পিয়ালী গাঙ্গুলি / আঠারো ভাটির দেশে

পিয়ালী গাঙ্গুলি / আঠারো ভাটির দেশে
বনদপ্তরের লোকেরা এসে খানিক আগে বস্তাটা দিয়ে গেছে। বস্তার ভিতরে মধুর লাশ, মানে দেহের ওই যতটুকু অবশিষ্ট ছিল আর কি। শুধু একটা গর র র শব্দ আর মধুর একটা চাপা গোঙানি। চোখের পলক ফেলার আগেই ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা। ভোরের আলো ফোটার আগেই ডিঙি নিয়ে বেরিয়েছিল কাঁকড়া ধরতে। খাঁড়িতে ঢুকে ভালো করে চারিদিক জরিপ করে নিয়েছিল দুজনে। ভাটায় জল নেমে চওড়া কাদা পাড় বিস্তৃত দুধারে। কোথাও কোনো পাগমার্ক চোখে পড়েনি দুজনের। ভালোই কাঁকড়া উঠছিল আজ, ওঠারই কথা। কালকে অমাবস্যা গেছে। নৌকা প্রায় ভরে এসেছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জোয়ারের স্রোত শুরু হয়ে গেছিল। আর এই জোয়ারের স্রোতে ভেসে এসেই আচমকা আক্রমণ দক্ষিণরায়ের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘাড়ের কাছটা কামড়ে ধরে মানুষটাকে টেনে নিয়ে চলে যায় জঙ্গলের গভীরে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মালতী কোনোমতে সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড় বেয়ে ছুটে যায় নিকটবর্তী ফরেস্ট ক্যাম্পে। বেশ কয়েকঘন্টা খানাতল্লাশির পরে যখন ওদের চোখে পড়ে তখন আর মধুর দেহের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই।

স্যাঙ্কচুয়ারি এলাকায় মাছ, কাঁকড়া ধরা বা মধু সংগ্ৰহ নিষিদ্ধ। তাই বিনা পারমিটে জঙ্গলে ঢোকার অপরাধে এই অবস্থাতেও কড়া বকুনি খেয়েছে মালতী। পেটের জ্বালা যে কি সাংঘাতিক তা কাকে বোঝায়! ঘরে দুটো ছোট ছেলেমেয়ে আছে। ছেলেটা স্কুলে যায়, মেয়েটার যাওয়া হয়না। বাবা মা বেরিয়ে গেলে ঘর সংসার তো ওকেই সামলাতে হয়। বাসন্তীতে মালতীর বাপের বাড়ির অবস্থা ভালোই। চাষবাস আছে, গরু ছাগল হাঁস মুরগিও আছে। মালতীর বিয়ের সময় মধুদের অবস্থাও খারাপ ছিল না। পোড়া কপাল। বিয়ের বছর না ঘুরতেই এল বিধ্বংসী আইলা। ঘরবাড়ি ভেসে গেল, জমি জমা যা ছিল চিরকালের মত নষ্ট হয়ে গেল। ওই নোনা জমিতে আর কোনোদিনই চাষ হবে না। সেইসময় সরকারি অনুদানের টাকায় যে ঘর বেঁধেছিল তাও ভেঙে গেছিল পরবর্তী বন্যায়। সেইথেকে প্রতিনিয়ত এই জীবনসংগ্রাম।

"কিছু খেয়ে নে দিদি, আর কদিন কাঁদবি"? মালতীর দিকে ভাতের থালাটা এগিয়ে দেয় কমলা। বাপেরবাড়ির গ্রাম সম্পর্কে মালতী দিদি হয় কমলার। কমলার শ্বশুরবাড়িতেও সংসার চলে মাছ ধরে। ওর শ্বশুরের চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাইই বাঘের পেটে গেছে। কমলার স্বামী ছোটু অনেক কষ্ট করে টাকাপয়সা জমিয়ে একটা বোট কিনেছে। গত দুবছর ধরে একটু একটু করে সাজিয়ে গুছিয়ে বোটটাকে তৈরি করছে। এখনও পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। পর্যটনের মরশুমে ভাড়া খাটে। তবে ছোটু একটু সৌখিন, খুঁতখুঁতে প্রকৃতির। তাই সেরকম পরিচিত নির্ভরযোগ্য ট্যুর অপারেটর ছাড়া যাকে তাকে ভাড়া দেয় না। ওর বোট বেশিরভাগ সময়ই ফটোগ্রাফারদের ভাড়া

খাটে। এরা নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির, নিজেদের কাজে ডুবে থাকে। নাচা, গানা, মদ্যপ আচরণের উৎপাত নেই। শুধু একটু রেঁধে, বেড়ে খেতে দিলেই হল। আর রান্নাটা তো ছোটু ভালোই করে।

"এই সুন্দরবনে ১০৪ টি বদ্বীপ আছে যার মধ্যে ৫৪টি লোকালয় আর ৪৮টি জঙ্গল। ৪২৬০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই জঙ্গলের ২৫৮৫ বর্গকিলোমিটার হল টাইগার রিজার্ভ। এই রিজার্ভ অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- স্যাঙ্কচুয়ারি, বাফার আর কোর এরিয়া। বাঘ, কুমীর ছাড়াও সুন্দরবনে ২২০ প্রজাতির পাখি, ৫৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৫ রকমের কচ্ছপ ইত্যাদি পাওয়া যায়"। প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন মৃণাল বাবু। ২২বছর ধরে এ জঙ্গলে গাইডের কাজ করছেন। অনেক কষ্ট করে, অনেক বাধা অতিক্রম করে বি. এ পাশ করে চাকরি বাকরি কিছু জোটেনি। সেইথেকে এই কাজই করে যাচ্ছেন। কথা বলার মাঝেই শার্টের বুকপকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনের ওপারে মেয়ের কান্নাভেজা গলা "বাবা শিগগির এসো, ঠাকুমা অজ্ঞান হয়ে গেছে"। তাড়াতাড়ি করে বোট ভেড়ানো হল নিকটবর্তী ঘাটে। সেখান থেকে পাখিরালয়ে নিজের গ্রামে যখন পৌঁছলেন মায়ের হাত পা ততক্ষণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। গ্রামে কোনো এলোপ্যাথিক ডাক্তার নেই, একজন আয়ুর্বেদ ই ভরসা। গোসাবা থেকে ডাক্তার এসে পৌঁছলেন সেই বিকেলে। দেখে বললেন স্ট্রোক হয়েছে, হাসপাতালে দিতে হবে। সব ব্যবস্থা করে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ হয়ে গেল। মৃণালের মনে পড়ল বাবাও প্রায় একইভাবে বিনা চিকিৎসায় চলে গেছিলেন। এভাবেই চলে এখানে জীবন।

পঞ্চায়েতের জরুরি মিটিং ডাকা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যেতে দয়াপুরের একটি ফিশিং ট্রলারকে অপহরণ করেছে জলদস্যুরা। মুক্তিপণের দাবিতে আজ তারা ফোন করেছিল। বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ডের সাথে সাথে নিজেদের দেশের জলদস্যুরাও সমানভাবে সক্রিয় এই অঞ্চলে। যখনই মুক্তিপণের দাবি নিয়ে ফোন আসে, পঞ্চায়েতের জরুরি মিটিং ডাকা হয়। কোন পরিবারের সদস্য অপহৃত হয়েছে তা না দেখে সকলে মিলে টাকা সংগ্ৰহ করা হয়, কারন যে কোনোদিন এই বিপদ যে কারুর পরিবারে ঘনিয়ে আসতে পারে। গ্রামে এখন বনবিবির উৎসব চলছিল। দুখের যাত্রা, পালাগান, খাওয়া দাওয়া এসব নিয়ে এইসময়টা মেতে থাকে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই মানুষ। বনবিবির লোককাহিনী থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট। হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ, বিদ্বেষ কিন্তু এই বর্তমান যুগের ফসল, প্রাচীন কালে মানুষের সম্প্রীতির অভাব ছিল না। আর সুন্দরবনের মত অঞ্চলে, যেখানে মানুষের অস্তিত্বই প্রতি মুহূর্তে সঙ্কটে, সেখানে ধর্ম নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করাটা বিলাসিতা।

মধুর মৃত্যুর পর একা আর কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার সাহস পায়নি মালতী। পঞ্চায়েতের সাহায্যে আপাতত ১০০ দিনের একটা কাজ জুটিয়েছে। বাঘের আক্রমণের চেয়েও আপাতত সুন্দরবনের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল নদীর ভাঙন। প্রতিদিন নদীর আগ্রাসী স্রোতে ভেঙে যাচ্ছে পাড়, তলিয়ে যাচ্ছে ঘর বাড়ি। এই পাড় তৈরির কাজই করছে এখন মালতীরা। বাদাবন না বাঁচালে নদীর আগ্রাসন নাকি আরও বেড়ে যাবে। মাঝে মাঝেই শহর থেকে বড় বড় শিক্ষিত লোকেরা এসে ক্যাম্প করেন, গ্রামবাসীদের বোঝান সুন্দরবনের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য বাদাবন রক্ষা করা কত জরুরি। কিন্তু এই একশো দিনের কাজ শেষ হয়ে গেলে তারপর কি করবে মালতী? দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি উঠতে মন সায় দেয় না। তবে কি শেষমেষ শহরে গিয়ে লোকের বাড়ি কাজ করতে হবে? ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে মালতীর।

বছর ঘুরতে যায়। মধুর মত আরও অনেকেই দক্ষিণরায়ের রোষানলে প্রাণ হারিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা খবরে বেরোয় না কারন মধু বা কাঁকড়া সংগ্ৰহ করবে বলে বেআইনিভাবে লুকিয়ে জঙ্গলে ঢোকে বলে সরকারি খাতায় এদের কোনো হিসেব থাকে না। আগে মানুষ মাথার পেছনে মুখোশ পরে জঙ্গলে ঢুকত মধু সংগ্রহ করতে। বাঘেরা আজকাল আর ওসবে ভয় পায় না। শুধু কি আর বাঘ? চিংড়ী আর কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কুমিরের শিকার হয়েছে আরো কত। এমনি করেই প্রতিনিয়ত সংগ্রামে কেটে যায় সুন্দরবনের মানুষের জীবন। জমিজমা বিক্রী করে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে ছেলের একটা এস এস সির চাকরি জোগাড় করেছেন মৃণাল বাবু। কাকদ্বীপের স্কুল। ছেলে ওখানেই ঘর ভাড়া করে থাকবে। মেয়েটাকেও পরেরবছর ওখানের স্কুলেই ভর্তি করে দেবেন। ছোটুর বোট মোটামুটি ভালোই ব্যবসা করছে। ছোটু এখন স্বপ্ন দেখছে আরেকটা বোট কেনার। একশো দিনের কাজের ভরসায় সংসার চলে না। বাধ্য হয়েই পাড়ার বউদের সাথে মীন ধরার কাজে নেমেছে মালতী। এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে প্রতিমুহূর্তে বুক দুরুদুরু করে মালতীর। এই বুঝি কুমীর এল। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকে "ঠাকুর, আজ ছেলেমেয়েগুলোর কাছে ফিরতে পারব তো?"

Previous Post Next Post