সঞ্জীব সিনহা / ফেলে আসা সত্তর বছর

ফেলে আসা সত্তর বছর    সঞ্জীব সিনহা

সত্তর বছর? সে তো কম নয়। দেখা যাক আমার দেখা গত সত্তর বছরে আমাদের পল্লীবাংলায় কতটা উন্নয়ন হয়েছে। শুধু উন্নয়নই যে হয়েছে অবনয়ন কিছু হয়নি তা নয়, আগেকার মতন সেই হৃদ্যতা আর নেই, হয়ত ব্যস্ততার মধ্যে সে নিজেকে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেনি। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সত্তর বছর কেন? কারণ তার আগে আমি খুবই ছোট ছিলাম, মায়ের কাছ ছাড়া বাইরের জগত বিশেষ জানা ছিল না। প্রথমে আমার গ্রামের কথাই বলি, ভাতের ডেকচি থেকে একটা ভাত তুলে দেখে যেমন বোঝা যায় সব ভাত সেদ্ধ হয়েছি কিনা সেই রকম একটা গ্রামের কথা জানলে মোটামুটি অন্যান্য গ্রামও কমবেশি একই রকম হবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আমদের গ্রাম কলকাতা থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে হুগলী জেলার এক প্রান্তে। গ্রামে তখন লোক সংখ্যা কত ছিল বলতে পারব না তবে এটা নিশ্চিত চার সংখ্যার কাছাকাছিও যায়নি। পাকাবাড়ির সংখ্যা পাঁচছটার বেশি নয়, বেশির ভাগই ছিল মাটির ঘরের ওপর খড়ের ছাউনি। গ্রামের প্রান্তে সাঁওতালপল্লীতে ছিটেবেড়ার দেওয়ালের ওপর তালপাতার ছাউনি দেওয়া কুঁড়েঘর, যারমধ্যে বেশ কিছু ভগ্নপ্রায়। নতুন প্রজন্মকে বলছি, - ছাউনি হল ঘরের ছাদ, আর ছিটেবেড়া হল কঞ্চি অর্থাৎ বাঁশের সরু সরু ডাল দিয়ে ঘিরে তার ওপর পাতলা করে মাটির প্রলেপ দেওয়া দেওয়াল। চারিদিকে ঝোপঝাড় আর পুরনো দিনের ভাঙ্গা বাড়ি, কারোর শুধু দেওয়াল গুলোই আছে কারোর আবার ছাদের কিছু অংশ তখনও বর্তমান। ছিল অনেকগুলো মন্দির তার মধ্যে বেশ কয়েকটা একদম ভাঙ্গা যেখানে তখন পুজা করার মতন অবস্থা ছিল না, কোনটায় হয়ত শিবলিঙ্গ ছিল, কোনটাতে তাও না। 

ঐ সময় আমাদের গ্রামে এক অতিবৃদ্ধ ডাক্তার এবং একজন এল এম এফ ডাক্তার ছিলেন, আর প্রায় তিনচার কিলোমিটার দূরে ষ্টেশন বাজারে ছিলেন একজন এমবি ডাক্তার। তখনো এমবি র সাথে বিএস যোগ হয়নি। আর হাসপাতাল বলতে তিরিশ চল্লিশ কিলোমিটার দূরের জেলা শহরের হাসপাতাল। ম্যালেরিয়া প্রায় ঘরে ঘরে হত, আর যক্ষা কলেরা হলে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। আমাদের গ্রামে কোন স্কুল ছিল না, প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। সেই স্কুলে ছিল টালির ছাদের দুটো ঘর, স্কুলে তখন কোন কুয়ো বা নলকূপ ছিল না, যেমন ছিল না কোন টয়লেট। আমি ঐ স্কুলেই পড়তাম। ছাত্ররা টিফিন নিয়ে যেত বার্লির কৌটো করে গুড়মুড়ি, আমিও তাই। গ্রামের স্কুলে এখনকার মতন তখন কোন ইউনিফর্ম ছিল না ছাত্রদের জন্য। ছিল না এখনকার মত পিঠে ঝোলানো স্কুল ব্যাগ, হাতে ঝোলা চটের ব্যাগ বা বড় জোড় কাঁধে ঝোলা কাপড়ের ব্যাগই সম্বল, কারোর পায়ে চটি কারো পায়ে তাও না। আমি যখন ছোট তখন সব চেয়ে কাছের হাই ইস্কুল ছিল আমাদের গ্রাম থেকে চার পাঁচ কিলো মিটার দূরে। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় বর্ষায় প্যাচপ্যাচে কাদা আর অন্য সময় ধুলোয় ভরা। গ্রামের মেয়েরা তখন সাইকেল চাপত না। মেয়েদের লেখাপড়া প্রাইমারী ইস্কুলের গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য খুব কম বাড়িতেই সাইকেল ছিল। গ্রামের দিকে তখন কোন কলেজ ছিল না, কলেজে পড়তে হলে জেলাশহরে যেতে হত হত, আর বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তখনও হয়নি। মেডিক্যাল কলেজ আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শুধু কলকাতায়। স্বভাবতই স্বাক্ষরতার হার ছিল তখন খুবই কম। 

সারা গ্রামটা ছিল সবুজ গাছগাছালিতে ভরা, নানারকম পাখি বসতো গাছের ডালে। ঝোপেঝাড়ে খরগোসও চড়তে দেখা যেত, রাতে শিয়াল ডাকতো। তখন আমরা জানতাম না যে আম জাম আতা বেল কুল কিনে খেতে হয়। ইচ্ছে হলে গাছে উঠে বা ঢিল ছুড়ে পেড়ে খেলেই হল, এই ব্যাপারে কেউ কিছু বলত না। এখন সেই সবুজ গাছগাছালির জায়গায় ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। গ্রামে ইলেক্টিকের আলো বা ফোন তখন কল্পনার বাইরে, সন্ধ্যার পর সূর্য্যের আলো চলে গেলে কেরোসিনের লণ্ঠন বা হারিকেনের আলোর ওপরই নির্ভর করতে হত। আর দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল ডাকব্যবস্থা, অর্থাৎ খাম পোষ্ট কার্ড। শহরে টেলিগ্রাফের ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামে সে সুযোগ ছিল না। 

গ্রামের লোকের বেশির ভাগই চাষি বা ক্ষেতমজুর, চাকরিজীবীর সংখ্যা দুচার জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই ছিল গরীব। তবে হিংসা হানাহানি ছিল না, রাজনীতির দলাদলি তখনো ঢোকেনি গ্রামে, ছিল সৌহার্দ্য। অনেক গরীব পরিবারের লোকেদের শাক ফ্যানভাত খেয়ে থাকতে দেখেছি। সাঁওতালপল্লীর আট দশবছরের মেয়েরা একটুকরো কাপড়ের কৌপিন পরে থাকত। সাঁওতাল রমণীরা ব্লাউজহীন থাকতেন, তাদের জামা কেনার টাকা মানে বিলাসিতা। দুঃখ কষ্টকে ভুলে সন্ধ্যের পর ধামসা মাদলের তালে তালে নাচগান ছিল ওদের নিত্যসঙ্গী।

আমার ছোটবেলায় দেখেছি সারা গ্রামে মাত্র দুতিনটে সরকারী নলকূপ ছিল, গুটিকয়েক অবস্থাবান ব্যক্তির বাড়িতে নলকূপ বা কুয়ো ছিল যেখান থেকে সারা গ্রামের লোকেরা পানীয় জল সংগ্রহ করত। আর এখন বেশির ভাগ লোকের বাড়িতেই কুয়ো বা নলকূপ আছে, সরকারী নলকূপের ওপর বিশেষ নির্ভর করতে হয় না। সময়ের সাথে সাথে উন্নয়ন তো থাকবেই। এবার গ্রামে গিয়ে দেখলাম গ্রামের প্রায় প্রতিটি রাস্তাই কংক্রিটের, ধুলো কাদার বালাই নেই। আগে বলদ আর লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ হত, গরুরগাড়ি করে ফসল ঘরে উঠত, বাজারে যেত। পুকুর থেকে ডিঙ্গি করে জল তুলে সেচ ব্যবস্থা বজায় রাখা হত। এখন ট্রাক্টর টিলার লাঙ্গলের কাজ করছে। গ্রামের রাস্তায় ট্রাক্টর ছুটে চলেছে। ক্ষেতের ধার দিয়ে ডিভিসির সেচের খাল চলে গেছে, যেখানে খাল নেই বিদ্যুত চালিত পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তুলে সেচের আয়োজন আছে। এখন পাকা বাড়িই বেশি, অল্প সংখ্যক কাঁচা মাটির বাড়ি অবশ্য আছে। গ্রামের মধ্যেই প্রাইমারী স্কুল আর এক কিলোমিটারের মধ্যে একটা বালিকা বিদ্যালয় আর একটা কো-এডুকেশন উচ্চমাধ্যমিক স্কুল আছে। দুকিলোমিটার দূরেই একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আর দশ কিলোমিটারের মধ্যে কয়েকটা সাধারণ কলেজও আছে। স্বভাবতই এখন স্বাক্ষরতার হারও অনেক বেড়েছে। গ্রামে একটা সরকারী ক্লিনিক আছে যেখানে ডাক্তার ও সাস্থ্যকর্মীরা এসে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কাছাকাছি ডাক্তারখানাও আছে, গ্রামে এখন এ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায়। বিদ্যুৎ তো আছেই, ল্যাণ্ডফোন, টিভি চ্যানেল, মোবাইল ফোন, হোয়াট নট, সবই আছে। গ্রামের পাশ দিয়ে ছুটে গেছে ফোর-লেনের জাতীয় রাজপথ।

গ্রামে এখন কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক হয়েছে, কৃষি সমবায় সমিতি হয়েছে। এল পি জি সিলিণ্ডারের বিক্রয় কেন্দ্রও গ্রামে আছে। গ্রামে দুটো বড় বড় কোল্ড স্টোরেজ আছে যেখানে চাষিরা আলু সংরক্ষণ করে রাখেন। আগের তুলনায় দারিদ্র অনেকাংশে কমেছে। এখন সাঁওতাল পল্লীর বেশির ভাগই পাকা বাড়ি, দোতলাও আছে। ওদের ছেলে মেয়েরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, অফিসে কাজ করে। 

এত সব উন্নয়নের পরও যে সব নিন্দুকেরা বলেন পল্লীবাংলার উন্নতি হয়নি তারা একবার গ্রামে গিয়ে দেখে আসুন।

সঞ্জীব সিনহা 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.