► তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় / এই বিপর্যস্ত সময়ে

তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় /  এই বিপর্যস্ত সময়ে
সময়টা যেমনই হোক, মাসটা তো বৈশাখ। সেটা যত এগোতে থাকে, ততই মনের মধ্যে গাঢ় হয়ে বসে একটা অনুষঙ্গ। কিন্তু এখন এই দুঃসহ সময়ে কিভাবে স্মরণ করবো রবীন্দ্রনাথকে? ঠিক কোন আবহে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবো? সারা পৃথিবী আক্রান্ত। কয়েকমাস ধরে একটা ভাইরাস ক্রমাগত নাস্তানাবুদ করে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে মানুষকে। রূপ নিয়েছে মহামারীর। অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতি। যে যেখানে আছে সেখানেই তাকে থাকতে হচ্ছে ঘরবন্দি, অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনে। কর্মহীন গোটা মানব সমাজ। স্তব্ধ হয়ে আছে সারা পৃথিবী। তৈরি হয়েছে একটা ভয়ের আর আতংকের আবহ। উন্নত অনুন্নত ইত্যাদি নামে যেসব সভ্যতার মাপকাটি ছিল, তছনছ হয়ে গেছে সেসব। 
                                       
কথাগুলো এসে যাচ্ছে কেননা যাই করি, যেভাবেই করি, সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে তো সেই মানুষ। তাই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে হলেও মননে এসে যায় মানুষের ভাবনাই। বিশেষ করে এখন যখন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন ভীষণ রকম বিপর্যস্ত। এই প্রথম বোধ হয় এমন হল যে অনেকে মিলে এক জায়গায় সমবেত ভাবে এবছর আর তাঁর জন্মদিন পালন করতে পারলোনা। চলন্ত বাসে ট্রেনে সহযাত্রী বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলোনা। তবে অতি উৎসাহীরা কোথায় কিভাবে কি পালন করল কে জানে! কিন্তু এগুলো আক্ষেপের বিষয় নয়। আক্ষেপের বিষয় হলো এই রবীন্দ্রনাথের কথাই তো আমরা শুনিনি। তিনি তো সাবধান করে গেছেন সেই কবেই!

কে আর কবে কথা শুনেছে! কথা শোনার জন্য নয়, কথা বলার জন্যই যেন মানুষের জন্ম। অনর্থক, অনাবশ্যক কথাও অনর্গল বলে যাওয়া। অথচ সারগর্ভ কিছু নেই তাতে। এক কথায় যার সমাধান হয়ে যায় খুব সহজেই, তাকে হাজার কয়েক কথার ঢেউ দিয়ে ফেনিয়ে তোলা। আর সেই তোড়ে ভেসে যায় আসল কথাটাই।

কিন্তু যদি শুনত? তাহলে বুঝতে পারত মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও কিছু বলতে চাইছে। পশু পাখিরাও কিছু বলতে চাইছে। শুনলে হয়তো আজ এই অপবাদটা মানুষকে শুনতে হতনা যে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিতে জানে যেমন এখন তার উপর চলে আসা এতদিনের অবিচারের প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রকৃতি এমনও পারে? পারছে তো! বন্যা খরা ঘূর্ণিঝড় সুনামি ভূমিক্ষয় দাবানল ইত্যাদির মত সর্বনাশা প্রাকৃতিক বিপর্যয় গুলো যখন ভিত নাড়িয়ে দিয়ে যায়, জীবন তছনছ করে দিয়ে যায় তখন তো তাকে আমরা প্রকৃতির রোষ বলেই উচ্চারণ করি। এর কোন কোনটার পিছনে মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ভুল আর অবহেলাই প্রধান কারণ একথা তো শুনতেই পাই। কিন্তু এই আশংকাকে গুরুত্ব দিয়ে এর প্রতিকার করতে, পৃথিবীকে আরও সম্ভাব্য অনেক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে এই পৃথিবীরই প্রত্যেকে মিলে উদ্যোগ নিয়েছে এমন দেখিনা তো!

একজন দেখেছিলেন। তিনি সর্বদর্শী রবীন্দ্রনাথ। উপলব্ধি করেছিলেন আত্মঘাতি মানুষ ক্রমাগত প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে, বিষাক্ত করে চলেছে। তাই তিনি সাবধানও করেছিলেন। ভবিষ্যৎ জীবনের বিপর্যয় নিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠা কিছু কম ছিলনা। তিনি ‘অরণ্যদেবতা’ প্রবন্ধে বলেইছিলেন, “বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারিদিকে তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন– মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে। বিধাতার অভিপ্রায়কে লঙ্ঘন করেই মানুষের সমাজে আজ এত অভিসম্পাত”। প্রকৃতিকে ভোগ করা নয়, তার উপর প্রভুত্ব করা নয়, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে হবে, এই পরামর্শ তিনি রেখে গেছেন তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য। কে শোনে! আমরা শুধু বলতে ভালোবাসি।

তাই এই মহামারী নিয়েও কাজের চেয়ে কথাই বেশি হচ্ছে যেন। অভ্যাস বোধ হয় থামতে জানেনা। কাজ হারানো অজস্র মানুষ যাদের ক্ষুধার্ত মুখগুলি ঢাকা পড়ে গেছে আবশ্যিক মাস্কের আড়ালে, আজ কাল পরশু কোন দিনেরই কোন উপার্জনের নিশ্চয়তা নেই যাদের, দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকলে তাদের কি দশা হবে জানা নেই। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম সারা বিশ্ব জুড়ে এরকম আতংক, করোনার গ্রাসে পড়া এক একটি বিখ্যাত শহরের ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে মানুষ, কোথায় কোন রন্ধ্রপথে ঢুকে পড়ছে ভাইরাস তার হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা সহজে, যারা আক্রান্তের সেবা করছেন তাঁরাও আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে, এই মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মানুষের একমাত্র কাজ, তাই অন্তত এইরকম সময়ে মানুষের কু-প্রবৃত্তিগুলো একটু চাপা পড়ে থাকবে। কিন্তু ওই যে, অভ্যাস কোথায় থামতে হয় জানেনা। কু-অভ্যাস তো নয়ই। তাই এই অতিমারীর দিনেও চকচক করে ওঠে সেইসব দুর্বৃত্তদের লোভী চোখ। হতদরিদ্র যারা তাদেরও খাবার লুঠ হয়ে যায়! মহামারীতেও এরকম! এই লজ্জা ঢাকতে নিজের মুখ নিজে লুকোই। আর একটা মাস্ক চাপিয়েও সবটা লুকোনা যায়না। এই সংক্রমণের সময়েও কোথাও ঘটে যায় হিংসা, মারামারি, খুনোখুনি। শত্রু চিনতে বড় ভুল করে মানুষ। এই মুহূর্তে ভাইরাসটাই যে আসল শত্রু সেটাও ভুলে যায়। এই সংকটেও কিছুতেই অভ্যাস বদলায় না। এমনকি মদের দোকানেও এমন ভিড় জমে যায় যে সে আর এক লজ্জার কারণ হয়ে ওঠে। কোথায় পড়ে থাকে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং আর খেতে না পাওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস!

এমন একটা আবহ তৈরি হচ্ছে যেখানে একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে প্রতিদিনের জগতটা, পাল্টে যাচ্ছে চেনা প্রকৃতি, চেনা জীবন যাপন। এতদিন যত ভেবেছি প্রাচুর্য আর বৈভবের মধ্যে দিয়েই কেটে যাবে আমাদের বাকি জীবন, তত চলে গেছি অনেক দূরে নির্বাসনে। প্রকৃতিও যে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে আমল দিইনি সেই কথাটিকে। এইভাবে কাটাতে কাটাতে কখন যে সামাজিক ক্ষেত্রের কিছু লোভ, দুর্নীতি আর মিথ্যাচারের বলয়গ্রাসে ঢুকে গেছি, টের পাইনি। এখন তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজি আপ্রাণ।

সেই খোঁজে অবধারিত ভাবে মনে আসে যাঁর কথা তিনি রবীন্দ্রনাথ। এই আবহেই এখন তাঁকে স্মরণ করি। অনেক রকম অনাচার দেখে মন যখন অশান্ত হয়ে উঠে, তাঁর কাছে যেন তখন একটু শান্তি খুঁজি। শুধু আমার পাড়া নয়, আমার রাজ্য বা দেশ নয়, এই মুহূর্তে অদৃশ্য শত্রুর অতর্কিত হানায় বিপদগ্রস্ত যে ভূগোলক, সেখানে কবে আবার জীবনের ছন্দে ফিরবে মানুষ সেই প্রশ্নও করি তাঁকে। তিনি যেন জানতেন এরকম হতে পারে। তাই তিনি সতর্ক করেছিলেন। আজ তিনি থাকলে কি পরামর্শ দিতেন জানিনা। কিন্তু এই বিপর্যস্ত সময়ে বিজ্ঞান সম্মত যা কিছু উপায় সেসব মেনে চলার পর তাঁর কাছেই একমাত্র আলো খুঁজি। তিনি নিজেই যে এক অনিঃশেষ আলো।  


Previous Post Next Post