পিয়ালী গাঙ্গুলি

কৌশানিতে কৌতূহল / পিয়ালী গাঙ্গুলি

বুল্টি ফিস ফিস করে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল “মনে হচ্ছে এরা যে আজ আর উঠবে না গো”। আমাদের বনফায়ার ঘিরে জনা দশেক ফ্রেঞ্চ টুরিস্ট সেই যে সন্ধে থেকে জাঁকিয়ে বসেছে তাদের আর ওঠার নাম নেই। বোতলের পর বোতল বিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাদের আসর আর ভাঙছেনা। নিজেরাই আমাদের সাথে আলাপ জমালো। আজকে সকালেই কৌশানির গান্ধী আশ্রম ঘুরে এসে তাদের খুব ভালো লেগেছে। প্রচুর প্রশ্ন তাদের মনে, মূলত গান্ধী আর পাকিস্থান সংক্রান্ত। আমাদের বার্বিকিউয়ের মুরগি ম্যারিনেট করা পড়ে আছে। এদের সামনে বসাতেও পারছি না। একটামাত্র মুরগি আমাদের, এদের সকলকে এক চিমটি করে দিলেও আমাদের আর কিছুই থাকবে না। এদিকে এদের ওঠার নাম নেই। সাড়ে নটা বেজে গেছে তখন। আর ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না। তাছাড়া খিদেও পেয়ে গেছে সকলের। অভীপ্সা তো ক্লান্ত হয়ে ঘরে গিয়ে শুয়েই পড়ল। হোটেলের ছেলেগুলোর সাথে সেটিং করে ফরাসিদের ডিনার সার্ভ করিয়ে দেওয়া হল। তারপর অবশেষে আগুনে চড়ানো হল আমাদের মুরগি। খানিক বাদে দেখি ওদের একজন একজন করে এসে দাড়িয়ে পড়ছে আগুনের পাশে। নাঃ, আজ আর মুরগি নেই আমাদের কপালে। গোল করে ঘিরে আমরা পাঁচ জন আর দুটো বাচ্চা। অধীর আগ্রহে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে আর তেমনি বাড়ছে আমার খিদে। খিদে পেলে সঙ্গে সঙ্গে না খেলে আমার ভীষণ শরীর খারাপ হয়। বললাম “চলো আমরা এবার যাই, বার্বি কিউয়ের অপেক্ষায় থাকলে আজ আর ডিনার পাব না”। 

কৌশানিতে একই হোটেলে ঘর পাওয়া যায় নি। তাই আমাদের আলাদা হোটেলে বুকিং হয়েছে। আমাদের হোটেল বিপ্লব আর শুভজিতদের হোটেলের থেকে বেশ খানিকটা দূরে। গাড়িতে প্রায় মিনিট পনেরো কুড়ি। হাঁটা পথে অবশ্য একটা শর্ট কাট আছে। পাহাড়ে যেমন হয় আর কি! কিন্তু এত রাতে অন্ধকার জঙ্গলের পথে তো আর হেঁটে যাওয়া যাবে না, তাও আবার বাচ্চা নিয়ে। ইতিমধ্যে হোটেলের ছেলেগুলোর কাছে শুনেছি এই পাহাড়ি জঙ্গলে লেপার্ড আছে, মাঝে মাঝেই তাদের দেখা যায়। আমাদের হোটেলে বলে দিয়েছে দশটায় ডিনার। এইসব জায়গায় লোকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, অতএব হোটেলেও খাওয়া দাওয়ার পাট দশটার মধ্যে চুকে যায়। আমরা যদিও বলে বেড়িয়েছি আমাদের ফিরতে দেরি হবে, তাও কত রাত অবধি আর ওরা অপেক্ষা করবে? সাড়ে দশটা বাজে। মুরগির একদিকটা হয়ে গেছে, কিন্তু আরেক দিকটা তখনও ভালোমত ঝলসায়নি, কাঁচা থাকার সম্ভাবনা আছে। আমি বললাম “আমি আর পারছি না, আমরা এবার বেরোই”। বেরোনোর কথা শুনেই সবাই সমবেত ভাবে প্রতিবাদ করে উঠল “আরে না না, তাই আবার হয় নাকি? এক্ষুনি হয়ে যাবে, খেয়ে যাও”। খিদের ঠেলায় যতই বলি চলো চলো, ওই ঝলসানো মুরগির লোভ ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা ততটাই কঠিন ছিল। কাঠের টুকরোগুলো নাড়াচাড়া করে আঁচটা গনগনে করা হল, বিপ্লব মুরগির গায়ে আবার খানিকটা মশলা লাগিয়ে উল্টে দিল। প্রায় পৌনে এগারোটা নাগাদ মনে হল অন্তত একদিকটা ঠিকমত ঝলসেছে। অতএব শিক থেকে খুলেই ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই। নাঃ, একটুও কাঁচা নেই। একদম পারফেক্ট। দারুণ সুস্বাদু হয়েছে। এর পুরো ক্রেডিটটাই বিপ্লবের। বার্বিকিউয়ের হুজুগ তোলা থেকে, বাজার করে আনা, মুরগিকে ম্যারিনেট করা সবকিছুই। হ্যাঁ শুভজিত সাহায্য করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য হল বাচ্চাগুলোও লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে। আমরা আশা করিনি। বিশেষত আমি তো টিনটিনের খাওয়ার উৎসাহ দেখে অবাক। এত আগ্রহ ভরে তো আজ অবধি কোনোদিন খেতে দেখিনি। সে তো রীতিমত গোটা মুরগিটা ধরেই টানাটানি করছে। এরমধ্যে ওদের ডিনার ও সার্ভ করে দিয়েছে। আমরাও এবার তাড়াহুড়ো করে বেরোলাম। গাড়িতে উঠে যেন একটু শান্তি হল। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া একেবারে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। হোটেলের সারি ছাড়িয়ে গাড়ি অন্ধকার পাহাড়ের বাঁক ধরল। দুপাশে শুধু পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। আলো বলতে শুধু গাড়ির হেডলাইট। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে যখন হোটেলের নীচে গাড়ি থেকে নামলাম দেখলাম হোটেলের প্রায় সব ঘর অন্ধকার। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে তো যথারীতি আমার জিভ বেরিয়ে গেল। ওপরে উঠে দেখি শুধুমাত্র ডাইনিং রুমে আলো জ্বলছে আর ম্যানেজার চেয়ারে বসে ঢুলছে। আমরা ঢুকতেই ধরমরিয়ে উঠে বললেন “আ গায়ে আপলোগ? আপ হি কা ইনতাজার কার রাহা থা। খানা তো সব ঠান্ডা হো গিয়া। রুকিয়ে, গারাম কারকে লাতা হুঁ”- বলে কিচেনের দিকে চলে গেলেন। সত্যিই দেখলাম ডাইনিং রুমে খাবারের পাত্র সব খালি। একটু পরেই গরম গরম রুটি, ডাল, একটা বেগুনের তরকারি, একটা চিকেনের ডিশ, স্যালাড আর ক্ষীর নিয়ে হাজির। আগেরদিন থেকেই দেখছি এদের প্রতিটা খাবারই দারুন সুস্বাদু। কিন্তু আজকের এই বেগুন আর চিকেন টা ‘জাস্ট অসাম’। বেগুনের ডিশটা একটু বেশি অয়েলি কিন্তু খেতে দুর্দান্ত। ম্যানেজারকে বললাম “ভাইসাব ইয়ে ব্যাঙ্গান অর ইয়ে চিকেন তো লাজাবাব হ্যায়। নাম ক্যায়া হ্যায় ইস ডিশ কা? অওর বানাতে ক্যায়সে হ্যায় ইসে?” ম্যানেজার বললেন “রুকিয়ে ম্যা কুক কো ভেজতা হুঁ”। খানিক বাদে চোখ কচলাতে কচলাতে একটা কমবয়সী ছেলে হাজির হল। বেচারিকে দেখে মায়া হল। ঘুমিয়ে পড়েছিল বেচারা, তাকে টেনে তুলে এনেছে আমার জন্য। যাইহোক রান্নার প্রশংসা শুনে সে একটু খশি হল আর তাতে আমার গিল্টি ফিলিংটাও একটু কমল। জানা গেল বেগুনের ডিশের নাম সুফিয়ানা ব্যাঙ্গান আর চিকেনটা হল কুমায়ুনী চিকেন। মশলাপাতি জিজ্ঞেস করাতে হেসে বলল “মে আপকো লিখকে দেতা হুঁ” - বলে ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ এনে খসখস করে হিন্দিতে রেসিপি লিখতে লাগল। বুঝলাম আন্তরিক প্রশংসায় সে সত্যিই অভিভূত। খেয়ে দেয়ে কাগজের টুকরোটা জ্যাকেটের পকেটে ভরে কুককে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে গিয়ে সোজা বিছানায় ডাইভ। এত রাতে শুয়ে কাল যে সকালে কিকরে উঠব কে জানে। কাল এখান থেকে বিনসার যাওয়া। সকাল নটার মধ্যে বেরোনোর কথা।

বেড়ানো এমনি নেশা যে পরদিন নিজে থেকেই কোন ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। পর্দা ঠেলে দেখলাম সানরাইজ তখনও হয়নি। সোয়া ছটা নাগাদ পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্য প্রথম উঁকি মারল। রেডি হয়ে আটটা নাগাদ যখন ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করতে এলাম ম্যানেজার এগিয়ে এসে বললেন “কিতনে বাজে লটা কাল আপলোগ? হাম গ্যায়ারা বাজে তাক ইন্তেজার কারকে ফির সব বনধ কারকে সো গায়ে”। আমি আর অনির্বান সমস্বরে বলে উঠলাম “তার মানে?” এই মালটার কি রাতের নেশা কাটেনি এখনো? “আপ হি তো থে কাল রাত কো, আপহি নে তো খানা সার্ভ কিয়া”- বলে তাকে যখন রাতের মেনু, তার রেসিপি ইত্যাদির কথা বললাম সে উল্টে আমাদের দিকে এমন চোখ করে তাকালো যেন নেশার ঘোরটা আমাদেরই কাটেনি। তাকে বোঝানোর বা মনে করানোর খানিক বৃথা চেষ্টা করে শেষে বললাম “কুক কো বুলাইয়ে, উসে জরুর ইয়াদ হোগা”। ম্যানেজার কি যেন একটা নাম করে জোরে চেঁচিয়ে ডাকতে হন্ত দন্ত হয়ে একটা মাঝবয়সী লোক ছুটে এল। “লি জিয়ে ম্যাডাম, ইয়ে হ্যায় হামারা কুক”। আমি বললাম “নেহি ইয়ে নেহি থে, আপকি দুসরে কুক কো বুলাইয়ে”। “হামারা এক কি কুক হ্যায় মেমসাব। ওর কাল রাত কো কই ব্যাঙ্গানকা সব্জি ভি নেহি বানা থা। “আমার হটাৎ রেসিপির চিরকুটটার কথা মনে পড়ে গেল। ছুটে ঘরে গিয়ে কাল রাতে পরা জ্যাকেটের পকেট হাতড়াতে একটা কাগজ বেরোলো। তাতে সত্যিই রেসিপি লেখা। ছুটে নিয়ে গেলাম ডাইনিং রুমে। উত্তরে শুনলাম এই হাতের লেখাটা কুকের তো নয়ই, ওদের কারুরই নয়। কি আর করি! যত তর্ক করব, ততই এরা আমাদের পাগল বা মাতাল ভাববে। অতএব আর কথা না বাড়িয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো। নটা নাগাদ সুরিন্দার গাড়ি নিয়ে হাজির। লাগেজ তুলে আমরাও উঠে পড়লাম গাড়িতে। কাল রাতে ভেবেছিলাম যাওয়ার সময় কুককে কিছু টিপ দিয়ে যাব। আর আজ যাওয়ার সময় তো পুরো ঘেঁটে ঘ। এরা যদি সত্যিই কাল রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে থাকে তাহলে এত যত্ন করে কে খেতে দিল আমাদের? আর বেগুনের রেসিপিটাই বা কি করে এল আমার পকেটে? কৌশানিতে নাকি ভুত আছে। আমায় দু একজন বলেছিল কথাটা। এক বন্ধু তো আবার পরশু রাতেই হোয়াটস্যাপ করেছিল “কি রে ভুতের দেখা পেলি ?” তবে কি সত্যিই??  তবে এরকম দয়ালু ভুত হলে আমার কোনো আপত্তি নেই। কি তৃপ্তি করেই না খেয়েছিলাম কাল রাতে। ভুত না থাকলে কাল খালি পেটেই শুতে হত। থ্যাঙ্ক ইউ ভুত, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। কলকাতা ফিরে তোমার রেসিপিটা অবশ্যই ট্রাই করব।

Previous Post Next Post