রাহুল ঘোষ

রাহুল ঘোষ/ অতিথি সম্পাদক / শব্দের মিছিল / sobdermichil
আগেও দেখেছি, আজও দেখি, পয়লা বৈশাখকে সিংহভাগ বাঙালিই লেখে '১লা বৈশাখ'। ইংরেজি হোক বা বাংলা, তারিখকে সংক্ষিপ্ত করে লিখতে গেলেই, এইভাবে লেখার স্বভাব আর যায়নি সিংহভাগ বাঙালির। এটা আসলে অনেকটাই ইংরেজির অনুকরণ। ঠিক যেমন ধরা যাক, আমরা ইংরেজিতে 1st April, 3rd June, 17th November, 22nd December ইত্যাদি লিখে থাকি। আমেরিকানরা অবশ্য বহুদিনই হলো, তারিখের সংখ্যার আগে মাসের নাম লেখা চালু করেছে এবং বাকি পৃথিবীর অনেকেই তাদের অনুসরণও করেছে। কিন্তু আমরা খাঁটি ব্রিটিশের কাছে অল্পবিস্তর ইংরেজি শিখেছি, আমরা এখনও মোটের উপর 'কুইন্স ইংলিশ'-এর অনুসারী। তাই নিজেদের ভাষাতেও ওই প্রবণতা এনে ফেলেছি স্বাভাবিকতায়। পত্রপত্রিকাগুলো অধিকাংশই আধুনিক হয়ে উঠলেও নিজেরা লিখতে গিয়ে তারিখের সংখ্যাটি লেখার পরে অনাবশ্যক লা, রা, ই, শে ইত্যাদি আজও ঝেড়ে ফেলতে পারিনি আমরা অনেকেই। যদিও সে-সব মূলত ইংরেজি তারিখের কথাই, কারণ বাঙালি তো এখন বছরের মাত্র দুটো বাংলা তারিখের খোঁজই রাখে! একটা নববর্ষের কারণে হলে, আরেকটার সৌজন্যে রবিঠাকুর। একটা নতুন বছরের প্রথম দিন, আরেকটা রবীন্দ্রনাথের জীবনের। ওই দিনটা আমরা মনে রাখতে না-চাইলেও, উপায় নেই! মিডিয়া মনে করিয়ে দেয়। চারিদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাবল্যে মনে পড়ে যায়। আর হ্যাঁ, এই পশ্চিমবঙ্গে ওইদিন একটা সরকারি ছুটি থাকে। না-হলে মনে রাখতাম কিনা, কে জানে! তাঁর চলে যাওয়ার শ্রাবণধারাময় তারিখটিকেও তো আমরা আজকাল প্রায় ভুলতে বসেছি! অতএব এহেন আত্মবিস্মৃত বাঙালি যে কর্ণসুবর্ণ নামক অধুনা-অখ্যাত একটি জায়গায় গৌড়ের রাজসিংহাসনে শশাঙ্ক নামের এক অধুনা-বিস্মৃত রাজার আরোহনের সময়কাল অর্থাৎ ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দকে ভুলে যাবে, সে তো স্বাভাবিক ব্যাপার! বাঙালি ভুলে যাবে যে, বঙ্গাধিপতি শশাঙ্ক নিজের রাজ্যাভিষেকের বছরকে ভিত্তিবর্ষ ধরে বঙ্গাব্দ চালু করেন, আর তাই আজ এই ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল আমরা ১৪২৬ অতিক্রম করে ১৪২৭ বঙ্গাব্দে পা দিচ্ছি।

১৪২৭-এ পা দিয়ে মনে পড়লো, গত নববর্ষেও যেখানেই পয়লা বৈশাখকে '১লা বৈশাখ' লেখা দেখেছি, তাকে হালকা মজার ছলে 'একলা বৈশাখ' পড়েছি। তখন আর কে জানতো, ১৪২৭-এর প্রথম দিনটি আক্ষরিক অর্থেই 'একলা বৈশাখ' হয়ে উড়ে আসবে আমাদের আকাশে! জ্ঞানত এই প্রথম বোধহয় নতুন বাংলা বছরে বাঙালির হালখাতা নেই, মিষ্টিমুখ নেই, বাংলা ক্যালেন্ডারও নেই। শুধু এক অজানা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কা আছে! অদৃশ্য এক শত্রুর এত শক্তি যে সারা পৃথিবীকে সে নাস্তানাবুদ করে ফেলছে, অতএব স্বভাবভীরু বাঙালি তো কোন ছার! করোনা-সতর্কতার এই আবহে তাই আমাদের কোনো উৎসব নেই। আমাদের শুধু লকডাউন আছে। যদিও আমাদের মধ্যে ছিঁচকে চোরের মতো লকডাউনের নিয়মবিধি ভাঙার প্রবণতাও পুরোদস্তুর আছে। আমরা সবাই নিজেদের নাগরিক কর্তব্যটুকুও ঠিকঠাক পালন করছি না, প্রশাসনিক নির্দেশ পুরোপুরি মান্য করছি না, তারপরে পান থেকে চুন খসলে 'যত দোষ নন্দ ঘোষ' সরকার তো আছেই! ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার বিরাট দেশে, যথেষ্ট সংখ্যক উৎশৃঙ্খল মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও সংক্রমণ যে এখনও মহামারীর আকার নেয়নি, তার জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সদর্থক ভূমিকা তো আছেই। আমাদের সরকারি স্তরে, প্রশাসনে বিপর্যয় মোকাবিলা করার যে-সব সীমাবদ্ধতা, তাকে অতিক্রম করার আপ্রাণ চেষ্টাও আছে। এর মধ্যে রঙের রাজনীতি না-করে আমরা যদি কয়েকদিনের জন্য দেখতাম কীভাবে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, বেশ কিছু মন্দির ও আশ্রম কর্তৃপক্ষ; পাশে দাঁড়াচ্ছেন বিখ্যাত শিল্পপতি, চিত্রতারকা, খেলোয়াড়দের অধিকাংশ; তাহলে বুঝতে পারতাম ঠিক কোন আচরণটা করা এখন বেশি জরুরি। আমরা নেহাতই সাধারণস্য সাধারণ মানুষ বলে, আমাদের যে কিছু করার নেই, তা তো নয়! নিজেদের সাধ্যমতো করার আছে এবং অন্যদেরও করতে উদ্বুদ্ধ করার আছে। কথায় আছে, আপনার ডানহাত যেন এমনভাবে দান করে, যাতে আপনার বাঁহাত পর্যন্ত জানতে না-পারে! সে-সব হয়তো নীতিকথাই। কিন্তু এই কাজে অন্যকেও উৎসাহিত করতে হলে যদি আপনার উদ্যোগের ডকুমেন্টেশন প্রয়োজনীয় হয়, এই বিপদের দিনে তাকে আত্মপ্রচার ভাবার মতো সংকীর্ণতা আমরা কেনই-বা করবো! নিজের পেশার সূত্রে অথবা পরিচয়ের কারণেও দুর্যোগ মোকাবিলায় এরকম নিরলসভাবে লেগে থাকা কিছু মানুষের কর্মকাণ্ড তো আমি দেখতে পাই, জানতেও পারি। তাঁদের পরিশ্রম দেখে মাথা নত হয়ে আসে এবং বুঝতে পারি, এইসব মানুষের চেষ্টার জন্যই আমাদের এক-একজনের দুই-একটা সাধারণ উদ্যোগও বিফলে যাবে না। তাঁরাই আমাদের সকলের সমবেত প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তুলবেন। 

এই আবহে 'শব্দের মিছিল'-এর আহ্বায়ক যখন বললেন, এই সংখ্যার অতিথি সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে হবে, তখন একটু অপ্রস্তুত হয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, এই পরিস্থিতিতে একটাও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের মতো মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। নিজের লেখা একটি ধারাবাহিক চলছে, তার বর্তমান পর্বটিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ছিল! অতীতে যখন একবার অতিথি সম্পাদকের ভূমিকায় ছিলাম, তখন ছিল আমাদের সুখ-দুঃখে কাটিয়ে দেওয়া সাধারণ সময়। এখনকার সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না। তবুও সামান্য কিছু আহ্বান থাকে, যা অগ্রাহ্য করা প্রায় অসম্ভব। মিছিলের আহ্বানও তাই। অতএব তার ৮৫ তম সংকলনের এই সম্পাদকীয় লেখার জন্য কলম ধরা। এখন বিশেষ করে বলার বিষয় এই যে, আগামী মাসে ৯ বছর পূর্ণ করতে চলেছে 'শব্দের মিছিল'। এই দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে প্রচলিত সবরকম গা-ঘষাঘষি বাদ দিয়ে, তেলা মাথায় তেল ঢালার সহজ উপায় এড়িয়ে গিয়ে, প্রায় প্রত্যেক মাসে নিয়মিতভাবে একটি সুসজ্জিত সুনির্মিত ওয়েব ম্যাগাজিন প্রকাশ করা খুব সহজ কথা নয়। মিছিল-আহ্বায়কের দক্ষতায় ও একাগ্রতায় সেই কঠিন কাজ সহজ হয়েছে। এটা কিন্তু খুব কম একটা অ্যাচিভমেন্ট নয়! তাছাড়া এই ৯ বছরে মিছিল কিন্তু একই জায়গায় আটকেও থাকেনি। উৎকর্ষের সন্ধান তার নিয়মিত কাজের অন্যতম। মিছিলের প্রথমদিকের কাজের সঙ্গে বর্তমান কাজের তুলনা করলেই তা বোঝা যায়। ইদানীং 'শব্দের মিছিল'-এর নিজস্ব অ্যাপ হয়েছে। এখন পাঠক বারবার ওয়েবসাইটে না-গিয়েও ওই অ্যাপ থেকেই পত্রিকাটি পড়তে পারেন। অতি সম্প্রতি তো নতুন ওয়েব ডিজাইনের মাধ্যমে নিজের খোলনলচেই পাল্টে ফেলেছে মিছিল, যা প্রায় চমকে যাওয়ার মতো। এবং এই পরিবর্তনটি সদর্থক ও প্রশংসনীয়। 

এরপরেও না-বললেই নয় যে, 'শব্দের মিছিল' কোনোদিনই শুধু শিল্পসাহিত্য প্রকাশের কাজ করেই নিজের কর্তব্য শেষ করেনি। সামাজিক দায় পালনেও তার আগ্রহ শিক্ষণীয় হতে পারে অধিকাংশ মুদ্রিত ও বৈদ্যুতিন পত্রপত্রিকার কাছে। এবারেও করোনা-সঙ্কট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লেখক-শিল্পীদের ভিডিও বার্তা প্রচার করে দারুণ ভূমিকা পালন করেছে মিছিল। এই সঙ্কট মোকাবিলায় নিজের মতো করে আরও পরিকল্পনা তার আছে। এমন দায়িত্বপূর্ণ ও মানবিক প্রকাশমাধ্যমই তো আলোকসন্ধানী অক্ষরজীবীরা চাইবেন! চাইবেন, মিছিলের যাত্রাপথ সুগম হোক। মিছিল আরও দীর্ঘ হোক।


রাহুল ঘোষ
বহরমপুর 


Previous Post Next Post