পাড়ায় ঢোকার মুখেই ক্লাবটা, আর তার লাগোয়া মাঝারি মাপের একখানা মাঠ। পাড়ায় সবুজ বলতে এটুকুই। তবে ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা ক'খানা নারকেল আর সুপারি গাছ পাড়ার এবাড়ী ওবাড়ী থেকে দিব্যি মাথা উঁচিয়ে শুধু মাটিতেই নয়, শূন্যেও খানিকটা সবুজের আভাস ছড়াচ্ছে। সে যাই হোক, ক্লাবের মাঠে এমন মখমলি সবুজ গালিচার মতো ঘাস এপাড়ার ক্লাবের কর্মকর্তাদের বিশেষ গর্বের বিষয়। ক্লাবের নামটিও বেশ... 'সবুজের অভিযান'! এমনকি পাড়াটাও লোকে আজকাল সবুজের অভিযান পাড়া নামেই চেনে। ফরাসিদের আমলে অবিশ্যি এ শহরের শোভাই অন্য ছিলো... বর্তমানে ফরাসিরাও নেই সেই জেল্লাও নেই। তবে ফরাসডাঙাবাসী... অর্থাৎ চন্দননগরবাসীর উৎসবপ্রিয়তা তাই বলে বিন্দুমাত্রও কমেনি... পালা-পার্বণে ঝাঁপিয়ে পড়ে একেবারে নতুন কিছু একটা করার উৎসাহে। সবুজের অভিযান পাড়া অগ্রণী।
নববর্ষ এবারে রবিবারে। ছুটির আমেজ। সকাল হতে না হতেই সানাইয়ের সুরেই ঘুম ভাঙলো শহরের গোটা একখানা পাড়ার। বলাই বাহুল্য সবুজের অভিযান পাড়ার। ব্যাপারখানা কি? একটু সরেজমিনে দেখতে হচ্ছে, এই ভাব নিয়েই পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ ক'জন আর জনাকয় ছেলে ছোকরাও ক্লাবের আশেপাশে জুটে গেলো। সদ্য ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা চোখ মুখ, কাঁধে তোয়ালে বা গামছা, পরণে লুঙ্গি অথবা বারমুডা, এবং অবশ্যই হাতের ব্রাশ ঘষা চলছে দাঁতে। টুথপেস্ট ফেনা হয়ে কষ বেয়ে গড়াচ্ছে। এমতাবস্থায় 'সবুজের অভিযান' ক্লাব থেকে জবরদস্ত ঘোষণা, "সারাদিনব্যাপী বর্ষবন্দনা", ক্লাবের সম্বৎসরের অনুষ্ঠানসূচীতে হলো নবতম সংযোজন এই বর্ষবন্দনা। পাড়াসুদ্ধু আবালবৃদ্ধের দল যারপরনাই উত্তেজিত, তবে এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বণিতাদের মতামত এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
বয়োজ্যেষ্ঠদের দলে অগ্রণী সবিতাব্রত সরখেল, পাড়ার ক্লাবের যেকোনো অনুষ্ঠানে তিনি হলেন গিয়ে প্রধান উৎসাহদাতা এবং সর্বোচ্চ চাঁদা প্রদানকারী। তা সেই সবিতাব্রতবাবু আজ একেবারে খুশিতে ডগমগ। আনন্দটা ওনার পেটের মধ্য দিয়ে গুরগুর ভুরভুর করে, বুকের মধ্য দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে মুখ দিয়ে একেবারে দুধের বলকের মতো উথলে উঠে ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। মনে মনে গুগাবাবাকে স্মরণ করে, এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি
ডানহাতের তর্জনী মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে মোক্ষম তালে টুসকি মেরে মেরে, নিজের অজান্তেই পথ চলতে চলতে দু'কলি গেয়ে ফেললেন, "আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, গাছে গাছে পাখি হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ......." পরক্ষণেই ঠোঁট সরু করে দু-তিনবার শিসও দিয়ে ফেললেন। বাহ্ বাহ্! নিজেকেই বাহবা দিলেন, কলেজবেলার শিস দেওয়ার অভ্যেস দিব্যি মনে আছে, ভোলেননি তো! তারপর মনে করতে লাগলেন সেই লিস্টিটা, কী কী কাজ যেন মানুষ একবার শিখলে জীবদ্দশায় আর ভোলে না। বেশ বেশ! সবই দেখছেন মনে আছে বেমালুম!
ঐ গান গাওয়া আর শিস দেওয়ার সময়টাতে, নতুন বছরের প্রথম রবিবাসরীয় বাজার সেরে ফিরতি পথে, তখন সবিতাব্রতবাবু একলাই ছিলেন। ভাগ্যিস সেসময় তাঁর আশেপাশে কেউ ছিলো না, নাহলে বেজায় অপ্রস্তুত ব্যাপারস্যাপার ঘটতো, লজ্জার আর শেষ থাকতো না! পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে যেতো রাতারাতি। অবিশ্যি এজন্য সবিতাব্রতবাবুকেও ঠিক দোষারোপ করা চলে না। হাজার হোক, এই অ্যাদ্দিন পরে, শেষে কিনা এই বয়সে এসে ভদ্রলোক তবু তাঁর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাবার একখানা সুযোগ পেলেন। আজ পাড়ায় "সবুজের অভিযান" ক্লাবের মাঠে সারাদিন ব্যাপী বর্ষবন্দনা অনুষ্ঠানসূচীতে "বসে আঁকো, বৃক্ষরোপণ, আল্পনা আঁকা রাস্তা জুড়ে... সময় ভাগ করে করে। আর রয়েছে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।এছাড়াও অন্যতম ইভেন্ট হলো গিয়ে "এসো বোসো, লেখো কবিতা... লিখে লিখেই আঁকো ছবিটা"... ক্যাপশন লেখা এন্ট্রি ফর্মের মাথায়। অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় দেওয়া থাকবে। আর তাই নিয়েই "তাৎক্ষণিক" একখানা কবিতা লিখতে হবে। শুনেই তো য়ারপরনাই খুশি সবিতাব্রতবাবু। বিকেলে ঠিক পাঁচটায় ঐ তাৎক্ষণিক কবিতা লেখা প্রতিযোগিতা। এখন সময় সকাল সাড়ে নটা, কয়েক ঘন্টা মাত্র সময় হাতে, একটু মুসাবিদা করে নিতে হবে। বিনা প্র্যাকটিসে কোনো কাজ করা সবিতাব্রতবাবুর মোট্টে পছন্দ নয়।
বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরের দরজার পাশে নামিয়ে দিয়েই কোনোরকমে ঘাড়ে চোখে মুখে একটু ঠাণ্ডা জলের ছিটে দিয়ে সবিতাব্রতবাবু এধার ওধার দেখে টুক করে সোজা নিজের ঘরে সেঁধিয়ে গেলেন। আর তারপরে ফেয়ারওয়েলে পাওয়া ডায়েরি আর জটার বলপয়েন্ট পেনখানা নিয়ে খাটের ওপরে পরপর চারখানা বালিশ রেখে উঁচু করে কাব্যসাধনায় বসলেন। নগদ পাঁচশো টাকা চাঁদার উপরন্তু কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য একান্ন টাকা এন্ট্রি ফি দিয়ে একেবারে নাম লিখিয়ে এসেছেন। আজ তিনি সব্বাইকে, বিশেষতঃ গিন্নী তরুবালাকে তাক লাগিয়ে দিতে চান। লিখছেন সবিতাব্রতবাবু নানান বিষয় নিয়ে। জানা তো নেই কোন বিষয়ের ল্যাজার সাথে কোন বিষয়ের মুড়ো জুড়ে নিয়ে "তাৎক্ষণিক" কবিতা লিখতে দিয়ে দেয়। ঐ আয়োজকদলের মধ্যে পেটমোটা, টাকমাথা, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা, বেঁটে কালো বগলারঞ্জন ব্রহ্ম নাকি কোনো এক প্রকাশনা সংস্থার সহ-সম্পাদক। খালি খুঁত খুঁজে বেড়ানো, আর পাড়ার সব অনুষ্ঠানে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনানো... এইই কাজ কবি বগলারঞ্জন ব্রহ্মের। যদিও আড়ালে পাড়ার ছেলে ছোকরারা বগলারঞ্জনকে "ফেঞ্চু বিবিকবি" বলেই রসিকতা করে। কট্টর ঐ লোকটাই আবার আজকের এই প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসনে। বিষয়ও নাকি সেই দেবে। বিষয় ঘোষণা করার তিরিশ মিনিটের মধ্যেই কবিতা লিখে তৎক্ষণাৎ স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে জমা দিতে হবে, তারপর ঘন্টাখানেক পরেই ফলাফল ঘোষণা।
দেওয়ালের ওপরে একটা টিকটিকি কুমীরের মতো গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে একটা আরশোলার বাচ্চাকে দেখে। বাহ্ বাহ্, বিষয়টি নিয়ে বেশ সড়সড় সড়াৎ করে একখানা বারো লাইনের কবিতা নেমে গেলো তো। এরপর বাইরে রাস্তায় ধর্মের ষাঁড় ভোলার গুরুগম্ভীর হাম্বা রব নিয়েও বেশ গুরুগুরু ঘনমেঘ গরজে গোছের ষোলো লাইনের কবিতা গড়গড়িয়ে লিখে ফেললেন সবিতাব্রতবাবু। নিজেই চমৎকৃত, আহা কী শব্দচয়ন! নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে হলো। বাইরে রোদ্দুরটা একটু ঝিমিয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ ঠিক তাই, ঘটছে নববর্ষে নব মেঘের শুভাগমন! তবে কালবৈশাখী না হয়ে বেশ একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মৃদু বাতাস বইলেই ভালো... নইলে যে সব আয়োজনই বৃথা!
বিমোহিত সবিতাব্রতবাবু নিজের শব্দভাণ্ডারের প্রয়োগে। আকাশে সন্তরণশীল সঞ্চরমাণ মেঘেরা সবিতাব্রতবাবুর কবিস্বত্ত্বাকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলো। সবিতাব্রতবাবুর কলম চললো লাউসেন ঝড়ের মতো, শব্দেরা বেরোতে লাগলো আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারোর অগ্ন্যুৎপাতের মতো, ইলাস্টিক ব্যাণ্ডের মতো বাড়তে লাগলো সে কবিতা, স্থিতিস্থাপকতা মাত্রা অতিক্রম হবো হবো সময়, ঠিক তক্ষুণি গিন্নী তরুবালার তরঙ্গায়িত হুহুঙ্কারে সবিতাব্রতবাবুর হাত থেকে কলম খসে পড়ে, ঘাবড়ে গিয়ে, সে একেবারে তরল বিয়োগের অবস্থা হয়ে পড়লো আর কী! তরুবালার তারসপ্তমে বাঁধা গলার নিনাদ ফের, "মরণদশা, আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। বলি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমপত্তর টত্তর লিখছো নাকি? বুড়োবয়সের ভিমরতি!" আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও সবিতাব্রতবাবু সটান গিলে ফেললেন কথাখানা, "না না, এখনি মোটেই ভাঙা চলবে না, একটু রহস্যই থাক!" নির্বিবাদী স্বরে নিখাদ মিথ্যে বলে দিলেন, "ঐ সংসার খরচের হিসেবে ক'মাস বড্ড গরমিল দেখা দিয়েছে, ঐ একবার মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিলুম আর কী!" তরুবালার সন্দিগ্ধ নজরে হাসির ঝিলিক খেলে গেলো, "চান সেরে খেতে চলো, বেলা হয়েছে যে, ওসব হিসেবপত্তর টত্তর ওবেলা কোরো এখন।"
মধ্যাহ্নভোজনের পরে তরুবালার একটু ভাতঘুম চাই। ঐ সুযোগটাই কাজে লাগালেন সবিতাব্রতবাবু। তরুবালার মন্দ্র সুরেলা নাসিকাগর্জন নিয়ে ভারী সুন্দর একখানা লিমেরিক লিখে ফেললেন। ঘড়িতে সময় সাড়ে তিনটে, আর বেশী সময় হাতে নেই প্র্যাকটিস করার। এবারে লাস্ট, জাস্ট একটা ফিনিশিং টাচ। মসৃণ গতিতে, তাতে মাখনের গলে যাওয়ার মতো মাখোমাখো একখানা চব্বিশ লাইনের প্রেমের কবিতা লিখে ফেললেন। আহা! বৃন্দাবনে শ্যামরাইয়ের ঝুলনযাত্রা নিয়ে, ঠিক পাক্কা সাড়ে ষোলো মিনিট সময়ের মধ্যে। তাজ্জব হয়ে গেলেন সবিতাব্রতবাবু নিজেরই কেরামতিতে। আজ সবিতাব্রতবাবুকে থামানোর ক্ষমতা এই বিশ্বসংসারে কারোর নেই। নিজেকে বেশ জন্মসূত্রেই স্বভাবকবি স্বভাবকবি বলেই মনে হলো। মেজাজটা বসন্ত বাতাসের মতো একেবারে ফুরফুর ফুরফুর করছে। একদম টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট তৈরী সবিতাব্রতবাবু।
সাজুগুজু করে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ী থেকে, ছেলেপুলেরা সব যে যার নিজের নিজের ঘরে, রবিবাসরীয় দুপুর বলে কথা, তায় নববর্ষ! তবে তাঁর তো আর দেরী করা চলে না। আজীবন পাঙ্কচুয়াল তিনি, ছত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে ট্রেন বাস ঠেঙিয়ে আপিস করেছেন, কিন্তু একদিনও লেট মার্কের লাল কালির দাগ অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে তাঁর নামের পাশে পড়েনি। এমনকি অবসর নেবার দিনে আপিসে তাঁর জুনিয়রদের সামনে বড়োসায়েব বড়ো মুখ করে একথা বলেওছেন। আর সেই সবিতাব্রত সরখেল এইরকম একটা মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানে দেরীতে পৌঁছবার কথা ভাবতেই পারেন না। কোলাপসিবল গেটটা টানার আওয়াজ ছাপিয়ে তরুবালার নাসিকাগর্জন পৌঁছচ্ছে কানে, মুচকি হেসে রাস্তায় পা রাখলেন সবিতাব্রতবাবু। জোরে শ্বাস টানলেন, তারপর দু'হাত শূন্যে দু'বার ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিলেন, প্রতিযোগিতায় কবিতা লিখতে বসে শেষে হাত না আটকে যায়। সবরকম
পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্যই সম্পূর্ণ তৈরী সবিতাব্রতবাবু।
"সবুজের অভিযান" মাঠে পৌঁছে সবিতাব্রতবাবু লাল ম্যারাপের তলায় পেতে রাখা সার সার সাদা ও সবুজ চেয়ারের প্রথমসারির শেষপ্রান্তে গিয়ে বসলেন। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে কোনো অবস্থায়ই নিজের মনঃসংযোগ নষ্ট করতে চান না। চেনা লোকের সাথে দেখা হলেই খামোখা আগডুম বাগডুম গল্পগাছায় সবিতাব্রতবাবুর মাথা ঘেঁটে ঘ হয়ে যেতে পারে। তাই শেষপ্রান্তের সিট, সাবধানের মার নেই।
চেয়ারে বসে কব্জি উল্টে ঘড়িটা দেখলেন সবিতাব্রতবাবু, এখনো পাক্কা এগারো মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ড সময় দেরী অনুষ্ঠান শুরু হতে। এবারে সবিতাব্রতবাবু একবার চতুর্দিকে নজর বুলিয়ে নিলেন। ভিড় মন্দ হয়নি! তা প্রায় শখানেক জন তো বটেই। জমায়েতটাকে সবিতাব্রতবাবু একবার চোখ দিয়ে জরিপ করে নিলেন। ছেলে ছোকরারাই সংখ্যায় বেশি, কয়েকজন মধ্যবয়সীও আছেন, ইস্কুল পড়ুয়া কুঁচোকাঁচাও কিছু আছে। তবে তাঁর নিজের আন্দাজ তিনিই হচ্ছেন গিয়ে প্রবীণতম।
তবে একটুও আশাহত হলেন না সবিতাব্রতবাবু। বরঞ্চ বেশ একটু ওভার কনফিডেন্ট বোধ করলেন। বয়সের নিরিখে তাঁর অভিজ্ঞতাই সর্বাধিক, উপস্থিত জনসমাগমের মধ্যে। সুতরাং লেখনীর গভীরতাও তাঁর কলমেই সর্বাধিক হবে বলেই তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা! একটাই উদ্বেগ আপাতত... কি যে মাথামুন্ডু বিষয় দেবেন "ফেঞ্চু বিবিকবি" থুড়ি কবি বগলারঞ্জন ব্রহ্ম! বড্ড দাঁতভাঙা কঠিন ভাষায় কবিতা লেখেন ভদ্রলোক। সবিতাব্রতবাবু ওনার কবিতা যে কখনো একেবারে পড়ে দেখবার চেষ্টা করেননি, বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। পাড়ার পুজোর স্যুভেনিরে একবার ওনার একটা কবিতা পড়েছিলেন সবিতাব্রত বাবু, কিন্তু ও কবিতা সবিতাব্রতবাবু মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, কিছুতেই ঢুকলো না মাথায়। তারপর অবিশ্যি আর চেষ্টা করেননি।
তবে একথা বিলক্ষণ শুনেছেন, যে বগলারঞ্জনের কবিতা নাকি অনেক হোমরাচোমরা সব পত্রিকায় ছাপা হয়, আর অনেক কেষ্টবিষ্টু কন্ঠশিল্পী সেসব আবৃত্তিও নাকি করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তাতেই বগলারঞ্জনবাবুর বড্ড দেমাক। তাও যদি হতেন সবিতাব্রতর মতো স্বভাবকবি! যারা সহজ থোড় বড়ি খাড়ার ভাষায় কবিতা লিখতে পারেন না, তাঁরাই ওসব দাঁতভাঙা খটোমটো সব ভাষায় লিখে পাঠকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। কবিতা হবে ডাল ভাত খিচুড়ি ঘুগনি বেগুনীর মতো, সব্বাই ডাইজেস্ট করতে পারবে। তা নয়... ভাবনার মধ্যেই মাইকে গমগমে ঘোষণা অনুষ্ঠান শুরুর, তিন মিনিট লেট। সে যাক গে মরুক গে, কিন্তু কবি বগলারঞ্জন ব্রহ্ম যে খটোমটো হিব্রু ল্যাটিন কী বিষয় দেবেন... সেটাই যা শুধু খানিকটা চাপের।
বেশী ভণিতা না করে বগলারঞ্জন একেবারে সোজা প্রসঙ্গে চলে গেলেন, কারণ তিনি সবকিছু একদম ঘোষিত সময়ের নির্ঘণ্ট মেনেই করতে চান। সুতরাং বিষয় ঘোষিত হলো, "গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা"!
সবিতাব্রতবাবু ভাবলেন, "ছোঃ, এ আবার একটা বিষয় হলো?" যাইহোক, সবাইকে হাতে একখানা বোর্ডে আটকানো রুলটানা কাগজ আর অগ্নিজেল পেন ধরিয়ে দেওয়া হলো। মাইকে আবার ঘোষণা হোলো, "ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান.... ইয়োর টাইম স্টার্টস্ নাও...."! একঝলক চারধারে দেখে নিয়েই সবিতাব্রতবাবু ঘসঘস করে তড়িৎ গতিতে কলম ছোটালেন। সওদাগরি আপিসে ছত্রিশ বছরের কলম পেশার অভ্যেস আর মনে মনে যখন তখন যেখানে সেখানে দু-চারলাইন কবিতা রচনা করার অভিজ্ঞতা তো আর মাঠে মারা যেতে পারে না! সবিতাব্রতবাবুর লেখা শেষ ঠিক সাড়ে বারো মিনিটের মাথায়। লিখে পরিতৃপ্ত। তারপর ছোট্ট একটু রিভিশন শেষ করে পাক্কা পনেরো মিনিট সময় হাতে থাকতেই সবিতাব্রতবাবু বীরদর্পে উঠে গিয়ে কবিতার পাতাটি স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে জমা দিয়ে দিলেন।
লেখা জমা দিয়ে বেশ একখানা গর্বিত মুখভঙ্গি করে বিবেকানন্দ স্টাইলে হাত দু'খানা বুকের ওপর স্থাপন করে নিজের চেয়ারটিতে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে রইলেন। সময় উত্তীর্ণ হতেই আবার মাইকে ঘোষণা, "ওয়ান, টু, থ্রি..... স্টপ।" স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রায় বানরসেনার গতিতে লম্ফঝম্ফ করে প্রতিযোগীদের হাত থেকে লেখার বোর্ডসমেত কাগজ একেবারে খামচেখুমচে কেড়েকুড়ে দখল নিয়ে বগলারঞ্জনের সামনের টেবিলে চালান করে দিলো। বগলারঞ্জনবাবু লেখাগুলো সব সাপটে নিয়ে ক্লাবঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। একঘন্টার অপেক্ষা, তারপর ফলাফল। তা এইসময়টুকুতে দর্শক টেনে রাখার জন্য শুরু হলো সাংস্কৃতিক বিনোদন, শিল্পীরা বলাই বাহুল্য সবই পাড়ারই খোকাবাবু খুকুমণির দল। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, এমনকি পাঁচ মিনিটের ম্যাজিক শোও দেখালো এক ক্ষুদে। তবে সবিতাব্রতবাবুর সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই, দু'মিনিট অন্তর অন্তর খালি কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখছেন।
অবশেষে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ, মাইকের সামনে বগলারঞ্জন ব্রহ্ম... গলাখাঁকারি দিয়ে ঘোষণা শুরু করলেন... তৃতীয় স্থানে... তারপর দ্বিতীয় স্থানে...
সবিতাব্রতবাবুর বুক ঢিপঢিপ। নাম নেই নিজের...
তারপর স্বান্তনা পুরস্কার প্রাপক চারজনের মধ্যেও নেই সবিতাব্রতবাবুর নাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সবিতাব্রতবাবু, হতাশাব্যঞ্জক ভঙ্গিতে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ থেকে প্রস্থানের উদ্যোগ নিলেন, ভাবছেন তখন, "ছি ছি, কী দরকার ছিলো এসব কবিত্ব করতে আসার!" তরুবালার কানে এখবর পৌঁছবেই, আর তিনি আরেকপ্রস্থ হেনস্থার শিকার হবেন তরুবালার মুখঝামটায়, ছেলেপুলের হাসির খোরাক হবেন। এহে হে, বড্ড বোকার মতো কাঁচা একখানা কাজ করে ফেলেছেন! মাঠের বাইরে ডান পাটা সবে বাড়িয়েছেন, আবার গমগমে ঘোষণা, "আজকের প্রথম স্থানাধিকারী বিজয়ী হলেন কবি শ্রী সবিতাব্রত সরখেল..." হকচকিয়ে হোঁচট খেয়ে ধুতির কোঁচা খুলে হুড়মুড়িয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলেন নিজেকে, সবিতাব্রতবাবুর কানে অনুরণিত তখনও, "কবি শ্রী সবিতাব্রত সরখেল"... আহা হা... কী সুমধুর!
স্টেজে পুরস্কার নিতে উঠে আজ বগলারঞ্জনের গলাটা অতও খারাপ মনে হলো না, ভুঁড়িটাও যেন কমই মনে হলো... আর মনে হলো এতোবড়ো একজন সম্মানীয় কবিকে "ফেঞ্চু বিবিকবি" বলে যারা রসিকতা করে তাদেরকেও, "প্যাপ্, দুষ্টু" , বলে বকে দেওয়া প্রয়োজন। তারপর সব স্বপ্নের মতো পরপর ঘটে যেতে থাকলো। উত্তরীয় পরানো, মানপত্র প্রদান, গলায় পদক ঝোলানো, তারপর হাতে রঙীন চকমকে কাগজে মোড়া বাক্সে পুরস্কার! তারপর অনুরোধ ঘোষিত মাইকে, "স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাবেন কবি শ্রী সবিতাব্রত সরখেল"... তুমুল হাততালিতে অভিনন্দিত হয়ে আবেগাপ্লুত সবিতাব্রতবাবু।
মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা কবিতার কাগজটি বগলারঞ্জনবাবুর হাত থেকে নিয়ে জলদ-গম্ভীর স্বরে পাঠ শুরু করলেন সবিতাব্রতবাবু....
কবিতা: গ্রীষ্ম-বর্ষা
রোদ কটকট, ছাতি ছটফট,
মেঘ কড়কড়, বুক ধড়ফড়,
ঝরে ঝরঝর, বর্ষা বাদল ঝরে।
ঘামে মুখ চুণ, গলা গুনগুন,
খেয়ে গপাগপ, বেগুনী মুড়ি চপ,
ফুলুরি টপাটপ, বুক জ্বালাপোড়া করে।
প্রাণ ধুকপুক, বৌ ঝামটায় মুখ,
অ্যান্টাসিড চেটেচেটে, ঘুম ঘেঁটেঘুঁটে,
বর্ষার গুষ্টির তুষ্টি, গিলে পাচন পুষ্টি,
পাকিয়ে বজ্রমুষ্টি, গ্রীষ্ম, বর্ষার শ্রাদ্ধ করে।।
পাঠ শেষ হতে না হতেই সে কী তুমুল হাততালি!
সবিতাব্রতবাবুর কানের পর্দা ফেটে যাবার জোগাড় সেই হাততালির আওয়াজে। পাড়াসুদ্ধু লোক তো ধন্যি ধন্যি করলো, সবিতাব্রতবাবুর এহেন সহজাত কবিপ্রতিভায়।
আর তরুবালাকে বোঝাতে হবে না মুখে কিছু বলে। আর তরুবালা কোনো খোঁটা মারতেই পারবে না। সবিতাব্রত বাবু ফেল নয়, রীতিমতো পাশ। তাছাড়া এখন তো তাঁর হাতে মোক্ষম দাওয়াইটি এসে গেছে বাবা, ঐ মানপত্র... তাতে শুধু সবিতাব্রবত সরখেল নয়, রীতিমতো নামের আগে "কবি" উপাধিটি গোটা গোটা মোটা হরফে কায়দা করে লেখা। এখন থেকে তিনি "কবি শ্রী সবিতাব্রত সরখেল".... চাট্টিখানিক কথা নয় মোটেই। মনে মনে সে কথা ভাবতেই সবিতাব্রতবাবুর ছাতি একলাফে বেড়ে একেবারে আটত্রিশ থেকে আটচল্লিশের ঘাটে পৌঁছে গেলো যেন। গলায় ঝোলানো উত্তরীয় আর পদক, বগলদাবা করা পুরস্কারের বাক্স আর হাতে গোল করে রোল করে লাল রেশমী ফিতেয় বাঁধা মানপত্র নিয়ে বাড়ীর পথ ধরলেন সবিতাব্রতবাবু। মুখে বিড়বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে চললেন, "রোদ কটকট..." সদ্য স্বরচিত কবিতাখানি, কবি শ্রী সবিতাব্রত সরখেল।।
Tags:
রম্য রচনা