস্থ্য আরও ভেঙে পড়ল । কয়েকদিনের মধ্যে তনয় ভাইয়ের মধ্যেও রোগের লক্ষন প্রকাশ পেল । মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন । সদা চঞ্চল তনয় ভাইয়া কেমন থ মেরে গেছে । সব কিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে । শেষ হয়ে যাচ্ছে সব । একটু পরেই ছোটমামা আসলেন । বাবাও আসলেন ।
আমার শরীর থেকেও নমুনা নেয়া হল । তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে । সন্ধ্যা তারারা জ্বলে উঠছে একে একে । প্রশান্ত বাতাসে দুলে উঠেছে শিউলি গাছের ডগা । পরিচ্ছন্ন আকাশের নিচে মানুষেরা ধুকছে বর্ননাতিত যন্ত্রনায় । বাবা আর ভাইয়ের সাথে মাকেও যেতে হবে । আমি থেকে যাব মামার সাথে । তনয় ভাইয়া স্ট্রেচারে শুয়ে আছে । এই প্রথম যেন ওর চোখে এত জল দেখলাম । মায়ের মুখ তখন মাস্ক দিয়ে ঢাকা । চোখ ঢাকার মত কিছুই নেই আর । বাবা তাঁর পাথর চাপা বুকে একে একে সব কিছু সামলে নিচ্ছেন । রক্তের দ্রুত প্রবাহে বাবার কপালের ধমনি গুলো স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে । আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছি , কাকে ডাকব । বাবাকে , মাকে নাকি ভাইয়া কে !
আমারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল । কিন্তু কিছুই হয়নি আমার । দাদি বলতেন বাও বাতাসের কথা । আমার গায়ে হয়ত বাও বাতাস লাগে নি । দাদি তাঁর আচল দিয়ে আগলে রেখেছিলেন আমাকে । আচ্ছা মামা, দাদি কেমন আছে?
হঠাৎ উঠে গিয়ে মামা মুখ ফিরিয়ে বললেন সবাই ভাল আছে ।
আমি নির্ভার হলাম । কিন্তু মামা কেন যেন নির্ভার হতে পারছেন না । চোখ মুছছেন । কখনও যে আড়ালে হাউমাউ করে কাঁদেন না কে জানে!
মা যাবার সময় আমার কপালে একটি চুমু দিতে চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই । কিন্তু দিতে পারেন নি ।
একদিন মাঝরাতে মামার চাপা কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল । মামা আমাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন । আমিও কেঁদেছিলাম না বুঝেই । ভেজা ভেজা চোখে ঘুমিয়ে পরেছিলাম আবারও । মামা মুখ লুকিয়ে রাখতে চাইতেন । মামা ভাবতেন তাঁর মুখে বুঝি সত্য আড়াল হয়না ।
একদিন আমার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো । সেই গাড়িটা আবারও ফিরে আসল । গাড়ির ভেতরে বাবার রুগ্ন , শুষ্ক শোকার্ত চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে । ওই চোখের রক্তিম অনলে যেন শত শোক পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছেন । গাড়ি থেকে বের হল তনয় ভাইয়া । সাথে আসা কলিগদের জড়িয়ে ধরে বাবা উন্মাদের মত কাঁদলেন । আমি জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরে কেন যেন মাকে ডাকতে লাগলাম , দাদিকে খুঁজতে লাগলাম । কিন্তু না , আমার কাছে ফিরে আসল যুদ্ধ ফেরত শুধু দুইটা মানুষ ।