আমরা গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাই, লঞ্চে বা নৌকায় গঙ্গাবিহার করি, গঙ্গা স্নান করি, গঙ্গায় ডুব দিয়ে পবিত্র হই, গঙ্গার জল ঘরে এনে দেবদেবীর পূজায় ব্যবহার করি, পূজার পর গঙ্গায় বিসর্জনও দিয়ে থাকি। পশ্চিমবঙ্গবাসী বিশেষ করে যারা দক্ষিণ বঙ্গে আছি তাদের কাছে আমাদের এই গঙ্গা কি সত্যিই গঙ্গানদী, এই গঙ্গার জল কি সত্যিই গঙ্গাজল?
গঙ্গা ভারত বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত একটা আন্তর্জাতিক নদী, এবং ভারতের জাতীয় নদী। গঙ্গানদী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্রতম নদী যাকে মাতৃদেবী রূপে পূজা করাও হয়। যদিও আমাদের লজ্জ্বা যে বর্তমানে বিশ্বের পাঁচটি দূষিততম নদীর মধ্যে আমাদের পবিত্র গঙ্গা একটি। সে যাই হোক তবু আমাদের গঙ্গাকে আমরা ভালোবাসি, গঙ্গাতীরে যখন একা বসে থাকি তার অপরূপ রূপে, তার কুলুকুলু কলতানে মোহিত হয়ে বিজ্ঞানাচার্য্য বসুর মতন মনে মনে জিজ্ঞাসা করে ফেলি ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ’ এবং সেই একই উত্তর পাই ‘মহাদেবের জটা হইতে।‘ গঙ্গা পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী মহাদেবের জটা থেকেই হোক বা দৃশ্যমান উত্তরাখণ্ডে হিমালয়ের গোমুখ-গঙ্গোত্রীর হিমবাহ থেকে হোক, উৎসারিত হয়ে তার দীর্ঘ ২,৫২৫ কিলোমিটার গতিপথের মধ্যে ২৫০ কিলোমিটার পাহাড়ী পথে নাচতে নাচতে এসে হৃষিকেশে হিমালয় ছেড়ে হরিদ্বারে সমভূমিতে নেমে প্রায় ১,৮০০ কিলোমিটার পথ হেলতে দুলতে দুলতে এসে ডান দিকে ঝাড়খণ্ডের রাজমহলকে রেখে মালদা জেলার রতুয়ার কাছে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। পথিমধ্যে অবশ্য অনেক নদী উপনদী গঙ্গার সাথে মিশেছে, আবার কিছু শাখানদী গঙ্গা মায়ের কাছ থেকে বেরিয়ে দামাল শিশুদের মতন এদিক ওদিক ছুটে চলেছে।
পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে আরও প্রায় ৮০ কিলোমিটারের মত পথ প্রবাহিত হওয়ার পর ফরাক্কা ব্যারেজে গঙ্গার গতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে বেরিয়ে আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার যাওয়ার পর মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুরের কাছে আহিরণের গিরিয়াতে গঙ্গা থেকে তার শাখানদী ভাগীরথী বার হয়ে সাগরের পথে দক্ষিণ বঙ্গের দিকে গেছে। মূল গঙ্গানদী তার সিংহভাগ জল বুকে নিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে অর্থাৎ হিমালয়ের উৎপত্তি স্থল থেকে ২,১৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পূর্বদিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যেখান থেকে তার নাম হয়েছে পদ্মা।
আহিরণের গিরিয়ার কাছে গঙ্গা মায়ের কোল থেকে নেমে ভাগীরথী ২৪১ কিলোমিটার হামাদিয়ে আসার পর নবদ্বীপের কাছে জলঙ্গীনদী ভাগীরথীতে মিশেছে, আর এখান থেকেই ভাগীরথী হুগলীনদী নাম নিয়ে কলকাতা তথা সাগরের দিকে এগিয়ে গেছে। আর এই ভাগীরথী হুগলী নদীকেই আমরা দক্ষিণ বঙ্গের বাঙালীরা গঙ্গা বলে থাকি। এই হুগলীনদীই বাঙ্গালীর বড় আদরের গঙ্গা, আমাদের মা গঙ্গা, গঙ্গা মাইয়া। গিরিয়ার কাছে গঙ্গা থেকে বার হয়ে ভাগীরথী হুগলী প্রায় ৫১১ কিলমিটার পথ অতিক্রম করে সাগর দ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই ৫১১কিলোমিটার প্রবাহপথে ভাগীরথী হুগলীতে মিশেছে ময়ূরাক্ষী, জলঙ্গী, অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ, হলদি ওর আরও কিছু ছোট ছোট নদী। সমুদ্রের জোয়ার এর জল হুগলী নদীর নবদ্বীপের কাছাকাছি পর্যন্ত আসে। আমাদের এই গঙ্গার ধারেই আমরা বেড়াতে যাই, হুগলী বর্ধমানের দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে তিরপুণীর (মগরার ত্রিবেণী) ঘাটে গঙ্গাচান করতে যাই, অশৌচান্তে নিজেদের পবিত্র করতে গঙ্গাস্নান করি, এই গঙ্গারই জল ঘরে এনে পূজাতে ব্যবহার করি। নদীর জল আমরা যেমন মিউনিসিপ্যালিটির জলসরবরাহ সিস্টেমে পাইপের মাধ্যমে বাড়িতে পাই, যা দিয়ে আমরা স্নান করি, পান করি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করি, ঠিক সেই রকমই আমরা মূল গঙ্গার জল পাইপের বদলে এখন ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে ভাগীরথী হুগলী থেকে পাচ্ছি, মূল গঙ্গাকে না পেলেও আসল গঙ্গার জলই এখন আমরা পাচ্ছি।
ভাগীরথীর উৎসমুখে অত্যধিক পলি পড়ার ফলে গঙ্গা থেকে ভাগীরথীতে জলের প্রবাহ খুব কমে যায়। ১৯৭৫ সালে ফরাক্কা ব্যারেজ উন্মুক্ত হওয়ার আগের কয়েক দশকের শুকা মরশুমে অর্থাৎ মার্চ এপ্রিল মে মাসে এই ভাগীরথীর জলে হিমালয় থেকে নামা গঙ্গাজলের পরিমাণ প্রায় শূণ্যই ছিল বলা চলে। মূল গঙ্গার প্রায় সব জলই সাবেক পূর্ববাংলায় চলে যেত। তখন ঐ কয় মাস ভাগীরথী-হূগলী নদীতে যে জল থাকত তার প্রায় সবটাই জোয়ারের সময় আসা সাগরের জল, ও ভাগীরথী হুগলীতে পড়া অন্যান্য উপনদী থেকে আসা জল। বাঙ্গালীর মা গঙ্গার এই সঙ্গীন অবস্থার সমাধানে মুর্শিদাবাদের ফরাক্কাতে গঙ্গার ওপর গড়ে তোলা হল ব্যারেজ। ব্যারেজ অর্থাৎ বাঁধে গঙ্গার জল কিছুটা আটকে ৩৮.৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেলের সাহয্যে জঙ্গীপুরের কাছে আহিরণে ভাগীরথীতে পাঠানো হচ্ছে। এই ফিডার ক্যানেলের তলদেশ বিখ্যাত সুয়েজ খালের তলদেশের চেয়ে বেশী চওড়া। ফিডার খাল দিয়ে গঙ্গার জল আসার ফলে ভাগীরথী হুগলীর নাব্যতা অনেক বেড়েছে, হুগলী নদীর জলে সাগরজলের লবণের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। আর আমরা বাঙালীরা আমাদের গঙ্গামাকে আমাদের কাছেই পাচ্ছি।
Tags:
অন লাইন