এলার্মের আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে বসলেন উমা। ঘড়িতে এখন বাজে ভোর পাঁচটা দুই। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে চোখ-মুখ ধুয়েই এগিয়ে গেলেন দক্ষিনের ঘরটার দিকে। ওই ঘরে ঘুমোচ্ছে তাঁর নয় বছরের ছেলে শুভম আর তার ঠাম্মা, অর্থাৎ উমার শ্বাশুড়ি। আজ থেকে শুভমের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। উমার শ্বশুর গত হয়েছেন দিন পনের হল।কাল পর্যন্ত ঘরে আত্মীয়স্বজনের সমাগম ছিল, কাজেই পড়াশুনার সুযোগ তেমন একটা হয়নি।
....শুভম, ওঠ্ সোনা, একটু দেখে না নিলে তো চলবে না। ওও শুভম, শুভুউউউ.....ওঠো, ওঠো।
চোখ কচলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো শুভম। আজ ভূগোল পরীক্ষা। এমনিতেই বিষয়টা নিয়ে বিশেষ সরোগড় নয় সে, তারপর এবার পড়াটাও হয়েছে কম। মনে ভয়টা এবার একটু জমিয়ে বসেছে। কাজেই ঘুম থেকে উঠতে বিলম্ব হলনা শুভমের।
_যা, চোখ-মুখ ধুয়ে আয় আমি হরলিক্স বানাচ্ছি।
মায়ের হাতটা জাপটে ধরলো শুভম...."মা আমি পারবো তো?"
_"কেন পারবি না? শুধু তো চোখ বোলানো,তোর তো হয়েই আছে সব।"বাইরে এখনো বেশ অন্ধকার, হালকা একটা শীতের আমেজ। হরলিক্সটা এক চুমুকে শেষ করে খাটের পাশেই মুখোমুখি বই খুলে বসলো উমা আর শুভম। গোগ্রাসে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে বইয়ের পাতায়। এই সীমিত সময়ে যতটা ভালো করে সম্ভব আর কি! হঠাৎ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ভেসে এল একটা অতর্কিত আওয়াজ...."টক্ টক্ টক্ টক্"। মনে হল, ঠিক কাঁচের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কে যেন টোকা মারছে। টক্ টক্ টক্ টক্। কিন্তু এ কি করে সম্ভব? ওরা তো থাকে একটা আবাসনের চার তলার একটা ফ্ল্যাটে। মূহুর্তে পড়া থেমে গেল শুভমের। শরীরে স্রোতের মত বয়ে গেল এক শীতল অজানা ভীতি।
_ও কিসের আওয়াজ মা?
_জানি না, দেখছি। তুই পড়।
_ওই দেখ আবার হচ্ছে, ঠাম্মি কে ডাকি?
_না, দাঁড়া না, আগে দেখি।
ভালো করে দেখা যাচ্ছে না বাইরেটা। আস্তে আস্তে অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আবছা আলো ঠিকমত জানালার খাঁজে এসে পৌঁছতে পারেনি এখনও। আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল উমা। জানালার গা ঘেঁষে রাখা আছে শ্বশুরের বড় সেগুন কাঠের সেক্রেটারিয়েট টেবলটা, যেখানে বসে দিন রাত কাজ করতেন বিনয়বাবু। জানালার দিকে চোখ যেতেই বিস্ময় বোধ হল উমার। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বেশ বোঝা গেল, কোন পাখি অনবরত তার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে চলেছে জানালার কাঁচ। শুভম ও কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে গিয়ে জানালার কপাটটা আআস্তে খুলে দিল উমা। এক অদ্ভুত ধূসর রঙা পাখি তার ছুঁচলো হলুদ ঠোঁটটা দিয়ে চতুর্দিকের নিঝুম পরিবেশটা নিমেষে সরব করে তুলেছে। জানালাটা খুলে দিতেই পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বসলো সামনের রাধাচূড়া গাছটার ডালে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো এদিক সেদিক। উমা একটু দূরত্বে যেতেই উড়ে এসে বসলো জানালার খাঁজে। এক অদ্ভুত ছটফটানি ভাব সে পাখির মধ্যে। মনে হল সকাল হতে না হতেই কে যেন তাকে বিশ্ব সংসারের সকল কাজ সঁপে দিয়েছে।
_এটা কি পাখি মা?
_জানি না, দেখতে হবে।
_ও কেন জানালা ধাক্কা দিচ্ছে?
_কি জানি? পোকা খাচ্ছে হয়তো। চল্ আমরা আমাদের কাজটা সারি।শুভমের ইস্কুল শুরু হয় সকাল সাড়ে নয়টায়। ঠিক সাড়ে আটটায় একটা গাড়ি আসে ওকে ইস্কুলে নিয়ে যেতে, অতএব সময় বিশেষ নেই। পড়া সেরে চট্ করে তৈরি হয়ে নিলো শুভম। বেরোনোর আগে মায়ের হাতটা ঝাকিয়ে বলে গেল...."মা, সকালের পাখিটার নামটা কি জেনে রেখ।"
উমা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "আচ্ছা বেশ, তুই পরীক্ষাটা ভালো করে দে তো! মন দিয়ে লিখবি কেমন? মাথাটা ঠান্ডা রাখিস।"
#
দুটো পরীক্ষার মাঝে একদিনের বিরতি। সকালে টেবিলে বসে জলখাবারটা নাড়াচাড়া করতে করতে শুভম বলল......" জানো মা!! আজ পাখিটা আবার এসেছিল।
_তাই?
_কিন্তু ও রোজ এতো সকালে কেন আসে মা?
_সব পাখিদেরই তো অনেক সকালে ঘুম ভাঙে, তাই হয়তো।
_ এতোওও সকালে? আগে তো কখনো আসেনি? মা তুমি বলেছিলে পাখিটার নামটা জানবে!! জেনেছ?
_না, সময় পাইনি রে, দেখে দেব।
খাবার দিকে মন নেই শুভমের। এই কটাদিন আগেই তো দাদু আর ঠাম্মির মাঝে শুয়ে ঘুমাতো শুভম। এক মুহুর্তে কেমন যেন অন্যরকম লাগে। রোজ ঠিক সকাল সাড়ে পাঁচটায় দাদু ডাক দিতেন......" দাদুভাই ওঠো শিগগিরই। মা এক্ষুনি এসে যাবেন। স্কুল যাবে না? "
_"দাদু, তুমি রোজ এতো সকালে ওঠো কি করে? তোমার ঘুম পায়না?"
দাদু হা হা করে হেসে বলতেন, "ওরে, এ আমার অনেক দিনের অভ্যাস। সেই ছেলেবেলা থেকে কখনো এর অন্যাথা হয়নি। দেশের বাড়িতে রোজ আলো ফোটার আগেই মোরগের ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমাদের বাড়িতে লাল ঝুঁটি ওয়ালা এইসা বড় বড় মোরগ আর মুরগি ছিল। একটা ডাকলে সব কজন ডাকতে থাকতো। আমার মা হাঁস, মুরগি, গরু ছাগল, খরগোশ, গিনিপিগ, কুকুর সব পুষতেন। সকালে ঘুম ভাঙলে আমি আগে নিমডাল দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে পুকুর যেতাম। মুখ হাত ধুয়ে সোজা চলে যেতাম মাঠে। তারপর এদিক সেদিক ঘুরে বাড়ি ফিরে দেখতাম মা গোবর ছড়া দিয়ে উঠোন নিকিয়ে হাঁস আর মুরগি গুলোকে ছেড়ে দিয়েছেন। আমি ঘরে ফিরে মায়ের অপেক্ষা না করেই হাঁড়িতে হাত চুবিয়ে পান্তা তুলে খেতাম। পান্তা আমার এতো পছন্দ ছিল, একদিন না খেলে আমি কোন কাজে মন দিতে পারতাম না। "
_পান্তা কি দাদু?
_জল ঢালা ভাত।
আজ কত কি মনে পড়ছে শুভমের। উমার ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে শুভম বলে উঠলো.....মা, তুমি বাড়িতে পান্তা ভাত কেন বানাও না?
#
আগামী কাল অঙ্ক। বাবাই বলেন, অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন বেশি অঙ্ক করলে নাকি সব গুলিয়ে যায়। আজ বিকালে ছাদে গিয়ে গাছের ফাঁকে ফোকরে পাখি দেখতে থাকে শুভম। এমন সময় মা এসে ছাদে দাঁড়ালেন।....…"জানিস! আমি নেট ঘেটে খুঁজে বের করেছি পাখির নাম। ছাতারে ........ বৈজ্ঞানিক নাম টুরডইডেস স্ট্রীয়াটা। "
_"দাঁড়াও মা, আমি ভুলে যাবো। নীচের থেকে আমার নোটবুকটা নিয়ে আসি? নামটা লিখে রাখবো।
এক ছুঁটে নীচে চলে গেল শুভম। নিমেষে নোটবইটা নিয়ে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে ওপরে উঠে এলো।
_আহ্, এতো দৌড়োচ্ছিস কেন? পড়ে গেলে কি হবে? পরীক্ষা চলছে খেয়াল আছে তোর?
_ কিচ্ছু হবে না। তুমি নামটা বলনা, বল প্লিজ.....
_বাংলা নাম ছা-তা-রে, "বৈজ্ঞানিক নাম টুর-ডই-ডেস স্ট্রী-য়া-টা"।
রাতে খেতে বসে শুভম বলল ...." মা, আজ আমায় এক মুঠো ভাত বেশি দিও। খিদে পেয়েছে।"
উমা হেসে বললেন, ..." আজ কোন দিকে যে সূর্যোদয় হয়েছিল! তুই বেশি ভাত চাইছিস?"
শুভম মুখ টিপে হেসে বলে, ...." সূর্য যেদিকে ওঠে সেদিকেই উঠতে দাও না।"
হাতের পাশে একমুঠো ভাত সরিয়ে রেখে অন্যদিক দিয়ে খেতে শুরু করল শুভম।
_"ভাতটা রে খাচ্ছিস না শুভু"
.…"খাবো খাবো"।
সবার চোখের আড়ালে একটা ছোট্ট বাটিতে চুপ করে ঢেলে রাখলো শুভম। তারপর জল ঢেলে বাটিটা লুকিয়ে রাখলো দাদুর টেবিলটার তলায়। উমা বললেন, ..." শুভম আজ আমার সাথে শুবি? তোর আজ সাউন্ড স্লীপ দরকার। পাখি পাখি করে তো কদিন তোর.....
_"মা প্লিজ, আমি একদম ঠিক করে ঘুমাবো। ও ঘরে গেলে আমার ঘুম ভালো হবে না।
_"আচ্ছা বেশ, চট্ করে ঘুমিয়ে পর তাহলে, বেশি রাত করিস না কেমন? "
উমা চলে আসার পর বেশ উৎকন্ঠায় রাত কাটলো শুভমের।বার বার উঠে ঘড়ি দেখতে থাকে। রাত যেন আর কাটে না। আচ্ছা ভাতটা ঠিক আছে তো? একবার টেবিলের তলায় উঁকি মেরেও দেখে নিল শুভম। টেবিল ঘড়িটা কানে ঠেকিয়ে টিক্ টিক্ আওয়াজটা শুনলো। এরপর কখন যে চোখটা লেগে এসেছে শুভমের। ভোর বেলা যথারীতি কানে এলো সেই চেনা আওয়াজ......
_"টক্ টক্ টক্ টক্..... টক্ টক্ টক্।
ঘুম চোখে উঠে এক ছুটে গিয়ে জানালার কপাট খুলে দিল শুভম। ওর ছুটের গতি এতটাই তীব্র ছিল যে পাখি উড়ে রাধাচূড়া গাছটার ছাড়িয়ে কোথায় চলে গেল আর দেখাই গেল না। শুভমের হাতে সারা রাত জলে ভেজা ভাতের বাটি তার চোখে পড়ল কিনা কে জানে? ভাতটা জানলার কাছে রেখে দূরে সরে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শুভম। নাহ্, আজ তো আর পাখির দেখা নেই। একরাশ অভিমান চোখের পাতা দুটো কেমন করে যেন ভিজিয়ে দিলো। ইচ্ছে করল, হাতের বাটিটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে জানলা দিয়ে যত্তো দূর যায়। তারপর আবার একটু শান্ত হয়ে জানালার গায়ে বাটিটা রেখেই চলে গেল মাকে ডাকতে।
আজ পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে বড্ড উদাস দেখাচ্ছে শুভমকে। বেশ ভারাক্রান্ত লাগছে মুখটা, হাসিটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে জানালার দিকে তাকিয়ে উঠে বসলো শুভম। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে যেতেই দেখে অবাক কান্ড!! বাটিতে পান্তা নেই ছিঁটে ফোটাও। আনন্দে দিশেহারা হয়ে শুভম ছুটে গেল জানলার কাছে, তারপর গলা বের করে ভালো করে দেখলো এদিক সেদিক কিন্তু নাহ্, কটা চড়াই আর কাক ছাড়া কিছুই চোখে পরলো না তার। তাড়াতাড়ি টেবিলের ড্রয়ার খুলে টেনে বের করল নোটবইটা তারপর এক ছুটে ছাদের ওপর। ছাদের উপর থেকে চতুর্দিকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রচুর গাছপালা দেখা যায়। বেশ একাগ্রতায় গাছের ডাল, বাড়ির ছাদ, লোকের বাড়ির জানলা লক্ষ্য করতে থাকে শুভম তারপর হঠাৎ চোখে পরলো মল্লিক বাড়ির অপরিস্কার বাগানটার দিকে। ওই তো ওখানে ঝোপের পাশে নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই পাখি, আবার মাঝে মাঝে মাটি থেকে খুঁটেও খাচ্ছে কিছু। এক অদ্ভুত রকম ডাকও দিচ্ছে। শুভম তাড়াতাড়ি নোট বইটার পাতা উল্টিয়ে চোখ বুলিয়ে নেয় তারপর ভুরু নাচিয়ে বলে...."কি নামে ডাকবো তোমায় মিস্টার পান্তা পাখি? না না মিস্টার ছাতারে, টুরডইডেস স্ট্রীয়াটা , নাকি (ফিসফিস করে) মিস্টার বিনয় রঞ্জন চক্রবর্তী?"
#
পরীক্ষাটা এখন প্রায় শেষের দিকে, আজ শেষ দিন। এতোদিনে শুভম বুঝতে শিখেছে ছুটে গেলে পাখি ভয় পায়, তাই আগে থেকে খাওয়ার রেখে দূরে সরে দাঁড়িয়ে থাকে, দূর থেকেই কথা বলে, হাসে। পাখিটার কখনো বাটিতে মুখ দেয়, কখনো শুধু তিরিং বিড়িং নাচে।
শুভম বলে...."ইসস্, পান্তা খেতে এতো নাচন কিসের? এখনো পান্তা খেতে তোমার এতো ভালো লাগে? মিস্টার পান্তা পাখি?"
পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে খাওয়ার টেবিলে বাবা-মায়ের আলোচনা শুনতে পায় শুভম। কোথাও যাবার ব্যাপারে আলোচনা করছেন তাঁরা।
_আমরা কোথাও যাবো মা?
_বহরমপুর।
_ছোট্ দিদার বাড়ি? ইয়েএএএ.....কি মজা!! কবে যাবো মা? কাল? কখন যাবো?
ছোট্ দিদার বাড়ি যাওয়ার একটা বিরাট আকর্ষণ শুভমের। গঙ্গার পাড়ে বাড়ি, একগাদা ঠাসাঠাসি ভাই-বোন, মজা, হুল্লোড়, হাজার দুয়ারী, লালবাগ।
_"শোন একদম ভোরে বেরোতে হবে বুঝলি? ওখানে নাকি শীত বেশ জাঁকিয়ে পরেছে। কাল নাকি সাতে নেমে গেছিল। চার পাঁচদিন থাকবো। এখনো অনেক গোছগাছ বাকি। তুই এখনি শুয়ে পড় আমি সাড়ে চারটায় এলার্ম দিচ্ছি। পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।
_এত সকালে?( মুখে আঁধার নেমে এলো শুভমের)। একদিকে ছোট্ দিদার বাড়ি যাওয়ার আকর্ষণ অন্য দিকে......কাল ভোর বেলায় পাখিটা এসে যখন দেখবে বাড়িতে কেউ নেই? চার পাঁচ দিন পান্তা না পেলে আর যদি না আসে?আচ্ছা, পান্তা কি শুধু ওই ছাতারে পাখিটাই খায়? সেদিন তো কিছু কাক আর চড়াই ও এসেছিল। তা হোক্, কিন্তু ও তো জানে পান্তা আমি ওর জন্যই রাখি। কি আগে তো কখনো আসেনি? ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আসে আমার কাছে, ঠিইক যেন দাদুর মত।কি করে জানে আমি ইস্কুল যাবো? তবে কি ও-ই.......?নিশ্চই তাই!"
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শুভম বলে উঠলো....." বাবাই, আমি যদি না যাই?"
_"কেন রে ছোট্ দিদার বাড়ি যাবিনা?"
_"আমার ঠিক মনে চাইছে না।"
শুভমকে দু'হাত দিয়ে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বাবাই বললেন...."ছিঃ শুভ, ছোটর দিদা কত ভালোবাসেন তোমায়, আর তাছাড়া আর এই কটা দিন হাতে, এরপর আমারও অফিস, তোমার স্কুল। এখন আমাদের কারো মন ভালো নেই, তুমি অবুঝ হলে সবার কষ্ট বাড়বে তাই না? "
শুভম বুঝদার ছেলে , তাছাড়া ছোট্ দিদার বাড়িটা তার বিরাট এক আকর্ষণের জায়গা। নিজের মনে বলে....." একটু বেশি করে খাবার দিয়ে রাখবো। সাথে একটা চিঠিও। একটা যখন বৈজ্ঞানিক নাম আছে, তখন চিঠি ঠিকই পড়তে পারবে। চট্ করে একটা চিঠি লিখে ফেললো শুভম....
বেশি করে খাবার দিলাম। তুমি খেয়ে নিও। আমি চার পাঁচদিন থাকবো না। ছোট্ দিদার বাড়ি যাচ্ছি। চারদিন পর তুমি আবার এসো কিন্তু। "
শুভম
এরপর বাটির তলায় চিঠিটা চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লো শুভম। পরদিন যথা সময়ে রওনা হয়ে গেল গন্তব্যে। ট্রেনের মৃদু দোলায় ঘুম জড়ানো ছোট্ট চোখ দুটো জুড়ে বসলো সোনালী মিঠেল স্বপ্ন....পান্তা পাখি মনের সুখে বাটি থেকে খুঁটে খাচ্ছে ভাতের দানা।
#
ছোট্ দিদার বাড়িটা বড় মজার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সারাদিন দেখা যায় কত দূর পর্যন্ত মানুষের কলরব, ঘাটের পাশে মানুষের প্রধান পর্ব, ছোট্ট ডিঙা নৌকা করে মাঝিদের মাছ ধরতে যাওয়া, পেল্লাই লঞ্চে করে যাত্রীদের নদী পারাপার। সন্ধ্যা বেলায় টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে ফেরিওয়ালাদের ফুচকা, ভেলপুরির স্টল। যখন খুশি খাও, যত্ত খুশি খেল কেউ বকবে না। আর আছে রাতের বেলায় সব ভাইবোন একসাথে মেঝেতে লঅম্বা বিছানা পেতে শোয়া, রাত জেগে গল্প। এবারও তার অন্যথা হয়নি। উমা বললেন......"শুভম রাতে উঠতে হলে আমায় ডেকো কেমন?"
বাথরুমটা লম্বা বারান্দার অপর প্রান্তে। অন্ধকারে একা যেতে ভয় পেতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা। উমা শুয়েছেন খাটের উপর বাড়ির অন্য মহিলা সদস্যদের সাথে। ঘুমের মধ্যে কানে আবছা ভেসে এলো শুভমের আর্ত চিৎকার....."মাআআ.......মাগোও...."
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে উমা দেখলো শুভম বিছানায় নেই, দরজা আলগোছে খোলা। ওই আবার চিৎকার......
_"মাআআ......মাগোওও.... শিগগির এসো!!"
পাগলপারা ভীতি নিয়ে উমা ছুটে বেরোলেন ঘর থেকে। চিৎকার আসছে ছাদের সিঁড়ির দিক থেকে। দ্রুত পা চালিয়ে উপরে উঠে গেলেন উমা ....."শুভ!! কী হয়েছে? কী হয়েছে সোনা?"
খিলখিল করে হেসে উঠলো শুভম। ছাদের দিকে আঙুল নির্দেশ করে পাঁচিলে বসা একটা ছাতারে পাখিকে দেখিয়ে বলল......
"দেখো মা দাদু এসেছে।"
সুচিন্তিত মতামত দিন