গভীর রাত। চুপ রাত। শহরের বাইরে এক ছোট এলাকা। কয়েকঘর খেটে খাওয়া মানুষের বাস। বাতাসে ঘুরে বেড়ায় নর্দমার পচা গন্ধ। এলাকার চারদিক ঘিরে এই নালা। ঠিক যেন কালো অজগর। পাক দিয়ে জড়িয়ে আছে বস্তিটিকে। তোলা উনুনের ধোঁয়া পাক দিয়ে ওঠে। ঘেঁষাঘেঁষি দরমার তৈরি ঘরগুলোর কোনটি থেকে শোনা যায় ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চার কান্না। কোনটি থেকে রমণের শীৎকার। কোনটি থেকে বুড়ো মানুষের কফ থুতুর ওয়াক শব্দ। আর আজ এই চাবুকের সাঁই সাঁই। রাত গভীর হয়। ক্রমে ক্লান্ত হলে পড়ে চাবুক মারা হাত। ধীরে ধীরে আরো শান্ত, কালো হয় চরাচর। ফরসা সুন্দর মাখন শরীরের নারী লুটিয়ে থাকে মেঝের উপরে। উবু হয়ে বসে নারীর উদোম ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখে এক পুরুষ। তার সমস্ত চক্ষু বেয়ে ঝরে পড়ে আদিম লালসা।
#
রশিদ মিঞার ঘরে আজ উৎসব। দামি চালের পোলাও। গোস্ত পাকান চলছে। গন্ধে পাড়া মাত। নর্দমার পচা গন্ধ ছাপিয়ে বিরিয়ানির গন্ধ ভুরভুর । হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে তদারকি করছে রশিদ মিঞা। নালার ধারের লোকের চোখ জুলজুল। লোভী গলায় গনাই এগিয়ে এসে বলে, "চাচা লটারি পাইলাম নাকি! এমন দাওয়াত চলছে!"
"তর কাম কী রে হারামির পো? হ , লাগছে লটারি। কী করবি ক।"
"চাচা, আমি আর কী করুম? তয় গালি দিও না। লটারি ত পুইস্যা রাখছ ঘরে। কিছু জানিনা ভাবছ! তুমার বিবি হইল গা..."
"অই ছেমড়া, জিভ টাইন্য ছিঁড়া দিমু খানে। এত্ত বড় সাহস! আমার পাঁঠা। আমি কাটুম না সোহাগ করুম সে ভাবনা আমার। তর কী?"
গোলমাল শুনে এদিক ওদিক আরো লোক এগিয়ে আসে। নিস্তরঙ্গ এলাকায় কলহ, যৌনতা, কদর্যতা , নালার নরম পাঁকের গন্ধ--- এসব নিয়ে বেশ কাটে। কেউ কল সারানোর কাজ করে, কেউ ইস্টিশনের কুলি, কেউ পরের জমির চাকর। ভোটের সময় ছাড়া দেশের সরকারের এদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই। দরমা, খবরের কাগজ, চট এসব দিয়ে বানানো গোটা দশেক ঘর। হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে থাকে। এদের কাছে, কলকাতা শহর অথবা ভারতবর্ষ --- সব এদের এই নালার পাড়। এখানে বসে গুলতানির মধ্যে জীবনের সব সুখ সীমাবদ্ধ।
"হেই রশিদ, বলি যতই তর বউ হোক। একটু বুঝে চলবি ত! ম্যয়েটা মরে গেলে কী হবে!"
"কিছু মরবে না দাদা। মাইয়া মানসের জান। দেখেন গিয়া ঘরে কেমন সাজতে নেগেছে।"
#
অদ্ভুত এলাকা। নিজেদের পেটের ধান্ধায় এত ব্যস্ত, সময় পায় না অন্যায়ের বিচার করার। আর ওদের কাছে ন্যায়-অন্যায়বোধ আলাদা। যেভাবে হোক পেট ভরে খাবার চাই। শরীর নিয়ে ছুঁত বিচার নেই।
রশিদ মিঞার ঘরে আজ তিনদিন হল আসে এক উঠতি লম্পট। রেলের লোহা চুরি করে বেচে প্রচুর টাকা। রশিদ মিঞার বউটি বড় ফুটফুটে। নাম--- আতর। চিক্কন নধর চঞ্চল মুরগি যেন। পয়সা ওয়ালা রইস আসে ,মদে টং। আতরকে ন্যাংটো করে মারে। তারপর উলটেপালটে খায়। রাত আরো গভীর হলে, গাড়ি করে চলে যায় ঢেঁকুর তুলতে তুলতে। রশিদ মিঞা পরের দিন বিরিয়ানি বানায়।
এমন সব হচর পচর দিন যায় এলাকায়। হঠাৎ করে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে। নর্দমা ভরে ওঠে জলে। কোথা থেকে খলবল মাছ ঝাঁপাতে থাকে। বাচ্চাগুলো নেংটি পরে গামছা নিয়ে মাছ ধরে। রইসের গাড়ি আটকে যায় নালার পাঁকে। কাদায়। তেজী গাড়ি। জোর করে ঠেলে উঠতে চায়। ততো বেশি করে আটকে যায় পাঁকে। নালার জল ভুটভুট করে। যেন অজগর ফনা তোলে। নিরুপায় গাড়ি পিছু হটে। সেদিন ছুটি পায় আতর।
বৃষ্টি ভিজে ভিজে নালার পাড়ে দৌড়ে যায় আতর।
বৃষ্টি, সোহাগ করে আতরের কালশিটে পড়া পিঠের উপর ঝরে পড়ে। খিল খিল করে হেসে ওঠে আতর __দুয়ো দুয়ো। হেরে গেল। দুয়ো।
গর্বিত ঘাড় ঘুরিয়ে নালার দিকে তাকায়। যেন বিজয়ী রাজকুমারকে দেখে এক বন্দিনী রাজকুমারী।
দু-দিন হল এলাকায় এক নতুন মানুষের আগমন। সোন্দর চেহারা। বাবরি চুল। বড় টানা চোখ। লাল জামা। কালো প্যান্ট। আর এন্তার সিগারেট। বিপিনখুড়ো মাতব্বর মানুষ। পাকা চুলের দাম দেয় সবাই। গম্ভীর মুখে বলে, "কে গ? দেখি নাই আগে? জাত কি?"
ছোকরা হো হো করে হাসে, "কও কী খুড়া? এক আকাশের নীচে থাক, এক সূর্যের আলো ভাগ করো, এক নদীর মাছ খাও---কীসে তবে আলাদা হলে গো?"
খুড়ো গোঁজ মেরে বলে, "তবু শুনি..."
"আমার ধর্ম জাত কিছুই নাই। ধরো ক্যানে আমি মানুষ নই। অই গাছ এক। বা হুই-ই-ই বৃষ্টি। তোমার ঐ নালাটাই ধরো আমি।
কথা শুনে মেঘ ভরা আকাশে ঝিলিক মারে আলো। ঘরের মধ্যে খিল খিল করে হেসে ওঠে আতরবিবি। ছোকরা বলে, "অমন হাসে কে গো? মানুষ না পরী?"
হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে আতর। ফরসা শরীরে নীল শাড়ি। কালো চুলের ঝাঁপিতে ঢাকা পিঠের দাগ।
ছোকরা বলে, "আরিব্বস! নালার ধারে পদ্ম ফুটল কী করে খুড়ো?"
"আরে ও বজ্জাত মেয়েমানুষ। শরীর বেচে খায়।"
"কী যে বলো, খুড়ো! শরীর ত কাঁথা-কাপড়। ব্যবহারের জন্য তো শরীর। জোর করে ছিনিয়ে খুলে নিতে পারো কাপড়। কিন্তু মন হল নিজের সম্পদ। মন বেচলে তবে তুমি হইলা ভিখারি।"
"তুমি দেখি লালন ফকির!"
"সবাই লালন আমরা। সবাই ফকির। কী গো পদ্মফুল? মন বেচলে কাউকে?"
এতক্ষণে বৃষ্টি থেমে আকাশ ফরসা। বিকেল শেষ হতে চলেছে। ক-দিন ধরে কাজ-কাম বন্ধ। মন মেজাজ খিঁচড়ে আছে। তার মধ্যে কোথাকার কে এক ছোকরা এসব কী বলে! রশিদ মিঞা হেঁকে ওঠে, "বলি, মতলব কী তোমার? চায়ের আশা করোনি কো। এসে থেকে দুয়ানি তিনানি কতা। যাও যাও।
"চা কী গো? আমি তো পেট ভরে ভাত খাব। পিয়াঁজ দিয়ে মুসুরি ডাল আর গন্ধলেবু।"
"আহা। শখ দ্যাখ বাবুর। আতর ঘরে যা। সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকবি নে।"
"কেন গো, চাচা? পদ্মফুল দাঁড়াবে না ঘরে যাবে সে তার মর্জি। তুমি বলার কে?"
"পদ্মফুল ডাকে আবার? ধরে দাঁতে কেইট্যে দিব। পদ্মফুল? আমি ঝা বুলব তেমন তেমন মাথা হিলাইবে আমার আতর। বুঝলা?"
"তাই নাকি! তোমার আতর পুতুল নাকি! তার শরীরে জান নাই?" বলেই এক পাক নেচে উঠল ছোকরা। বৃষ্টি ভেজা আকাশের নীচে যেন এক তরুণ শালগাছ। উমনো-ঝুমনো চুলগুলি কপালে লুটিয়ে... ভেজা দিয়াশালাই ঘষে ঘষে সিগারেট ধরাতে ধরাতে হেসে হেসে সে বলে, "আতর গন্ধ ছড়ায়, পদ্মফুলের গন্ধে থাকে সৌরভ। কোনটা চাও কন্যে ? বলো দেখি!"
এ এক অদ্ভুত বাদানুবাদ। নারী মাঝে রেখে দুই পুরুষ। উঠোন জুড়ে মুখের সারি। প্রশ্ন ভরা কৌতূহল নিয়ে ঝুঁকে আছে বৃষ্টিস্নাত বিকেলের আকাশ। কী মনে হতে, রমা নাপিতানির ঘর থেকে চা এসে গেল হাতে হাতে। বিড়ি ধরিয়ে মৌজে বসল সবাই। রশিদ মিঞা লাফিয়ে উঠে বলে, "এ কুথাকার ছোকরা হে। আমার বিবি, আমি কাটুম রাখুম মারুম। কার কী!"
সব কটা মাথা নড়ে ওঠে, "ঠিক ঠিক। বিবি যার, হুকুম তার।"
শুনে ডাঙ্গস লাগা সাপের মত ফোঁস করে লালন ছোকরা, "অমন কথা না বলতে আছে, না শুনতে আছে? নালার হোক আর সরোবরের, পদ্ম তার নিজের জন্যে ফোটে গো।"
আতর অবাক। পদ্ম নিজের জন্য ফোটে। ধুস, তাই আবার হয় নাকি! তার দিন থেকে রাত--- কিছুই নিজের না। কতদিন আরাম করে ঘুমোয়নি সে। সেখানেও হাত বাড়ায় লোমশ পুরুষ। ধোপার কাঠে কাপড় আছড়ে ফেলার মত শরীর আছড়ায়। রশিদ মিঞা ধমকে ওঠে, "তুই থাম, শালা।"
"থামব ক্যান গো, চাচা? মেয়েমানুষ তো মানুষ বটে। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকে। বৃষ্টি পড়লে ভিজতে চায়। খোলা বাতাসে ভাসতে চায় । কত কিছু যে চায়!"
সব কটা মাথা আবার নড়ে, " ঠিক ঠিক।"
শুধু আতর অবাক থেকে আরো অবাক হতে থাকে। এ কেমন কথা বলে লালন? আতরের সুন্দর চোখ দু-টো ছলছল করতে থাকে। যেন কোন জাদুগর এসে এলাকার কালো কালো ঝুপসি ঘরে ফুল ফোটায়। যেন নালার জলে বইতে থাকে অনেক অনেক পদ্ম ফুল। আচমকা কর্কশ গলায় চেঁচায় রশিদ, "যাও যাও। যা ভাগ ইখান থেকে। ভাগ। শোনো ছোকরা, ইখানে সূয্যি ওঠে আমাদের মর্জি মতো। আকাশের তারাগুলি ফুটবে না, যতক্ষণ না বলব! তুই কে? আমাদের মর্জির বাইরে চালাতে চাস ? কে তুই?"
হা হা করে হাসে সেই ছেলে। ছেলে না কোনো দূরদেশ থেকে আসা ডাকহরকরা? যার ঝোলাতে রাখা চিঠিতে আছে আতরের মুক্তির খবর!
ছোকরার হাসিতে উদ্দাম নালার জল। আজ সব উলটে যাচ্ছে। পালটে যাচ্ছে নিয়ম। ইতিহাস কখনো কখনো সাক্ষী থাকে কোনো কোনো অঘটনের। আজ যেমন ঘটছে আজব কান্ড।ছোকরা চোখ নাচিয়ে বলে, "যাব যাব। তাড়া কিসের চাচা? পদ্মফুল বলুক আগে। কী চায় সে?"
সব কটা মাথা নড়ে ওঠে আবার, " ঠিক ঠিক।"
রশিদ মিঞা বলে, "এমন কথা কে সনছে? মাইয়া মানুষ কইবে সে কী চায়?
সেই আদ্যিকাল হইতে, রাম সীতার সুময় থেকে দ্যাখ নাই? কেউ শোনে? মাইয়া মাইনষের কতা?"
সব কটা মাথা নড়ে ওঠে, "ঠিক ঠিক।"
"আজ বলবে কথা। তোমরা শুনবে? কী গো পদ্মফুল, বলবে না কথা?" চোখে মুখে কেমন করুণ ভাব ফুটে ওঠে তার।
আজ আতরের অবাক হবার দিন। কখনো কখনো এমন হয়! ছোটবেলায় দেখেছিল তার বাপের ঘরে এক চাঁদনি রাতে এসে বসেছিল ইয়া বড় পাখি। জেল্লা কী পাখির! রঙিন, ঝলমলে! সব্বাই বলল, "ভগমানের দূত এয়েছে।"
ওই লালন না কে যেন অমন ভগমানের দূত! এই প্রথম কেউ কিছু চাইল আতরের কাছে। আতরের জন্ম লোকের শরীরে ছিটিয়ে পড়ার জন্য। পদ্ম জন্ম কেন হয় , সে জানে না। আতরের ভাবনার মাঝে ঝোলা কাঁধে উঠে দাঁড়াল ছেলে। " চলে যাব? চলেই যাব? বলবে না কিছু? ও পদ্মফুল?"
রশিদ মিঞা চেঁচায়, "আতর! খুন কইরা ফালুম। ভুইল্যা গেলি? চাবুক চাবুক।" বলে লাফ দিয়ে ডিঙ্গি মেরে দু-হাতের বুড়ো আঙুল বাতাসে ঘোরাতে থাকে। ধূর্ত হাসি রশিদের মুখে। সে জানে, চাবুক ভয় পাবে মাইয়া মানুষ। এতদিন তাই হয়েছে। সুন্দরী বিবির শরীর বেচে টাকা কামানোর সুখ অনেক। দিনরাত কাঁদে আতর। মরা বাপ মায়ের কথা বলে আর কাঁদে। তার কেউ নাই। যাবার জায়গা নাই। ফান্দে পড়ে থাকা কবুতর। ছটফট করলেও , ডানা মেলার ক্ষমতা নাই! রশিদ ভারি নিশ্চিত গলায় বলে,
" তুই যা রে। যা। পাগল। আতর কুথাও যাবেনা। হিহিহি।"
আতর যেন শুনেও শোনে না। দেখেও দেখে না। তার কানে আসে ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ছোটবেলার ঝলমল রঙ্গীন পাখি বুকের ভিতর ডাক পাড়ে। সে উঠে দাঁড়িয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে লালনের। নালার জলে ঝুঁকে পড়েছে বর্ষার ভারি আকাশ। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে জল।
"আতর নয়, আমাকে পদ্মফুল বলে ডেকো, মিঞা।"
সবকটা মাথা নড়ে ওঠে, " ঠিক ঠিক।"
Tags:
অণুগল্প