শ্রীশুভ্র / যমালয়ে জীবন্ত মানুষ

শ্রীশুভ্র / যমালয়ে জীবন্ত মানুষ

যমালয়ে জীবন্ত মানুষ। গোটা বিশ্বই যেন এখন যমালয়। কেউ জানে না চলমান মৃত্যু মিছিলে পরবর্তী সওয়ারি কে হবেন। কারণ রোগটা ছোঁয়াচে। আর সেই করণেই আতঙ্কের। মানুষের পক্ষে মানুষের ছোঁয়া এড়িয়ে দিনযাপন দুরূহ। ফলে রোগের সংক্রমণ এত ব্যাপক। ফলে মানুষই মানুষের আতঙ্কের কারণ এখন। মানুষের মুখ যেন যমদূতের রূপ ধারণ করছে। সকলেই তাই সকলের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন। এই দূরত্বই হয়তো প্রাণ বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেকের। না, শুধু যে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকার সামাজিক দূরত্ব রক্ষার উপর জোর দিচ্ছে বলেই আমরা গৃহবন্দী ঠিক তাও নয়। মনের গভীরে যে ভয় বাসা বেঁধেছে, সেই ভয়ও আমাদের অনেককে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। সেটিই চিরন্তন মৃত্যুভয়। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের যাবতীয় কোলাহলের নিচে যে ভয়টি চাপা পড়ে থাকে। আজ সেই ভয়ই ঘোমটার আড়াল সরিয়ে সরাসরি মুখোমুখি। আমরা যে যাই করি না কেন, সারাদিন এই ভয় আমাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রমাগত। খবর দেখলেই চেখের সামনে করোনা আক্রান্তের আর করোনায় মৃতের পরিসংখ্যান। আমরাও হিসাব করে চলেছি মনে মনে। সেই পরিসংখ্যানের ভয়াল গ্রাসের থেকে আমরা কতটা নিরাপদে। আবার নিরাপদেও যে নেই, জানি সেকথাও। তবুও যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। তাই নিরাপদে থাকার চেষ্টাই এই মুহূর্তে আমাদের কাছে প্রধানতম বিষয়। 

কিন্তু কিভাবে সম্ভব নিরাপদে থাকা? থাকলেও কতদিন সেটি নিরাপদ? ভয় কি শুধুই করোনা নিয়ে? নাকি অর্থনৈতিক বিপর্যয় জনিত জীবন জীবিকা ও জীবনধারণের সম্ভাবনা নিয়েও ভয়? একদিকে করোনা, অন্যদিকে খাদ্যসঙ্কটের আশু সম্ভাবনা। একদিক মহামারী অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ্য। মৃত্যু যে কোনদিকে ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে, সেটাই সবচেয়ে বড়ো চিন্তার বিষয়। আতঙ্কের বিষয়। এই আতঙ্কের ভিতরেই আজও ভোর হলো। পাখি ডাকল। সকালের রোদ হাতছানি দিল। না বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকাটা কতক্ষণের কেউই জানি না আমরা। কোনদিনই জানতাম না। কিন্তু সেই না জানার ভিতরেও একটা ধারণা থাকে, মৃত্যুর এখনো দেরি আছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। সারতে হবে সেসব। কিন্তু আজকের ভোরে যারা জেগে উঠে দেখলাম বেঁচে আছি, তাদের কতজন নিশ্চিত এই বেঁচে থাকার সময়সীমায় অচিরেই দাঁড়ি পড়ে যাবে না? ফলে সকালের রোদের হাতছানির ভিতরেও মৃত্যুর কালো ছায়াপাত। 

যুদ্ধটা তাই শুধুই করোনার বিরুদ্ধে নয়। যুদ্ধটা আশু খাদ্যসংকটের সাথেও। যুদ্ধটা এই মৃত্যুভয়ের সাথেও। সেই যুদ্ধে কে থাকবে আর কে যাবে, প্রতিদিন সেই পরিসংখ্যানের পরিমার্জন চলছে বিশ্ব জুড়ে। শীতের পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো ঝরে পড়ছে মানুষের জীবন। এক এক করে। মানুষের জীবন রাতারাতি এক একটি মৃতদেহের সংখ্যায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান হয়ে যাচ্ছে। জীবন থেকে পরিসংখ্যান হয়ে ওঠার এই মিছিলে কে কবে পা মেলাতে বাধ্য হবো, জানি না আমরা কেউ। তবু আমাদের আশা অন্তহীন। সেই অন্তহীন আশা নিয়েই জানার চেষ্টা করে চলেছি এই রোগের মৃত্যুহার কেমন? বোঝার চেষ্টা করে চলেছি, সেই হারের পরিসংখ্যানের গুরুত্ব কতটা ভয়াবহ আর কতটা আশাপ্রদ। মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার অন্তহীন প্রয়াসের এও এক মানসিক প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি আমাদের মজ্জাগত প্রকৃতি। জন্মের ক্ষণেই আমাদের আবির্ভাব ঘটে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। সেই মৃত্যুর খাঁড়া মাথায় নিয়েই আমাদের প্রতিদিনের জীবন উদযাপন। প্রতিদিন মৃত্যুভয়কে ভুলে প্রায় তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে আমাদের চলার চেষ্টা। করোনা সেই চেষ্টাকে সরাসরি চ্যালেন্জ করে চলেছে। ভয় আমাদের এই চ্যালেন্জকেই। 

বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে মানুষের প্রভুত উন্নতিও প্রকৃতির রোষের কাছে অসহায় বোধ করছে এইসময়। কে হারে কে যেতে। আপাতত পাওয়া পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বিশ্বে করোনা আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৪ লক্ষ ৭১ হাজার ৫৪৬ জন। যার ভিতর মারা গিয়েছেন ২১ হাজার ২৯৬ জন। আর সেরে উঠেছেন ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৬৯৪ জন। এবং যে ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ৭৬৬ জনের চিকিৎসা চলছে তার ভিতর মাত্র ৪% রুগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। অর্থাৎ চিকিৎসাধীন ৯৬% রুগীরই রোগমুক্তির আশা রয়েছে। বিস্তর পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করে আমরা যখন এই একটি পরিসংখ্যানে এসে পৌঁছই তখন মনে হয় আশা আছে। আশা আছে। প্রকৃতির রোষ আর মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য লড়াইয়ের ভিতর এখনো আশা আছে। আশা আছে মানুষের বিজয়ী হওয়ার। সেই আশার পরিসংখ্যান আমাদের মনের স্থিতি রক্ষায় বল জোগায়। আমাদের আরও দৃঢ়চেতা করে তোলে। অন্তত মরার আগে না মরার মনোভাবকে বাঁচিয়ে রাখার। সেখানেই মানুষের শক্তির ভরকেন্দ্র। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২৯শে জানুয়ারীর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় করোনায় মৃত্যুর হার ২ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ ৯৮ শতাংশ রুগীরই রোগমুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে এই পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। এই সময় পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত প্রথম সারির দেশগুলির প্রায় সবই প্রথম বিশ্বের উন্নত স্বাস্থ্য পরিসেবার পরিকাঠামোযুক্ত দেশ। এবং যেখানে সাধারণ মানুষের জনবসতির ঘনত্বও খুব বেশি নয় একমাত্র চীন ছাড়া। ফলে একদিকে জন বসতির ঘনত্ব কম থাকা। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিসেবার উন্নত আধুনিক পরিকাঠামো। এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জরিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত পরিসংখ্যানের পিছনে। তাই মাত্র ২ শতাংশ মৃত্যুহার জেনেও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার উপায় নাই। এই মারণ ব্যাধি তৃতীয় বিশ্বের ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশগুলিতে চীন ইতালি স্পেনের মতো তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়লে করোনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি হওয়ারই সমূহ সম্ভাবনা। আমাদের এই দেশগুলিতে অনুন্নত পরিকাঠামো, জনবসতির বিপুল ঘনত্ব, চিকিৎসকের অভাব, স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে জনসচেতনতার অভাব, ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রেক্ষিত ভয় হওয়াই স্বাভাববিক। এবং সেক্ষেত্রে করোনা জনিত সার্বিক পরিসংখ্যানে বিস্তর ওলোট পালোট হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা। 

তাই মৃত্যভয় আজ আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে চারদিক দিয়েই। কখন কোথায় ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে যমদূতের বাহিনী কেউ জানি না। শুধু জানি, আমাদের মতোন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যমদূত বাহিনীর জন্য প্রশস্ত রাজপথ আর পুস্পক রথের অভাব নাই। শুধু একবার যাত্রা শুরু করলেই হলো। আর ঠিক সেই আশঙ্কাতেই আজ আমরা গৃহবন্দী। মনে করছি এইটিই শেষ এবং একমাত্র পথ। আর তাই যত বেশি সংখ্যক দরজায় খিল আঁটা যায়, সেই লক্ষ্যেই আমরা দরজা বন্ধ করে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায়। কিন্তু দেশ জুড়ে সকলেই যখন এই একটি পথই বেছে নিতে বাধ্য হয়, তখন আরও একটি প্রশস্ততর হাইওয়ে খুলে যায় পিছন দিকে। যে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে আসে খাদ্যসংকট। আর তার পিছু পিছু যমদূতের বিশাল বাহিনী। সামনের দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকলে পিছনের দরজা যায় হাট করে খুলে। করোনা ঠেকাতে সক্ষম হলেও খাদ্যসংকট ঠেকানো দায়। 

কিন্তু এখানেই একটা মস্ত টুইস্ট রয়েছে। করোনারূপী যমদূত ধনী দরিদ্র কাউকে রেয়াৎ করে না। তার চাই শুধু লাশ। কিন্তু খাদ্যসংকটরূপী যমদূত ধনীদের বাড়িতে ঢুকতে পারে না। সেখানে থাকে কড়া পাহারা। সেই পাহারা এড়িয়ে যমদূত বাহিনীর সাধ্য নাই প্রবেশ করে। তাই দরিদ্র গৃহের হাট করে খোলা পিছনের দরজাতেই তখন তাদের যাবতীয় ভীড়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে তাই করোনার সাথে খাদ্যসংকট ফ্রী! এবং তখন মৃত্যমিছিল ধনী পাড়া এড়িয়ে দরিদ্রপল্লী উজার করতে করতে এগিয়ে চলতে থাকবে। পরিসংখ্যান রক্ষার ভার তখন আর পড়ে থাকবে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাতে। 

অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসাবে আমাদের সামনে এবং পিছনে দুই দিকেই বিপদ। তাই মৃত্যুভয়ের বিকট হাঁ এখানে আরও বেশি ভয়াবহ। মৃত্যুভয়ের সেই করাল গ্রাস এড়িয়ে যারা রয়ে যাবে আগামী পৃথিবীতে তারা সত্যিই ভাগ্যবান না আরও বেশি হতভাগ্য, সেকথা বলতে পারবে একমাত্র আগামী ভবিষ্যতই। আপাতত একথা বলাই যায়, মানুষের এই বিশ্ব আর ঠিক মানুষের বসবাসের যোগ্য নয়। তাই মৃত্যুর ঠিকানায় যাঁদের নিয়তি লেখা হয়ে যাচ্ছে এইসময়ে, তাঁরা হয়তো এক অর্থে ভাগ্যবানও বটে। এই অসুস্থ বিশ্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার এই হয়তো এক মাহেন্দ্রক্ষণ। যমালয়ে জীবন্ত মানুষ হিসাবে বাস করার থেকে মৃত্যু কি বেশি কষ্টের? নাকি বেশি আতঙ্কের? 

২৯শে মার্চ’ ২০২০
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
Previous Post Next Post