গত দু থেকে আড়াইমাস অনেক কিছু শেখালো।যখন প্রথম করোনা থাবা বসাচ্ছে, আমার ও ধারণা ছিল এখানে কিস্যু হবেনা, এত গরম! কী আশ্চর্য ধারণায় সব বাঁচি আমরা, এমনকি শিক্ষিত লোকেরা, যদিও এ প্রসঙ্গে আগের একটি লেখায় লিখেছি।করোনায় আস্তে আস্তে গতিবিধি রুদ্ধ হলো। আমার জন্মদিন ছিল একুশে মার্চ। শুধু আমার বন্ধু সেমন্তী এসেছিল, আর আমার পাড়ায় একটা ছোট গ্যাঙ আছে যারা সব সুখ দুঃখেই একসাথে থাকি তার তিনজন । এত অনাড়ম্বর , ভীত জন্মদিন কখনো কাটাইনি।আমি পার্টি অ্যানিমাল।হইচই করে কাটানো স্বভাব। বন্ধুরা আমার প্রাণশক্তি। তাদের যে কোনো অসুবিধা আমার, আমারই অসুবিধা বরাবর।কাছ থেকে যারা চেনেন তারা জানেন বহু মহিলা আমাকে ফোন করেন, আর আমি একটা মোটামুটি পেশেন্ট হিয়ারিং এর টোল চালাই ফোনে ফোনে। তারা তাদের সমস্যার কথা বলেন, আমি যা অনুভব করি তাই তাদের বলি। আমি কোন " মুশকিল আসান" ও নই , সাইকোলজিস্ট ও নই, আমি শুধু জানি মানুষের সবচেয়ে কমন সমস্যা হল সে চায় তার কথা কেউ শুনুক।কেউ ধৈর্য্য ধরে তার কথা শুনলেই তার অনেকটা হালকা লাগে, সে একটু নিঃশ্বাস নিতে পারে । বাকি বিষয়টা পরে আসে।আগে থেকেই মানুষ একা ছিল। কলকাতা শহরটা এখন গোটাটাই একটি বৃদ্ধাবাস। সকলের ছেলে মেয়েরা ভারতের অন্য শহরে বা বিদেশে।বুড়ো বুড়িরা পড়ে আছেন বাড়িতে। এছাড়াও নিঃসঙ্গ লোকের সংখ্যা অনেক। কারো হাই স্টেটাস, ঠাঁট বাট, কিন্তু বাড়িতে একটা কথা বলার লোক নেই।আছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, ভার্বাল অথবা ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ, আছে বাচ্চাদের উপরে দুনিয়ার ফ্রাসট্রেশন তোলা। কোভিড যখন সবার দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিল, এই সমস্ত মানুষ আরো একা হয়ে গেলেন। কলকাতা হয়ে গেল একটি অবসাদের শহর।তার গোঙানি আছে, ফোঁপানি তার আকাশছোঁয়া, প্রতিটি অলিন্দে ক্লিষ্ট মুখ। তবু মানুষ এক এমন জীব, যে কোন অবস্থাতেই বেঁচে যায় ঠিক।
এ সময়ে এক নতুন যুদ্ধ শুরু হল। অবসাদে মানুষ আত্মহত্যা করতে লাগলো। আত্মহত্যা বাড়লো অনাহারে ও। তবু অনেক মানুষ যেটুকু সম্বল সেটুকু নিয়ে শুরু করলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে , নিজের গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিদেশ থেকে ও মানুষ ফিরতে চাইল, অন্য রাজ্য থেকে অভিবাসী মানুষ ফিরতে চাইল। এখন উচ্চবিত্ত ফিরতে চাক ,কী শ্রমিক , প্রতিরোধ এলো প্রচুর। একটি নতুন বক্তব্যে মুখরিত হল আকাশ-বাতাস, " ওদের জন্য আমরা মরব কেন?"
একটু ভাবুন তো আপনার ছেলে বাইরে আছে চাকরির সূত্রে। ধরুন মহারাষ্ট্রেই। আপনি চাইবেন না সে আসুক, যা হওয়ার সামনেই হোক। ইঁদুর ও মারা যাবার আগে তার গর্তে ছোটে। বাড়ি শব্দটাই মানুষের আজন্মের মোহ, ভালো থাকার পাসওয়ার্ড।সে চাইবে না ফিরতে? আমার ভাই ও বোন দুজনে মুম্বাই য়ে একা একা একটি করে ফ্ল্যাটে আছে, এমনকি অন্যদের মুখ ও দেখা যায় না সেখান থেকে, রাস্তাও না। তাদের ফেরার অপশন থাকলে কেউ না ঢুকতে দিলেও আমি দরজা খুলে দিতাম। শুরু হলো পাড়ায় পাড়ায় বিক্ষোভ, থানায় ধর্ণা, অমুকের বাড়িতে তমুকে হায়দরাবাদ থেকে ফিরেছে, আপনারা ধরে নিয়ে আসুন। মিডিয়া প্যানিক ছড়াতেই থাকলো আর আমরা গিলতেই থাকলাম। কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে আসা রোগিকে ঢুকতে দিলাম না, ডাক্তার -নার্সদের ঘাড় ধরে বের করে দিলাম, যেন আমি অক্ষতই থাকবো,কোন ডাক্তারের, হাসপাতালের আমার প্রয়োজন পড়তেই পারবেনা। আমাদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন ছিল, ছিল জাতের, কাস্টের বিভাজন, ছিল ধনী -গরীবের বিভাজন , এখন আরো হাজার টুকরোয় ভেঙে গেলাম আমরা।
এত বিপর্যয় ও আমাদের বিভেদকামী মানসিকতা কে বদলাতে পারলোনা। অন্যে বড়লোক হলে আমাদের প্রচন্ড রাগ, "এরা,এরাই তো যত নষ্টের মূল; কথায় কথায় বিদেশ যায়,এরাই তো সব্বোনাশ করল।"
যখন চাকরি বাকরি যেতে লাগলো মানুষের, প্রান্তিক অসংগঠিত শ্রমিক,ঠিকা মজুর, চাষিদের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলো, আমাদের রাগ আরো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগলো।ও ফেসবুকে লাইভ করে, চাকরি আছে, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আছে, তাই ফুটানি।ও খাবারের ছবি দেয়, কী ঘৃণ্য মানুষ, ওর ঠোঁটে এখনো লিপস্টিক, মানুষের রক্ত ঠোঁটে মেখে বসে আছে আসলে! আবার উল্টোটাও হল, 'এই ভিখিরি, গরীবগুলোকে রাজ্যে ঢুকতে দিয়ে আমরা মরব নাকি?'
সেই ওরা-আমরা।সেই বিভাজন। সেই চূড়ান্ত সর্বনাশেও ধর্মের তাস, সেই ধর্মের নামে চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতা।সেই খিদে নিয়ে মিম, সেই একের অপরের বিরুদ্ধে খাপ পঞ্চায়েত।কিছুই বদলালো না, শুধু এতগুলো মানুষ টপাটপ মরে গেল। নতুন যেটা দেখলাম, মায়ের শরীর নিতে অস্বীকার করছে ছেলে, করোনা হয়নি, তাও, আবার যারা নিতে চাইছে, তারা পেলোনা,মৃতের শেষ যাত্রায় দুটি মানুষের বেশি কেউ থাকতে পারলো না। মানুষ শোকেও একা হয়ে গেল।এর মধ্যে এক প্রবল সুপার সাইক্লোন এসে গুঁড়িয়ে দিলো শেষ মাথা তোলার চেষ্টাটুকু। আবার ওই একই খেলা শুরু হল। ওরা কেন গান গায়, ওরা কেন কবিতা বলে, ওরা কেন খায়, ওরা কেন বুটিকের শাড়ি পরে লাইভ করে?একজন বিখ্যাত লেখিকা লিখলেন যারা এইসময় প্রেমের কবিতা লিখছেন, তাদের করোনা নয়, কুষ্ঠ হয়েছে, কুষ্ঠ হলে শরীরে সাড় কমে যায়।আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এরকম বক্তব্য দেখে।
একটা কথা আর আমরা কবে বুঝবো যে প্রত্যেকের জীবন তার নিজের,তার নিজস্ব বিষাদের, নিজস্ব আনন্দের। কেউ গান গাইলেই সে আনন্দে গায় না, তার কাছে এটা এস্কেপ রুট ও হতে পারে। আপনি ফেসবুকে বিলাপ করে শান্তি পাচ্ছেন, সে হয়তো গান গেয়ে কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছে। আমি চূড়ান্ত কষ্টের দিনে, স্বজন হারানোর দিনে ফুল এনে ফুলদানিতে সাজিয়েছি। আমার সে সাজানোর পিছনের যন্ত্রণা , সেই নিভৃতিটুকু আপনি নিয়ে নেবার কে? ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স শুধু মারধোরেই হয়না। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের নানা রূপ । সবসময় ছেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তে সবাই থাকে না। আর লকডাউনে ছেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি ও নেই। সে সময় সেই মানুষটি যদি একটু সেজেগুজে নিজের কালো দাগগুলো ভুলতে চায়, তার দোষ সেটা? অমানবিক কে? যারা তাকে সহজেই দাগিয়ে দিল , ট্রোল করল, তারা মানবিক?
অনলাইন সাইট খুলেছে সব, জামাকাপড় ডেলিভারি হচ্ছে, স্যুইগি তো খোলাই ছিল, পার্লার ও চালু হয়েছে। এবার আমি ধরুন একটা জামা কিনলাম, একটা থ্রেডিঙ করালাম,আপনি বলবেন সুন্দর বনের গ্রামের মানুষেরা রাস্তায় বসে আছে, স্রেফ রাস্তায়। আপনি বলার সময় বেমালুম ভুলে যাবেন, আমি যদি জামাকাপড় কেনা বন্ধ করে দিই, তবে অনলাইন সাইটের ছেলে মেয়েগুলোর চাকরি যাবে, যারা কাপড় বোনেন তাদের কোন ক্রেতাই থাকবেনা, যারা প্যাকেজিঙ করেন, যারা সেটা দর্জির থেকে এনে ডিস্ট্রিবিউটর কে বিক্রি করেন, এছাড়া টাটা ক্লিক বা অ্যামাজনের আইটি বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে কোম্পানীর সঙ্গে টাই আপ, ক্যুরিয়র বয়, ক্যুরিয়ার ব্যবসার মালিক আরো অনেকের কাজ কমবে, কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যাবে। কনজিউম করা ছেড়ে দিলে জিডিপি বলে কিছু থাকবে না এ বোঝার জন্য ইকনমিস্ট হতে লাগেনা। এমন অনেক মহিলা আছেন যারা কস্টিউম জুয়েলারি বানিয়ে ঘর চালান, আমরা নাক উঁচু করে বললাম, 'এ তো বাহুল্য '; তার তো সংসারটাই ভেসে গেল।ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই থাকলে তবে ইকনমি চলবে। দান-ধ্যানে ইকোনমি চলেনা কিন্তু।ভাবাবেগে একটা ঘরের পাখাও ঘোরে না। আমার ঘরে জল ঢোকেনি। শুধু কল্পনায় আর ছবি দেখে সেই একই কষ্ট আমি অনুভব করতে পারবো? কক্ষণো না। আমি কবিতা লিখলেও না, না লিখলেও না।আমি আমার সাধ্যমতো রিলিফ ফান্ডে দেবো। কখনো সাধ্যের বাইরে ও দেবো। আমার মা, মামা-শ্বশুর যিনি ক্যানসার রুগি, আমার দেওরের পরিবার ( দেওর আটকে আছে বাইরে) সবাইকে আমাদের তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে হচ্ছে। বলবেন না যেন, ওরা তো নিজের লোক, মাকে সাহায্য করাও কোন মানুষ কে সাহায্য করা, আর নিকট আত্মীয় স্বজনদের সাহায্য না করে দেশসেবায় আমি বিশ্বাস ই করিনি কোনদিন। আমার কম ইমিউনিটি যুক্ত ক্যানসারের রুগি মামাশ্বশুরের বাড়ি হাওড়ায়। এখান থেকে বাজার করে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে,তার হঠাৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া অবধি করা হয়েছে, 'এখন তো লকডাউন' বলে অন্য আত্মীয়দের মতো হাত তুলে নিতে পারিনি। আবার 'ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার' গান ও গেয়েছি। কবিতা ও লিখেছি। আমার বাড়ি উড়ে যায় নি। আমার সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়নি। যাদের গেছে তাদের জন্য কোমর বেঁধে কাজ করতে পারি কিন্তু আহা উঁহুর 'শৌখিন মজদুরি' করে না ওনাদের আমি কোন সাহায্য করতে পারবো না নিজের। আমি এখনো জীবিত। আমার এখনো চাকরি আছে। আমি এখনো চিকেন খাচ্ছি। এটা আমার ভাগ্য কিছুটা , কিছুটা সময়ের সাথে অর্জিত। এখন আমার চাকরি আছে এর জন্য আমি হা হুতাশ করবো? আমার চাকরি আছে,এটা আমার অপরাধ? যে মানুষ যে জীবন যাপন করে, তার জীবনের ধারণাই তার থাকে, সে সেভাবেই মানুষের পাশে থাকতে পারে । কিন্তু রাতদিনের মরবিডিটি চর্চা আর আতঙ্কের সাতকাহন, আর ফেসবুকের বিলাপের বাইরে স্বাভাবিকভাবে নিজেকে ছুঁয়ে দেখেননি কতদিন বলুন তো?
কতদিন নিজের ভিতরমানুষটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন নি, "আহা , তুমি তো বড় ক্লান্ত।"কতদিন ইচ্ছে গুলো কে লুকিয়ে বেঁচে আছেন,কাল মরে গেলে কাকে সান্ত্বনা দেবেন বলুন তো? মৃতদেহের পাশে দাঁড়ানোর একটি লোক পর্যন্ত নেই। তাই ফুরিয়ে যাওয়ার আগের প্রতিটি দন্ড, পল, মুহূর্তে রাখুন শ্বাস, রাখুন ভালোবাসা। প্রেম ন্যাকা নয়, শুধু একটু ভালোবাসার ছোঁয়া থাকলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে ঘুরে দাঁড়াতে ভরসা পায় মানুষ। যে পরিযায়ী শ্রমিকটির রাস্তায় বাচ্চা প্রসব হলো ,সে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি আপদ বালাই বলে, সে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে ও এঁকেছে একটি ভালোবাসার চুমো সেই সদ্যজাতর কপালে। এভাবেই মারী ও মড়কে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়, জীবনকে ভালোবাসা ছেড়ে দিলে এত যুদ্ধ লড়ব কী দিয়ে বলতে পারেন?
সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে, আলো ছড়াচ্ছে, এখনো সেখানে লকডাউন হয়নি, যতদিন আলো, কিছুতেই উদ্ভাসিত হওয়ার আনন্দটুকু ছাড়তে পারবোনা।
সুচিন্তিত মতামত দিন