তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় / আবার আনন্দধারা বইবে ভুবনে।

তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় / আবার আনন্দধারা বইবে ভুবনে।

ক্রমাগত একটা যুদ্ধ করে যাচ্ছি। এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিছুটা জানি তাকে, তার রকম সকমও বুঝে গেছি অনেকটা, প্রস্তুতিতে যদি একটুও দুর্বলতা থাকে তাহলে সে প্রচণ্ড ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে তাও শুনেছি, কিন্তু তাকে দেখতে পাইনা। নিজেকে আড়ালে রেখে সে বিক্রম দেখিয়ে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের সামনে, যেন তার দখলদারিতে কেউ বাধা না দিতে পারে। জানি, সে ইন্দ্রজিৎ নয়, তবু তারই মতো কৌশলে কখন যেন সে মেঘনাদ হয়ে উঠেছে আর নিজেকে অলক্ষ্যে রেখে বীরত্ব দেখাচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীতেও।

আবহটা যখন এই রকম, করোনা ভাইরাস ঠেকাতে যখন অধিকাংশ মানুষ লকডাউনের নিয়ম মেনে ঘরবন্দী, তখন বিহ্বল বসন্তের শেষ দিনগুলিতে চৈতি পবন উড়ে যাচ্ছে অপরিণত আলস্যে এ পাড়া থেকে ওপাড়ায়। সে লকডাউন জানেনা। অথচ তার ম্যাজিক আর কাজ করছেনা উদ্বিগ্ন মানুষের মনেও। মানুষের কোলাহল বিহীন শূন্য প্রকৃতিরও তাতে সেরকম যোগদান নেই। প্রকৃতিরও তো মন খারাপ। মানুষকে বাদ দিয়ে সে কি করে ভালো থাকে? যদিও এখনকার দুঃসহ দিনগুলিতে প্রকৃতির আরও বেশি মোহিনী আর সুন্দরী হয়ে ওঠার গল্প করছেন অনেকেই। পরিবেশের নিশ্চয় কিছু নিরাময় দরকার। মানুষের ঢেলে দেওয়া বিষ থেকে শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসা দরকার। সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার নামে যে উদাসীনতা আর নিষ্ঠুরতা আমরা প্রাণীকুলের প্রতি দেখাতে অভ্যস্ত তার বদল হওয়া দরকার। অনাবশ্যক চড়া আলোয় রাতের অন্ধকারকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়ে জীবজগতকে বিভ্রান্ত করে যেভাবে আমরা প্রকৃতির ব্যালেন্সটা নষ্ট করে দিই, তার প্রভাব পড়ে সেই মানুষেরই জীবনে। তাই বলে মানুষের বদলে পশুপাখিরা রাস্তায় বেরিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে ঘোরাফেরা করবে, সী বিচে সমুদ্রের ঢেউ নিতে হরিণেরা উচ্ছল লাফালাফি করবে আর মানুষেরা ঘরে বন্দী থেকে সেই ছবি দেখেই সার্থক করবে দিনগুলি এটা মেনে নেওয়া মুশকিল।

আসলে এক বিরূপ বাতাসের কবলে পড়েছে আমাদের এবারের বসন্ত। তাই উৎসবের আবহটা মন থেকে উড়ে চলে গেছে সেই ফাল্গুনেই। সেই বাতাস আরও রুদ্ররূপে বয়ে যাবে বৈশাখেও, নববর্ষে হালখাতার উৎসব পণ্ড করে দিয়ে তার যাত্রা অন্য কোন সন্ধিক্ষণের দিকে হয়তো। কিন্তু আমরা যারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি, অনলাইনে যা যা পাওয়া যায় সেসব বেশি বেশি অর্ডার দিচ্ছি, আর যারা ওসব অনলাইনের ধার ধারিনা তারা প্রয়োজনের বেশি বাজার যাচ্ছি, গলির শেষপ্রান্তের দোকানে অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু চাও খেয়ে আসছি, তারা যেকোন ছুতোয় উৎসব খুঁজে নিতে পারি। তাই বাতাসের মন ভারি থাকলেও ১লা বৈশাখ কিভাবে কাটাবো, কি কি মেনু হতে পারে তার আয়োজন করছি আগে থেকেই। 

কিন্তু শারীরিক পরিশ্রমই যাদের বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত, যারা শ্রমিক, দিনমজুর এবং আসলে দেশ চালায়, না বেরলে যাদের কোন উপার্জন নেই, সেইসব প্রান্তিক মানুষগুলোও তো আমাদের প্রতিবেশী। তাদেরও সুস্থ থাকাটাও খুব জরুরী। ছোট্ট একচিলতে ঘরে দিনের পর দিন পরিবারের কয়েকজন মিলে সারাদিন আটকে থাকা যে কতটা অসম্ভব তা কি আমরা অনুভব করতে পারি? হয় অনাহার, না হয় করোনা ভাইরাস, এছাড়া আর যদি কোন অপশন না থাকে আর সেইজন্যই যদি মহামারীর ভয়কে সরিয়ে রেখে তারা বেরিয়ে পড়তে চায় যে যার পেশায়, সেই দিকটা গুরুত্ব দিয়ে দেখার এই তো উৎকৃষ্ট সময়। হয়তো দেখছেন অনেকেই, সরকারী বেসরকারি সাহায্যও কিছু আছে, তবু তাতে কি আর দিনযাপনের সব প্রয়োজন মেটে! তাই অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি অনেকটা ঝাপসা হয়ে যায়। তবু হতাশার জায়গা নেই কোথাও। সহনশীলতা, মনের জোর আর প্রতিরোধ ক্ষমতা তো আছেই, তা দিয়ে অনেক প্রতিকূলতাকেই জয় করা যায়। তবু তার সঙ্গে দূরে দূরে থেকেও যদি সেইরকম সহনাগরিকদের প্রতি আর একটু সহমর্মিতা দেখাতে পারি, সাহায্য করতে পারি, পারস্পরিক ভরসার জায়গাটা দৃষ্টান্তমূলক ভাবে আরও একটু পাকা করে নিতে পারি, তাহলে সহজেই পার হয়ে যাবো এই অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ।

সেইসঙ্গে কালবৈশাখীর কাছেও কিছু শর্ত রাখা যায়। সে যদি সাহসী ঝড়ে উড়িয়ে দিতে পারে ভয়ের চালাঘর, ভেঙে দিতে পারে জমে থাকা কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের ঢিবিগুলি, তবে বেঁচে থাকাটা আরও সহজ আর অর্থময় হয়ে ওঠে। তাকে সাহায্য নিতে হবে সময়ের।

সময় সব জানে। সে গাছ থেকে মাটিতে আপেল পড়ে যেতে দেখেছে অনাদিকাল থেকে। কিন্তু সেই দৃশ্য থেকে বিজ্ঞানের কি লাভ হল তা সামনে আনতে অপেক্ষা করেছে এক বিশেষ মানুষের জন্য। অনুসন্ধিৎসু চোখে খুঁজে নিতে হবে। খুঁজছেও মানুষ হন্যে হয়ে। পৃথিবীর প্রায় সকল বিজ্ঞানী গবেষকরা যে যার মত করে খুঁজছেন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক বা তা থেকে মুক্তির উপায়। হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে। ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে যুদ্ধ করার কৌশল জেনে যতই মেঘনাদ হয়ে উঠুক, তার নিয়তি নিশ্চিত হয়ে যায় মর্তের মাটিতেই, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে।

এই ভাইরাসেরও নিয়তি নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে এক অন্যরকম যজ্ঞাগারে। গবেষকদের অবিরাম প্রচেষ্টায়। আড়ালে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তার ছদ্ম বীরত্বকে খতম করার অস্ত্র বেরিয়ে আসবে ল্যাবরেটরি থেকেই। আসবেই। সময়ের অপেক্ষা শুধু। ততদিন আমরা তাকে প্রোটোকল মেনে ঠেকিয়ে রাখি, ঘরে থেকেও, দূরে থেকেও সবার মনের খুব কাছাকাছি থাকি, বন্ধনের অদৃশ্য সুতোয় সবাইকে বেঁধে বেঁধে রাখি। মায়া মমতায় ভরা এই জীবজগতে সবাই যে যার মত করে সুখে দুঃখে বেঁচে থাকবে, আবার আনন্দধারা বয়ে যাবে ভুবনে, এই প্রত্যয় নিয়ে থাকি।

তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

-

Previous Post Next Post