শাস্ত্র কি ? আচারই বা কি ? লোকাচারের সৃষ্টি কোন পটভূমিকায় ... আমাদের অনেকেই এই দুয়ের প্রভেদ না জেনে না বুঝে সবই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রথা হিসেবে মেনে নিই ... আর নিজেদের অজ্ঞতার জন্য দোহাই দিই শাস্ত্রের ... এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা মেয়েকে পাইলটের চাকরি করতে পাঠাই , আর্মিতে জয়েন করাই অথচ মেয়ের হাতে বিপদ তারিনীর তাগা বেঁধে দিতে ভুলি না ... বিয়ের সময় পাইলট মেয়ের কন্যাদান না হলে বিয়ে অসম্পূর্ণ থেকে গেল এমনই একটা গেল গেল রব ওঠে ... সুতরাং এই দ্বিচারিতা আমাদের মনে ... যুক্তি বুদ্ধি জ্ঞান দিয়ে প্রতিটি সামাজিক বিধানকে বিচার করে অসাম্যটুকু দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেই আমাদের ... সব সামাজিক বিধান বা লোকাচার তো অযৌক্তিক নয় তবে তার মধ্যে থেকে কোনটা গ্রহন করব আর কোনটা নয় তার জন্য একটি স্বচ্ছ যুক্তিশীল মন দরকার , দরকার পরিশীলিত বিচার বোধ ... আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মেয়েরা প্রায় সব পেশার সঙ্গেই যুক্ত । সে সাবমেরিন চালানো হোক বা মহাকাশ অভিযান , রকেট উৎক্ষেপন হোক বা পাইলটের চাকরি , কৃষিকাজ থেকে কম্পিউটার সর্বত্র তাদের গতিবিধি অবাধ , এই যুগ নারী শক্তির উন্নয়নের যুগ ; তবে পৌরহিত্যের মতো একটি পেশায় মেয়েরা ব্রাত্য থাকবে কেন ? সে কি কেবল সংস্কার সর্বস্বতার অচলায়তনের জন্য ? মেয়েরা যদি ডোম হতে পারে করতে পারে শেষকৃত্যের মতো কাজ তবে তাদের পুরোহিত হতে বাধা কোথায় ? বিশেষতঃ ঋকবৈদিক যুগে এই ভারতবর্ষেই তো ছিলেন গার্গী অপালা লোপামুদ্রা খনার মতো শাস্ত্রসিদ্ধা বিদুষী রমণীরা ...নারীদেহ অশুচি নয়, উপযুক্তশাস্ত্রজ্ঞান আর ভক্তির জোরে তারা পৌরহিত্য করতেও সক্ষম ... এইটাই এই সিনেমার মূল প্রতিপাদ্য...
এবার আসি সিনেমার কথায়, দুর্বল গল্পের প্লট , ততোধিক দুর্বল চিত্রনাট্য উইন্ডোজ মিডিয়া প্রোডাকশনের বোধহয় সবচেয়ে দুর্বলতম প্রযোজনা।প্রত্যেক সিনেমারই একটা সোশ্যাল মেসেজ থাকে, একটা গল্পের মোড়কে সেই মেসেজটা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই পরিচালকের কাজ। এই গল্পের প্লটে যে বাতাসিয়া গ্রামের পটভূমিকা আনা হয়েছে সেখানে কোনো সুস্পষ্ট সময়ের যাকে বলে টাইম ফ্রেমের দিক নির্দেশিকা নেই ... বৈদিক মন্ত্রে বিবাহ এখনও পর্যন্ত আরবান কালচার ; গ্রামের দিকে পৌঁছয় নি ... বাংলার কোন গ্রাম আছে যেখানে মেঠো রাস্তার পাশাপাশি একাধিক বর্ধিষ্ণু বড়লোক যাদের অনেকের বাড়িতে ইনোভার মতো দুটি বড় গাড়ি আছে ! সিনেমার প্রথমার্ধে হাসির মোড়কে যে গল্প পরিবেশনের চেষ্টা হয়েছে তা আদ্যন্ত অবাস্তব ও নড়বড়ে লেগেছে ... যদি অযৌক্তিক স্ত্রী আচারের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ এর মূল উপজীব্য হয় তবে সেটা কেন মেয়েদের পিরিয়েডস চলাকালীন ঠাকুর পুজো ও বিবাহে কন্যাদানের মতো দুটি ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল বোঝা গেল না ... বিধবাদের যে বিয়ের কোনো কাজ করা বারণ অর্থাৎ বিয়ের কাজে এয়ো স্ত্রী প্রয়োজন বা কন্যাদের পিন্ডদান বা পুত্রের মতো শ্রাদ্ধ করায় বিধিনিষেধ আরোপের যে প্রথা আজও প্রবহমান সে সম্বন্ধে এই সিনেমা নিরুত্তর।গল্প লেখিকা হিসেবে জিনিয়া সেন এবং পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায়ের কাজ মানোত্তীর্ণ হতে পারে নি ।
অভিনয়ে সোহম মজুমদার অত্যন্ত দুর্বল ! বাঙ্গালী পুরুষ কি এরকমই হয় ? ক্যাবলা spine less যৌথ পরিবারে কোনো উচিত কথা না বলতে পেরে রাতে বৌয়ের আঁচলের তলায় কাঁদে ... অথবা ঋতাভরী চক্রবর্তীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী স্পষ্টবাক চরিত্রের পাশে ইচ্ছে করেই এরকম অনুজ্জ্বল ও ম্যাড়ম্যাড়ে রাখা হয়েছে বিক্রমাদিত্য চরিত্রটিকে ! তবে ছবির সংলাপ বলিষ্ঠ ... ছাপ রেখে যায় তর্জার ছান্দিক কবিগানগুলি ... ছবির ক্লাইম্যাক্সে যে কন্যাদানের মন্ত্র উচ্চারণের নিষিদ্ধতার জন্য ঠাকুরমশাইয়ের কাছে হেরে যায় শবরী তার যুক্তিগ্রাহ্যতা ঠিক বোধগম্য হল না ... শুভাশিস বন্দোপাধ্যায়কে ভিলেনের চরিত্রে বসানো হয়েছে ... বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ পুরুষ মানেই খলনায়ক ?
সব মিলিয়ে উইন্ডোজ মিডিয়া প্রোডাকশনের বেলাশেষে বা কণ্ঠ যে প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দিয়েছিল এই সিনেমা তার পঞ্চাশ শতাংশ পূরণেও ব্যর্থ হয়েছে ... চড়া সামাজিক মেলোড্রামা ব্যহত করেছে চলচিত্রেশিল্পের কারুকাজকে ...
সুকন্যা সাহা
Tags:
সমালোচনা