“তুমি বললে নাতো অভিশাপ তাকে নিয়ে?” সুহাসিনী সকালে চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে অচ্যুতকে বলেন। নিজেদের ঘরেই চা খাচ্ছিলেন ওরা। দুজনে। অচ্যুত তাকালেন, “জানতে চাও?”
“যে বাড়ির বউ হয়ে আছি এতগুলো বছর - জানবো না? যদি জানার যোগ্য না মনে করো তো”....
“না, না ছোটগিন্নী, যোগ্য কেন হবে না। তোমাকে বলিনি - কারণ যদি ভয় পাও”। “ভয়ানক কিছু?”
“হ্যাঁ, আমাদের বিয়ের মাস দুয়েক আগেই তো অভিশাপ টা ফলেছিলো আবার…”।
“অনির দাদা?” “হ্যাঁ।" "বাবিনও কী?”
“ঠিক তাই। বংশের প্রতি প্রজন্মের প্রথম ছেলে বাচ্চা - ঐ তোমরা যাকে পুত্র সন্তান বলো-তাকে নিয়েই অভিশাপ”।
“পুত্রসন্তানকে নিয়ে অভিশাপ? কী এমন?”
“আমাদের জমিদারী ছিল জানো তো? ছিলো কেন বলছি, এখনো কিছু জমি জিরেত আছে, বীরভূমে”।
“বাগদেবীপুর গ্রাম, জানি”। “যাওনি তো কখনো”।
“তুমি গেছো?’ “নাহ, বাবা গ্রামে আমাদের নিয়ে যেতে চাইতেন না। মা বারবার বললেও এড়িয়ে যেতেন। সেই যে দাদা হবার মাস ছয়েকের মধ্যে কলকাতা চলে এসেছিলেন বাবা - আর নিয়ে যান নি”।
“ব্যবসার চাপ?” “বলা যায়। এসেছিলেন যখন তখন তো সদ্য ব্যবসা জমেছে তবে এড়ানোটাও ছিলো। জানিনা কেন। আসলে বাবা শহরের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। জেঠা নন। তাই হয়তো ঐ পরিবেশে আমাদের মানুষ করতে চাননি”।
“নিজের অংশ?” “বেশিটা বসত বাড়ি সহ জেঠাদের বেচে দিয়েছিলেন। কিছু জমি আছে। ঐ যে, মনির ভাই আছে জানো তো? বিপ্লব?”,
“শুনেছি তার নাম মনিদির কাছে”। “ও থাকে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ঐ গ্রামেই, ও-ই চাষবাস করে, দেখাশোনা করে”।
“ও।ওরা কি বংশপরম্পরায় তোমাদের জমিদারিতে কাজ করে?”
“হ্যাঁ, মনির মা, বাবা দুজনেই কাজ করতো জানি। ওর বাবা পুরোহিত ছিলো। মা রাধুনী বামনী”।
“তারপর?” “বাবা না নিয়ে যেতে চাইলেও গ্রামের কথা টুকটাক কানে আসতো। নিধু, মনি এরা গ্রামেরই। মা-ও কখনো-সখনো বলে ফেলতেন ওখান থেকেই শোনা আমার”।
“বাড়ির প্রথম পুত্রসন্তান?”
“প্রজন্মের প্রথম, রক্তপাত হয়ে মারা যাবে। মুখে রক্ত উঠে,বলা হতো”।
“তোমাদের আগের জেনারেশন হয়েছিলো?”
“হ্যাঁ, জেঠার বড়ছেলে… বাবা তো দাদা হবার ছয় মাস পরেই এইজন্যই চলে আসে”।
সুহাসিনী মাথা নাড়লেন, “স্ট্রেঞ্জ!”
“হ্যাঁ খুবই রহস্যজনক”। “অভিশাপটা কার ছিলো?”
“একজন তান্ত্রিকের।কালীর উপাসক ছিলেন। গ্রামের মধ্যেই সাধনাপীঠ বানিয়ে ফেলেছিলেন নাকি। মরা টরা আনা যখন শুরু করলেন তখন আমার ঠাকুরদার বাবা নাকি উৎখাত করে নদীর অন্যপাড়ের শ্মশানে পাঠিয়ে দেন। লোকটা এটাকে ভালোভাবে নেয়নি। যেতে যেতে অভিশাপ দিয়ে যায়”।
“উচ্ছেদের জন্য এত বড় অভিশাপ!”
“হবেই, এপারে শিষ্য সম্প্রদায় হয়েছিলো। তারা দক্ষিণা দিতো বেশ পেট চালাতো। ওপারের শ্মশানে ভুতের কারবার। কেউ সাহস করে যেত না। ঠাকুরদার বাবা ওটাই বলেছিলেন। তন্ত্র সাধনার জন্য নির্জন জায়গা দরকার। সেখানেই যান।কিন্তু ইনি তো সাধনা নয় ধান্দায় এসেছিলেন। ওপারে নাকি তিনদিনও টেকেনি। উধাও হয়ে যান”।
“ওনার অভিশাপেরই এত জোর?”
“হ্যাঁ, তারপর থেকে হচ্ছে তো। প্রতি প্রজন্মে, দেখছ না?”
“তুমিও মানো তবে”!
“মানি, তাই অনিকে নিয়েও ভয়ে থাকতাম”।
“অনিতো ফার্ষ্ট বর্ণ মানে প্রথম জন্মানো নয়”।
“আমি ইংরেজি বুঝি, বৌ। রুদ্রর মত না হলেও একই স্কুলে পড়েছি তিনজন, মনে নেই?”
সুহাসিনী অচ্যুতের মুখে হাসি দেখলেন।“এ কেমন মস্করা”।
“বউয়ের সাথে মস্করা করা যাবেনা? সারাজীবন পারলাম কই? বাচ্চা কাচ্চা নাতি পুতি নিয়েই তো কেটে গেলো। এবার অতীন আর অনুপমকে ব্যবসা ছেড়ে ভাবছি বিরাম নেবো। সারাদিন মস্করা করবো তোমার সাথে”।
“যাঃ!” “কী যাঃ”।
প্রায় ষাট হলো, রিটায়ার করতে হবে, প্ল্যান করছি কত জানো? তোমাকে নিয়ে এবার ঘুরবো - সারা পৃথিবী”।
“সকাল সকাল বাই উঠেছে তোমার”।
“ঐ দেখো, বিশ্বাস হয় না?” “আচ্ছা বাপু, হয়েছে বিশ্বাস। এবার উঠে রেডি হয়ে নাও”।
“অনিকে নিয়ে তুমি ভয়ে থাকতে কেন বৌ? তুমি তো অভিশাপের কিছু জানতে না”।
“জানিনা - কেমন যেন গা ছমছম করতো”। “ও বাড়িতে?"
“হ্যাঁ, খালি মনে হতো কেউ অনির ক্ষতি চায়। আর সে খুব কাছেই আছে”।
“তোমার এই অপছন্দের ঘেন্নার বরকে সন্দেহ করতে, তাইনা?” অচ্যুত মুচকি হেসে কথাটা বললেন। সুহাসিনী মাথা নাড়লেন, “না, এই একটা ব্যাপারে কোনদিন সন্দেহ করিনি”।
“সত্যি বলছো?” “মিথ্যা বলে লাভ?” “তাও ঠিক, ভাগ হয়ে যখন চলে এলুম এ বাড়ি, কষ্ট হয়েছিলো, না?”
“খুব, কিন্তু বলিনি”। “আটকালে না তো?”
“দাদা ভাই, দিদিভাই ও তো চাইলো। তোমরা সবাই একদিকে আর আমি একা”।
“তোমার বাড়ির লোকেরাও।তারা বললে তাদের সম্পত্তি আর আমার ভাগ নিয়ে একটা নতুন দোকান খুলতে”। “জানি”।“ভাগটা না হলে ভালো হতো বউ”।
সুহাসিনী চমকালো “কেন?” “তোমাকে দু'বাড়ি ছোটাছুটি করতে হতো না। মনটা তো বড় জনের কাছেই পড়ে থাকে?”
“বোঝো তুমি?” সুহাসিনী অবাক হন।
“বুঝি, আসলে আমি তোমাকেই সাজা দিতে চেয়েছিলাম”।
“সাজা!” “সারাজীবন ভালোবাসা না দেওয়ার সাজা। ভালোবাসারজনেদের থেকে আলাদা করে”।
সুহাসিনী চমকে উঠলেন, “এখন এসব বলছো?”
“ভালো লাগছে, নিজের মনের সব কথা তোমাকে বলতে ভালো লাগছে। আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ টা যখন জেনেই গেছো”।
“এখন যাও না তার কাছে আর তো?”
“অনির দিব্যি”।বলেই হেসে উঠলেন অচ্যুত,“তোমার এটা মনে আছে?”
‘থাকবে না!” “আর গেলে আমাকে মেরে ফেলো”। "ছি! এ কেমন কথা তোমার”।
“পাগলামো”। “কোথাকার মেয়ে ছিলো?”
“কী হবে জেনে?” “বাচ্চা কাচ্চা নেই তো?”
“নাহ”। “আমার দিব্যি, বলো?” অচ্যুত উঠে দাঁড়ালেন।
সুহাসিনীর মাথায় হাত রাখলেন," না,তার আর আমার কোন সন্তান নেই।তার সাথে তার স্বামীর আছে।""ঘরের বউ তবে!ছি!"অচ্যুত সুহাসিনীর চোখে চোখ রাখলেন, “তুমি একটু ভালো বাসলেই হতো না, বৌ”।
সুহাসিনী জানেন কথাটা সত্যি। অচ্যুতকে উনি ভালোবাসলেন আর কবে! “এবার থেকে বাসবে তো?”
সুহাসিনী উঠে দাঁড়ালেন, “আগে ভালো হও”। “হচ্ছি তো”।
“আরো ভালো হতে হবে”। অচ্যুত সুহাসিনীর কোমর জড়িয়ে ধরেন।
“একি …… সাতসকালে …”। “ভালো হওয়া”।
“ছাড়ো”। অচ্যুত মাথা নাড়েন, “না”।
“ছেলে বৌ-রা চলে আসবে”।
“দরজা বন্ধ আছে – খেয়াল করোনি”।
“দাবী কি তোমার?”
অচ্যুত সুহাসিনীর দু গালে আদর করে দিলেন।
“এটুকুই”। সুহাসিনী জীবনে কোনদিন অচ্যুতকে এভাবে আদর করতে দেখেনি। “ব্যাস?”
“হ্যাঁ”, অচ্যুত সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলেন,“আমার বৌ”।
অচ্যুতের চোখে একটা আলোর ঝলকানি দেখলো সুহাসিনী। যেটা আগে কখনো দেখেনি।
“হঠাৎ তোমার, এটা বললে যে?”
“আমার সাতজন্মের ভাগ্য – বলবো না?”
“মানো তুমি?” “আলবাৎ মানি”। “ভালো না বাসলেও মানো?”
“হ্যাঁ, ভালো তো বাসাবই একদিন। আর না বাসলেও এই যে আমার মা, বাবা, দাদা, বৌদিকে সম্মান, শ্রদ্ধা দিয়েছ – তিনটে ছেলেকে ভালোবাসা দাও, নাতি নাতনিদের আদর দাও – এটাই কম কি?”
“এক থাকলে আরো ভালো হতো। অতীন, অনুপম – ওরা মানুষ হতো”।
“হিংসার বীজটা ঢুকে গিয়েছিলো যে। বৌদি খুব করে আলাদা হতে চাইছিলো। তোমার মা, বাবারও সায় ছিলো এতে, আমারও। দাদা, বৌদি চলে গেলে আমি অনিকে সাহায্যই করতে চেয়েছিলাম। সম্পত্তি আত্মসাৎ নয়। কিন্তু সে তো ঢুকতেই দিলো না ব্যবসায়। বিশ্বাস কর,তাতেই আরো কষ্ট পায় আমি”।
“পরীকে দেওয়াটা?” “পরীর ভালোর জন্য। জানি তুমি ভাবো,এটা আমার স্বার্থ, সম্পত্তির লোভ … আমিও অতীন, অনুগমের সামনে এমনি বলেছি তোমায়। অথচ পরী ওখানে বেশি ভালো থাকবে জেনেই দিয়েছি। অনি, অতীনের থেকে মেয়েটার অনেক ভালো বাবা হতে পারবে”।
“তোমার ছোটছেলে ফিরলো?” “না”। “সদ্য ছেলে হলো – এখনি বাইরে?” "
থাক না, কোম্পানির ট্রিপ তো। বৌ বাপের বাড়ি যখন। ঘুরে আসুক”।
“ব্যাঙ্কক?” “হ্যাঁ”। “আবার?” “ফিরবে, তিন দিন পর”। “অনুপম তোমার ধাত পাচ্ছে না তো?”
অচ্যুত জানেন না, পাচ্ছে কি পাচ্ছে না। কিন্তু কানাঘুঁষো শুনেছেন। এক্সট্রা ম্যারিটাল আছে নাকি। এদিকে ছোট বৌমার ও তো বাচ্চা হলো আবার, “জানি না”।
“রাশ টানো”। “তুমি মা”। “তুমিও যাবা, এসব ব্যাপারে মায়ের থেকে বাবা বললেই কাজ হয়। কড়া হও, একটু”। অচ্যুত বুঝলেন সুহাসিনী কী বলতে চায়, উনি কড়া হবেন, এবার।
পর্ব – ২৭
“মামণি-“ স্কুল থেকে ফিরেই ডাক দেয় অনিকেত। নীরা ঘড়ি দেখলো। তিনটে বাজে, আজকেও একটু আগে ছুটি হয়েছে তবে। ভালো হয়েছে, ওই মেয়েটা সাথে আসেনি। নীরা পরীকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাবিনের ছবিটার সাথে কথা বলাটা এখন অনেক কমেছে ওর। তবে খাওয়ায় এখনো। পরী ফেরার আগেই । ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে অনিকেত ব্যাগ কাঁধে চেয়ারে বসে আছে। নীরা ব্যাগটা পিঠ থেকে খোলায়, জুতো মোজা খুলে দেয়।
"তাড়াতাড়ি ছুটি?”
“হ্যাঁ, টিফিনের পর ছুটি হয়ে গেলো”।
“কেনো?”
”এক্সাম ছিলো দুটো”।
“ক্লাস টেষ্ট?”
“হ্যাঁ, মামণি – আগের খাতা বেরিয়েছে, দেখবে?”
“দেখবো, আগে খেয়ে নে”।
“পরে খাবো, এই তো টিফিন খেলাম। মিসও কেক খাওয়ালো”।
“মিস!”
“হ্যাঁ – এটা ওটা খেতে দেয় তো”।
নীরা চোখ বড় করে তাকালো, “তোকে টিফিন কম দিই?”
“না, মামণি”।
“তাহলে লোকের থেকে নিবি না”।
“দেয় যে”।
“নিবি না, কানে গেছে কথাটা!"
নীরা ধমক দিলো। অনিকেত চুপ করে গেলো। “মিস তো। কী করে না করবে স্কুলের মধ্যে!” নীরা বললো।
‘চল! চেঞ্জ করবি”।
শাঁওলির পড়ানোতে ভরসা পায়না নীরা। ও পড়িয়ে গেলে নিজে আবার সমস্ত চেক করে, ভুলও পায়। শাওলিকে গত কাল এই নিয়ে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছে। আজ অনিকেতের পরীক্ষার খাতা দেখে খুশি হয়েছে নীরা। যেমন শিখিয়েছিলো – তেমন লিখে এসেছে। ফুল মার্কস পেয়েছে। নীরার কোলের কাছে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলো অনিকেত। নীরা ঝুঁকে একটু আদর করলো। মামণির খুব বাধ্য ও। মামণি যা বলে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। বাবিনটা যদি এমন হতো তাহলে হারিয়ে যেত না। নীরা শুয়ে পড়ে ঘুরলো অনিকেতের দিকে। কাছে টেনে নিলো। সেদিন রাতের পর থেকে নিজের কাছে শোওয়ায় নীরা। কাছ ছাড়া করে না। অনি বিশ্বাস না করলেও নীরা বিশ্বাস করে – অনিকেত যেটা দেখেছে – সত্যিই দেখেছে। কথাটা কাকিমণিকে বলতে ভীষণ বকুনি খেয়েছিলো নীরা। ছেলেকে একা শোওয়াবার জন্য। কারোর হাতে যেন ছেলে না খায় – বলে দিয়েছেন কাকিমণি। নীরাও চায় না অন্য কারোর হাতে থাক ও। অনি, নীরা, কাকিমণি – ব্যাস। আর কাউকে ভরসা করতে মানা করেছেন কাকিমণি, ডাক্তার কাকা। ঠিকই করেছেন মনে হয়। সেদিন যে এসেছিলো – সে কে? ভুত প্রেত – নাকি মানুষ। দ্বিতীয়টার সম্ভবনাই বেশি মানে নীরা। মানুষ হলে গেলো কোথায় – উবে গেলো? নাকি বাড়ির পিছন দিকের ভাঙা ঘরগুলোতে – অনি এলে একবার দেখতে বলবে নীরা। আজই। বাড়ির সামনে যতটা মাঠ পিছনেও প্রায় ততোটাই। পিছনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে কয়েকটা ভাঙা ঘর আছে, পাতকুয়ো আছে একটা। পাঁচিলের ধারে জঙ্গল হয়ে গেছে। ঘরগুলো অব্যবহারে ভেঙে পড়ছে। কেউই যায়না। সামনে থেকে ঐ ঘর গুলোতে চট করে নজর পড়বে না। গেট থেকে তো নয়ই, সার্ভেন্ট কোয়াটার থেকেও না। লুকনোর ভালো জায়গা ওঠা। যে এসেছিলো সে এই পরিবারের ক্ষতি চায় – এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মোটিভ কী – এটাই জানতে চায় নীরা।
অতীন ঠাকুরপো,বড় জা জিনা এসেছিলো কাল। পরীকে দেখতে। অনিকেত আসায় পরীর কদর কমলো কিনা – দেখতে এসেছিলো, আসলে। অনিকেতকে দেখে তারাও ভারী অবাক। বাবিনই ভেবেছে। সাথে কাকাও ছিলেন। তিনি বলছিলেন অনিকেতকে নিয়ে যাবেন মাঝে মাঝে। কাকিমণি নাকি পরী ছাড়া রাতে ঘুমোতে কষ্ট পান। কাকার যেন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে এই ক’দিনে। সত্যি এই পরিবর্তন,নাকি লোক দেখানো। কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা নেই তো? নীরা এই ব্যাপারে অনেক ভেবেও কূল পাচ্ছে না।
অনিকেত ঘুমের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলো নীরাকে। এরকম প্রায়ই ধরে। বেশ জোরে, ভয় পায় মনে হয়। নীরা ছাড়ায় না। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে। সেদিনের ভয়টাকে মনে ছাপ ফেলতে দেওয়া যাবে না। ঘরে অ্যাটাচড বাথ আছে। অনিকেত রাতে উঠে হিসি পেলে একা যেতে চায় – কিন্তু নীরা নিজে ওঠে। হিসি করিয়ে আনে। বাথরুমেও একা ছাড়ে না। বাবিনও কি এইরকমই কোন ভয় পেয়ে জ্বরে পড়েছিলো?আর জ্বরে ভুগেই... একভুল দু’বার রিপিট করতে চায় না নীরা। যদি বাবিন এইরকম কারোর জন্যই চলে গিয়ে থাকে – তাকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেবে নীরা, দেবেই।
কে হতে পারে এমন? কাকিমণিকে প্রশ্নটা করেছিলো নীরা। কাকিমণি বলেছিলেন পুরনো শত্রু। একটা অভিশাপের গল্প আছে মুখার্জী পরিবারের সেটাও বলতে যাচ্ছিলেন – নীরা শোনেনি। নীরা যুক্তিবাদী মেয়ে। যুক্তিতে এসব অভিশাপের জায়গা নেই। মানুষের লোভের জায়গা আছে, সেই লোভবশত যদি অনির দাদা, অনির বড় ঠাকুরদার ছেলে,এমনকি বাবিনও চলে গিয়ে থাকে – তবে সেটা ঠান্ডা মাথার খুনীর কাজ। যে অনিকেতকেও সরাতে চাইবে পথ থেকে, যে কোন মূল্যে।
শাঁওলি মেয়েটাকে খুব অপছন্দ নীরার। অনিকে বলতে না পারলেও ঠারেঠোরে বুঝিয়েছে। দু’মাস আসবেই নাকি। তারপর না আসা-ই ভালো। ওর মধ্যে একটা ইতস্তত বোধ দেখে নীরা। নীরার চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। কোথাও একটা কিছু লুকায়, কী সেটা? জানতে চায় নীরা। অথচ জানতে পারছে না। কোথাও না কোথাও একটা অপরাধ বোধ আছে ওর। সেটা কী নিয়ে জানা নেই। তাই এই মেয়েটাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে, নীরা।
কপালে কারোর হাত পেয়ে চমকে তাকায় নীরা, অনি, আগে ফিরে এসেছে। “এখন?” “মিটিং করে চলে এলাম, ঠিক করিনি?” “দোকান?” “আজ আর গেলাম না সেকেন্ড হাফে। স্টাফরা সামলে নেবে। ভুল করেছি?” নীরা হাসে, “না। খাবে তো?” “ব্যস্ত হয়ো না, কাকিমণি খেতে দিচ্ছে”। “এমা, আমি উঠে দিই?” “না, নীরা, তুমি বাবিনকে পরীকে নিয়ে রেস্ট করো, খুব ঘুমোচ্ছে দুষ্টু দুটো”। “বড়জন দুষ্টু না, অনি, তোমার মনের মতো”। অনিরুদ্ধ অনিকেতের গায়ে হাত বোলায়।
“কখন এলো?” “ঘন্টা খানেক”।
“খেয়েছে?” “হ্যাঁ, অনি – তুমি পিছন দিকের ঘরগুলো একটু সার্চ করো তো”। “ভাঙা ঘর গুলো?”
“হ্যাঁ, পিছন পাঁচিলের দিকের” “কেন?” “যদি কোন সূত্র পাওয়া যায়”।
“বাবিনের মনগড়া না বলছো?” “একেবারেই না”। “তাহলে? ভৌতিক?”
“মানুষেরই কাজ, মানুষটাকেই খুঁজছি”। “কাল দেখি?” “হ্যাঁ, ভোরে। আর উপরের ঘরগুলোতে সার্ভেন্টদের একসেস কমাতে চাইছি আমি”। “এতটা ভাবছো?” “এতটাই। বাবিনের জ্বর আসার আগের দিন ও একা শুয়ে ছিলো,অনি। ছুটে চলে এসেছিলো। আমরা বাহানা ভেবেছিলাম,মনে আছে?"
“কী বলতে চাইছো?” “ভয় থেকেও তো জ্বর আসতে পারে?” “তা পারে, কিন্তু ব্লিডিং?”
“জানি না, তবে কিছু একটা গড়বড় আছে। আমাদের আরো সতর্ক থাকাতে হবে। এক ভুল দু’বার যাতে না হয়”। “কাকিমণি অভিশাপের গল্প করলেন, মানো?” “নাহ, আমি মানুষের হিংসা,ক্ষতি করার চেষ্টাকে মানি,অনি। এটাও তো মানুষেরই কাজ”।
“ভয় দেখানো?” “হ্যাঁ,” “কী চায় সে?”
“ক্ষতি”। “বংশের প্রতি শত্রুতা?” “মনে হয়। কেউ তো আছে যে প্রতিশোধ নিতে চায়। যে কিনা কোন কারণে আহত”। “আজ ওষুধ খেয়েছো?”
অনির কথায় থামে নীরা, “তোমার মনে হছে – ওষুধ খাইনি বলে ভুলভাল বকছি?”
“ধুর! এমনিই বললাম, আমি খেয়ে আসি?”
“এসো, পিছনের ঘর গুলো দেখতে হবে অনি। আমার কথা শোনো”।
অনিরুদ্ধ ঝুঁকে নীরাকে চুমু খেলো। “দেখবো”। “একা আমাকে?” অনিরুদ্ধ হাসলো। “না, দুটো ছেলে মেয়েকেও আদর করবো। খেয়ে আসি”।
“বড়টা ক্লাসে হায়েস্ট পেয়েছে, ম্যাথ টেষ্টে”। “কত?” “ফুল মার্কস”। অনিরুদ্ধ খুশি হয়, “সোনা ছেলে তো!" “শাওলি করালে হতো না, সব অঙ্ক আমার করানো”।
“বাহ”। “এমন টিউটর রেখে কী লাভ”। “দু’মাস, বলেছি তো –” “দু’মাস পেরেলো একদিনও নয়।""আচ্ছা।এত অপছন্দ? " "অপছন্দের মতোই।" “খেয়ে আসি?” “এসো”।
“নীরা খুব চিন্তিত ব্যাপারটা নিয়ে“। খেতে খেতে কাকিমণিকে কথাটা বললো অনিরুদ্ধ।
“চিন্তিত হবারই কথা, আমি যেন আর কোনদিন না শুনি বাবিন একা হয়েছে”।
“অভিশাপের ভয়?” “কিছু একটার ভয়।
সেই কিছুটাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, তবে কিছু”।
“যে ভয়ে আমাকে সবসময় আগলে রাখতে?” “বলতে পারিস”
আমিতো ফার্স্ট বর্ন নই”। “তবুও, কেউ তোর ক্ষতি চাইতো – আমার মনে হতো”।
“বাবিনের ব্যাপারে আরো সর্তক থাকা উচিৎ ছিলো তবে।"
সুহাসিনী মাথা নাড়লেন,
“আমি আগে অভিশাপটা জানলে, সতর্ক হতাম”। “এসব মানো?” “না মেনে উপায়?”
“নীরা মানে না। ওর মতে মানুষের কাজ”। “মানুষ! মানুষ হলে বাবিন দেখার পর তাকে সারা বাড়ি খুঁজে পাওয়াই যেতো না!”
“পিছনের ঘরগুলো দেখতে বলছে নীরা”। “দ্যাখ তাহলে”।
“কাল দেখবো, ভোরে”।“একা নয়”।
“তুমি থাকো রাতে, দুজনে দেখবো।” সুহাসিনী হাসলেন, “তা আমাকে যে রাখবি – শুতে দিবি কোথায়?”
“কেন? ওরা মা, ছেলে মেয়ে একঘরে, আমি আর আমার মা সেই ছোট্ট বেলার মতো একঘরে”।
সুহাসিনী চমকে উঠলেন, “কী বললি অনি? মা?” অনিরুদ্ধ হাসলো,
“কেন – ভুল বললাম? আর কাউকে বলা উচিৎ? ছোট থেকে যে বড় করেছে আদর শাসন সেই তো মা”। আর জন্ম?” “পরের বার দেবে। কী, দেবে তো?”
সুহাসিনী অনিরুদ্ধর দিকে সজল চোখে তাকালেন, “ মাঝে এতগুলো বছর দেখিনি যে –“
“সেটাও হয়তো আমার ভালোর জন্যই। আর দেখতে কী তুমি চাওনি? সবাই আলাদা হতে চাইলো – বিশেষ করে মা আর কাকা। তুমি একা.... একটা কথা বলবে? আলাদা হবার আগে মায়ের সাথে তোমার কোন সমস্যা হয়েছিলো?” “কেন আবার সেসব টানা অনি? সে তো নেই”। “তাতে কী? জানতে হবে না আমায়? তোমায় কষ্ট দিয়েছিলো খুব, না?”
“দিদিভাই তো আবেগে চলতো অনি। জেদী ছিলো, কেউ মনে কোন কিছু একটা ঢুকিয়ে দিলেই ----” "সে তো তুমিও বাবার এক মেয়ে,আদুরে মেয়ে।" "সবাই সমান হয়?" "না,হয়না।তা কোন কিছুটা কী,বলবে?" "অনি,থাক না।" "আমি জানি।" সুহাসিনী চমকালেন,"কী?" "মা'কে কেউ বুঝিয়েছিলো আমাকে তুমি মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো,তাই না?" সুহাসিনীর চোখে জল দেখলো অনিরুদ্ধ, " তোমাকে আমাকে আলাদা করার জন্য এই আয়োজন, তাই না,মা?" সুহাসিনী কেঁদে ফেললেন এবার,অঝোরে।"পনেরোটা বছর নিজের অনির কাছ থেকে এটা লুকিয়েছো! কার সম্মান রাখতে এই আত্মত্যাগ, বলো?" সুহাসিনী অনিরুদ্ধর হাত চেপে ধরলেন,"আর তো লুকাচ্ছি না অনি।ছাড় ওসব।"
“বেশ তাই হোক, ওসব ছাড়ো, থাকবে কিনা বলো”। নীরা উঠে এসেছিলো। “কাকিমণিকে থাকতে বলেছো?”
“দেখো না নীরা, পাগলের কীর্তি”। নীরা হাসলো, “থাকুন না কাকিমণি, আপনার ছেলে খুব খুশি হবে তাতে,মেয়েও”।
“দেখলে, ছেলের সাথে মেয়ের ও আবদার।থাকবে না কী করে?" সুহাসিনী হাসলেন, “বেশ, থাকবো”।
অনিরুদ্ধের মুখ অনাবিল হাসিতে ভরে গেলো। কাকিমণির ওকে এই বারো তেরো বছর কর্তব্য বাদে এড়িয়ে চলার কারণ আজ ওর কাছে স্পষ্ট। অনিরুদ্ধর মায়ের মিথ্যা অভিযোগে আঘাত পেয়েছিলো কাকিমণি, অভিমান হয়েছিল খুব আর অভিমানটা বাড়তে দেবে না অনিরুদ্ধ।
পর্ব – ২৮
ফোনে সুহাসিনীর জরুরি তলব পেয়ে মুখার্জী বাড়িতে এসেছিলেন রুদ্রদেব। এত ভোরে তলবের কারণ বুঝতে না পারলেও, গুরুতর কিছু – বুঝেছিলেন, পৌঁছে শুনলেন সুহাসিনী আর অনি পিছনের ভাঙা ঘরগুলোর দিকে আছে – নিধু খবর দিলো। প্রায় ছুটতে ছুটতেই পিছনের মাঠ পেরিয়ে ওখানে গেলেন রুদ্রদেব।
“কী ব্যাপার?” “ঘরের ভিতরটা দেখো, রুদ্র”।
রুদ্রদেব দেখলেন, অবাক হলেন, “স্ট্রেঞ্জ!” “কী বুঝলে?”
“কেউ এখানে তন্ত্রমন্ত্র সাধনা করে, নাকি?” “তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কে?”
অনিরুদ্ধ জানলায় ঝোলা সাদা শাড়ি দেখালো,
। “কোন মহিলা?”
“মনে তো তাই হচ্ছে”। “বাইরের কেউ তো নয়”।
“সম্ভবই নয়”। “তবে? বাড়ির মেইডদের কেউ?”
“সবাই তো যার যার ঘরে থাকে, তাহলে?”
“মানুষের মাথায় খুলি– যে-ই করুক, সে বড় মাপের সাধিকা,” রুদ্রদেব বললেন।
“ঘরটা এর মধ্যেই ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ দেখো – ধুপের ছাই,কাঠের পোড়া টুকরো পড়ে আছে”।
“শাড়িটা চোখে ধুলো দিতে নয় তো, অনেক সময় শুনেছি শাড়ি পরেও তান্ত্রিকরা সাধনা করেন”।
সুহাসিনী যোগ করলেন, “বড় রকমের কালীসাধক – গল্পে পরেছি”। “একটা ম্যাল প্র্যাকটিস চলছে – এটাই সোজা কথা”।
রুদ্রদেব বললেন। “এখনতো বাবিনের ভয় পাওয়াটাকেও গল্প নয় – সত্যি মনে হচ্ছে”,
অনিরুদ্ধ যোগ করলো। “ঠিক। বাবিনও তো সাদা শাড়ি – লম্বা চুল দেখেছিলো”। “আর শ্বাসের আওয়াজ কাকিমণি? পা টেনে হাঁটা –“
“এমন তো কেউ নেই – অনি – কারোর হাঁপানি আছে এদের মধ্যে জানিস?”
“না,কাকাবাবু। বড় কথা পা টেনে কেউ হাঁটে না”। “পা, টেনে হাঁটছিলো – সদ্য কোন চোট পেয়েছিলো হয়তো—“ সুহাসিনী বললেন। রুদ্রদেব একটু ভাবলেন, “সবাই আছে বাড়িতে?” “হ্যাঁ, মণিপিসি গ্রামে গেছে, ভাইয়ের অসুখ”।
“হ্যাঁ সে তো বাবিন ভয় পাওয়ার আগের বিকালেই। ওকে বাদ দিলেই হয়”। সুহাসিনী বললেন।
“বাকিদের খেয়াল করো। সুহাসিনী, অনি –এখন কী দেখলে কাউকে বলবে না”। “সবে তো সাড়ে পাঁচটা, সবার ঘুমই ভাঙ্গেনি। দারোয়ান আর নিধুকাকাই দেখেছে কেবল।" "একটু দাঁড়াও,সু।" রুদ্রদেব পিছন পাঁচিলের দিকটা গেলেন,একাই।জংগল আছে ওদিকে,কাঁটাঝোপ।ঝোপ সরিয়ে একটু দেখেই ফিরে এলেন। "কী দেখলে?" "ঝোপে কেউ লুকিয়েছে কিনা।চলো,ফিরি।" "ঝোপে কেউ লুকিয়ে থাকবে!এই ভোরে!তুমি পারোও।"সুহাসিনীর কথার জবাবে রুদ্রদেব বললেন," তাও বটে।আমার বিলেত ফেরত বুদ্ধি তো!"
“রুদ্র তুমি ব্রেকফার্ষ্ট করে নেবে, এখানেই”। সুহাসিনী বললেন।
“কাল তুমি ছেলের কাছে ছিলে?” সুহাসিনী হাসলেন।
"ঐ জন্যই সু, এত খুশি”। রুদ্রদেব অনির পিঠে হাত রাখলেন।
“রেখে দিবি – যে দিনই পারবি”। “আমি তো চাই, সবসময় থাকুক”। “অনিরুদ্ধ বললো।
“তোর কাকা ছাড়বে?” রুদ্রদেব হাসলেন।
“আমি হলে ছাড়তাম।" "এসব মস্করা ছাড়ো। ঘরের শত্রু বিভীষণের কী হাল করবে দেখো”। সুহাসিনী বললেন।
“কে বিভীষণ ধরা পড়ুক আগে, সু। তবে তোমাকে বলছিলাম অভিশাপ নয় – মানুষের হাত আছে এতে”।
“বাবিনের যাওয়াটাও কি …”। অনিরুদ্ধ বলে। “এখন তো মনে হচ্ছে তা-ই”।
সুহাসিনী অবাক হলেন, “ব্ল্যাক ম্যাজিক করে মেরে দিলো! তা হয়!” রুদ্র বলেন,
“আমার পয়জনিং থিওরি থেকে আমি সরছি না। অনিকেত কারোর হাতে খায় না তো?”
“না।” “একদমই যেন না খায় সু, দেখো”। রুদ্রদেবের যুক্তি বোঝেন সুহাসিনী।
“আমি সবসময় খেয়াল রাখছি। অনিও রাখে। নীরাকেও বলেছি এটা মানতে”।
“নীরা এখন এটা নিইয়ে আমাদের থেকেও কনশার্নড, কাকাবাবু। ওরই দৃঢ় ধারণা – এর পিছনে মানুষের হাত আছে”।
“মানুষটা কে? সেটা ধরলেই তো মিটে যায়! আর তার মোটিভ কি? খামাখা তন্ত্রমন্ত্র আর পয়জনিং করে মেরে ফেলতে যাবে কেন?” সুহাসিনী যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা চাইলেন।
“যাবে – কারণ সে অনিকেত একা শুয়েছে খবর পেয়েই খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েছিলো যে সে আদৌ বাবিন কিনা”।
“যে গেছিলো সে-ই বাবিনের – আই মিন ……”। অনিরুদ্ধ পুরোটা বলতে পারে না।
“মোস্ট প্রোব্যাবলি ইন মাই ভিউ”। রুদ্রদেব বলেন।
“তার শিকার বেঁচে ফিরে এলো কি করে সেটা দেখার জন্য এসেছিলো – এবং ঐ আলো আধারিতে কতটা সার্টেন হয়েছে কে জানে”!
“তার মানে অনিকেতের কী …?” রুদ্রদেব মাথা নাড়েন।
“হ্যাঁ – ফাঁড়া আছে, অনি – রাতে দোতলার এন্ট্রান্স খোলা রাখবে না, প্রয়োজনে কোলাপসিল লাগাও, যাতে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে বা একতলার সার্ভেন্টস রুম গুলো থেকে দোতলা একেবারেই একসেসিবল না হয়, রাতে”।
“আচ্ছা, কাকাবাবু”। “রাতে শোবার আগে তুমি, নীরা প্রতিটা ঘর চেক করে নেবে, বাথরুমও। দেন কোলাপসিবেলে তালা দেবে”।
“বেশ”। “প্রয়োজনে আমি আর সুহাসিনী অল্টারনেটিভ করে থাকবো”।
সুহাসিনী তাকান, “তোমার ব্যস্ত প্র্যাকটিস – তুমি পারবে?” “বাবিন কি তোমার একার নাতি?”
“এর থেকে সবাইকে বাদ দিয়ে নতুন লোক নিলে?” সুহাসিনীর কথায় রুদ্রদেব হাসলেন।
“তাহলে ধরা পড়বে না সে কোনদিনই। আর সে বাইরে গিয়ে নতুন রূপে বিপদ আনবে, তাই ঘরের শত্রুকে ঘরেই ফাঁদ পেতে ধরতে হবে। সে যেটা করতে চাইছে, সেটা করতে না পারার ফ্রাষ্ট্রেশন তাকে দিয়ে ভুল করিয়ে নেবে – আমি নিশ্চিত”।
“দেখো – যেটা ভাল বোঝো”। “অচ্যুতকে এসবের কিছু বলো না”। “তুমি কি ওকে …”। “কাউকেই বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। আমরা চারজন ছাড়া”।
“ঠিক আছে, তাই হবে”। “তুমি থাকতে না পারলে বলো – আমিই রোজ থাকবো”।
“থাকবো, বাবিন, পরীর বাহানায়। কঠিন হবে না জিনিসটা। ছেলেরা বা ওর কাকাও আপত্তি করবে না”। "
বেশ, তবে তাই হোক”।
লনে বসে চা খাচ্ছিলেন রুদ্রদেব, সুহাসিনী। অনি উপরে গেছে।
“সকালের চা আমার সাথে – ভাবতে পারো?” “স্বপ্ন মনে হচ্ছে”। সুহাসিনী হাসেন। “অচ্যুত জানলে?”
“জানবে”, “আলাদা খাটে শোয়?” “সে তো বিয়ের পর থেকেই”। “সেকি, তাহলে অতীন- অনুপম ……”। “চলে এসেছে বলা যায়”।
“কবে থেকে একেবারেই … ইউনো …”। সুহাসিনী তাকান, “অনুপম পেটে আসার পর থেকেই ……”। “কী বলো! একত্রিশ বছর!”
“হ্যাঁ – বাইরে ও ছিলো তো মেয়ে মানুষ”। “সেই।তোমার সমস্যা হয়নি?” “মন থেকে না চাইলে শরীর জাগে?”
“তাও ঠিক, এখন তো ওসব মেয়েমানুষ নেই বললে – এখন যদি চায়?” “ধুর! কী যে বলো!”
“কেন? এখন চাইতে নেই? বয়স – টয়স মানো তুমিও?” "
তোমার চাওয়ার অধিকার থাকলে – চাইতে?” রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাত ধরেন, “আমি হলে, চাইতে হতো?” সুহাসিনী জবাব দিলেন না।
চোখের ইশারায় দেখালেন পরীকে কোলে করে নীরা আসছে, এক হাতে বাবিনকে ধরে রেখেছে।
“ঠাম্মা ………” পরী লাফিয়ে উঠলো। সুহাসিনীর কোলে চেপে বসলো। নীরা সামনের চেয়ারে বসলো। অনিকেত পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। নীরা ওকে টেনে নিয়ে কোলে বসালো।
“নীরা – বাবিন তো সেই আগের মতোই মা ন্যাওটা, দেখছি”। রুদ্রদেব হাসলেন। নীরা অনিকেতের দিকে তাকায়। কাল রাতে বকুনি খেয়েছে ছেলেটা। ওর ঠাম্মা না থাকলে নীরা আরো একটু শাসন করতো। ক্লাসওয়ার্কের খাতায় হোমওয়ার্ক করে ফেলেছিলো। ওর মিস সেটাও দেখেনি। নীরা পড়াতে বসে হোমওয়ার্ক মেলাতে গিয়ে দেখে। বকুনি দিতেই নিঃশব্দে কান্না। অনি এসে বাঁচিয়েছে। তবে অনির আসাটাও কাকিমণির কথাতেই হয়েছে – নীরা বোঝে। কালরাতে ওখানে ওরা মা, ছেলে আর পরী শুয়েছে। নীরার ঘরে নীরা আর অনিকেত। নীরা ঘরে ঢুকে যখন লক করছিলো দরজাটা ছেলেটা বলে, “মামণি লক করে দিলে?”
নীরা মুচকি হেসেছিলো, “হ্যাঁ যাতে ঠাম্মা , বাপি কেউ বাঁচাতে না পারে তোকে ধরলে”। অনিকেত সেটাই সত্যি ভেবেছিলো। মাথা নীচু করে ভয়ে কাঁপছিলো। নীরা পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। “দেখে হোম ওয়ার্ক করবি পরের দিন থেকে”। “বাপি খাতাটা ঠিক করে দিয়েছে তো”। অনিরুদ্ধ পেজ দুটো রিমুভ করে হোম ওয়ার্কের খাতায় লাগিয়ে দিয়েছিলো। “জানি, তাই বকছি না আর”।"বাপি না এলে মারতে”। নীরা চোখ মোছায়, “হ্যাঁ।কেউ মারেনি তোকে কখনো?” “না তো, আমি তো সবসময়ই ফার্ষ্ট হই মামণি। ওখানে স্যাররা, মিসরা, ফাদাররা, ব্রাদাররা যা বলতো শুনতাম – মারবে কেন?” “তাও ঠিক। পানিশমেন্ট?”
“তাও কোনদিন না”। “তাহলে মনে হয় মামণিই খারাপ, বকে, কানমলা দেয়, পড়া একটু না পারলেই উঠবোস করায়। আজ মারতোও …”।
অনিকেত আকুল চোখে তাকায়, “না, না মামণি, তা কেন? ওখানে সবাইতো এত খুঁটিয়ে দেখতো না – আর মা সবারই শাসন করে, বাপিও গল্প করেছে ঠাম্মার কাছে কত্ত মার খেয়েছে –“ নীরা হাসে।
“আমিও খেয়েছি, দিদুনের কাছে”। নীরা অনিকেতকে শাসন করে। কারণ বাবিনকে শাসন না করে যে ভুল করেছে সেটার পুনরাবৃত্তি চায় না। ছেলেটা একটা কিছু করতে গেলেও ভয়ে থাকুক। মামণি কী বলবে, ভাবুক। এটাই নীরার চাওয়া।
“বোন আসবে না?” “বোন ঠাম্মার কাছে শোবে। বাপি আর ঠাম্মার মাঝে”। “ও”। “তুই যাবি? বাপি বলছিলো”। নীরা উত্তরটা শুনতে চায়। “না, না মামণি তুমি একা শোবে নাকি। তুমি শোও। আমিও শুয়ে পড়ছি”। নীরা খুশি হয়, বাবিন মা ন্যাওটা ছিলো খুব। অনিকেত কতটা – সেটা দেখার জন্যই ওকে বাপির কাছে যেতে বলেছিলো।
“আমি একা শোব বলে, নাকি তুই মামণির কাছে ঘুমোতে চাস বলে?” অনিকেত শুয়ে পড়েছিলো, তারপর বলেছিলো, “আমি তো চাইবই মামণি। কিন্তু বোন তো ছোটো। বোনের তোমাকে ছাড়া কষ্ট হবে কিনা তাই ……”।
নীরা বুঝেছিলো নিজের চাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলতে শেখেনি এই ছেলে।
“নিজেরটা ভাব আগে, বোকাটা”।
নীরা ওর দিকে কাত হয়ে শুয়েছিলো। অনিকেত ভয়ে ভয়ে কোল ঘেঁষে এসেছিলো।
“কী হলো?” “কিছু না”। নীরা বুঝে কোলের মধ্যে টেনে নিয়েছিলো।
“রোজই তো কোলের মধ্যেই ঘুমোস আজকাল”।
“যদি বকো”। নীরা হেসে ফেলেছিলো, “বকছি না”। অনিকেতের কপালে চুমু খেয়েছিলো।
“মামণি –“। “বলো”। “তুমি সবেচেয়ে ভালো”। নীরা অনিকেতের দুগালে চুমু খেয়েছিলো। “জানি”।
“তোমার কাছে থাকতে সবচেয়ে ভালো লাগে আমার”।
“সেটাও জানি, কিন্তু সেটা বলতে গেলেই চুপ হয়ে যাস – কেন?”
অনিকেত উত্তর দেয় না। মামণি তো ওকে বাবিন বলে না। বাকি সবাই বলে। ও তো সেটা নিয়ে প্রশ্ন করছে না মামণিকে।
“ঘুমো”। অনিকেত নীরাকে জড়িয়ে ধরেছিলো দু’হাতে। বাবিনও এভাবেই ঘুমোতো। অনেক ক্ষেত্রেই অদ্ভূত মিল খুঁজে পায় নীরা। দু’জনের মধ্যে।
“একটা কথা, প্লিজ”। “বল”।
“আর এভিলটা আসবে না তো?” নীরা বোঝে ভয়টা ছেলেটার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।
“সবসময় আমার, বাপির, ঠাম্মার কথা শুনে চলবি, আসবে না”
“সেদিন যখন এসেছিলো খুব ভয় লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো – তোমাকে ডাকতে পারলে, তুমি তাড়িয়ে দেবে”।
নীরা বোঝে, মামণিকে ভয় পেলেও ভরসা করে খুব। অনিকেতকে খুঁটিয়ে অনেকবারই দেখেছে নীরা। সত্যিই মিল আছে। এত মিলের তল খুঁজে পায় না ও – বাবিনের ছবি হাতে করেও একদিন মিলিয়ে দেখেছে, অনিকেতের ঘুমের মধ্যে।
“আমার কাছেই ঘুমোবি সবসময় – কেউ ভয় দেখাতে পারবে না”।"
আচ্ছা। জানো মামণি ………”। “আবার? স্কুল আছে কাল”।
“লাষ্ট কথা …”। নীরা আটকায় না, “শুনি”।
“ক্লাসের ছেলেরা সবাই খুব মায়ের গল্প করতো – আমি তো আগে শুনতাম শুধু – বলতে পারতাম না। এখন বলি”।
“কী বলিস শুনি?” “এই যে তুমি কত্ত ভালো, আমাকে কত ভালোবাসো, বোনকে কত ভালোবাসো – আমাকে পড়াও, খাওয়াও, ঘুম পাড়াও ……”।
“বুঝছি, সবার কাছে ভালো টাই শুধু বলা হয় তাই তো?”
“উঠবোস খেয়েছি – বলিনি”। অনিকেত হেসে বলে।
“ওরা বলে তোর মামণি বকে না? শুধু আদরই করে? আমি বলেছি – হ্যাঁ।”
এই হ্যাঁ-টা একজনের ক্ষেত্রে সত্যি ছিলো। নীরার চোখে জল আসে। খাটের মাথার কাছের টেবিলে রাখা তার হাসিমুখের ছবিতে চোখ পড়ে। চোখ থেকে জল পড়ে।
“মামণি, কাঁদছো? আমি ভুল বললাম?”
নীরা চোখ মছে, “যেটা সত্যি, সেটাই বলবি। মা'কে মিথ্যা ভালো করতে হবে না”।
অনিকেত মামণির বুকের মধ্যে মুখে গোঁজে।
“না, থাক। মামণি, তুমি দাদাকে বকতে না। বাপি বলেছে। কিন্তু আমাকে বকো। আমি গল্পে পড়েছি মা যে বাচ্চাটাকে বেশি ভালোবাসে তাকেই বকে”।
নীরা জানে গল্পের কথাটা এক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে মিথ্যা। তবুও ভুলটা ভাঙ্গায় না। “গল্পের বই পড়িস?"
“ওখানে লাইব্রেরী থেকে নিয়ে নিয়ে পড়েছি – ছোটদের বই”।
“বেশ, আমি কিনে দেবো আরো বই তোকে”। নীরাও ছোট বেলায় খুব বই পড়তো। অনিকেত খুশি হয়।
“আচ্ছা, আমার স্কুলে যাবে?” “যাবো”, “কবে?”
“আর একটু সেরে নিই। তোর ডাক্তারদাদু বললেই যাবো”।
“ডাক্তারদাদু ভাই খুব ভালো। ঠাম্মার হাজব্যান্ড দাদুভাই – ও ভালো। তোমার বাবা দাদুভাই – ও”।
“সবচেয়ে ভালো ঠাম্মা, তাই তো?” “হ্যাঁ, ঠাম্মা বেষ্ট”।
“বাঁচায় তো সবসময়!” নীরা মুচকি হাসে।
“হ্যাঁ, ঠাম্মা না থাকলে আরো বকুনি খেতাম রোজ”।
“এবার কি কট কট করা বন্ধ হবে – নাকি কালকের মতো উঠবোস করাতে হবে?” নীরা ভয় দেখালো।
“ঘুমোচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। বোনের সামনেও উঠবোস খেয়েছি কাল”।
নীরা দুটোকে নিয়ে একসাথেই পড়তে বসায়। “তাতে কী, বোন তো”। “ইস!”
“লজ্জা? লজ্জা হলে তবেই শিক্ষা হবে”। “একটু ভুলে গিয়েছিলাম তো ……”
“একটুও ভুললে ফার্ষ্ট হওয়া যাবে?”
অনিকেত বোঝে মামণিই ঠিক। আরো জোরে জড়িয়ে ধরে, নীরা বলে, “ঘুমো”।
“নীরা, কী ভাবছো অত?” “কই, কিছু না তো কাকাবাবু”।
রুদ্রদেব বুঝলেন নীরা বলতে চায় না। “বাবিন, ভালো ঘুম হয়েছে কাল?”
“হ্যাঁ দাদুভাই। ভোরে বোনকে দিয়ে গেলো বাপি। বোনের ঘুম ভেঙে গেছিলো।"
“বোনের দুষ্টুমিতে ভোরের পর আর ঘুম হয়নি বলতে চাইছে”। নীরা বোঝালো।
“বাহ, বলার ভঙ্গিটা ভালো তো বাবিনের। সুহাসিনী, তোমার বড় নাতি বেশ বুদ্ধিমান। নীরা – এখন মন ভালো তো , মা?”
“হ্যাঁ, কাকাবাবু”। “সত্যি বলছো?” “হ্যাঁ, ফাঁকা ভাবটা কমেছে অনেক”। “ওষুধ?”
“খাচ্ছি, কিন্তু কমাতে চাইছি”।
“ডাক্তার দাদুভাই – তুমি দাদাভাইকে বলো না, একটু খেলি। কাল বিকালেও খেলেনি”। “দাদাভাই খেলেনি বিকালে? ভারী অন্যায়। বাবিন যাও বোনের সাথে খেলো একটু”।
“যাবো, মামণি?” নীরা হাসলো। “যা – তবে চোখের আড়াল হবি না”।
“এই তো তোমাদের সামনেই মাঠে খেলবো”। “যা-“।
অনিকেত আর পরী গেলে সুহাসিনী বললো, “বাবিনের স্কুল নেই আজ?”
“আছে, ভোরে একটু গা গরম গরম দেখলাম। কাশিও হচ্ছিলো। আজ থাক পাঠাবো না”।
“ভাল ডিসিশন নিয়েছো, খেলে ফিরুক। আমিও দেখে দেবো, নীরা – বাবিন মনে হয় সেদিন রাতে যাকে দেখেছিলো সেটা কল্পনা নয়”।
“জানি, ও মিথ্যা বলার ছেলে না, কোন মানুষেরই কাজ এটা, আর সে এই বাড়িতে আক্সেস পায় সহজেই”।
“তুমি কাউকে সন্দেহ করো?” সুহাসিনী বললেন।
“না, আবার সবাইকেই করি। মোটিভটা বুঝতে পারিনা। পিছনের ঘরে কিছু পেলেন?”
“হ্যাঁ, তন্ত্র সাধনার চিহ্ন”। নীরা ভাবলো একটু, “কোন অন্য চিহ্ন?”
“একটা সাদা শাড়ি, ধুপের ছাই পোড়াকাঠ। এর মধ্যেই কোন রাতে সাধনা হয়েছে”।
“আচ্ছা, এইসব সাধনার উদ্দেশ্য মুখার্জীদের ক্ষতি, তাই তো?”
“অভিশাপের লেজেন্ডটাকে বাঁচিয়ে রাখার তাড়না বলতে পারো”। রুদ্রদেব বললেন,
“অনিকেত এসে ওর বা ওদের হিসাবটা ঘেঁটে গেছে। যাকে সরিয়ে দিলো, সে আবার ফিরে এসেছে কী করে …”। “বুঝেছি”।“তুমি বুঝবেই। তুমি ল’ইয়ার, তাও ক্রিমিনাল ল নিয়ে পড়েছো”। নীরা অদ্ভুত ভাবে হাসলো।
“বাবিনকে কেউ আমায় চোখের সামনে মেরে ফেললো আর আমি বুঝতে পারলাম না – কিসের আর লইয়ার আমি কাকাবাবু। মা-ই হতে পারিনি ঠিক করে”। সুহাসিনী রুদ্রদেবের দিকে তাকালেন। এই মেরে ফেললো শব্দটা অর্থবহ খুব, অর্থাৎ বাবিন মারা গেছে – এটা নীরা মানতে শুরু করেছে। পুরোটাই অনিকেত আসার সুফল।
“তন্ত্র মন্ত্রে এসব হয় না কাকিমণি। অভিশাপেও না। হয় শত্রুতায় বিষ দিয়ে। সম্পত্তির লোভে বিষ দেওয়া বা দেওয়ানোর উদাহরণ তো কম নেই পৃথিবীতে”।
“যাকে সামনে দেখছি সে – “ বোড়ে হতে পারে। মন্ত্রী, রাজা অন্য – বাদ দিন সেসব। এবার কী করবেন ভাবলেন? যে করেছে তাকে ধরতে কিন্তু হবেই”। রুদ্রদেব সংক্ষেপে বললেন।
ওদের তিনজনের আলোচনার সারাংশ, “রাজি তুমি?” “রাজি, তবে খুব সতর্ক থাকতে হবে, সবাইকেই”।
“ওরা বাবিনের ফেরাটাকে না মেনে নিতে পেরে খুব শীঘ্রই আক্রমণ করতে পারে। এটাই আমাদের সুযোগ, ওদের ধরার”। সুহাসিনীর কথায় নীরা অমত করলো না। নীরা নিজেও জানে ওদের ধরার – এর থেকে ভালো সুযোগ আর পাবে না।
পর্ব – ২৯
বাবার আর দাদার কাছ থেকে ডিনার টেবিলে কথাটা শুনলো অনুপম। ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে এসেছে ও, আজ দুপুরে।
“মা, ও বাড়িতে শুচ্ছে, কেন?”
“বাবিন আর পরীকে দেখবে বলে”। “থামো বাবা, পরী না হয় বুঝলাম – পরীকে তোমরা দিয়েছো, কিন্তু বাবিন?”
“বাবিন ফিরে এসেছে”, অতীন বললো। অনুপম হো হো করে হাসলো।
“ফিরে এসেছে! মানে! মারা গেছে ও। দাদাভাই পোড়াতে গিয়েছিলো – আমি গিয়েছিলাম সাথে। ফিরে এসেছে মানে কি!”
অচ্যুত অতীনের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “এতে হাসির কিছু নেই ছোট খোকা, বাবিনের মত একটা ছেলেকে এনেছে অনি”। “একটা ছেলেকে এনেছে? তাও বাবিনের মত! কোথা থেকে!”
অতীন বোঝাতে চাইলো, “ভাই – আমি নিজে চোখে দেখেছি, সত্যিই অবিকল বাবিন, কেবল শান্ত বেশ এই যা।"
“আবারো গল্প ফাঁদছ তোমরা। একরকম দেখতে হয় নাকি?”
“হ্যাঁ ভাই, একইরকম”, অতীন বললো। “বয়স?” “ওয়ানে পড়ে, বছর ছয়েক”।
“কোত্থেকে আনলো?” “কোনো অরফ্যানেজ, দাদাভাই ডিটেলটা বলেনি”।
“বাব্বাঃ! অনেক খোঁজ লাগিয়েছিলো তাহলে! বুদ্ধিটা কার? দাদাভাই – এর নাকি মায়ের বয়ফ্রেন্ডর?” চোখ মারলো অনুপম। অচ্যুতের কান গরম হলো।
“তোদের মা সামনে নেই বলে এসব কথাও বলছিস?”
“বলবো না? তুমি মা’কে একা ছাড়ছো কেন? ওখানে?”
“বাবিনের দেখভালের জন্য”। “যাহ বাবা! দাদাভাই আছে, বৌদিমণি আছে, সে তো ছেলেকে ফিরে পেয়েছে। এখন আমাদের মা’কে কি দরকার”।
অচ্যুত উঠে পড়লেন। অতীন বললো, “বাবা, খাবার ছেড়ে উঠো না”।
“এসব শোনার পর থাকা যায়? তোদের মায়ের নামে কী বললো ও ……”। অচ্যুত হাত ধুলেন।
“এসব লোকের মুখের কথা শুনিস না, ছোট খোকা। সে আমার এতগুলো বছরের বিয়ে করা বৌ। আমার সব দোষ ত্রুটি জেনেও ছেড়ে যায়নি কখনো। তাকে অন্য কারোর সাথে এভাবে ……”।
অনুপম হাসলো, “খেয়ে নাও, বৌ নিয়ে এতো ইমোশনাল হতে নেই। নাকি রাগটা পরীর পাওনা অর্ধেক হয়ে গেল তাই!” "তোরা খা।"অচ্যুত চলে গেলেন।অতীন রেগে গেলো এবার," মাকে নিয়ে এগুলো কেমন কথা,ভাই?" "মায়ের বাড়াবাড়িটাও কম কী?সারাজীবন তো দাদাভাইকেই প্রায়োরিটি দিলো, যাদের জন্ম দিয়েছে তাদের চেয়ে।সেই নিয়ে জেঠিমণির ক্ষোভ ছিলো।সেই ক্ষোভেই তো সংসারটা ভাঙলো।" “বাবিনটা এসেছে – “, “আরে রাখো তোমার বাবিন,গাল গল্প যতো”।
অনুপম বিরক্ত হয়।অতীন কথা বাড়ায় না।ওর ছোটভাই বদমেজাজি, রাগী। ব্যবসায় মন কোনদিনই ছিলো না। মদ, গাঁজা, নারী সঙ্গ বরাবরই ছিলো – এখনো আছে। আবার বৌ পেয়েছে খুব ভালো। পরমা অশান্তি করে না খুব একটা। মেনে নেয়। বংশের মধ্যে এই নেশা ভাঙের দোষ কেবল অনুপমেরই আছে। নারীসঙ্গ বাবারও ছিলো – কানাঘুঁষো শোনা যায়। জেঠার তেমন কিছু শোনেনি অতীন। তবে চাকর বাকর মহলের গসিপে একবার ওদের ঠাকুরদার গ্রাম ছাড়ার পিছনে অবৈধ সম্পর্কের জের ছিলো, শুনেছিলো অতীন। কাউকে বলেনি। নিধুকাকার ছেলে তখন বেড়াতে আসতো মাঝে মাঝে। অতীনের বয়সী। অতীনের সাথেই খেলতো। ওর মুখেই শুনেছিলো জমিদারীর মধ্যেই কোন এক মেয়ের সাথে নাকি …… ঠাকুমা ঠারেঠোরে সবসময় বলতেন অনুপম ঠাকুদার মতো হয়েছে। ঠাকুরদা মারা যাবার মাস দশেক পরে অনুপমের জন্ম। ঠাকুরদা পুর্ণজন্ম মানতেন ঠাকুমা, বাড়ির অন্যরা সংস্কার ভাবলেও ঠাকুমার কাছে স্থির বিশ্বাস ছিলো। গ্রামে ঠাকুরদার করে আসা সব কুকীর্তি ঠাকুমা হয়তো জানতেন, হয়তো না। ঠাকুরমা গ্রাম যেতে চাইলেও ঠাকুরদা কোনদিন নিয়ে যাননি। পরে বাবা জেঠারাও গ্রাম নিয়ে গা করেননি আর। তবে ঠাকুমা মৃত্যু শয্যাতেও বারবার গ্রামের কথা বলতেন। স্পষ্ট মনে পরে অতীনের। নাতিদের মধ্যে অনুপমকে পছন্দ করতেন না একেবারেই। ঠাকুরদার মতো দেখতে বলে – নাকি অতিরিক্ত দুষ্টু বলে – নাকি ডাকাবুকো বলে – জানে না অতীন। তবে অনুপমের দু’চারটে অ্যাফেয়ার্স, কলেজে ইয়ার ড্রপ, মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা ঠাকুমাও দেখে গেছেন। ঠাকুমার মারা যাবার পরেই যখন সম্পত্তি দুভাগ হয়ে গেলো – ঠাকুমার স্ত্রীধন অনুপমকে বঞ্চিত করে কেবল অনিরুদ্ধ আর অতীনকে লিখে গেছেন ঠাকুমা – দেখা যায়। তখন আঠারো বছরের অনুপম কিছুই পায়নি। এই নিয়ে অনুপমের কম ক্ষোভ নেই। ঠাকুমার কোন কাজই করতো না – নেহাত মায়ের ভয়ে করেছে। আজ মা থাকলে এত বড় কথা বলতে পারতো না অনুপম। অতীন জানে না কেন মায়ের হঠাৎ এত আগলানোর প্রয়োজন বাবিনকে – কিন্তু অনুপমকে আগলানোর প্রয়োজনও ও অস্বীকার করতে পারে না। মায়ের শাসনের জন্যই ও এখনো সংসার করছে। দুই বাচ্চার বাবা হয়েছে। না হলে কবেই চুলোর দুয়োরে যেতো।
“দাদাভাই-“ অতীন ফোন করে অনিরুদ্ধকে।
“অতীন,এতরাতে? সব ঠিক আছে তো,ভাই?”
অতীন বারান্দায় পায়চারি করছিলো, বাবা নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পরীর মাও ছেলেকে নিয়ে ঘুমে কাদা।
“ঠিক আছে।অনুপম ফিরেছে আজ। মা অখানে শুনে বাবার সাথে অশান্তি করলো একপ্রস্থ”।
“ওহ”, “মা’কে বলতে হবে না”। “বেশ, বলবো না”।
“মা ঘুমিয়ে পড়েছে?” “না, সবে খাওয়া হলো”।
“বাবিন, পরী?” “দাদা, বোন মিলে খেলা চলছে”।
“ভালো মিলে গেছে না?” “খুব, বাবিন খুব কেয়ারিং বোনের প্রতি। পরীও দাদাভাই কে খুব ভালোবাসে”।
অতীন মনে মনে ভাবলো এ বাড়ি থাকতে নিজের দাদা বোনেও এমন ভাব দেখেনি। বুবলাই পরীকে হিংসাই করতো বেশ। মা – বাবার আদর ভাগ হয়ে যাবে বলে।
“পরী আমাদের কথা বলে তোমাদের কাছে?” সঙ্গীন প্রশ্নটা করেই বসলো অতীন। অনিরুদ্ধ মিথ্যাটাই বললো,
“বলে তো, এখন ঠাম্মা আছে বলে খুব খুশি”।
“বৌদিমণি এখনো সামলাতে পারছে না দুজনকে বলো, মা তাই থাকছে?”
অনিরুদ্ধ সত্যিটা লুকালো, “হ্যাঁ রে, নীরা আর একটু সুস্থ হোক। তোদের অসুবিধা হচ্ছে খুব, না?”
“আমার ঠিক নয়, তবে অনুপম খুশি নয় এতে। ওকে সামলাবার জন্যও তো মা’কে লাগে এখনো জানোই তো”।
“আর কয়েকটা দিন, অতীন, প্লিজ”।
অতীন হাসে, “দাদাভাই, ওভাবে বলছো কেন? মা তোমাকে আমাদের সাথে আলাদা করেছে কখনো?”
“তাও-“ “তাও আমার অনুমদি লাগবে? একেবারেই লাগবে না। মা যা বলবে তাই হবে”।
অনিরুদ্ধ খুশি হলো, “বড় হয়ে গেছিস অনেক”।
“তা হয়েছি বটে। বেশ বড় ব্যবসা সামলাচ্ছি যখন। দাদাভাই – একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? বাবিনকে নিয়ে”।
“কোথায় পেলাম ওকে তাই তো?”
অতীন হাসলো, “তোমার ইন্টেলিজেন্স একটা আলাদা লেভেলেরই”।
“পেয়েছি অতীন, কপালে ছিলো। পেয়ে গেছি। উপরি পাওনা ছোট্ট মেয়েটা। বেশ পরিপূর্ণ লাগে এখন, জানিস?”
“বুঝি।পরী জেঠুমণিই বলে?”
“হ্যাঁ, ডাক বদলাইনি। নীরার খুব ন্যাওটা, নীরাও কোল থেকে নামায় না”।
“বাবিনও তো বৌদিমণির চোখের মণি ছিলো বলতে পারো”।
“এখন বড়টা শান্ত অনেক। তাই ছোটটার প্রতি নজর বেশি”।
“পরী বলছিলো ওর দাদাভাই পড়াশুনাতেও ভালো?”
“হ্যাঁ, ফার্ষ্ট হয়”। “স্বভাবে মিলটা নেই তবে” অনিরুদ্ধ বললো।
“বড় হলে বদলায়ও, তাই না?” “তা বটে”।
“ওর স্কুলেরই একটা অরফ্যানেজে থাকতো এতদিন”। “মিশনারী?”
“হ্যাঁ, শিয়ালদহের কাছে”। “আচ্ছা, সেদিন ওর জন্য চকোলেট ছাড়া কিছু নেওয়া হয়নি আমার”।
“ওসব আবার কেন?”
“তাও, বড় কাকামণি বলে কথা”।
“বই আনিস আনলে, গল্পের বই পড়ে খুব”।
“তাই আনবো তবে। বাবা সেদিন বলছিলো বাবিনকে এ বাড়িতে এনে রাখবে কদিন”।
“নীরা ঠিক হোক আগে ছাড়বো”।
ফোন রাখলো অতীন। পরী কি দাদাভাইকে বাবা বলবে, কখনো? নাকি জেঠুমণি বলেই ভালোবাসবে,অতীনের থেকে অনেক বেশি করে। লাভক্ষতির হিসাবে মেয়েটাকে দিয়েছে অতীন। ওখানকার অর্ধেক পেলেও যে অনেক। কিন্তু আজ কেমন যেন ফাঁকাফাঁকা লাগছে। সব থেকেও কী যনেই মনে হচ্ছে, হঠাৎ। বিস্বাদ লাগছে অতীনের সব। হেমন্তের রাত, শিশিরের শব্দ, শিরশিরে হাওয়ার সাথে বুকে বিঁধছে যেন।
পর্ব – ৩০
সকাল সকাল অনুপমকে এ বাড়ি দেখে অবাক হলেন সুহাসিনী। এত সকালে তো ওঠে না সে। আজ রবিবার। আজ তো আরো দেরী হবার কথা।
“কী ব্যাপার? এত সকালে?”
নীচের তলার ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের আয়োজন করছিলেন সুহাসিনী। অনিরুদ্ধও ছিলো। পরী, বাবিন, নীরাও আজ উপরে ব্রেকফাষ্ট না করে নিচে এসে খাবে।
"দেখতে এলাম, কী করছো”।
সুহাসিনী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অনিরুদ্ধ কথা ঘোরালো।
“বস, ব্রেকফাষ্ট হয়ে গেছে”। “মণিপিসির কাজটা, কী মা করছে আজকাল?” সুহাসিনী চমকে উঠলেন।
“কী বলছিস এসব, অনুপম!”অনিরুদ্ধ বললো।
“তাইতো দেখছি, কোথায় সে, মণিপিসি?”
“অনি- তোমার ছোটভাইকে বলো বাড়ি যেতে”।
“কাকিমণি – রাগ কোরো না”। “দাদাভাই – ছোটবেলার নাটক এখনো চালাচ্ছ? মাকে তুমি থামাতে যাতে আমাদের না বকে। উল্টে মা বেশি করে আমাদের মারতো। কার কথায় জানি না ভাবছো?”
“ছোটোখোকা!” সুহাসিনী ধমকে উঠলেন। “খুব ভয় পেলাম”। অনুপম হাসলো।
“মণিপিসি কোথায় বললে না?” “গ্রামে গেছে”। “ওহ, সেই মুখার্জীদের বাগদেবীপুরের জমিদারী। বাপের জন্মেও যা দেখলাম না। ঠাকুরদা লোকটা সেই যে চলে এলো গ্রাম থেকে আর গেলই না ফিরে – আর সেই রাগে বুড়ি মরার সময়ও তার গয়না দিলো না আমায়”।
অনিরুদ্ধ আড়চোখে কাকিমণিকে দেখছিল। রাগে কাঁপছেন। যদি কিছু হয়ে যায়? ” অনুপম, ঠাকুমা ছিলেন উনি, আমাদের। কোনো বুড়ি নয়। আর তোর ব্যবহারে এখন দেখছি উনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন”। অনুপম থমকালো, দাদাভাই এত কড়া ভাবে বলবে ভাবেনি।
“ছোটবৌমা তো মা লক্ষ্মী। দুই ছেলের বাবাও হয়েছিস। তাও এসব কেন? ব্যবসা তো দেখিস না, জানি। বয়ে গেছিস শুনেছি।তবে এতোটা – ভাবিনি”। “দাদাভাই-“ “নে, চা-টা খা। উনি তোর মা আর আমার কাকিমণি হলেও তার সম্মানহানিকর কোন কথা যেন তোর মুখে না শুনি আর”। অনিরুদ্ধর গলায় শাসনের সুর ছিলো। এভাবে বহুদিন পর শাসন করলো দাদাভাই ওকে। অধিকার নিয়ে, ছোটবেলার মতো। অনুপম আর কিছু বললো না।একটু পর বললো,
“বাবিন এসেছে শুনলাম”। “হ্যাঁ, তবে এমন অভদ্র ব্যবহার করলে দেখা করাবো না। কাকা এমন উচ্ছন্ন দেখলে কি শিখবে!”
“আমি তো খারাপই। মুখার্জী পরিবারের ব্ল্যাকশিপ”। “ভালো হতে কে মানা করেছে শুনি?”
অনুপম চুপ করে থাকলো। “কাকিমণি বেশি করে খেতে দাও তোমার ছোটখোকাকে। কাল শনিবার রাত ছিলো, ছাইপাঁশ গিলেছে বাইরে নিশ্চয়”।
অনুপম মায়ের দিকে তাকালো, মা ভীষণ রেগে আছে। “সঙ্গদোষ”। সুহাসিনী বললেন।
“সঙ্গটা ঠিক করতে হবে এবার। কাকাকে বলবো আমি”। “তোমাদের আলাদা আলাদা খেলার পর কি এটা এক এক খেলা চলছে?”
অনিরুদ্ধ এবার হেসে ফেললো। “কাকিমণি দেখলে তো কেমন ছেলে মানুষ? কেন, এক হওয়া ভালো না?” "সেটা যারা আলাদা হতে চেয়েছিলো – তারা বলবে”। বলেই অনুপম থমকে গেলো। বৌদিমণি আসছে। পরীকে কোলে নিয়ে। সাথের বাচ্চাটা সত্যিই অবিকল বাবিন। এটা কী করে হয়! বাবিনকে তো পুড়িয়ে এসেছে ওরা সাবাই। ও নিজে ছিলো সেখানে।
“এটা কে বাবিন, জানিস?” অনিরুদ্ধ ইচ্ছা করেই বললো। অনিকেত তাকালো। ঠাম্মাকে মা বলতে শুনেছে একবার। বড় কাকামণিকে চেনে ও। তাহলে ছোট কাকামণিই হবে।
“ছোট কাকামনি, বাপি”। অনুপম অবাক হলো।
“চিনিস”? নীরা বললো, “হি ইজ ইন্টেলিজেন্ট, ক্যাল্কুলেট করেছে”।
“বাহ, বৌদিমণি – শান্তও তো, বেশ”।
“হ্যাঁ, মামণির চোখের সামনে একটু বেশিই শান্ত। পিছন ফিরলেই বোনের সাথে হুটোপুটি ”।
অনুপম কাছে ডাকলো, “এদিকে আয়”। অনিকেত মামণির দিকে তাকালো, “যাও, কাকামণি তো”।
অনুপম কোলে বসালো, খুঁটিয়ে দেখলো ওকে। “দাদাভাই, অবিকল …”। অনিরুদ্ধ চোখের ইশারা করলো। অনুপম বুঝলো বাচ্চাটাকে বোঝানো হয়েছে ও-ই বাবিন।
“বাবিন কোন স্কুলে পড়ে?” অনিকেত নামটা বললো।
“পার্কষ্ট্রিটে?” “না – শিয়ালদহরটা” অনুপম থমকালো। “বেশ বড় স্কুল তো …” অনিরুদ্ধ বললো।
“হ্যাঁ, তা বড়ো”। “ওদের একটা অরফ্যানেজ আছে না?” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লো। “হ্যাঁ, তুই চিনিস?” "না, ওই রাস্তায় যেতে আসতে দেখেছি”। “ওহ!” “ছোট কাকামণি-“ অনিকেতের ডাকে তালালো অনুপম, “হ্যাঁ, বাবিন?” অনিরুদ্ধ, সুহাসিনী, নীরা খুশি হলো। অনুপম ভুল করেনি তবে, মুখ ফস্কায়নি।
“বোন গল্প করেছিলো – তুমি নাকি ওদের সাথে খেলোও বাড়িতে!”
অনুপম মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ, তা খেলি, আমার তো আর তেমন কাজ নেই”।
পরী বলে উঠলো, “সানডেতে মাস্ট খেলে”।
“পাকা বুড়ি আমার”। অনুপম হাসে, “পরী,এখানে ঠাম্মা, জেঠুমণি জেঠিমণি খুব মজা না?”
“দাদাভাইও”। পরী মাথা নাড়ায়। “ওখানেও তো তোর দুটো দাদা আছে”। অনুপম জানতে চায়।
“ছোট কাকামনি – তুমি জানোই না কিছু।আমার দাদাভাই বেষ্ট”।
“বাবিন দাদা?” “নাম ধরে বলতে নেই। জেঠিমণি বলেছে”। নীরা হেসে ফেলে, “দাদা বোনে খুব মিল।"অনুপম অনিকেতের মাথায় হাত রাখে, “বোন ভালো?” “বোন তো বোনই ছোটকাকামণি, ভালো আর মন্দ কি?” অনুপম হেসে ফেলে, “কথার মার প্যাঁচ আছে। মায়ের মতো উকিল হবি?”
“না, ডাক্তার। ডাক্তারদাদুর মতো”। অনুপম থমকায়, বাকিরা হাসে।
ডাক্তারকাকা তার মানে প্রায়ই আসেন, এখানে। “ছোট কাকামণি – চলো না, খেলবে”।
পরী বলে, অনুপম খারাপ লাগাটাকে গিলে নেয়। ওকে সত্যি গুলো জানতে হবে, হবেই।
পর্ব – ৩ ১
“কেমন বুঝলেন?” ডক্টর চক্রবর্ত্তীর চেম্বার থেকে বেরোবার আগে প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ৷।কাকিমণি নীরাকে নিয়ে বেরিয়েছেন চেম্বার থেকে। বাইরে নীরার মা, বাবার কাছে বাচ্চারা রয়েছে। এখন চেম্বারে শুধু অনিরুদ্ধ আর রুদ্রদেব।
“কাজ করেছে ওষুধ”। “ওষুধ ?” রুদ্রদেব বললেন।
“প্ল্যানটার কথা বলছি। এখন মেডিসিনের ডোজ কমানো যায়”।
“বন্ধ করা যাবে না?” অনিরুদ্ধ হতাশ হয়।
“ডোন্ট জাম্প দ্যা গান, ট্যাপার করে বোধ করতে হয়। নাহলে সমস্যা।আই মিন, ডোজ আসতে আসতে কমাতে হবে”।
“ওহ”। “তবে, এখনো কিন্তু বাবিন বলে মানে না”। ডক্টর চক্রবর্ত্তী বললেন। অনিরুদ্ধ অবাক হলো, “বললো?”
“হ্যাঁ, সবই জানে, ওর নাম অনিকেত, অরফ্যানেজ থেকে এসেছে। তবে বাবিন যে আর ফিরবে না এটা মানতে শুরু করেছে”।
“এতো যত্ন করে – বাবিন নয় জেনেই!” রুদ্রদেব নিশ্চিত হতে চাইলেন।
“হ্যাঁ, সবার খুশির কথা ভেবে, তবে একটা ভালো ব্যাপার যে – হারাতে চায় না। আগলাতে চায়”।
“ওষুধ কতদিনে পুরো বন্ধ করা যাবে?” “মাস তিনেক”। “বেশ”, রুদ্রদেব বললেন।
“মিষ্টার মুখার্জী – ঐ এভিলের ব্যাপারটায় কিন্তু খুব চিন্তিত রয়েছেন ম্যাডাম”।
“আমরা সবাই – ই, ডক্টর”। “অনিকেত?” “ভয় পেয়েছিলো খুব”। “ওকে একা শোওয়াবেননা আর। কল্পনা হলেও ……”
“না, শোওয়াবো না। নীরা এ ব্যাপারে খুব কনশ্যার্নড”।
“নীরা আপনাকে সহ্য করছে, আইমিন ………”। রুদ্রদেব বুঝলেন।
“অনি, তুই কথা বল, আমি দেখি তোর কাকিমণি কি করছে”।
রুদ্রদেব গেলে অনিরুদ্ধ বললো, “কোয়াইট নর্মাল এখন”।
“সেক্সুয়ালি?” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লো। “আমিই এগোইনি।” “সে কি! প্ল্যনডওয়েতে এগোন।ডেফিনিটলি উইথ কন্ট্রাসেপশন। প্রত্যাখ্যান করবে না”। অনিরুদ্ধ কিছু বললো না।
ফেরার পথে অনিরুদ্ধ, নীরা বাচ্চাদের নিয়ে একগাড়িতে উঠেছিলো। নীরার মা,বাবা বেরিয়ে গেছেন। কাকাবাবু আর কাকিমণিকে অন্য একটা গাড়িতে তুলেছে ওরা। স্পেস দেবার জন্য। অনিকেত গাড়িতে উঠেই ভাবছিলো মামণি কি বোনকে কোলে নিয়ে বসবে – অমনি ডাক শুনলো।
“এই বাঁদর, সামনে নয়, পিছনে অ্যায়”। অনিরুদ্ধ হাসলো।
“বাঁদর আর কোথায়? শান্ত ছেলে তো তোমার নীরা”।
“তুমি জানো না অনি, বাড়িতে থাকো কতটুকু? বাঁদরটাকে চেনো?উপরে ভালোমানুষি,ভিতরে দুষ্টুমি ভর্তি।”
অনিকেত মনে মনে খুশি হলো। মামণির কাছে ও বসবে তবে। বাপি বোনকে কোলে নিয়ে বসলো। অনিকেত বাপি আর মায়ের মাঝে।
“নীরা, একটু দুষ্টু হওয়া তো ভালো”। নীরা হাসলো, “আগে উল্টোটা বলতে”।
অনিরুদ্ধ থমকালো, অনিকেতকে ঝুঁকে চুমু খেলো।
“মামণির কোলে চড়ে বস, জানলা পাবি না নাহলে”। “মামণি ডাকেনি যে বাপি”।
“নীরা – ডাকোনি বাবিনকে? ভারী অন্যায়” । নীরা কোলে নিলো। “কট কট করে কথা খুব, না?”
অনিকেত ঘাড় নাড়লো। “না তো, মামণি”। নীরা চুমু খেলো ওকে।
“অনি, চলো না – একটু বাইরে কোথাও বসি”। অনিরুদ্ধ অবাক হলো, “যাবে তুমি?”
“হ্যাঁ, বাচ্চারা প্রথম এসেছে তো আমাদের সাথে বাইরে, চলো না”। “কিন্তু বাড়ি?” “কাকিমণিরা যাচ্ছে তো”।
অনিরুদ্ধ নীরা কে বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরলো। ঝুঁকে চুমু খেতে যাচ্ছিলো নীরার কটমট করে তাকানো দেখে সামলে নিলো। ছেলেটাকে চুমু খেলো তার বদলে”।
“জেঠুমণি –আমরা ডাইন আউটে যাবো?”। “হ্যাঁ পরী, ডাইন আউট করা হবে আজ”।
“কী মজা!” পরী লাফিয়ে ওঠে। অনিকেত চুপ করে থাকে, ও এসবের কিছু বোঝে না। ডাইন আউট মানে কি …। "আমরা বাইরে খেতে যাচ্ছি ডিনার”। নীরা বুঝতে পেরেই কানে কানে বলে।
“কোথায় মামণি?” “দেখি, বাপি আমাদের কোথায় নিয়ে যায়”।
অনিকেত চুপ করে থাকে, বড় হোটেলে যাবে ওরা? হোটেলেই তো খাবার পাওয়া যায়। নাকি কী বলে একটা – রেস্টুরেন্ট।
“নীরা তোমার মেডিসিনের ডোজ অনেক কমেছে, জানো?”
“জানতাম, ওসব এখন থাক অনি, বাচ্চা দুটোকে একটু ঘুরিয়ে নিই”।
অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরার মাতৃত্বভাব ফিরে এসেছে, আবারো, ও এটাই সবচেয়ে বেশি করে চেয়েছিলো।
পর্ব – ৩২
“এই অঙ্কটা ভুল হলো কী করে?” নীরা ম্যাথ টেষ্টের খাতা দেখছিলো।
“ব্র্যাকেটের কাজটা আগে, হবে, জানিস না?”
অনিকেত স্কুল থেকে ফিরেছে সবে। মামণি জানতো আজ ম্যাথ টেস্টের রেজাল্ট দেবে। চেঞ্জ করাবার আগেই তাই খাতাটা নিয়ে বসেছে। বোন ঘুমোচ্ছে, ঠাম্মাও নেই। ও বাড়ি গেছে।বাপির ঘরে ওদের পড়ার টেবিল চেয়ার রাখা। ওখানে বসেই খাতা চেক করছে মামণি। অনিকেত ভয়ে কাঁপছিল।
“কী রে, বল?” “করেছি তো মামণি” “তাহলে?”
“টুকতে ভুল হয়েছে, মামণি। গুণ টুকেছি, ভাগ ছিলো”।
নীরা দেখে এবার। তাই তো! মাল্টিপ্লিকেশন টুকেছে, ডিভাইডেড বাই – এর জায়গায়।
“মন কোথায় থাকে?” অনিকেত চুপ করে থাকে।
“ক্লাস টেস্টে দুটো নম্বর, গেলো তো?” অনিকেত কিছু বলে না।
“আমি কোয়েশ্চেন টুকে মিসকেও দেখিয়ে ছিলাম মামণি – মিস কিছু বললো না …”।
একটু পরে কথা বলে অনিকেত। নীরার গা জ্বলে ওঠে। ঐ অসভ্য মেয়েটা কী-ই বা বলবে, সে আসুক আজ। ধরবে। নীরা অনিকেতের কান ধরলো। ভালো করে কানমলা দিলো।
“নিজে নেলাবি এবার তেকে”। “হ্যাঁ, মামণি”। অনিকেত বললো।
নীরা একবার ভাবলো ছেড়ে দেবে, পরক্ষনেই ভাবলো অমনোযোগের জন্য শাস্তিটা দেওয়া উচিৎ।
“এত কেয়ার লেস হয়েছিস যখন পানিশমেন্ট পাবি। কান ধর”।
অনিকেতের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিলো, তাও কান ধরালো।
“উঠবোস কর”। অনিকেত করুণ চোখে তাকালো।
“নিজে দেখে টুকিসনি যেমন, মেলাসনি যেমন – উঠবোস কর – এর পর থেকে মেলাতে মনে থাকবে”।
অনিকেত উঠবোস করতে শুরু করলো। খাতা পেয়েই ও জানতো বাড়ি এসে মামনির কাছে উঠবোস খাবে। ওর নিজেরই খারাপ লাগছিলো, দুটো নম্বর, ইস! বোনের সামনে খাচ্ছে না – এটাই ভালো।
“বৌমা –“, মণিদিদার গলা শুনে তাকালো অনিকেত। “হ্যাঁ মণিপিসি-“
অনিকেত থেমে গিয়েছিলো।
“তুই থামলি কেন বাঁদর ছেলে? তোকে থামতে বলেছি?” “বাবিন – খাবে না?”
“খাবে, চেঞ্জ করিয়েই খাইয়ে দেবো”।
“ছোট বৌদি আসতে দেরি হবে?”
“হ্যাঁ মনে হয়। চিন্তা করবেন না। আমি খাইয়ে দেবো”।
“আচ্ছা, বলছি – অনেক বকেছো। ছেড়ে দাও। তুমি তো বকোই না ওকে। দেখো, মুখটা শুকিয়ে গেছে বাচ্চার” ।
“দেবো, এখন বড় হয়েছে তো পিসি, বকতে হচ্ছে, না হলে বাঁদর হয়ে যাবে। আপনি বিশ্রাম করুন”।
মণিদিদা গেলে মামণি আবার অনিকেতকে ধরলো। “থেমে এখনো?”
অনিকেতের চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো, মণিদিদাও দেখে ফেললো। লজ্জা লাগছিলো ওর। নীরা সেটা বুঝে ওকে কাছে ডাকলো।
“ঠিক করে টুকবি তো এবার থেকে, মিলিয়ে?”
“হ্যাঁ, মামণি”।
নীরা কানটা আবার মুলে দিলো ভালো করে। চোখ মোছালো তারপর।
“আর করব না”। অনিকেত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, নীরার মায়া করলো। কোলে তুলে বসালো।
“বেশ, করলে এবার মার লাগাবে মামণি।”
অনিকেত মামণির বকুনি খেয়ে মামণিকেই আঁকড়ে ধরলো। “আর হবে না”।
নীরা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলো। “চেঞ্জ করে, খাবি চ”।
“দুটো নাম্বার বাদ যাওয়ার মানে জানা আছে?” শাওলিকে কড়া ভাবে বললো নীরা।
“আমি খেয়াল করিনি, বৌদি”।
“খেয়াল করোনি, বাহ। কী জন্য গুচ্ছের টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে তোমায় যদি এমন রেজাল্ট হয়?”
শাঁওলি অনিকেত পরীকে পড়িয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, বেরোবার মুখে বৌদির প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছে ওর। খুব খারাপ লাগছে। ফাদার না বললে আর অনিদা না থাকলে ও আসে এখানে? অনিদার বৌ – এই মহিলা অত্যন্ত অহংকারী, পয়সার ভীষণ গরম।
“তোমার এই না দেখতে পাওয়ার জন্য যদি র্যা ঙ্ক পিছিয়ে যায় – তোমাকে দেখে নেবো আমি”।
নীরা ইচ্ছা করেই বললো, মেয়েটা অপমানিত হয়ে যদি কাল থেকে না আসে, তাহলে বাঁচবে।
“সরি, বৌদি ……”।
“আর এত লোয়ার ক্লাসের মতো বৌদি বলো কেন? ম্যাডাম বলবে, অনিদা – বৌদি … এসব কী? প্রফেশনালিজম – এর পি – ও নেই”।
শাঁওলির চোখ ফেটে জল আসছিল। এতটা অপমানিত ও জীবনেও হয়নি।
“আসছি ……”।
“অনিরুদ্ধই ভুল আসলে, বন্ধুর বোনকে দেখতে গিয়ে ক্লাসটা বজায় রাখতে পারেনি”।
শাঁওলি ছুটে বেড়িয়ে চলে গেলো। আর কিছু শুনবে না ও। শোনার ইচ্ছা নেই, একেবারেই নেই।
অনিরুদ্ধর ফিরতে রাত হয়েছিলো আজ। প্রায় সাড়ে ন’টায় ফিরেছে। সারাদিন মিটিং ছিলো, ক্লান্ত ছিলো খুব তার মধ্যে শাঁওলির টেক্সট, সেই সুত্রে ফাদার অগাষ্টিনের ফোন – মেজাজটাও ঠিক ছিলো না, নীরা আজ যা নয় তাই বলেছে নাকি শাঁওলিকে। অভিমানী মেয়েটা কেঁদেকেটে একশা। বাবিন একটা অঙ্ক ভুল টুকেছে বলে ওকে বকার কী আছে কে জানে। ফাদার শাঁওলির কমপ্লেন পেয়ে নীরার মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন তুলে ফোন করেছিলেন একটু আগে। এমন হলে তো অনিকেতকে রাখাটাই সম্ভব হবে না। এখনো পেপার ওয়ার্কস হয়নি – সবে মাস খানেক হলো ছেলেটা এসেছে – চেঞ্জ করে দোতলায় ডাইনিং – এ গিয়ে অবাক হলো। কাকাবাবু চলে এসেছেন। চেম্বার তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেছে, নাকি?
“অনি – চলে এলাম, তাড়াতাড়ি”।
অনিরুদ্ধ হাসলো, “ভালো করেছো। চেম্বার?” কাকাবাবু হাসলেন।
“একটু ফাঁকি দিলাম আর কি। তোর কাকিমণি তো বলেই চলেছে – ছেলেটা ফেরেনি – তুমি যাও – নীরা একা ……”। “ফোনে?” “নাহ, হোয়াটস্যাপ”।
অনিরুদ্ধ মুচকি হাসলো। “বাহ”।
“নীরা আমি এসেছি দেখেই রান্নাঘরে ব্যস্ত। বললাম কত করে …”।
“ঠিকই তো করেছে। বাচ্চারা কোথায়?”
“তারা মা’কে ছাড়ে? সারাক্ষণ মায়ের আগুপিছু ঘুরছে। ঐতো এসে গেছে সব-“
নীরা এলো, সাথে বাবিন আর পরীও।
“ডিনার রেডি, অনি খাবেতো?”
অনিরুদ্ধ নীরাকে এখন কিছুই বলবে না, আলাদা ভাবে বলবে। “দাও”।
“পরীকে খাওয়াতে পারবে তো?”
“দুটোকেই খাইয়ে দেবো”।
বলেই বাবিনের দিকে তাকালো অনিরুদ্ধ। বুঝলো তার মামণির হাতে খাবার ইচ্ছা। নীরা সেটা বুঝে বললো, “না – বড়টাকে আমি খাওয়াচ্ছি”।
“নীরা – একা সার্ভ করবে – খাওয়াবে - - আমি হেল্প করি?”
“এমা! কাকাবাবু, একদম না, আমি পারবো, এখন তো অনেক সুস্থ, শুনলেন না?”
অনিরুদ্ধ বললো, “কাকাবাবু, আমি হেল্প করছি নীরাকে”।
“থাক, সারাদিন খেঁটে খুটে এলে …”।
“তাতে কী? অনি যা হেল্প কর”। রুদ্রদেব বললেন।
খেতে খেতে রুদ্রদেব কথাটা তুললেন, “অনি, তোরা গ্রামে যাসনি কখনো, তোর বাবা কাকা ও না, তাই তো?”
“নাহ, ঠাকুমা চাইতেন খুব ঠাকুরদা নিয়ে যেতেন না”।
“হুম, নিজেও যেতেন?”
“মনে হয় না, আর গেলেও খুব কম। বাবা কাকাও তো শহরেই মানুষ”।
“অন্য শরিকরা আছে ওখানে?” “হ্যাঁ, ঠাকুরদার দাদার বংশ”। “যোগাযোগ?”
“নেই বললেই চলে। কেন বলো তো? অভিশাপের ইতিবৃত্ত খুজছো?”, রুদ্রদেব বললেন।
“খোঁজা তো উচিৎ, না হলে দোষী ধরা পড়বে কী করে। গ্রামের সাথে যোগাযোগ আছে এমন কেউ আছে?”
নীরা বললো, “মণিপিসি, নিধু কাকা-ই তো গ্রামের”।
“ও হ্যাঁ, তাই তো, ওদের থেকে জানতে হবে গ্রামের ব্যাপারে, ডিটেলে”।
“নিধুকাকার ছেলেরাও তো গ্রামেই থাকে।
মণিপিসির ভাই বিপ্লবও”। “তাই? মণি ক’দিন আগেই গ্রামে গিয়েছিলো না?”
নীরা বললো, “হ্যাঁ, পরশু এসেছেন”।
“এই তো, ওর থেকেই পুরোটা জানা যাবে, এখন গ্রামটা কেমন, কে কে থাকে – অনি, এই যে কোলাপসিবল বন্ধ হচ্ছে রাত দশটা বাজলেই – এটা নিয়ে চাকর বাকরদের কোন রিএকশন?”
“অবাক বুঝছি, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না”।
“পিছনের ঐ ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে ছিলি?”
“হ্যাঁ, জমাদার করছে, ভয় পাচ্ছিলো সব আয়োজন দেখে, করতে রাজি হচ্ছিলো না। শেষে হাতে শ পাঁচেক গুঁজে –“
“যার সাধনা ক্ষেত্র ঘরটা সে চটে থাকবে এতে”।
“এভিল, দাদুভাই?” অনিকেতের কথায় থমকালো সবাই। নীরা জড়িয়ে ধরলো,
“না, এভিল নয়, তুই খা, শুবি তারপর”।
“আজ ডাক্তার দাদুভাই – এর সাথে শোব, জেঠিমণি?”
“একদম!” রুদ্রদেব হাসলেন, “দাদুভাই আর পরী শোবে, অনিকে নেবো আমরা?” “জেঠুমণিও শোবে।“
“আর দাদাভাই?” “এই দাদাভাই- শুবি?” অনিকেত মামণির দিকে তাকালো।
“না, পরী, দাদাভাই আরটু পড়বে, তুই শুয়ে পড়”।
রুদ্রদেব বুঝলেন নীরা অনিকেতকে কোলছাড়া করবে না।
“দাদাভাই এর খালি পড়া”। “তুই বড় হ- তোর ও হবে”। অনিরুদ্ধ বললো।
“হলেও। জেঠিমণি তো আমাকে বকেই না। উঠবোস তো আর খাবো না।“ বলেই দুষ্টু হাসলো পরী।
অনিকেত লজ্জা পেল। নীরা পরীকে বললো, “জলদি খেয়ে নে। না হলে এখনি বকবো”।
অনিকেত মামণিকে জড়িয়ে ধরলো দুহাতে। রুদ্রদেব আর অনির চোখ চাওয়া চাওয়ি হলো, অনিকেত আর ওর মামণির ভালোবাসার বাঁধন জোরালো হচ্ছে, তবে।
“বাবিন ঘুমোলো?” অনিরুদ্ধ এসেছিলো নীরাদের ঘরে। কাকাবাবু আর পরী ঘুমিয়ে গেছে। “সহজে ঘুমোয়? গল্প বলে বলে”।
“বকেছো, আজ?” “কই, না তো?” “বিকালে?”
“ওহ, সে স্কুল থেকে ফিরতেই। অঙ্ক পরীক্ষায় কম পেয়েছে। দু নম্বর। প্রশ্ন থেকে টুকতে ভুল”।
“আগে তো কতই করতো”, অনিরুদ্ধ বলে।
“সে আগে, এখন করুক চাই না, র্যা ঙ্কটা যাবে”।
অনিরুদ্ধ সোফায় বসলো, “ফাদার ফোন করেছিলেন”।
“ফাদার?” “যেখানে বাবিনকে রেখে ছিলাম”। “ওহ, যেখান থেকে নজরদারি করতে ঐ মেয়েটাকে পাঠায়”।
অনিরুদ্ধ বুঝলো শাঁওলিকে নীরা ভীষণ অপছন্দ করে। “ও প্রতীকের বোন”। “হোক। দু’মাসের পর আসবে না”।
“হয়তো কাল থেকেই আসাবে না – তুমি যেমন ভাবে বলেছো”।
“সেটা বলেও দিয়েছে তোমাকে? বাহ”।
“ও কেন বলবে? ফাদার বলেছেন। দেখো নীরা- বাবিনকে ওরা নিয়ে যাক এটা আমি চাই না যেহেতু কাগজ হয়নি কোনো।“
“বেশ, তার জন্য কী করতে হবে? ক্ষমা চাইতে হবে মেয়েটার কাছে?”
“নীরা – এভাবে বলছো কেন? শান্ত হয়ে শোনো”।
“কী শুনবো অনি, কি শোনার আছে?”
“উত্তেজিত হত না, ষ্ট্রেস ভালো নয় তোমার জন্য”।
“হচ্ছি না অনি, শুধু জবাব চাইছি, তোমার তো কত বন্ধু। তাদেরও বোন আছে। তাদের মধ্যে এর সাথে এত ঘনিষ্টতা কেন?”
নীরার কথায় আহত হলো অনিরুদ্ধ। “কী বলতে চাইছো?”“তুমি বুঝতে পারছো না?”
“না, খোলাখুলি বলো”। “মুখার্জী বাড়ির ছেলেদের বাড়ির বাইরে মন বেশি থাকে।
এটা আমার মা’কে বিয়ের আগে সবাই বলেছিলো। বিয়ে হয়ে এসে থেকে অনুপমকে দেখছি। শুনেছি কাকাও নাকি এমনই ছিলেন। তুমি তো তেমন ছিলেনা। নাকি দেড় বছর আমাকে না পেয়ে –“ অনিরুদ্ধর বুকে তীরের মতো বিধলো কথাগুলো,
“নীরা – সবাই ঠিকই বলে। ইউ আর সিক। নিজের স্বামীকে চেনোনি এত বছরেও। যে অভিযোগ করলে তার কোনো সারবত্তা নেই। তবে কোন সাফাই আমি দেবো না, ঘুমাও”।
অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো, নীরা ওর হাত টেনে ধরলো। “কী হলো?”
নীরা উঠে দাঁড়ালো, অনিরুদ্ধর মাথাটাকে টেনে নামিয়ে আনলো নিজের দিকে। অনিরুদ্ধর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো।
“নীরা ……”। “কোন কিন্তু নয় –“ গভীরভাবে অনিরুদ্ধকে চুমু খেলো নীরা, অনিরুদ্ধ বুঝলো এটা বিশ্বস্ততার পরীক্ষা। “কী হলো – এসো – দেড় বছর – অনেক বড় সময় অনি। আমি জানি এর মধ্যে বহু কষ্ট পেয়েছো তুমি, বলতে পারোনি”। নীরা অনিরুদ্ধকে চুমু খেতে খেতে বলতে থাকে কথা গুলো। অনিরুদ্ধ জানে নীরাকে থামাতে হবে। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। নীরার মাথায় হাত রাখলো।
“পেরেছি, তবে তার জন্য অন্য কারোর দিকে যাবো, এমন ভাবলে কী করে?”
“ওসব ছাড়ো, তোমার পাওনা – নেবে না?” “পাওনা?”
“ও এলে নেবে বলেছিলে?” অনিরুদ্ধ বুঝলো বাবিন ফিরে আসার কথা বলছে নীরা।
“নেবো, তুমি আর একটু সুস্থ হও। ওষুধটা বন্ধ হোক। এখন পারবে না।" নীরা অভিমানী চোখে তাকালো, “খুব পারবো, তুমি এড়াচ্ছো অনি, এসব করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছো খুব”।
অনিরুদ্ধ নীরার সারা মুখে চুমু খেলো, “এড়াচ্ছি না”।
“তাহলে?” নীরা আবারো অনিরুদ্ধকে আদর করতে শুরু করলো, ঘাড়ে, গলায়, বুকে …… অনিরুদ্ধ বুঝলো এবার ওর শরীরও জাগছে । বহুদিনের না পাওয়া পেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এই ওষুধগুলো চলাকালীন – কোনো প্রোটেকশন নেওয়া নেই – নীরা কনসিভ করে গেলে …… নানা কথা মাথায় ভিড় করছে।নীরার কোমর জোরে জড়িয়ে ধরলো অনিরুদ্ধ, আগে সন্দেহটা মেটাতে হবে। শাঁওলিকে নিয়ে নীরা ইনসিকিওরড বলেই এমন বিহেভ করে শাঁওলির সাথে। নীরা অনিরুদ্ধর এগিয়ে আসায় ভীষণ খুশি হচ্ছিলো মনে মনে। তার মানে ও যা ভেবেছে ভুল। অনি ওরই। নীরার প্রতি , নীরার অসুস্থতার প্রতি কোন বিতৃষনা নেই ওর।
“মামণি!” অনিকেতের ডাকে চমকে উঠলো অনিরুদ্ধ।ছেলে জেগে গেছে? নীরার দিকে তাকালো, ওর রিয়াকশনটা দেখা জরুরী। আগে এমন হলে অনিরুদ্ধ বিরক্ত হলেও নীরা ছেলের কাছে তৎক্ষণাৎ চলে যেতো, কিন্তু এখন কি করবে? নীরা অনিরুদ্ধর বাহুবন্ধন এক ঝটকায় সরালো। খাটের দিকে গেলো। বসলো।
“এই তো আমি”। “কই?” অনিরুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলো নীরা কী করে।
“এই যে, ঘুম ভেঙে গেলো?” অনিকেত উঠে বসলো।
“বাপি?” অনিরুদ্ধ মনে মনে ভাবলো বাবিন জেগে উঠে ভালোই হয়েছে।
“হ্যাঁ, বাবিন। আমি।” “এখানে শোবে?” অনিরুদ্ধ বললো, “হ্যাঁ, আজ শোব”।
নীরা ছেলেকে কোলে নিলো। “ভয় পাচ্ছিস?” “না তো”। “তবে?”
“তোমাকে খাটে পেলাম না যে”। নীরা হেসে বললো, “বাপির সাথে কথা বলছিলাম। চল, হিসি করে শুয়ে পড়বি”।
অনিরুদ্ধ হাত বাড়ালো, “দাও, আমাকে দাও, হিসি করিয়ে আনি”। অনিরুদ্ধ কোলে নিলো অনিকেতকে। বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে এনে খাটে শোয়ালো।
“আজ বাবিন,বাপি-মামণির মাঝে, একা। তাই না নীরা?”
নীরা নিজেকে সামলে নিয়েছিলো, অনির ব্যাপারে কিছু জানার বাকি নেই ওর। শুয়ে পড়লো।
“তাই তো, অন্যদিন তো বোন থাকে”।
“বোনকেও আনো”।
অনিরুদ্ধ হাসলো, “না, আজ কেবল বাবিন, মামণি আর বাপি”।
নীরা ছেলেকে বললো, “আয়”, অনিকেত নীরার কোলের মধ্যে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো নিমেষে। অনিরুদ্ধ ঘুমন্ত অনিকেতকে আদর করলো।
“এভাবে ঘুমায়? জড়িয়ে ধরে?”
“হ্যাঁ, রাতে মামণির কোল না হলে চলে না।অনি-“, বলো”। “তোমার খারাপ লাগলো?”
অনিরুদ্ধ অবাক হলো, “কেন?” “জেগে গেলো যে-“ “না তো”।
“আগে তো বিরক্ত হতে”, “সে আগে, এখন আমারও বাবা হিসাবে বয়স, ম্যাচিওরিটি দুটোই বাড়ছে, না?”
“সরি”। “কেন, সোনা?” “ওভাবে বললাম”।
“ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করিনি। আমি কেমন – তুমি তো জানো, বোঝো। শাওলিকে নিয়ে বৃথা সন্দেহ করো না, ওর আসাটা একটা কমপালসন, এর বেশি নয়। প্লিজ আর একটা মাস কাটিয়ে দাও – প্লিজ। বাবিনকে হারাতে চাই না আমি আর”। নীরার হাত ধরে বললো অনিরুদ্ধ। নীরা বুঝলো,
“খুব ভালোবাসো?” “বাসবো না?” অনিরুদ্ধ চোখ মুছলো,“তুমি বাসো না?”
“না বাসলে এভাবে আগলাই?” অনিরুদ্ধ ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।
“ওর তোমাকে পেলে আর কাউকে চাই না”।
“শাসন করি বলে রাগ করো না তো?”
“না, না, রাগের কী আছে?”
“আগের বার করিনি বলেই তো পালিয়ে গেলো ও, অনি, এবার তাই-“ অনিরুদ্ধ নীরার কপালে চুমু খেলো।
“বেশ, তবে খুব ভালো ছেলে ও। বেশি বকতে হবে না, দেখো”।
“অনিকেত, নামটা ভারী পছন্দের আমার। তোমার সাথে মেলেও”। অনিরুদ্ধ চুপ করে শোনে।
“কোন প্রাণে যে এমন ফুটফুটে ছেলে ফেলে যায় লোকে, অনি”। “আমারা নিয়ে নিলাম যে?”
“ঠিক, কেউ না ফেলে গেলে আমরা পেতাম কী করে”। নীরা চুমু খায়।আবারো অপলকে তাকিয়ে থাকে।
“কী এত দেখছো?”
“এত মিল অনি – এত – কী করে!! আমি তো সারাদিন সেটাই দেখি”। অনিরুদ্ধ নীরার কপালে,মাথায় হাত বোলায়।
“সবই তার ইচ্ছা, আমিতো ভাবিইনি – এমনটাও হতে পারে”।
“মিরাক্যল!ও এসেই কেমন বদলে দিয়েছে সব বলো? বাড়িতে সবসময় হৈ চৈ – লোকজন – আনন্দ – এ বাড়ি ওবাড়ির মিল – যাতায়াত”।
“ভালো লাগছে তোমার?”
“খুব, বাঁচতে ইচ্ছা করছে আবার, মাঝের দেড় বছর করতো না”।
“সবচেয়ে কখন ভালো লাগে?”
“যখন কানমলা খেয়ে, উঠবোস খেয়ে, বকুনি খেয়েও একবার ডাকলেই কোলে উঠে যে মা ওকে এতক্ষণ শাস্তি দিলো তাকে জড়িয়েই কাঁদে - মামণি বলে যখন আধো, আধো গলায় ডাকে – তখন”।
অনিরুদ্ধ বললো, “কী সুন্দর করে বললে সোনা। নীরা – এবার তো সেরে উঠছো, কোর্টে যাওয়া শুরু করো”।
“যাবো, ফাঁড়াটা কাটুক”।
“ধরা পড়বে সে, মনে হয়?”
“পড়তে হবেই, অনি, না হলে বিপদ”।
“চেষ্টা তো করছি সবাই”।
“ঠিক সে কোন একটা ভুল করবে, একদিন”।
“লেটস হোপ ফর দ্যাট, নীরা, পরীটা মা বলুক চাও, তাই না?”
“চাই, তবে জোর করে না, নিজে থেকে”।
“আমিও চাই, বাপি বলুক, তবে দাদা বোনে খুব মিল”।
“খুব, তবে বড়টা একটু মায়েরর কোল বেশি চায়”।
“চাইবেই নীরা। ওরই মা”।
নীরা কিছু বললো না। অনিকেতের মামণি হতে পেয়ে খুশি ও। খুবই খুশি।
ভালো করে মানুষ করতে চায় ওকে। এবার, ফাঁক রাখতে চায় না কিছু তেই। ভালো মা ওকে হতেই হবে কাকিমণির মতো, নিজের মায়ের মতো।
পর্ব – ৩৩
“ছোট কাকামণি ---“ অনিকেত স্কুল ছুটি হতেই বেরিয়ে এসেছিলো ফাদারকে বলে, বাপিকে বলিয়ে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে। বেরিয়েই দেখে, ছোট কাকামণি দাঁড়িয়ে আছে। অনুপম অনিকেতের সামনে উবু হয়ে বসলো, “ক্লাস শেষ, বাবু?”
“হ্যাঁ, তো।এক পিরিয়ড আগে, বাড়ি যাবো, ড্রাইভার কাকু আছে। ঐ তো।"অনুপম অনিকেতের চুলগুলো ঘেঁটে দিলো। কোলে নিলো তারপর।
“তুমি এখানে?” “বাবিনকে দেখতে মন করলো। বাড়িতে গিয়েও দেখতে পারলাম ভাবলাম একবার স্কুলে গিয়েই দেখি”।
অনুপম চুমু খেলো অনিকেতের দু’গালে। ওর ঘ্রাণ নিলো ।
“বাড়ি যাবো আমরা, তাই তো, বাবিন?” “হ্যাঁ”,
গাড়িতে উঠে বললো অনুপম। “বাড়ি গিয়ে কিন্তু খেলা হবে আজ”।
“গিয়ে আগে চেঞ্জ, তারপর খাওয়া ---“ “তারপর খেলা”।
অনুপম হাসলো।“তোমার অফিস?” “নেই”।
“ছুটি?” “একদম, আমার তো রোজ ছুটি”। “এমা! ছুটি রোজ? ভালো না”।
“তাহলে কোনটা ভালো?”
“বাপির মতো অফিস, রোজ।উইকে একদিন ছুটি”। অনুপম হাসে।
“বেশ, আমিও তাই করবো। বাবিন চায় যখন”।
“কাকামণি- তোমার দুই ছেলে?” অনুপম থমকায়, আসতে আসতে বলে, “তোর দুটো ভাই আছে”।
“বোন?” “ঐ যে – পরী?”
“একটাই বোন সবার”।
“ঠিক, হ্যাঁ রে – এখানে অরফ্যানেজটায় থাকতিস?”
“হ্যাঁ, বাপি রেখে গিয়েছিলো যে”। অনুপম কোলের কাছে টেনে নিলো।
“ঠিক, কেউ দেখা করতে আসতো,কখনো?”
“না তো, বাপিই প্রথম এলো”। “ওহ”।
“ভাই দুটো কোথায়, কাকামণি?” অনুপম অনিকেতকে কোলে বসায়।
“ছোট ভাইটা সবে হয়েছে, দুই মাস। ওদের মামা বাড়িতে আছে ওরা”।
“কাকিমণি ও আছে?” “হ্যাঁ,তোর কাকিমণি ওখানেই আছে। যাবি তোর ভাইদের দেখতে,কাকিমণিকে বলবো?”
“না, না কাকামণি, এখন বাড়ি যেতে হবে। মামণির পড়া করতে হবে – একটু বাকি আছে”।
“বৌদিমমণি বকে তোকে?”অনুপম অবাক হয়। বাবিনকে তো বকতেই না। প্রশ্রয় ছিলো খুব, “মামণি খুব স্ট্রিক্ট”।
“আর বাপি?” “বাপি একদম বকে না। বন্ধুর মতো, বিহেভ করে।তুমি ভাইদের বকো?”
অনুপম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ছোটটা সদ্য হয়েছে। বড়টা বছর সাড়ে তিন। অনুপম তাকে কখনো আদর করেছে – মনে পড়ে না। পরীকে, পরীর দাদা বুবলাইকে আদর করেছে অনেক, অথচ নিজের ছেলেকে বকাঝকা, শাসনই করেছে সবসময়। ছেলেটা ভয় পায় ওকে। তটস্থ হয়ে থাকে,বাবা ফিরলে। তার উপর অনুপমের মদ খাওয়া, বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা তা নিয়ে ওর মার সাথে ঘরের মধ্যেই ঝগড়া,অশান্তি।
এসবের জেরও ওর উপর দিয়ে গেছে অনেক। আর নয়। দাদাভাই ঠিকই বলেছে। এবার জীবনটাকে গোছাতে হবে। ব্যবসা দেখতে হবে, ছেলেদের মানুষ করতে হবে।
“ছোটজন তো ছোট্ট, বাবিন। কী আর বকবো, তবে বড়জন, মানে অবিন ভালোই বকুনি খায়”।
“বাপি বলে বকাঝকা ভালো না”। অনিকেতের কথায় অনুপম মুচকি হাসে।
“বাপি ঠিকই বলে। দেখ, বলতে বলতেই তোর বাপির ফোন এসেছে”।
অনিরুদ্ধ ফোন করেছিলো অনুপম বাবিনকে ঠিক মতো কালেক্ট করলো কিনা, জানতে।
“দাদাভাই, বাবিন গাড়িতে। ফিরছে বাড়ি”।
“বাহ, তুই ওদিকে হঠাৎ গিয়েছিলি?”
“না, একটা বন্ধুর বাড়ি। ফেরার পথেহ মনে হলো বাবিনের স্কুল এদিকেই। আমাদের গাড়ি দাঁড়ানো দেখলাম – মানে তোমার গাড়ি … ফোন করলাম তোমায়”। অনিরুদ্ধ খুশি হলো।
“আমাদেরই গাড়ি ওটা। বাড়ি, ব্যবসা আলাদা হোক আমি চাইনি কখনো”।
“আমিও না। বাবা, জেঠুমণি, জেঠিমণি,আমার মামা বাড়ি – আর তোমার বড়ভাই, অতীনবাবু”।
“ছোটন,অতীন তোর দাদা হয়, অমন বলে না”।
“তোমার রামচন্দ্র অবতারটা এখনো ভালোই আপ আন্ড রানিং”।অনিরুদ্ধ হেসে ফেললো, অনুপমের মানুষ না হওয়াটা কাকিমণির কষ্টের একটা বড় কারণ। এটাই দূর করতে চায় অনিরুদ্ধ, তাই বললো,
“তুই আমার একটা দোকান দেখ তাহলে। দেখবি? কাজে মন দে একটু”।
“দেবো, বাবিনও বকলো আমায় এটা নিয়ে। বললো রোজ ছুটি ভালো না”।
হাসতে হাসতে বললো অনুপম।“কোন দোকানটা দেখবি,ছোটন?”
“যেটা বলবে”। “বেশ, একটা কথা বলি ভাই?”
“বুঝেছি, ওসব ছাইপাঁশ আর খাচ্ছি না”।
“না, সেটা না, কাকিমণিকে ওভাবে কথা বলবি না আর”।
অনুপম চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “মা ভালোবাসেনি যে কোনদিন”।
“ধুর বোকা, কে বললো তোকে? খুব ভালোবাসে। মা তো, ভালোবাসবে না?”
“বুঝিনি কখনো।না, মা, না ঠাকুমা। বাবাও বড়ছেলেকেই বেশি,আর তোমাকে। তবে জেঠিমণি আমাকে ভালোবাসতো খুব, মনে আছে?”
“হ্যাঁ, আমার মায়ের ছটফটে দুরন্ত বাচ্চা পছন্দের ছিলো”।
“তোমার আর আমার মা যেন পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়েছিলো, না – দাদাভাই?”
অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকে। বড্ড সত্যি কথা এটা। অনুপম পরিবেশ হালকা করার জন্য বললো।
“তোমার কাকিমণিকে হার্ট করে কিছু বলবো না আর”।
অনিরুদ্ধ বললো, “বাবিনকে নিয়ে বাড়ি যা, আমার কাকিমণি বসে আছে”।
“ছোট ঠাকুরপো – তোমার সাথে খেলবে বলে তো বাচ্চারা ঘুমচ্ছেই না’।
নীরার গলা পেয়ে তাকায় অনুপম। দাদাভাই – এর ষ্টাডিতে বসেছিলো ও। তাক থেক পেড়ে বই পড়ছিলো। দেওয়াল ঘড়ি দেখলো।
“চারটে তো বাজতেই যায় বৌদিমণি। তুমি ছেড়েই দাও এবার”।
নীরা বলে, “তাই ছাড়তে হবে দেখছি। কী বই পড়ছো?”
অনুপম দেখালো।“দ্যা কাইট রানার? বাহ”।
“এককালে খুব পড়ার শখ ছিলো, স্কুলের বই টই না। গল্পের বই, তারপর সেসব শখও গেলো”।
“ল নিয়ে পড়াটা শেষ করতে পারতে”।
অনুপম হাসলো, “কী হতো? সেই তো ব্যবসা। ওটাই ভবিতব্য। দাদাভাই বিলেত থেকে এম.বি.এ করেও সোনার দাম, খাদের হিসাব করছে”।
নীরা অনুপমের পাশের চেয়ারে বসলো। এই দেওরটি ওর থেকে বয়সে ছোট। বিয়ের পরে সংসার আলাদা হবার জন্য সেভাবে কথা হয়নি কখনোই। বাড়ির সবার থেকে অনুপম আলাদা, অনি বারবার বলে। দূর্গাপুজোতেও তাই কোণ ঘেঁষেই থাকতো।
“তোমার ব্যবসা অপছন্দ?” “কী আছে ওতে?” নীরা হাসলো, “অর্থ”।
“অনর্থের মূল”। “তবে কী চাও?” “কী যে চাই – জানি না। তবে, জানতে হবে এবার। ছেলেরা আছে। ওদের জন্য”।
নীরা হাসলো, “তা বেশ”। “বৌদিমণি, হাসলে তোমায় বেশ লাগে, হাসো না কেন বলতো?”
“এটা ফ্লার্টিং?” অনুপম মাথা নাড়লো, “জানি,আমার চরিত্র নিয়ে তোমাকে মুখার্জী বাড়ির স্তম্ভরা আপডেট দিয়ে রেখেছেন,তবে ফ্লার্টিং নয় এটা। প্রশংসা। তুমি সুন্দর, সত্যিই”।
“তাই? ভাগ্যিস তুমি বললে, তোমার দাদাভাই তো বলেই না” নীরা মজাটা চালিয়ে গেলো।
“বলতে বলবো?” “তুমি বলবে, তবে বলবে সে? এ কেমন কথা?” অনুপম হেসে ফেললো।
“তুমি সত্যিই উকিল হবার যোগ্য। বৌদিমণি, একটা প্রশ্ন করবো? বাবিন এসে তুমি খুব খুশি এখন, তাই না?”
নীরা অস্বীকার করলো না, “খুব”। “ফিরে পেয়েছো বলে?”
“না, যে গেছিলো আর যে এসেছে তারা অনেক আলাদা। তবুও – যে এসেছে সেও তো মা হারিয়েই এসেছে”।
নীরা অনুপমের চোখে জল দেখলো। “ছোট ঠাকুরপো, এমন খারাপটাই তো সবার লাগা উচিৎ, তাই না?”
অনুপম চোখ মুছলো, “বাবিনকে দেখে অদ্ভুত মায়া হয় বৌদিমণি। সবসময় মনে হয় আগের ছ’টা বছর – কত কষ্টে কাটিয়েছে। ওকে ভালবাসতে, আগলে রাখতে ইচ্ছা হয়, তাই”।
“বেশ তো, তুমি তো ওর কাকামণি। তুমি আগলে রাখবে তো বটেই”।
পরী ছুটতে ছুটতে এলো তখনি, পিছনে অনিকেত।
“কাকামণি – চারটে বাজে”। অনুপম হেসে ফেললো।
“ঘুমোসনি নিশ্চয়, দাদাভাই কেও ঘুমোতে দিসনি দুষ্টু মেয়ে”। অনুপম কোলে নিলো পরীকে।
“বোন দুষ্টু না কাকামণি। খেলবো বলে আমিই ঘুমাইনি”।
নীরা বলে, “দেখলে? বোনকে কিছু বলা যাবে না”। অনুপম খুশি হয়, “চল, খেলবি চল”।
“জেঠিমণি তুমিও চলো”।
“তোরা খেল। আমি উপরের বারান্দা থেকে দেখছি”।
“চলো না – বৌদিমণি, লনে বসে দেখবে”, অনুপম বলে।
সুহাসিনী শুয়ে ছিলেন অনির ঘরে। বাচ্চাদের গলা পেয়ে উঠে এসেছেন। নীরা ঘুরে তাকালো,
“দেখেছেন কাকিমণি – ছোট ঠাকুরপো আমাকেও বলছে লনে বসে খেলা দেখতে”।
অনুপম চুপ করে গেলো। মা বৌদিমণিকে না বকে দেয়। “বেশ তো, চলো, আমিও গিয়ে দেখছি”, সুহাসিনী হেসে বললেন।
অনুপম অবিশ্বাসের চোখে মায়ের দিকে তাকালো।
“নীরা – বাবিন, পরীর মতো তাদের ছোট কাকামণিটিও ছোটই আছে এখনো। আমি তো ত্রিশ -একত্রিশ বছরে পারলাম না। তুমি ওর বৌদিমণি, দেখো হাল ধরতে পারো কিনা”।
নীরা হেসে ফেলল, “ছোট ঠাকুরপো, কাকিমণি কী বলছেন? হাল ধরবো?”
“যে বললো তাকে বলো তার বর আর বড়ছেলেকে বোঝাতে যে আলাদা আলাদা খেলাটা বহুদিন হলো – এবার এক হতে”।
“দেখলে তো নীরা? বর, বড়ছেলে – এসব ………”।
নীরা থামালো, “ঠিক বলেছো ছোট ঠাকুরপো, আমি নিজেই বলবো কাকাকে। তোমার সাথে একসাথে, হবে?”
অনুপম খুশি হলো খুব, “কবে?”
“যত তাড়াতাড়ি পারি”। সুহাসিনী খুশি হলেন খুব। ওনার এক হবার ইচ্ছাটা যে এই প্রজন্মেও চারিত হয়েছে সেটা দেখে – ওনার থেকে খুশি আর কে হবে?
পর্ব – ৩৪
অচ্যুতের আবদারে সুহাসিনী অবাক হলেন। “কী বলছো!” “কি এমন বলছি!”
সুহাসিনীকে ফোন করেছিলেন অচ্যুত। বারাসাতের দোকান ভিজিট থেকে ফেরার পথে, গাড়িতে।
“তুমি এখানে থাকবে, আজ রাতে?” “হ্যাঁ – তাতে কী!”
“তাতে কী মানে?” “আমার বৌ রাতের পর রাত থাকছে – আমি একরাত থাকবো না?”
“বুড়ো বয়সে ভীমরতি হলো?” “কেন?”
“ছেলে বৌমা ভর্তি সংসার। মুখ টিপে হাসবে ওরা। একদিন অন্তরই তো ও বাড়ি থাকছি”।
অচ্যুত হাসলেন, “ওহ, সেই ভয় তোমার! ভয় না, লজ্জা। কিন্তু এই অন্তরটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে যে!একা একা ঘুম আসছে না ফাঁকা ঘরে”।
“মরণ! সারাজীবন আলাদা খাটেই তো ঘুমোলে”।
“বাকি জীবনটা এক খাটে ছাড়া ঘুমোবোই না”।
“দেখো, কালই তো যাবো”।
“বড্ড নিষ্টুর তুমি। আজ থাকতে দাও না, বৌ। কষ্ট হবে না হলে। আমি কিছুটি করবো না। জ্বালাবো না, পরীটাকে মাঝে নিয়ে ঘুমোবো কেবল –“ সুহাসিনী বললেন, “বেশ। সন্দেহবশত করছো না তো?”
“কী সন্দেহ? রুদ্রকে নিয়ে?” “আর কি”।
“ও অন্য দিনগুলো থাকে, জানি। ঐ দিনগুলো বৌ আমার কাছেই থাকে”। দুষ্টু হেসে বললেন অচ্যুত।
“ছোটগিন্নী – রুদ্রটাকে ডেকো একদিন। বন্ধু ছিলো একসময়। ভুল বোঝে আমাকে, তখন তোমাকে না পেয়ে থাকতে পারিনি। ঠিক বেঠিক ভুলে গিয়েছিলাম। ব্যাটাকে বলে দেবো – এবারটা ছেড়ে দে, পরের বার,তোর”।
সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন।“সাত জন্মের জন্য বুক করে নিয়েছি, ভাবছো?”
“না, সেসব ভাববো কেন?”
“যদি করে নিই – এভাবেই না ভালোবেসে থেকে যাবে?”
“লাঞ্চ খেয়েছিলে?” “কথা ঘুরিয়ো না। এই ধরো যদি মরে যাই আমি। এখনি। এই জন্মেই … রুদ্রকে বিয়ে করে নিও। শোধ হয়ে যাবে পাপের ঋণ”।
“বাড়ি এসো”। সুহাসিনী বললেন, “আসছি”।অচ্যুত বুঝলেন আর কথা বাড়ানো ঠিক নয়।
“অনি, শরীরটা ভালো না, বুঝলি – বুকটা ব্যথা, ব্যথা”।
অনিরুদ্ধ কাকার দিকে তাকালো, “সে কি! ডাক্তার ডাকি? কাকাবাবুকে ফোন করি?”
“না, গ্যাসের ব্যথা হয়তো’।
অনিরুদ্ধ বললো, “না, না। এত কেয়ারলেসনেস ঠিক না। নীরা – ডাকো কাকাবাবুকে আর কাকা এই ব্যথা ট্যাথা নিয়ে একা একা শোবে – একদম না। কাকিমণি – কাকাকে থাকতে বলো এখানে”। অচ্যুত সুহাসিনীর দিকে তাকালেন। এখনো রেগে আছে।
“না থাক, চলেই যাই। তোদের অসুবিধা,খামোখা”।
নীরা বললো, “না, না। এতে আবার কি অসুবিধা? আপনি থাকবেন, একদম যাবেন না। আমি কাকাবাবু কে ডাকছি”।
“রুদ্র ব্যস্ত মানুষ, আবার তাকে জ্বালাবে-“।
সুহাসিনী বললেন, “না, আসুক, দেখুক কতটা অসুখ। শরীরের উপর অত্যাচার তো কম নয়। ঠিক মতো সময় খাওয়া নেই, দাওয়া নেই…”।
“ঠিক বলেছো কাকিমণি, নীরা – কাকাকে বলো একদম ওজর আপত্তি যেন না করে। তেমন হলে সব কাজ বন্ধ। এখানেই থাকবে, ক’দিন”।
অচ্যুত অনিরুদ্ধর উদ্বেগ দেখে খুশি হলেন। এতো দিনের দূরত্ব, টানাপোড়ন ওর মূল্যবোধকে বদলাতে পারেনি।
“কাকিমণি, কাকাকে ঘরে নিয়ে যান। কাকা অনির জামা কাপড় ফিট করে যাবেন, চেঞ্জ করে বিশ্রাম নিন”। নীরা বললো।
অচ্যুত সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসলেন। সুহাসিনী বললেন, “চলো”।
“বি পি এত বেশি – জানতিস না?” রুদ্রদেব গম্ভীর গলায় বললেন।
সুহাসিনী বললেন, “প্রেসারের ওষুধ খেয়েছিলে, আজ?”
অচ্যুত ভাবলেন, “এই যাঃ, ভুলেই গেছি”।
“একটা কিছু মনে রাখতে পারো না!”
সুহাসিনী গজগজ করলেন। “বুকে ব্যথাটা কদিন থেকে?”
অচ্যুত আড়চোখে সুহাসিনীর দিকে তাকালেন।
“মাসখানেক। একা একা রাতে শুলে বেড়ে যাচ্ছে, অভ্যাস নেই তো”।
রুদ্রদেব অবাক হন, “কেন? ভয় পাস, নাকি?”
“না, ঐ এনক্সাইটি, বয়স হচ্ছে তো”।
“কাকাবাবু – এনিথিং সিরিয়াস? ই সি জি করতে হবে?”
“ক’দিন রেষ্টে থাকবে, ইসিজি আর সমস্ত ইনভেষ্টিগেশন কাল করিয়ে নেবো”।
“টেষ্টে ফেষ্টের কী দরকার আবার!” অচ্যুত বললেন।
“তুই ডাক্তার, না আমি?” অচ্যুত হাসলেন।
“আমি ডাক্তারের বন্ধু। হাফ ডাক্তার তো বটেই”। “অতীনদের জানিয়েছিস?”
“না, খামোখা চিন্তা করবে, কাল টেষ্ট করি – দেখি কী হয়”।
“সুহাসিনী – ক’দিন অফিস যাওয়াটা বন্ধ করে দাও”। “বেশ”।
“সারাদিন ঘরে! রুদ্র! এতো বড় সাজা দিয়ে দিলি!”
সুহাসিনী মুচকি হাসলেন, রুদ্রদেবকে আগেই টেক্সট করে অচ্যুতের ছেলেমানুষি জানিয়ে ছিলেন সুহাসিনী। তাই এই ব্যবস্থা।
“না বেরোলে হাঁফিয়ে যাবো যে”।
“সারবি তাড়াতাড়ি। আর এখানেই থাকবি। সুহাসিনীর টানাপোড়েন কমবে”।
“ঠিক বলেছো কাকাবাবু। কাকা – এখানেই থাকবে না সারা অবধি”। অচ্যুত বুঝলেন এসবের পেছনে কে রয়েছে। খুব মজা তার। একদিন থাকতে চেয়েছিলেন বলে এঘরে আটকেই দিলো, আসুক শুতে। মজা দেখাচ্ছেন অচ্যুত।
“কিছু খেতে দিলে না আমায়! ট্যালটেলে মাছের ঝোল!”
সুহাসিনী ঘরে ঢুকতেই বললেন অচ্যুত।
“বিপি বেশি। তো কি খাবে?” “সব তোমার কীর্তি”।
“এমা, আমি কি করলাম, তোমারই তো বুকে ব্যথা। একা ঘুম হচ্ছে না, কদিন বিশ্রামে থাকো। এংক্সাইটি কমবে”।
“রুদ্র তো জানে সব নাটক, তবে কাল দিলে এত্তো টেস্ট ?”
“করাও না, বয়স তো হলো। এই তো মরে যাবে বলছিলে”।
“মরলে ভালো, বৌ?”
“এসব কথা বলছো যখন, ভাবছোও। ভেবো না, বিপি বাড়বে”।
“তখন কী সহজে বলে দিলুম – মরলে বিয়ে করো। এখন ভাবছি – মরেও শান্তি পাবো না তবে”।
সুহাসিনী অচ্যুতকে রাতের ওষুধ দিলেন। প্রেসারের, কোলেষ্টেরলের।
“জানি আমি সেটা, যেটা চাওনা, বলো কেন?” “কষ্ট হয়, তাই”।
“কী নিয়ে?’ “তুমি জানো”।
“অবিশ্বাস – এখনো?”
অচ্যুত সুহাসিনীর কোমর জড়িয়ে ধরলেন।
“নাহ, ইনসিকিওরিটি, রুদ্র বেশি যোগ্য, জানি তো”।
“এখন এই বয়সে আর সেসবের প্রশ্ন আসে?” অচ্যুতকে ভোলাতে চাইলেন সুহাসিনী।
“তাও বটে”।“আজ তো সরে জমিনে দেখলে, এবার শান্ত হও”।
সুহাসিনী কোমর ছাড়াতে গেলেন, অচ্যুত কাছে টেনে নিলেন, বুকে মুখ রাখলেন।
"কী করছো, ছাড়ো ……”
“পরী কই?’ বুক থেকে মুখ তুললেন অচ্যুত, “ও ঘরে ঘুমিয়ে গেছে,জেঠিমণির কাছে”।
“দরজা লক করেছো?”
“হ্যাঁ, ছাড়ো – এবার শুয়ে পড়ি”।
“নীরা, অনি এরা কিছু ভাবলো?”
“ওদের দুজনের এত জটিলতা আসে না। নাটক করবে বুড়ো কাকা – বৌয়ের কাছে থাকবে বলে – ভাববে কী করো”। সুহাসিনী ঠেস দিলেন।
“বুড়ো কিনা দেখবে?”
“না, খুব জোয়ান, জানি”।
“এত ভয়?” “ভয় কেন? দূরত্ব। ত্রিশ বছরের”।
অচ্যুত বললেন, “শোও”।
“অনুপম পেটে থাকতেই অ্যাফেয়ারটার শুরু, তাই না?”
অচ্যুত চমকালেন, “আবার সে কথা কেন?”
“আবার! এই কথাটা তো সারাজীবনই থাকবে, ছোটকর্তা”।
“কষ্ট পেতে, তাও বলোনি। সেটা কেন? ভাঙবে তবু মচকাবে না, না? তোমাকে কষ্ট দিতেই তো ……”।
“বললে কী হতো? ছাড়তে?”
“তোমার জন্য সব ছাড়তে পারি”।
সুহাসিনী শুয়ে পড়লেন। অচ্যুতও পাশে শুলেন।
“ভারী জেদ তোমার, বৌ”। “আর তোমার?”
“অভিমান।নিজের স্বামীর উপর জোর খাটাতেই জানলে না তুমি কোনদিন”।
সুহাসিনী চুপ করে থাকেন। অচ্যুত কাছে আসেন।
“একটাবার ডাকতে। আমি তোমাকে ছাড়া ভালোবাসিনি যে কাউকেই”।
সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলন অচ্যুত।
সুহাসিনী বললেন, “ভালোবাসতে এই চুমুটারই প্রয়োজন। অথচ আমাদের মধ্যে মাঝরাতে উঠে শরীরের প্রয়োজন বিনিময় ছাড়া আর কি কিছু হতো?”
“হতো না, বোকা ছিলাম।তেইশ চব্বিশে কী বোঝে মানুষ। বুঝতাম না তুমি কী চাও, এখন বুঝছি”।
আরো দুটো চুমু খেলেন অচ্যুত।
“আমার বৌ”।অস্ফুটে বললেন আর একবার।
রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো অচ্যুতের। টয়লেটে যেতে হবে। অ্যাটাচড বাথরুম, এ ঘরেও। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ ডাকছে। বিদ্যুত-ও চমকাচ্ছে মাঝে মাঝেই। অচ্যুতের চোখে পড়লো পায়ের দিকের একটা জানলা খোলা। ঝোড়ো হাওয়া ঢুকছে। সুহাসিনীর ঠান্ডার ধাত। জানলা বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। উঠে জানলা বন্ধ করতে করতেই বিদ্যুৎ চমকালো। পিছনের মাঠের দিকে চোখ পড়লো, সাদা শাড়ি, খোলা চুল কেউ একজন পিছনের ঘরের দিকে যাচ্ছে, পা টেনে টেনে। কে এ! পিছনের ভাঙ্গা ঘর গুলোতে ধিকিধিকি আগুনের আঁচ দেখলেন অচ্যুত। কেউ ওখানে আলো জ্বালিয়েছে। কে সে? নাকি কারা? অচ্যুত ছুটে এসে সুহাসিনীকে জানালেন।
“বৌ – ওঠো … ছোটগিন্নী ……” সুহাসিনী ধড়মাড়িয়ে উঠে বসলেন।
“কী হলো! বুকে ব্যথা? জল খাবে?”
অচ্যুত হাত ধরে টানলেন। “এদিকে এসো”। জানালার দিকে ইশারা করলেন। সুহাসিনী ছুটে গেলেন।
“কে ওখানে?’ বলতে যাচ্ছিলেন, অচ্যুত মুখ চেপে ধরলেন। সুহাসিনী স্পষ্ট দেখলেন অনিকেত ঠিক যেমনটা বলেছে তেমন কেউ একজন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে জলে ভিজে ভিজে পিছনের ঘরে যাছে।
“কে ও?” গলার আওয়াজ নামালেন সুহাসিনী।
“সেটাই তো ভাবছি”। “অনিকে ডাকো”।
অচ্যুত ভাবলেন সেটাই ঠিক। “ডাকছি”।
“জানলা লাগাচ্ছো কেন?”
“আমি অনির সাথে নীচে যাবো, খুঁজতে। তুমি একা থাকবে, তাই”।
জানলা লাগিয়ে বেরোতে গেলেন অচ্যুত, সুহাসিনী হাত ধরলেন।
“একদম না। আমিও যাবো”। “বেশ, চলো”।
অনিরুদ্ধ, অচ্যুত আর সুহাসিনী মাঠ পেরিয়ে ভিজতে ভিজতে পিছনের ঘরের সামনে যখন এলো – ওখানে কেউ নেই। অনিরুদ্ধ টর্চ জ্বালালো। পাঁচ ব্যাটারির বড় টর্চ। চারিদিকে ফেললো।
“নাহ, কোথাও কেউ নেই। অথচ আগুন জ্বলছিলো কিছুক্ষণ আগেই। এখনো ধোঁয়া আছে।
“স্ট্রেঞ্জ! গেল কোথায়?” অচ্যুত বললেন, “পালিয়েছে, পাঁচিল টপকে”।
“আমরা আসতে না আসতেই?”
“হ্যাঁ, কোলাপ্সিবল খোলা বন্ধ, সিঁড়ি দিয়ে নামা, মেনগেট খোলা, এতটা আসা – ছোটগিন্নী – পাঁচিলের দিকটা দেখতে হবে, চলো”।
পাঁচিলের দিকে টর্চ ফেলেও কারোর চিহ্ন মাত্র পাওয়া গেলো না।
“এত উঁচু পাঁচিল টপকে গেলো?” সুহাসিনী অবাক হন।
“প্রেতাত্মা হলে যেতেই পারে”। অচ্যুত বললেন। “না, না – মানুষ”।
অনিরুদ্ধ বললো।“কী করে জানলি?”
“বলছি – একে পাওয়া মুশকিল। চলো উপরে যাই”।
“ডাকিনি বিদ্যা এটা”। অচ্যুত সব শুনে বললেন। উপরে উঠে এসেছেন ওনারা, ডাইনিং রুমে বাস কথা হচ্ছিলো।
“আমাকে বলোনি তো – বাবিনকে ভয় দেখিছে – আর সেই জন্য তুমি থাকছো”।
সুহাসিনীর দিকে কড়া চোখে তাকালেন অচ্যুত।
“বললে কী হতো?”
“আমি অনেক আগে থেকে থাকতাম এখানে তবে।অনি একা, তোমরা সবাই মেয়ে মানুষ, ছোট বাচ্চা রেয়েছে দুটো ……”
“ডাকিনী বিদ্যা তুমি নিশ্চিত?”
অনিরুদ্ধ বললো। “হ্যাঁ, প্রেতাত্মা ভাবছিলাম। কিন্তু এসব ঘরে টরে আসা শুনে মত বদলাতে হলো”।
“তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছো কী করে?” অচ্যুত হাসলেন,
“মায়ের থেকে শুনেছি এসবের কথা অনেক। বাগদেবীপুরে আগে নাকি এসব জলভাত ছিলো। তন্ত্র মন্ত্র, ডাকিনী বিদ্যা – সমস্ত ম্যাল প্রাকটিস হতো ওখানে। তোমাকে সেই অভিশাপ দেওয়া তান্ত্রিকের কথা বলেছিলাম না? তার আমল থেকেই এসব ঢুকে গেছিলো গ্রামে”।
“তোমার মা তো আমাদের বলেননি এসব কখনো?”
“তোমরা যখন এলে তখন ধীরে ধীরে গ্রামের কথা এড়াতে শুরু করেছিলেন মা। শেষ শয্যায় আবার শুরু করেছিলেন – দেখোনি?”
“সে তো দেখেছি।অনি, সার্ভেন্টস কোয়াটারের দিকটা বড্ড চুপচাপ। আমরা তিনজন বেরোলাম, ঢুকলাম – কেউ জাগলো না! এমনকি নীচতলায় যে ক’জন থাকে তারাও ……”
“সর্ষের মধ্যেই ভূত, থুড়ি ডাকিনী আছে”।
অচ্যুত বললেন, “সব কটাকে কুলোর বাতাস দে, অনি”।
“কিন্তু কাকা – তাহলে তো ধরা পড়বে না। বাইরে বেরিয়ে যদি বাবিনের আরো ক্ষতি করে?”
“তুই -ওতো মায়ের মতো বলছিস। মা বলতেন ডাইনিবিদ্যাতেই জেঠার বড়ছেলেটা মরেছে। বাবা ঐ জন্যই নাকি পালিয়ে এসেছিলেন,দাদা ছয় মাসের হতেই। ওসব অভিশাপ- টাপ কিছু না। সব ডাইনির কাজ।
তুই-ও সেটা মানিস?” অনিরুদ্ধ চশমা ঠিক করলো,
“অভিশাপ, ডাইনি দুটোর একটাও মানার মতো নয়। আমি মানুষের লোভকে ভয় পাই কাকা – খুন মানি এগুলোকে”।
অচ্যুত চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “বাবিন মানে উৎসবেরটাও? ডাক্তার তো ডেঙ্গু বলেইছিলো”।
সুহাসিনী বললেন, “তুমি কি বলে মানো এগুলোকে?”
“ভাগ্য, সমাপতন”। “এত বার?”
“তবে অনিকেতের ডাইনি দেখাটা আর আজ নিজের চোখে তাকে লক্ষ্য করাটা মত বদল করাচ্ছে আমাকে”।
“মোটিভ কি?” সুহাসিনী বলে।
“এদের আবার মোটিভ! সিদ্ধিলাভ-টাভ এসবের জন্যও করতে পারে। মানুষের বাচ্চা মারলে মনে হয় সাধনার সিদ্ধি বাড়ে। অনিকেতকে নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে, আমাদের। তবে, আমার মতে সবকটা তাড়িয়ে দেওয়াই ভালো”।
“বাইরে এতো সার্ভিলেন্স সম্ভব না ছেলের উপর, কাকা”।
“আর মোটিভটা এত সরলও নয়, আমার যা মনে হয়, পুরনো শত্রুতা নির্ঘাত থাকবে। থাকতেই হবে”।সুহাসিনী বললেন।
“নীরা ঘুমোচ্ছে?” অচ্যুত বললেন,
“না, আমি উঠে আসতেই জেগে গেছে, বাবিনও। পরীটা ঘুমোচ্ছে।ও বাবিনের জন্যই যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও গেলো না আমাদের সাথে। এখনো ছেলেকে ফেলে বেরোচ্ছে না”।
“তুইও ঘুমোতে যা তবে, পরে এসব আলোচনা হবে,কাল একবার নিধুকে মণিকে ডেকে বসবো আমি। গ্রামের এখনকার খবর নিতে হবে”।
“কাকাবাবু, মানে ডাক্তারকাকাও সেটাই বলছিলেন, গ্রামেই এর লিংক কোথাও আছে”।
“রুদ্রও! দেখলে ছোটগিন্নি – ওর আমার এক লাইনে ভাবার স্বভাবটা গেলো না”। সুহাসিনী চোখ বড় করলেন।
অনিরুদ্ধ লজ্জা পেলো। উঠে পড়লো, “কাকা,গুডনাইট। কাকিমণি শুয়ে পড়ো। কাকা, বুকে ব্যথা করছিলো তখন – রাত জেগো না আর”।
অনিরুদ্ধ গেলে অচ্যুত বললেন, “কতটুকু ছিলো, মনে পড়ে? এখন এটা করো না, ওটা খেয়ো না, অফিসে যাবে না, রেস্ট নাও …”।
“জীবন তো এমনই”।
“ঐ জন্যই জীবন সুন্দর”।
“মরার কথা আর বলবে না, কখনো, মনে থাকবে?”
সুহাসিনীর হাত ধরেন অচ্যুত, “থাকবে, বৌ – ভালোবাসো তো, আমায়?”
সুহাসিনী বললেন, “ছেলে কি বললো শুনলে না? বুকে ব্যথা নিয়ে রাত জাগা ঠিক নয়”। অচ্যুত হেসে ফেললেন।
“ঘুমোবে চলো”, সুহাসিনী বললেন।
“এখনো ঘুমোয় নি?” অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকে দেখলো নীরা বাবিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে।পরী পাশে ঘুমোচ্ছে।
“অনি, জোরে কথা বলো না। ভয় পেয়ে আছে”।
নীরার গলার স্বর ভারী হলো। অনিরুদ্ধ বুঝলো।
“বেশ, দাও-আমাকে কোলে দাও”।
“ভেজা জামা – বদলে নাও আগে”।
অনিরুদ্ধ ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এলো।
অনিকেত বললো, “বাপি, এভিলকে পেলে?”
“না বাবিন, দাদুভাই কি দেখতে কি দেখেছিলো”।
“না, বাপি, এভিল আছে। দাদুভাই ঠিকই দেখেছে”।
নীরা ছেলেকে অনিরুদ্ধর কোলে দিলো, “বাপির কোলে যা, বাপি কতো স্ট্রং জানিস? এভিল এলেও তোকে ধরবে কি করে?”
অনিকেতকে কোলে নিলো অনিরুদ্ধ। জোরে জড়িয়ে ধরলো।
“আমি আছি তো বাবিন, ভয় কী?” অনিকেত চুপ করে থাকলো।
“কেঁদেছে?” “ফুঁপিয়েছে। চিৎকার করে কাঁদে তো না, সারাক্ষণ ফোপাছিলো”, নীরা বললো।
“ওকে বলো যে বাপি আছে মামণি আছে ওর কোনো ভয় নেই”।অনিরুদ্ধ বললো।
“কাল বাবিনকে ছুটি দেবে একটু?”
“তুমি নিয়ে বেরোবে? বেশ তো।বাবিন,বাপির সাথে ঘুরতে যাবি?” “তুমি?”
“দাদুভাই অসুস্থ তো। তুই আর বাপি ঘুরে আয়”।
এই বাড়ির বাইরে একটু ছেলেকে ঘোরাতে চাইছে অনিরুদ্ধ। ভয়ের চিন্তা মাথা থেকে কাটবে।
“বাপির অফিস, আমার স্কুল?”
নীরা আর অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে, “একদম সেলফ ডিসিপ্লিনড বাচ্চা জন্মেও দেখিনি অনি”। “আমিও”।
অনিরুদ্ধ সোফায় দাঁড় করায় অনিকেতকে, “পিঠে চাপ”।
“পিঠে?” নীরা ভাবে বাবিন হলে লাফিয়ে উঠে পড়তো। “গলা জড়িয়ে পিঠে”। অনিকেত ওঠে।
“এইভাবে ঘুরবো আমরা কাল, পিঠে চেপে?” “মজা না?”
“হ্যাঁ।একটা কথা বলবো, বাপি?”
“বলো”, অনিরুদ্ধ ঘুরে চুমু খায় অনিকেতকে।
“তোমার অফিসে নিয়ে যাবে? বোন দেখেছে, আমি তো দেখিইনি”।
নীরা হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে নিলো অনিকেতকে।
“অফিসে যেতে হবে বাবিন?” অনিরুদ্ধ বললো।
“হ্যাঁ, যাই নি তো”।
“বেশ, তাও নিয়ে যাবো, কিন্তু কাল একদম পড়ায় ছুটি। দুপুরে স্কুল করে এসেই বাপি নিয়ে বেরিয়ে যাবে, সকালে দাদুভাইকে টেস্ট গুলো করিয়ে দেবো, হবে?”
অনিকেত মামণিকে বললো, “ফিরে এসে পড়া নেবে, মামণি?”
নীরা ওর নাকে নাক ঘষলো। “না, কাল না”।
“তবে যাবো”। অনিরুদ্ধ নীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
“বাপরে অনি, তোমার ছেলেকে বেড়াতে যেতে রাজি করাতে এতো হ্যাপা?” নীরা বলেই ফেললো।
“দেখছি তো তাই”।
“পড়া দেওয়া থাকলে যাবো কি করে মামণি? দেখলে না, আজও তো উঠবোস খেলাম”। নীরা হাসলো,
“তিন লাইনে চারটে শেখানো বানান ভুল করলে আদর তো খাবি না”।
অনিরুদ্ধ বললো, “বাবিন এক কাজ কর, আমার কাছে পড়িস, অফিস থেকে ফিরে পড়িয়ে দেবো। মামণি রাগী, বকে খালি, বাপি তো রাগেই না”।
নীরা বললো, “তাই কর তবে”।
অনিকেত মামণিকে জড়িয়ে ধরলো।
“কী হলো?” “তোমার কাছেই পড়বো মামণি”।
“বকি যে”। “সে হোক, তুমি বকলেও পরে কত আদরও তো করে দাও। আর তোমার মতো ভালো করে কেউ বোঝাতে পারে না”।
অনিরুদ্ধ বললো, “নীরা – প্রশ্রয় দিলেও মা-ই ভালো হয়, আবার শাসন করলেও – দেখছো তো? বেচারা বাবারা কখনোই জিততে পারে না। বকে বকে তো নয়ই প্রশ্রয় দিয়েও না”।
নীরা খুশি হয়, যে ফিরে এসেছে সে নীরার হয়েই ফিরে এসেছে।
Tags:
উপন্যাস