এই ছদ্ম লকডাউনের মানে আমার এই মোটা মস্তিষ্কে ঢোকেনি আজও। শুনছি আমরা তৃতীয় ধাপ এর দিকে এগোচ্ছি। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবু বাজার খোলা। লোকজন বাজারে যাচ্ছেন। জিনিসপত্র কিনছেন। মানুষ জিনিসপত্র বেচছেন। আমার এখনো মনে হয় এই পোড়া দেশে সম্পুর্ণ লকডাউনের কোনরকম পরিকাঠামো নেই। এবং কেন্দ্র বা রাজ্য কোন সরকারেরই এ বিষয়ে যতটা উদ্যোগ থাকা দরকার তা একেবারেই নেই। জনগণের কথা বাদই দিলাম। তারা এখনো ফেসবুকীয় রসিকতায় ব্যস্ত চা আর গাঁদাফুল নিয়ে।
ভারতের জনসংখ্যার যে বিপুল পরিমান মানুষ দৈনন্দিন স্বাস্থ্য, স্বচ্ছতা বিষয়েই সম্পুর্ণ অসচেতন তাদের মহামারী বিষয়ে সচেতন করার জন্য যে বিপুল আয়োজন দরকার তার তুলনায় যা হচ্ছে তা সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসে যা নিদান দিলেন তা হল তালি বাজানোর। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় ইঁট দিয়ে গোল্লা এঁকে দেখাচ্ছেন তিনহাত তফাৎ যাও। আর তার চারপাশে লোকজন গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দেখছেন সে কাণ্ড। মাননীয়ার সে দিকে চোখ পড়লো না। বলা হল দৈনন্দিন সব্জি ফলমূলের দোকান খোলা থাকবে। এদিকে পুলিশ বাইরে দেখলেই আগুপিছু না শুনেই পেটাতে শুরু করলো। নির্দেশ এল এক্কেবারে বাইরে বেরোবেন না। অথচ না বেরোলে খাবার আসবে কোথা থেকে সে বিষয়ে কোন নির্দেশ নেই। বলা হল অনলাইন ডেলিভারি সিস্টেম চালু থাকবে। অথচ দেখছি সেসব কিছুই চালু নেই। শুনলাম এ রোগ বায়ুবাহিত নয়। অথচ মাস্ক পরার হুড়োহুড়ি লেগে গেল। শুনলাম স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধোওয়া দরকার। অথচ স্যানিটাইজার কোত্থাও পাওয়া যাচ্চে না। যা বুঝলাম বিদেশ থেকে যারা এসেছেন তাদের দ্বারাই এ রোগ বাহিত হয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু যারা ফিরেছেন তাদেরকে ধরে ধরে সব্বার করোনা টেস্ট করা সম্ভব হলো না। ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। দু একখানা স্টেডিয়ামকে রাতারাতি হসপিটাল বানিয়ে আগামীদিনের পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো যাবে তাও আমার কাছে পরিস্কার নয়। অথচ সব্বাই তাই নিয়ে খানিক নেচে নিলেন।
কেউ বলেছিলেন যে দেশের জনগণ যেমন তারা তেমনই সরকার পেয়ে থাকেন। চিরদিনই অভিজ্ঞতায় দেখলাম সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। রাজ্য সরকার কত কোটি বরাদ্দ করলো আর কেন্দ্র সরকার কত কোটি বরাদ্দ করলো তাই নিয়ে আকচাআকচি করে যাচ্চেন দেশের মাননীয় নেতানেত্রীবৃন্দ। আর আমরা মেতে আছি কোন রাস্তায় হরিণ দেখা গেল আর কোন রাস্তায় ডাইনোসোর দেখা গেল সে নিয়ে।
যে কথাটা তিক্ত সত্যি সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাদের অসংখ্য অকর্মণ্য চেলাচামুণ্ডাদের পেটের ভাতের কথা ভাবতে হয় না। ভাবতে হয় না হাইরাইজে বসে ফেসবুক লাইভে হঠাৎ জন্ম নেওয়া উঠতি শিল্পীদেরও। সমস্ত শিল্পের আগে পেট কথা বলে।
ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম। অতটা দেখার বোঝার মত মেধা আমার নেই। বাংলার গ্রামেগঞ্জে শহরে পথে ঘাটে ঘুরে ঘুরে এই মাটিটাকে খানিক যা চিনেছি তাতে হাততালি দিতে বলায় তাসাপার্টি নিয়ে বেরিয়ে পড়লে আমি অন্তত অবাক হইনি।
আমাদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল আমরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কখনোই সচেতন নই। কোনদিন ছিলাম না। ফলতঃ সময়কে কাজে লাগিয়ে যে যেমন নাচায় আমরা তেমনই নাচি। আর নাচানোর দলে চিরকালই থাকে ক্ষমতা এবং অর্থবানরা। যার যেমন ক্ষমতা এবং যার যেমন অর্থ সে তেমন বড়ো মান্যিগন্যি। একমাত্র রোগই এ দুয়ের ধার ধারে না। এবং যখন রোগ চিকিৎসাসীমার বাইরে তখন তো কথাই নেই। কিন্তু সে কথা বোঝে কে! আমরা মাস্ক পরেই পরমানুবোমা ঠেকিয়ে দিতে পারি।
কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার যে অর্থ বরাদ্দ করেছেন সে আমার আপনারই টাকা। নেতানেত্রীরা নিজেদের ঘরবাড়ি বেচে দেননি যে তার জন্য তাকে আলাদা করে থ্যাঙ্কিয়্যু বলতে হবে। বরং যে কাজগুলো করা অত্যন্ত দরকার ছিলো কিন্তু এখনো করেন নি সেগুলো মনে করিয়ে দিন।
এমন গাজোয়ারি লকডাউন ঘোষণা করে কিচ্ছু হবে না। বরং অজুহাত তৈরি করা যাবে আমরা তো পইপই করে বেরোতে বারন করেছিলাম, তোমরা বেরিয়েছো কেন? অতএব দোষ তোমাদেরই।
অতঃপর প্রশ্ন হল কী করা যায়?
📢 ১। বাজার সম্পুর্ণ বন্ধ হোক। চালু হোক সরকার নিয়ন্ত্রিত র্যাশন হোম ডেলিভারি। যার আয় বন্ধ তাকে বিনামূল্যে দেওয়া হোক।
আমি আয় করলে যখন সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয় তখন আমার আয় বন্ধ হলে সরকার দায়িত্ব নেবে না কেন সে প্রশ্নটা আর কবে করবেন? আটটায় লাইভ এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে তালি বাজাতে বলে বা বাজারে ঘুরে গোল্লা এঁকে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় সেটা বোঝার সময় এসেছে!
📢 ২। সমস্ত কর্পোরেট সংস্থার ওপর জরুরি ভিত্তিতে অতিরিক্ত কর চাপানো হোক।দেশের প্রায় সমস্ত মানুষের কাছে ফ্রিতে জিও সিম পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে যখন তখন খাবার কেন পৌঁছে দেওয়া যায় না, জ্বালানি কেন পৌঁছে দেওয়া যায় না সে প্রশ্ন করুন। চিৎকার করে করুন!
📢 ৩। সারা রাজ্যে অঞ্চলভিত্তিক করোনা টেস্ট চালু হোক।হোম কোয়্যারান্টাইনে রেখে দেখা নয়। টেস্ট চালু হোক প্রথম সুযোগেই। উপযুক্ত সংখ্যক কিট নেই এ কথা শুনে মেনে নেওয়ার সময় নয় এখন। যার সংক্রমণ হয়েছে তার চেন ফলো করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যায় এ কথা বোঝা তো শক্ত নয় তেমন।
📢 ৪। প্রত্যেক পৌরপ্রতিনিধি এবং পঞ্চায়েত প্রতিনিধি রাস্তায় নামুন। মানুষের পাশে গিয়ে আস্বস্ত করুন।ভোটের সময় প্রতিনিধিরা একটি বাড়িও বাদ দেন না। এখন তারা পথে নামুন। প্রতিটা বাড়িতে যান। হ্যাঁ। প্রত্যেকটা বাড়িতে যান। সচেতন করুন জনে জনে ধরে ধরে। সুবিধে অসুবিধের কথা খোঁজ নিন। কিছু সমস্যা থাকলে চটজলদি সমাধান করুন।
এসব কিছুই হবে না জানি। কারন এসব চাওয়ার মত দম আমাদের নেই। আদায় করে নেওয়ার মত দম কাকে বলে আমরা কস্মিনকালেও দেখিনি। আমরা খোঁড়াতে খোঁড়াতেই চলতে অভ্যস্ত। ট্যাক্সিওয়ালা হারানো টাকা ফেরৎ দিলে আমরা তাকে হিরো ভাবতে অভ্যস্ত। যেন না ফেরত দেওয়াটাই স্বাভাবিক। তেমনই যে প্রশাসন কোনদিন ফিরেও তাকায়না সে খানিক অপাঙ্গে দেখলেই আমরা গলে জল হয়ে যাবো। আমরা বরং ভাববো ধুস... এসব আকাশকুসুম দাবী আবার কোনদিন সত্যি হয় নাকি! আর বেশি হবেটাই বা কী? কিছু লোক মরবে। যার সিংহভাগ হয়তো দেখা যাবে সেই হাভাতে সাধারণ মানুষ। দেশের বেশিরভাগই তো গরীব মানুষ। র্যান্ডম দশজন মরলে তাতেও তো আটজন গরীব। তাতে আর কী এসে যায়। একদিন না একদিন এসব থামবেই। তারপর বরং কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় সেই নিয়ে প্ল্যান করুন। নাহয় বরং টিকটক আর গোপন মেসেজ মেসেজ খেলুন। আপনাকে গোপন মেসেজ করার অ্যাপ এর লিঙ্ক দিয়ে যান কমেন্টে। বা কোয়্যারান্টাইনে আপনার কী শিল্পপ্রতিভা বিকশিত হলো তা জানিয়ে যান।
"মাফ করবেন। এই জটিল পরিস্থিতিতেও কয়েকটা তিক্ত কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।আর হ্যাঁ.... 'লাইক' করে আপনার সহমত না জানালেও চলবে। এ লেখা লাইক পাওয়ার জন্য নয়। বরং আপনার নিজের কথা মনে হলে কপি করে নিজের দেওয়ালে রাখুন। ফিসফাস থেকে চিৎকার তৈরি হোক।
Tags:
প্রবন্ধ