সায়ন্তনী নাগ

অ-সুখের শপিংমলে / সায়ন্তনী নাগ

ক্রমশ উত্তরণের চলমান সিঁড়িগুলো ঘন সবুজ ঘাসে ঢেকে যায়। সাথে চলন্ত হাতল পেঁচিয়ে নেয় নাম না জানা গুল্ম, লতা, পরজীবীর আরোহী মূল। একদিন যে শপিং মল ঝলসে উঠত ব্র্যান্ডেড শোরুমের আলো প্রতিফলনে, এখন তার ছাদের ফাটল দিয়ে সূর্যালোক এসে পড়ে প্রশস্ত করিডোর ছেয়ে ফেলা বুনো গাছগাছালিতে। কিছু বছর আগেও মাল্টিপ্লেক্সের শেষ শো ভাঙা দর্শকের দল কলকাকলিতে ভরিয়ে তুলত ঘুমন্ত মাঝরাত। এখন চাঁদের আলো র‍্যাক ভর্তি ধুলো পড়া জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ওগুলোকে আর চেনা যায় না। পড়া যায় না আবছা হয়ে আসা ব্র্যান্ডের নাম, ঝুলতে থাকা বহুমূল্য প্রাইসট্যাগ। ঠিক এমন একটা সন্ধেয় প্রায় ভেঙে যাওয়া সদর দিয়ে ভেতরে ঢোকে রাজু।

মাথার ওপর আজ আর বাজনা বেজে ওঠে না মেটাল ডিটেক্টরে। আলোও জ্বলে না। এইখানে বাঁ দিকে একটা টেবিলে দুটো ইউনিফর্ম পরা মেয়ে বসে থাকত। কালোকোলো, হাতে কি একটা মেশিন থাকত, ছুঁইয়ে নিত সব ব্যাগে। কোনো সময় আবার ব্যাগের চেন খুলে দেখাতেও বলত। শনি-রোববারে বিশাল লাইন পড়ে যেত ব্যাগ চেকিং-এর। কেউ কেউ ফাঁক গলে ঢুকেও পড়ত, এত ধৈর্য ধরা যায় নাকি! মেয়েগুলো জয়নগর মজিলপুর থেকে আসত, জানে রাজু। সকাল নটা থেকে রাত এগারোটা ডিউটি, টানা সাতদিন। ছুটি করলে টাকা কাটা যেত। মাঝে পালা করে গিয়ে স্টাফ টয়লেটের পাশের খুপরি ঘরটায় বসে ঠাণ্ডা শক্ত রুটি আর ঢ্যাঁড়শের তরকারি খেত। ওরা কবে বাড়ি ফিরে গেছে। এতদিনে মরেও গেছে বোধহয়।

পায়ের গোছ অবধি ডুবে যায় বুনো জঙ্গলে। এর নিচে কোথাও দামী টাইলসগুলো শুয়ে আছে। প্রায় সাত-আটজন স্টাফ রোজ ন্যাতা লাগানো লাঠি দিয়ে ঘষে ঘষে চকচকে করে তুলত মেঝে। এমন চকচকে যে কাস্টোমাররা মুখ দেখতে পেত। হাইহিলে ভর দিয়ে দু-চক্কর নেচেও নিত কোনো কোনো কিশোরী। শুধু মেঝে নয়, সাবান জল দিয়ে সব শো উইন্ডোগুলো মুছতে হত প্রতিদিন। বাথরুম ধুয়ে মুছে ছড়িয়ে দিতে হত রুম ফ্রেশনার। এখন হাওয়ায় খুব হালকা মিষ্টি গন্ধ পায় রাজু। না, ল্যাভেন্ডার বা আর কোনো পারফিউম নয়। এগুলো সব অরণ্যের গন্ধ। ঐ সাত আটজন সাফাইওয়ালা দেশে ফিরে গেছে। না, সবাই পারে নি। আসলে ওদের দেশ বহুদূরে। আর ততদিনে ট্রেন, বাস সব বন্ধ হয়ে গেছে। পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছিল সবাই। হাতে, মাথায় ব্যাগ, সাথে বৌ-বাচ্চা। দু-একজন মরে গেছিল কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে। দু-একটা বাচ্চাও, মায়ের কোলেই। 

এইখানে একটা বিশাল বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। কী না পাওয়া যেত সেটায়! চালডাল থেকে জামাকাপড়, কাঁচা সবজি থেকে রান্না করা খাবার, বাসনকোসন থেকে টিভিফ্রিজ। এখনো অনেক কিছু সাজানো রয়েছে। চেনা যাচ্ছে না। মাকড়শার দল পুরু জালে ঢেকে নিয়েছে সে সব সম্পত্তি। খাদ্যবস্তু যা যা ছিল, ইঁদুর আর পোকামাকড়ের দল মহাভোজ সেরেছে কয়েক বছর। কেউ তো সরাবার সময় অবধি পায় নি। এই স্টোরে যে সব সেলসম্যানেরা কাজ করত, তাদের বসার নিয়ম ছিল না। বারো ঘণ্টার ডিউটি পুরোটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করতে হবে। তাও কোনোদিন লোকের অভাব হয়নি। সেই মেয়েদের চিনত রাজু। সবার খোঁপায় কালো জাল আটকানো, চোখে লাইনার, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাঁটু অবধি কালো মোজা। ছেলেদের টাই পরতে হত, আর সবসময় জুতো পালিশ। তারা সবাই এখন বসে আছে, বাড়িতে। মানে যদি এখনো কেউ বেঁচে থাকে! 

এরপরে গয়নার দোকান ছিল একটা। কি তার জাঁকজমক। হাজার আলোয় ঝিকিয়ে উঠত রোশনাই! এক বিখ্যাত নায়িকা ছিল ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর। তার কানের ঝুমকো, গলার নেকলেস, হাতের রতনচূরের ছবি টাঙানো থাকত দেওয়াল জুড়ে। যারা কিনত, তারা ভাবত ওসব গয়না পরলে ওদেরও নায়িকার মত লাগবে। সে নায়িকা তখন নিউইয়র্ক গেছিল শুটিং করতে। আর ফেরা হয়নি। ওদেশে রোগ তখন মারাত্মক ছড়িয়ে গেছে। নায়িকার ছবিগুলোতে কত জংলি লতা বাইছে এখন! হীরে জহরত পড়ে আছে যেমন কে তেমন! ইঁদুর বাদুড়ের পেট ভরায় না সোনাদানা! আর চোরডাকাতরাও সবাই মরে গেছে সেই কবে!

এখন রাজুর সামনে একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁ। উৎসব অনুষ্ঠানে নাকি দুদিন আগে টেবিল বুক করতে হত। টেবিল চেয়ারের কঙ্কাল এখনো রয়েছে কিছু। পর্দা, সাজসজ্জা, মিউজিক সিস্টেম কিছুই চেনা যাচ্ছে না ঠিকঠাক। বুফের জন্য সাজানো বড় বড় রূপোলী পাত্রগুলো পড়ে আছে সারসার। রাজু দু-পা এগোতেই মা-পাখি ডানা ঝাপটিয়ে আপত্তি করে। যে বাসনগুলোয় ঝলসানো মুরগি, সাঁতলানো শুয়োর কিম্বা কচি পাঁঠার মাংস সাজিয়ে পরিবেশন করা হত, এখন সেখানে বাসা বেঁধেছে নানা জাতের পাখি। ডিম ফুটছে, ছানা বেরচ্ছে, ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে শিখছে তারা। পুরো রেস্তোরাঁয় এখন তাদের পূরিষের গন্ধ। ছড়িয়ে আছে পালক, যেমন এককালে জন্মদিনের পার্টিতে গায়ে মাথায় উড়ত রাংতা আর কাগজের কুচি। 

সবকটা শো উইন্ডো বোঝাই ভুতুড়ে মানুষদের পেরিয়ে যায় রাজু। নানা ভংগীমায় দাঁড়ানো নানা বয়সের ম্যানিকুইন। ছুঁলে বোঝা যায় প্রাণহীন শীতল। ধাতব কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে দেবার সেলসম্যানটি মরে গেছে। তাই উলঙ্গ পড়ে আছে কোনো কৃত্তিম নারীশরীর। রিং বোঝাই হ্যাঙ্গার ঝোলানো জীর্ণমলিন জামাকাপড়। বিশ্ববিখ্যাত সব ডিজাইনারদের লেবেল। এখন বিনি পয়সায় বিলিয়ে দিলেও পরার লোক নেই। দোকানের ট্রায়াল রুমের মধ্যে খসখস শব্দ শোনা যায়। কিম্বা নখের ঘষটানি। হয়ত বাসা বেঁধেছে কোনো শ্বাপদ। হাঁ করে নিজের দাঁত দেখছে লাগোয়া আয়নায়।

এরপর একটা খোলামেলা জায়গা। এখানে একদিকে নানা বিচিত্র শব্দে চলত ভিডিও গেম। আরেকদিকে আরও কচি বাচ্চারা মা-ছাড়া হয়ে প্লাস্টিকের ব্লক, স্লাইড, গাড়ি ইত্যাদি নিয়ে খেলত কিছুটা সময়। সেইসব কিশোরেরা খেলে খেলে ক্লান্ত হয়ে গেছে এখন। তাদের ইশকুল কলেজ সব চিরকালের জন্য ছুটি হয়ে গেছে। কোন বন্ধুকে পাবে তারা খেলার সঙ্গী হিসেবে? এ রোগের প্রথমদিকে কেবল বয়স্ক মানুষই আক্রান্ত হত। ক্রমে সব বুড়ো শেষ হয়ে গেলে ভাইরাস তার থাবা বাড়িয়েছিল ছোটদের দিকে। এখন আর শহরে কোনো নীরোগ মানবশিশু নেই। 

এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেই মাল্টিপ্লেক্স। নানা সিনেমা, হাজার স্বপ্নপূরণ আর স্বপ্নভঙ্গের গল্প! সারাক্ষণ কিছু না কিছু ঘটত কোনো না কোনো পর্দায়। এখন বটের ঝুড়ি, অশ্বত্থের শিকড় সেসব রূপোলী পর্দা বেয়ে বর্ষবলয়ের মতো এঁকে দিয়েছে চিরস্থায়ী বলিরেখা। কত হিরো হিরোইন নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে কত ছবির প্রিমিয়ার! সেসব হলিউড বলিউড টলিউড এখন পুরো ঝাঁপবন্ধ। কত বছর হয়ে গেছে আর কোনো সিনেমা রিলিজ করেনি, কেউ অন্ধকারে টর্চ দেখিয়ে সিটে নিয়ে বসায়নি, হাতলের খোপে রাখেনি মশলাদার পপকর্ন কিম্বা হিমশীতল কোক। হাততালিতে ভরে ওঠেনি, সিটি ছোঁড়ে নি, হেসে কিম্বা কেঁদে ওঠেনি একজনও। 

এতক্ষণে কোনোরকমে সিঁড়ি টপকে টপকে সবচেয়ে ওপরের ধাপে এসে গেছে রাজু। এখান থেকে কি চমৎকার দেখাতো গোটা শহরের স্কাইলাইন! সবাই এখানে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলত, শহরকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে। সে শহর এখনো দেখা যাচ্ছে অবশ্য, কিন্তু বড়ই অচেনা। পাশের পঁয়ত্রিশ তলা বাড়িগুলোর কোনো তলাতেই আলো জ্বলছে না। আলো জ্বলছে না গোটা শহরে। কারণ আলো জ্বালার লোকরাও বেঁচে নেই আর। রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হর্নের চিৎকার, লোকের আসা যাওয়া কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে আর্তনাদ ছুঁড়ে ছুটে যাচ্ছে এক আধটা অবশিষ্ট অ্যাম্বুলেন্স। কিম্বা কাঁচ ঢাকা হিয়ার্স ভ্যান। এখন অবধি বেঁচে থাকা কিম্বা সদ্য মরে যাওয়া গোটা কতক মানুষের জন্য। 

বুক ভরে শ্বাস নেয় রাজু। দারুণ টাটকা হাওয়া। পোড়া মবিল, পেট্রোল, ধূলোবালি, দূষণ কিছুই নেই এ হাওয়ায়। আছে গাছের গন্ধ, পাখির গন্ধ, জলের গন্ধ। হ্যাঁ, জলের গন্ধও। আসলে ছিল তো একটা মস্ত জলা, রাজুদের ঐ কারখানাটার পিছনের জমিতে। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। কারখানা বন্ধ হয়ে গেছিল অনেকদিন। মালিক আর ইউনিয়ন নেতাদের ঝামেলা, প্রোডাকশন কম, ওয়েজ কম, ধর্মঘট, পতাকা, ধর্ণা…আরো কত কী-র পর। আজকের এই পোড়ো শপিংমলটার মতোই কারখানাটাও দাঁড়িয়ে ছিল সব যন্ত্রপাতি বুকে নিয়ে। প্রথমদিকে অনেকেই নিয়মিত আসত গেটে, আশায় যে একদিন খুলে যাবে ফ্যাক্টরি। আবার সচল হবে মেশিন, ভোঁ বাজবে, হাজিরা খাতায় সই পড়বে। হয়নি। সবকটা লোক মরে হেজে গেছে একে একে। তবু রাজু বসে ছিল, বসে থাকত ওর ছোট গুমটিটায়, যেটা সবাই জানত দারোয়ানের ঘর। জলাভূমির পরিযায়ী পাখিদের সাথে গপ্পো জমাতো। কথা বলত আশেপাশের বড়বড় গাছগুলোর সাথে। রাজু জানত না, কখন তলে তলে হাতবদল হয়ে গেছে, গোপন চুক্তি হয়ে গেছে যুযুধান সব পক্ষের। কিছুতেই দারোয়ানের ঘর ছাড়তে রাজি হয়নি রাজু। শপিং মল বানানো পুরোদমে চলছে তখন। শেষটায় এক সন্ধ্যেয় পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জের গুলি চলেছিল। 

রাজু এখন ছাদে। এখানে সারসার গাড়ির পার্কিং ছিল এককালে। এখন হু হু শূন্যতা। আসলে সব অসুখের ভ্যাকসিন যে বানানো যায় না, এটাই বোঝে নি মানুষ। ভেবেছিল গায়ের জোরে গড়ে তোলা যায় ঈর্ষার উচ্চতা। কিন্তু যদি কোনোদিন প্রতিশোধের জীবাণু গুটিগুটি ছড়িয়ে পড়ে শহরময়? যদি উচ্ছেদ হওয়া গাছগাছালি, পোকামাকড়, পাখপাখালি, জন্তুজানোয়ার সবাই আবার ফিরে আসতে চায়? নিজের জায়গায়? তখন পালাতে পালাতে শেষ অবধি এই ছাদের পাঁচিলে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ নামতে চায়, অথচ সবকটা চলমান সিঁড়ি এখন ঢেকে নিয়েছে ঘন সবুজ ঘাস। সাথে চলন্ত হাতল পেঁচিয়ে নাম না জানা গুল্ম, লতা, পরজীবীর আরোহী মূল।

রাজু শপিং মলের কঙ্কাল ছেড়ে ভেসে পড়ে…


Previous Post Next Post