কাজী রুনা লায়লা খানম

কাজী রুনা লায়লা খানম  / গণমাধ্যম :দেশপ্রেমে নয় দ্বেষপ্রেমে

গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলো গণমাধ্যম। খুব সহজ করে বললে অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল এর সূত্রানুসারে মিডিয়া তথা গণমাধ্যমের কাজ তাই জনগণমনের চিন্তা চেতনার সাথে শাসকের সমন্বয়সাধন করা। ওয়েলফেয়ার স্টেট এর সরকারের জনকল্যাণমূখী কার্যাবলীর সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম বিশ্বস্ত ও একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে এটাই দস্তুর। নাগরিকের বাকস্বাধীনতা প্রকাশের অন্যতম বাহনও এই গণমাধ্যম। সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদি মূলধারার গণমাধ্যম হলেও বর্তমানে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম,ইউটিউব এবং অজস্র ই-পত্রিকা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

গণমাধ্যমে পাঠকের রুচি, চিন্তাশীলতা, মনোভঙ্গী অনুযায়ী নানা ধরণের খবর পরিবেশিত হয়। তবে মূল খবর গুলি পরিবেশনের সময় সাংবাদিককে সত্যনিষ্ঠ,নিরপেক্ষ, তথ্যসন্ধিৎসু হতে হবে এটাই সাংবাদিকতার প্রাথমিক এবং অন্যতম শর্ত।সাংবাদিককে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। সহজ সাবলীল ভাষায় সংবাদ পরিবেশনের দক্ষতা সাংবাদিকের অন্যতম গূণাবলী হবে। গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেকখানি। বলা যায় শব্দ দুটি পরস্পর পরিপূরক। তবে মনে রাখতে হবে কোন স্বাধীনতাই সীমাহীন নয়।সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা যেন কোন নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্মান মর্যাদাকে বিঘ্নিত না করে।অকারণ সম্মানহানি না করে কোন সহনাগরিকের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে সংবাদ সংগ্রাহক এবং পরিবেশককে।

মূল ধারার মতো দায়বদ্ধ নয় অথচ মূলধারার চেয়ে অনেবেশি শক্তিশালী মাধ্যম এখন ফেসবুক। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ফেসবুক বা এইজাতীয় যোগাযোগমাধ্যমকে অনায়াসে গণমাধ্যমে পরিণত করে যেমন একদিকে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলগুলোকে নিষ্প্রভ করেছে খানিকটা। কিংবা পক্ষান্তরে তাদের কাজকে সহজ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন অ্যাপের ব্যবহারের ফলে ভুল এবং বিকৃত করে সংবাদ পরিবেশনের সম্ভাবনাকে প্রবল করেছে। নিজস্ব মত জানানোর সুযোগ থাকায় ফেসবুকে খুব দ্রুত কোন ঘটনার ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইদানীং (একদশকেরও কম সময়) গণমাধ্যমে প্রপাগান্ডা শব্দটি এতো প্রচলিত যে কোনটি আসল খবর কোনটি প্রপাগান্ডা, রিউমার বোঝা মুশকিল। এছাড়া অধুনা গণমাধ্যমের আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পক্ষপাতিত্ব। দেশের তাবড় তাবড় মিডিয়া হাউসগুলো কিভাবে ক্ষমতার কাছে নিজের কলম বিকিয়ে পদলেহনকারীতে পরিণত হয়েছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার কাছে নিরপেক্ষতা, সাংবাদিক সুলভ সত্যবাদীতা, নির্ভীকতাকে বন্ধক রেখে শুধু মুনাফালাভের মেশিনে পরিণত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভটির ঘূণে খাওয়া খোকলা ছবিটাই প্রকট করে। 'গিভ এন্ড টেক'এর সরল সমীকরণে শাসকের হয়ে গলা ফাটায় মিডিয়া আর বিনিময়ে আরো আরো মুনাফা।আরো বেশি ফুলে ফেঁপে ওঠা। 

যে গণমাধ্যমকে একদা গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী বলা হতো। সেই গণমাধ্যম আজ শাসকের, ক্ষমতাসীনের নির্লজ্জ পদলেহনকারী। তাই মানুষের জন্য, মানুষের হয়ে কাজ না করে শাসক যদি আত্মসুখের প্রয়াস পায় গণমাধ্যম তাকে নির্লজ্জ তোল্লাই দিয়েই যাবে। এটাই এখন দস্তুর। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এটাই বোধহয় সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের যে শাসন পরিচালনায় সরকারের চরম অপদার্থতা,ভঙ্গুর অর্থনীতি, ক্ষীয়মান সংস্কৃতি এই এতো এতোসব দুর্বলতা সত্ত্বেও ন্যায়নীতিবর্জিত রাজনীতির চাটুকাররা জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পরস্পরকে লড়িয়ে দিয়ে মূল ফোকাস থেকে সরিয়ে দিয়ে সস্তা রাজনীতির চর্চা করে চলেছে! এরচেয়ে গভীর অন্ধকার সত্তরোর্ধ স্বাধীনতা কখনো দেখেনি এর আগে। মানুষের নুন্যতম অন্নবস্ত্রবাসস্থানশিক্ষাস্বাস্থ্যের চাহিদা পুরণে চরম ব্যর্থ শাসক, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এতোদিন রেখে-ঢেকে সুকৌশলে, ইদানীং প্রকাশ্যে বিদ্বেষের বীজটি বুনে দিলো মিডিয়া ক্রমাগত তাতে জলহাওয়ার জোগান দিয়ে বিষবৃক্ষটিকে মহীরুহে পরিণত করে তোলার কাজটি সুসম্পন্ন করছে সুচারুভাবেই। দেশের প্রথম সারির মিডিয়া হাউসগুলো আজ নিরপেক্ষতা,সত্যবাদীতা, নির্ভীকতা, শব্দগুলিকে ক্ষমতার কাছে বন্ধক রেখে বিরোধী কন্ঠকে দাবিয়ে রেখে, মিথ্যা কুৎসা করে, ষড়যন্ত্র করে, চরিত্র হননের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করে চলেছে। আর সাধারণ জনগণমন পচনশীল গনতন্ত্রের শব হতে নির্গত দুষিত বায়ুতে আজ ওষ্ঠাগতপ্রাণ। 

আজ ভারতের জাতীয় চর্চায় তাই শিক্ষার লেশনপ্ল্যান নেই, দারিদ্র্যমুক্তির পথানুসন্ধান নেই, কর্মসংস্থানের হদিশ নেই, অর্থনীতির মন্দা কাটানোর সুলুকসন্ধান নেই,কৃষকের স্বার্থরক্ষার সুপরিকল্পিত প্রয়াস নেই,ভগ্ন ও মৃতপ্রায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার মজবুতিকরণের কোন মোক্ষম দাওয়াই নেই, আছে কেবল জাত- পাত -হিন্দু -মুসলিম -দলিত -উচ্চবর্ণ -নিম্নবর্ণ। বিজ্ঞানচর্চা নেই আছে অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, আছে পশ্চাৎগামীতা।এমনকি এইমুহূর্তে বৈশ্বিক মহামারী করোনা রুখতে সারাপৃথিবী যেখানে টেস্ট কীট, পিপিই, ওষুধের জোগান দিতে মরিয়া, প্রতিনিয়ত ভাইরোলজিস্টদের গবেষণাকর্মে উৎসাহ যুগিয়ে চলেছে এবং চিন ইতিমধ্যে প্রায় তেতাল্লিশটা প্রকার (সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী) আমেরিকা ছাপ্পান্নটি(মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এখনো গবেষণার স্তরে আছে)আবিষ্কার করে ফেলেছে ভারত সেখানে মাত্র সাতটি। টেস্ট কীট পিপিই সরবরাহের পরিসংখ্যান হাস্যাস্পদ। সেসব নিয়ে প্রশ্ন না তুলে দেশের তাবড় মিডিয়া হাউসগুলি প্রতিনিয়ত এই জনগণমনমেধযজ্ঞে বিদ্বেষের ঘৃতাহুতি দিয়েই চলেছে। যদিও কিছু ছোট ছোট এবং দু একটা বড় মিডিয়া হাউস ব্যতিক্রম। এইসব দেখেশুনে আজ জীবনানন্দ দাশের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে 

"অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাহাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় "


Previous Post Next Post