গার্গী মালিক

হালখাতা  / গার্গী মালিক

"মা , বাবা বলছিল কাল ১লা বৈশাখ? তুমি তো এবার আমায় চৈত্র সেলে নিয়ে গেলে না? নতুন জামা কিনে দিলে না? সেই কবে থেকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছো ... আর ভালো লাগছেনা মা "

কান্না ভেজা গলায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল লক্ষ্মী; দশবছরের ছোট্ট জীবনে এই প্রথমবার - বছরের শেষ দিনে তার একখানা জামা হয়নি; মা গৌরী তিনবাড়ি বাসনমাজার কাজ করে - এই সময় কিছু বাড়তি টাকা আসে তার হাতে - তাই দিয়েই সে লক্ষ্মীকে দুখানা বাড়িতে পড়ার জামা কিনে দেয় - সেলের বাজারে - বেশ সস্তায় , হেসে খেলে - সেলাই জুড়ে দিব্যি চলে যায় একবছর; কিন্তু , এবছর তা কিছুই হয়নি - লকডাউন চলছে - সবকাজ বন্ধ। 

শম্ভুর পানবিড়ির গুমটির দরজায় তালা পড়েছে - বাড়ীতে বসে আর কতক্ষণ চলে! দড়িতে ঝোলানো জামার পকেট থেকে বার করা আধখানা পোড়া বিড়িতে আবার আগুন দিয়ে সুখটান দিতে দিতে শম্ভুর মনে পড়লো গতবছরের কথা - পয়লা বৈশাখে বেশ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হয়েছিল - ওইদিন লক্ষ্মীর জন্মদিন; ভাত - ডাল -আলুভাজা -খাসির মাংস -চাটনি - পাঁপর - পায়েস - মিস্টি - সবটাই ছিল পাত ভরে। আজ দিন দশ হল , ফ্যান - ভাত - আলুভাতে , সাথে বাড়ির এদিক সেদিকে হওয়া লাউ - কুমড়ো- কিংবা সজনে শাক ভাজা। ডিমের দামটাও বেশ বেড়েছে। এক বছরে স্বাদেরও কত পরিবর্তন!

"গৌরী ..... গৌরী , একবার শুনে যাও তো এদিকে "

গৌরী পোড়া বাসনগুলো মাজতে মাজতে মেয়ের কথা গুলো আনমনে ভাবছিল - মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিল কিছু মনগড়া উত্তর। ঘোর কাটল শম্ভুর ডাকে; ইদানিং তার কপালের সাথে বাসনগুলোও পুড়ছে বড় বেশি - গ্যাস শেষ - টাকা শেষ - অগত্যা সম্বল সেই পুরনো স্টোভ। হাতের পোড়া কালি ধুয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সে শম্ভুর কাছে এসে দাঁড়ালো। বিড়ির শেষ টানটা দিয়ে , টুকরোটা মাটিতে গুঁজে , বলল - "কাল মেয়েটার জন্মদিন - ওর মুখে একটু মাংস - পায়েস কি তুলে দেওয়া যায়না? আমার তো হাত-পা বাঁধা … তুমি যদি কিছু করতে পারো।"

গৌরী মাথা নীচু করে শুনছিল , ধীরে ধীরে বলল - " আগের মাসের টাকা তো একমাসের চাল আর মেয়েকে ডাক্তার দেখাতেই চলে গেল; দেখি - কাল একবার কাজের বাড়ি গুলোতে যাবো - যদি কেউ কিছু দেয় , প্রায় একমাস কাজে যাইনি - টাকা চাইতেও তো লজ্জা হয়!" 

#

পরদিন গৌরী সকাল সকাল নিজের ঘরের কাজগুলো সেরে নিয়ে কাজে গেল - হাঁটতে হাঁটতে মনে হল যেন সেই ব্যস্ত জীবনটা খুঁজে পাচ্ছে - বেশ ভালো লাগলো তার। চায়নাদির বাড়িতে কলিংবেল বাজালো - ঘুমচোখে দরজা খুলল তার মেয়ে - বৌদির ততক্ষণে ঘরমোছা - বাসনমাজা - সবকাজ হয়ে গেছে! তাকে দেখেই মুখটা হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল! বলল - " গৌরী তোমায় আমি খবর দিয়ে উঠতে পারিনি - তুমি বোধহয় জানোনা , আমার কাজটা আর নেই - মালিক জবাব দিয়েছে - এই একমাসে তার কিচ্ছু জামাকাপড় বিক্রি হয়নি - তাই আমাকে তিনি আর পুষতে পারবেন না; এই অবস্থায় আমার পক্ষেও আর তোমাকে ....." বলেই তার দুচোখ জলে ভরে এলো ...

"ঠিক আছে বৌদি " বলে একবুক কান্না নিয়ে গৌরী গেল পরের বাড়ি। কাজ প্রায় শেষের দিকে - এমন সময় রমাবৌদি বললেন - "গৌরী , পরিস্থিতি খুব খারাপ বুঝলে , তোমার দাদার দোকান তো একমাস বন্ধ - এই মুহূর্তে রোজগার বলতে আমাদের কিছুই নেই , এই বোশেখ মাসের উপরিটা তোমাকে লকডাউন উঠলেই দেবো ,কেমন ?" 

গৌরী চুপচাপ ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল, মনে মনে বলল - যাক কাজটা তবু রইল।

"ডিংডং ... ডিংডং" তিন নং বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠল, আশীষ দাদাবাবু একলা মানুষ। গৌরীই তার সব কাজ করে এমন কী রান্নার জোগাড়টাও। এতদিন দাদাবাবুর খুব কষ্ট গেছে - তারই সাতকাহন শোনাতে লাগলেন তিনি; গৌরীর কানে যেন কিছুই ঢুকছে না - সে যেন দুরুদুরু বুকে অপেক্ষায় আছে - এই বুঝি জবাব এলো! " 

..... শোন আর কামাই করিসনে বাপু্ , বয়স হচ্ছে তো - এতো কাজ আর পারিনে। আজ বছরের প্রথম দিন - এই নে একশ টাকা রাখ, মিষ্টি খাবি। বাকিটা পরে দেবো। করোনা করোনা করে আর পারিনা , দেখছিস তো এতদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল - আর আমার দ্বারা ওসব নেট ব্যাংকিং হয়না - সেকেলে মানুষ - ফরম ফিলাপ না করলে টাকা ওঠেনা ..." বলেই খুব হাসতে লাগলেন ... 

গৌরীর ঠোঁটের কোনায়ও এক টুকরো হাসি খেলে গেল - মনে মনে বলল - " মিষ্টির দোকান খুলেছে , মাংস না হোক - সবাই মিলে আজ পেটপুরে মিষ্টি খাবো।" 



Previous Post Next Post