► অনিকেত মহাপাত্র / দেবেশ রায় বিষয়ক প্রতিবেদন

 দেবেশ রায় বিষয়ক প্রতিবেদন       /    অনিকেত মহাপাত্র
তাঁর প্রতিবেদন পড়তে পড়তে বড় হয়ে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন লেখা, এক দুঃসাহস বলা যেতে পারে। একটি প্রবন্ধের সূত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। আর প্রবন্ধটির প্রকাশও ‘পরিচয় ‘পত্রিকায়। বলা যেতে পারে পরিচয়ে পরিচয়। 

‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত 'নিয়ে ছিল প্রবন্ধটি, লিখে সটান সম্পাদক বিশ্ববন্ধু ভট্টাচাচার্যের কাছে পৌঁছনো, পরিচয়ের দপ্তরে। লেখাটি পরে প্রকাশিত হয় এবং সম্পাদকমশাই জানান যে তিনি দেবেশ রায়ের কাছে সংখ্যাটি পাঠিয়ে দিয়েছেন।এইভাবেই শুরু হয়েছিল সাক্ষাৎ পরিচয়ের সূত্রপাত। কিন্তু বহু পূর্ব থেকে গোগ্রাসে গিলেছি তাঁর লেখা। তখন তাঁর সঙ্গে শুধু অক্ষরের সূত্রে যোগ। মনে পড়ে যাচ্ছে একটি আবিষ্কারের মত প্রসঙ্গ। দেবেশ রায়কে নিয়ে ‘কঙ্ক‘ পত্রিকা একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে। আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি উপন্যাসকে খুঁজে বার করার। দেবেশবাবু সংখ্যা সম্পাদককে জানিয়েছিলেন যে উনিশ শো আশি থেকে অষ্টআশির মধ্যে কোনো একটি বছর ‘বসুমতী’ পত্রিকায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাঁর কাছে তার কোনো কপি নেই। তিনি ‘বসুমতী ‘দপ্তরেও খোঁজ নিয়ে ছিলেন কিন্তু পাননি। তাই কোনো লাইব্রেরি বা কারোর নিজস্ব সংগ্রহে যদি থেকে থাকে ওটিকে যেন উদ্ধার করার চেষ্টা করেন ‘কঙ্ক ‘ গোষ্ঠী। 

মাস ছয়েক কলকাতার বিভিন্ন লাইব্রেরি, জেলার লাইব্রেরিগুলি খুঁজে অবশেষে উপন্যাসটি পাওয়া যায়। উনিশ শো পঁচাশি খ্রিস্টাব্দে শারদীয় ‘ বসুমতী‘তে প্রকাশিত উপন্যাস ‘সমুদ্রের লোকজন ‘। প্রিয় কথাকারের আন্তরিক ইচ্ছেকে রূপায়িত করার এক গভীর প্রশান্তি এসেছিল মনে, সঙ্গে আবিষ্কারের আনন্দ । তাঁর সঙ্গে আবার একবার অন্যরকম সাক্ষাৎ হয় যখন উপন্যাসের গঠন শৈলী নিয়ে গবেষণা করছি। পড়ছি ‘উপন্যাস নিয়ে,‘ উপন্যাসে নতুন ধরণের খোঁজে ‘। উপন্যাসের সূচনায় ইউরোপীয় মডেলের অনুবর্তন নিয়ে একটি সংবেদনশীলতার গণ্ডিকে তিনি ভেঙে দিলেন, বলা যায় মুক্তি দিলেন বাংলা উপন্যাসের ফর্মকে কলোনিয়াল হ্যাংওভার থেকে। সেদিন মনে হয়ে হয়েছিল ঔপন্যাসিক শুধু উপন্যাস লেখা নয়, কী লিখছি কেন লিখছি --- এই তাত্ত্বিক জায়গাটাও যদি স্পষ্ট করে দেন তাহলে উপন্যাসের ধারা কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতার এই প্রেরণা নিয়ে কারোর প্রশ্ন থাকতে পারে। থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে এই যে প্রশ্ন করার জায়গাটি তৈরি করে দিয়ে গেছেন এটি বিপুল প্রাপ্তি। 

আবার শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ -জোলেখা’র আখ্যানকে উপন্যাসের ফর্মে আনলেন তা অনবদ্য । কারণ এই বাংলায় সগীরের উক্ত কাব্যের আখ্যানকে অন্য ক্রিয়েটিভ ফর্মে আনার দৃষ্টান্ত তিনি প্রথম স্থাপন করলেন। বহু জেলার পত্রিকাগোষ্ঠীকে দেখেছি গুরুত্ব দিতে, সময় দিতে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি সদ্য শুরু হওয়া পত্রিকা সম্পাদককে বুঝিয়ে চলেছেন প্রকাশনা সংক্রান্ত নানান খুঁটিনাটি বিষয়। মনে হয়েছে তিনি শুধু নিজে অন্যরকম সম্পাদক ছিলেন না, তিনি সম্পাদক তৈরি করেন।  উনিশ শো তিরাশি থেকে শুরু হওয়া ‘প্রতিক্ষণ ‘বা তার পূর্ব থেকে ‘পরিচয় ‘-এর সম্পাদনা তাঁর জাতনায়। আবার একইভাবে বারোটি খণ্ডে অপ্রকাশিত জীবনানন্দ সমগ্রমননশীল ও পরিশ্রমী সম্পাদনার সাক্ষ্য দেয়। 

প্রশ্ন কী করিনি ! করেছি অনেক। মানুষ কেন খুন করে? এই জিজ্ঞাসা তাঁর সামনামী উপন্যাসটি পড়ার পর আরও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, তেমনভাবে মানুষ কেন নিজে নিজেকে খুন করে ! জীবনে যা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, অনুভূতির তীব্র আঘাত পেয়েছিলেন। মহাকাব্য বলা যেতে পারে ওই উপন্যাসটিকে , দুহাজার দশ সালে প্রকাশিত ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল ‘এরকথা বলছি । প্রশ্ন করেছি কেন সাতচল্লিশের পরে আর পেলাম না যোগেন মণ্ডলকে আখ্যানে। প্রশ্ন জাগানোর কাজ করে গেছেন, মননকে করেছেন শানিত ও মুখর । 

আপনি আমাদের ভাবান, আরোও ভাবাবেন। পিতামহ স্রষ্টা, এটি হয়তো আমাদের জন্য পাথেয়। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.