ভর দুপুরের সময়। হঠাৎই একটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো৷ ভাই.... ভাই.....জলদি চলেন! ওদিকে কিছু ছেলে আমাদের টেন্টে রঙ দিয়ে আমাদের লেখাগুলো মুছে দিচ্ছে।
দুই বিল্ডিয়ের মাঝবরাবর সরু গলিতে বসে বিড়ি ফুঁকতে থাকা তারিক চোখ তুলে তাকায়। বিড়িতে টান দেয় দুবার। ধোয়া ছাড়ে। নাক দিয়ে ভর ভর করে ধোয়া বের হয়। সাথে থাকা সঙ্গীকে নিয়ে বাইকে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে টেন্টের দিকে। শতশত গাছের সারি ক্যাম্পাস জুড়ে। বিশাল বড় ক্যাম্পাস। তারই মাঝে গাছের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা টেন্ট। একেকটা একেক রাজনৈতিক দলের। এর মাঝে নতুন দুটো তৈরী হয়েছে। এদুটোর দখল নিয়েই টানাপোড়েন চলছে কিছুদিন থেকে। একদল আগে থেকেই সক্রিয় ছিল টেন্ট দখলে। এর মাঝে একদল ছাত্র কলেজ প্রশাসন থেকে নিজেদের জন্য একটা টেন্টের বরাদ্দ নিয়ে নিলো। অপরটার বরাদ্দ হলো নবীন একদলের জন্য৷ কিন্তু ঝামেলা শুরু হলো এটা নিয়েই৷ তারিকের দল প্রভাবশালী গ্রুপ। নবীন দলের বরাদ্দকৃত টেন্টটা যে তারা দখলে রেখেছে, ওটা তো তাদের চাই-ই চাই৷ আফটারল সব ক্ষমতা যখন তাদের হাতে। ইতিমধ্যে নিজেদের নামে বিভিন্ন স্লোগান, কবিতার অংশ টেন্টের সর্বত্র লিখেছে তারিকরা একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে। এখন কার এত সাহস এসব মুছে ফেলার।?
বাইক থেকেই নজর গেলো দূরের টেন্টের দিকে। তিনচারজন ছেলে রঙের বালতি হাতে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে একজন সাদা রঙদিয়ে মুছে দিচ্ছে তারিকদের পূর্বের লেখাগুলো।
বাইকটা ঘ্যাচ করে থামালো ছেলেগুলোর একদম পিছনে৷ ইঞ্চির জন্য গায়ে লাগলো না যেনো। ঘুরে তাকালো সবাই। তারিককে চেনে সবাই। জানে কেমন কেউকেটা ও। সবার চোখে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত ভাব।
"তোদের এত সাহস আমাদের টেন্টের লেখা মুছে দিচ্ছিস " -চেঁচিয়ে উঠলো তারিক।
আমতা আমতা করতে লাগলো ছেলেগুলো৷ চশমাপড়া রোগাপটকা একটা ছেলে এগিয়ে এলো সামনে। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সামনে ধরলো। আর কোন কথা বললো না ৷ ঝট করে কাগজটা হাতে নিলো তারিক। কলেজ প্রশাসন থেকে টেন্টের অনুমতি সম্পর্কিত প্রমানপত্র।
"ড্যাম ইট " নিজের উপর রাগ হলো তারিকের। পিছনে বসা ছেলেটাকে হুকুমের সুরে বললো " কোন কাগজ-টাগজের টাইম নাই, এরা যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে না সরে তবে আজ সব কয়টার লাশ পড়বে। টেন্ট আমাদের ছিলো আমাদেরই থাকবে৷ প্রিন্সিপালের সাথে আমি কথা বলবো। "
পিছনে বসা গুন্ডা টাইপের ছেলেটা বাকীদের গালিগালাজ করতে শুরু করলো৷ ছেলেগুলা ভাবেনি এমন কিছু হতে পারে বা তারিকরা হঠাৎই চলে আসবে৷ ওরা ঝামেলাবাজও না, তারিকদের সাথে পেরে উঠবে তাও না। তাই ওরাও কয়েক মিনিটের মধ্যেই উধাও হয়ে গেলো৷
তারিকের মেজাজ টা চড়ে গেছিলো। শালা এতবড় সাহস হয় কি করে। আমাদের টেন্ট দখল করতে চায়৷ আজ সাথে আরো কিছু পোলাপান থাকলে মাইর হইতো মাইর। পরে হবে। ফেস তো চেনা আছে৷ যাবে কোথায়। আর প্রিন্সিপালের এত বাড়াবাড়ির সাহস কি করে হলো। চাকরী থাকবে না দেখে নিস। রাগে ফুঁসছিলো যেনো তারিক। সাথের সঙ্গী অবস্হা নিয়ন্ত্রন করতে তারিক কে বুঝিয়ে কলেজের বাইরে নিয়ে যায়। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। অনেক কাজ পড়ে। রাতের প্রথম প্রহরে ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে হবে দলীয় ভাবে৷ সকালে আরেকবার৷ ব্যানার, ফুল, সমর্থকদের ভীড় তৈরী করার দ্বায়িত্ব সব তারিকদের উপর৷ বাইকে ছুটে চলে তারিক। বাইকের ভোঁ ভোঁ বিশ্রী একটা শব্দ এলাকা জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
#
#
এই মধ্য ফ্রেবুয়ারীর বিকেলেও সূর্যের তাপ বোঝা যাচ্ছে। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো তৃষা৷ হলের এই তিনতলা থেকে ক্যাম্পাসের বিশাল একটা অংশ দেখা যায়৷ শহীদ মিনারের চূড়াটা দেখা যায় গাছের ফাঁকে ফাঁকে । নিশ্চয়ই এখনো কাজ চলছে সেখানে। আগামীকাল ভোরে ওরা যাবে ফুল দিতে, হলের সব ছাত্রীরা ব্যানার, ফুলের তোড়া বানাতে ব্যস্ত। হলের নিচের ফুলের বাগানে সারি সারি গাঁদা ফুল ফুটে আছে৷ কিন্তু হল প্রশাসন এসব নিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে৷ তাতে কি? ফুল চাই সবার। রাতেই দেখা যাবে সব চুরি হয়ে গেছে৷ অনান্যবারের মতো কাল বাগানের বিশাল অংশ লন্ডভন্ড লাগবে দেখতে। তৃষার অবশ্য ফুল নিয়ে চিন্তা নেই৷ তারিক ওকে আলাদা ভাবে এনে দেবেই৷ অনেকেই ফুল আনতে বাইরে যাচ্ছে। ডলি এসে ঘরে ঢুকলো৷ ডলি তৃষার কাছের বন্ধু। যদিও দুজন আলাদা ডিপার্টমেন্টে পড়ে কিন্তু হলে থাকতে থাকতে সখ্যতা দৃঢ় হয়েছে।
'কিরে যাবিনা বাইরে, ফুল আনি , চল যাই ' ডলি প্রশ্ন করে।
'না রে। তুই যা । ভালো লাগছে না বাইরে যেতে " উত্তর দেয় তৃষা।
"আচ্ছা কিছু লাগবে নাকি বল '?
" না, কি আর লাগবে, জলদি ঘুরে আয় "
ডলি বেরিয়ে যেতেই আবারো জানালা ধরে দাঁড়ায় তৃষা। বাইরে পড়াশুনা করতে এসে ভালোই হয়েছে৷ মফস্বল শহরে জাতীয় দিবসগুলোর চর্চা স্কুলের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। এখানে এসে বোঝা গেলো সেইসবের বিস্তৃতি৷ ভালোই লাগে। তারিকের কথা মনে পড়ে হঠাৎ। ওকে একটা ফোন দেয়া দরকার৷ পাঁচ-সাতদিন হয়ে গেলো কোন দেখাও করে না, কথাও বলে না তেমন। কি এমন এত ব্যস্ততা ওর? ওপারে ফোনের রিং বেজেই চলে ...
#
কলেজ ক্যাম্পাসটা বিশাল হওয়ায় এর চারপাশজুড়ে নানারকম দোকানপাট, বাজার, মেস বাড়ি, আবাসিক এলাকা গড়ে উড়েছে। ছোটখাটো বানিজ্যিক এলাকা বলা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে অনেক ফুলের দোকান বসেছে। চলছে রমরমা ব্যবসা। সবকাজ মোটামুটি গুছিয়ে তারিকরা ক্যাম্পাসের বাইরে আড্ডায় মসগুল। দলের সিনিয়র নেতারা আজ সবাই আসবে আড্ডায়৷ ভাইদের পাশে পাশে থাকা দরকার -ভাবে তারিক৷ দলে আগামীতে ভালো অবস্হা একরকম পাকাই তারিকের। যদিও কেউকেটা স্বভাবের জন্য অনেকেই পছন্দ করে না ওকে৷ তাই এখন সময় - সুযোগটা দরকার একবার শুধু। টেন্ট নিয়ে ঝামেলার কথাটাও বলা দরকার। তবে ও যে সহজে অন্যদের টেন্ট দখল করতে দেয়নি এটাও ওর ক্রেডিট হিসেবেই যাবে বৈকি।
ক্যাম্পাস এর ভেতর থেকে বাড়ির মুখে একদল ছাত্রছাত্রী। বেশ সুন্দরী মেয়ে দেখা যায় আজকাল। নাম খারাপের ভয়ে তারিকরা সাধারনত কাউকে উত্যক্ত করে না৷ করবেই বা কেন, ক্যাম্পাসের সুরক্ষার দ্বায়িত্ব তো ওদেরই৷হঠাৎ ই তারিকের সহযোগী বাড়িমুখো একদল ছাত্রীকে বাজে মন্তব্য করে। শুনে তারিকও হেসে ওঠে। ছাত্রীরা মাথা নিচু করে ভয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়। এইসবের মাঝে, সারাটা সন্ধ্যা রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে কর্মবিবরন সব নিয়েই আলোচনা হয়৷ ভাইয়েরা তারিকদের প্রশংসা করে। তারিকের পিঠ চাপড়ে দেয়। আত্মবিশ্বাস আরো বাড়ে ওর। আলোচনা শেষে বাড়ির পথে রওনা দেয়। রাতে যে আবার আসতে হবে । মন ফুড়ফুড়ে থাকায় তৃষাকে একবার ফোন দেয়ার কথা মনে পড়ে। রিং বেজেই চলে কিন্তু না ধরলো না তো। আবারো কল করে, কিন্তু না এবারো কোন রেসপন্স নেই৷ " ধুর বেশি দেমাগ "। ভুরুর কোনায় তারিকের ভাঁজ পড়ে। " না ধরলে নাই ; যা ইচ্ছা হয় করুক "।
ক্যাম্পাস এর ভেতর থেকে বাড়ির মুখে একদল ছাত্রছাত্রী। বেশ সুন্দরী মেয়ে দেখা যায় আজকাল। নাম খারাপের ভয়ে তারিকরা সাধারনত কাউকে উত্যক্ত করে না৷ করবেই বা কেন, ক্যাম্পাসের সুরক্ষার দ্বায়িত্ব তো ওদেরই৷হঠাৎ ই তারিকের সহযোগী বাড়িমুখো একদল ছাত্রীকে বাজে মন্তব্য করে। শুনে তারিকও হেসে ওঠে। ছাত্রীরা মাথা নিচু করে ভয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়। এইসবের মাঝে, সারাটা সন্ধ্যা রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে কর্মবিবরন সব নিয়েই আলোচনা হয়৷ ভাইয়েরা তারিকদের প্রশংসা করে। তারিকের পিঠ চাপড়ে দেয়। আত্মবিশ্বাস আরো বাড়ে ওর। আলোচনা শেষে বাড়ির পথে রওনা দেয়। রাতে যে আবার আসতে হবে । মন ফুড়ফুড়ে থাকায় তৃষাকে একবার ফোন দেয়ার কথা মনে পড়ে। রিং বেজেই চলে কিন্তু না ধরলো না তো। আবারো কল করে, কিন্তু না এবারো কোন রেসপন্স নেই৷ " ধুর বেশি দেমাগ "। ভুরুর কোনায় তারিকের ভাঁজ পড়ে। " না ধরলে নাই ; যা ইচ্ছা হয় করুক "।
#
বাড়ির গেটে অনেকক্ষন দাঁড়ানোর পর গেট খুলে দেয় নানুভাই। অন্যদিন হাসিমুখেই গেট খুলে দেয় নানুভাই কিন্তু আজ কেনো যেনো গম্ভীর। যদিও বিরক্ত তারিক, তবুও ব্যাপারটা চোখ এড়ায় না ওর। গেট লাগিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নানুভাই গম্ভীর গলায় অনেকটা আদেশের সুরেই তারিককে তার ঘরে নানির সাথে একবার দেখা করে যেতে বলেন৷ মনে হয় গম্ভীর কোন ব্যাপার নয়ত পরিবেশ এতটা গুমোট হতো না। তারিক তাড়াতাড়ি জুতা খুলে নানুর ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। রুমটা গুমট। নানী বসে আছেন জানালার দিকে মুখ করে। "কি ব্যাপার হলো টা কি হঠাৎ? " মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে তারিক। নানীকে ডাক দেয় কিন্তু নানী কোন কথা বলেন না৷ নানুভাই তারিক কে ইশারায় বসতে বলেন৷ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে অবশেষে মুখ খোলেন...
" নানুভাই তোমার আব্বা আম্মা বেঁচে নেই। তোমাকে সব সময় আমরা আদর-স্নেহে বড় করতে চেষ্টা করেছি। তুমি দুষ্টামি করলেও কখনো ভাবিনি বদমাইশ হবে তাই তোমাকে সব সময় স্বাধীনতা দিয়েছি।তোমাকে সব বিষয়ে প্রশ্রয় দিয়েছি৷ তুমি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছো আমরা মানা করিনি৷ কিন্তু আদর্শটা ধরে রাখতে হবে তো। রাজনীতি করার মানে এই না যে তুমি নিজের স্বার্থে যেকোন অযৌক্তিক কাজে যুক্ত থাকবে। চেষ্টা করো আগে মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরী করতে৷ মেয়েদের সম্মান করতে। তোমার বাবা -আমি দুজনেই যুদ্ধ করছিলাম দেশের জন্য৷ ওরা দেশের সম্ভ্রম নিয়ে খেলছিলো৷ দেশ মানে মা, মা হলো আমাদের প্রতিটা নারী। আমরা বাঙালীরা বাহান্ন থেকে একাত্তর সব প্রতিবাদ ;যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, ভাষার জন্য৷ আজ সন্ধ্যায় তোমার নানীকে ভীষন আঘাত দিয়েছো তুমি। নারীদের যদি সম্মান দিয়ে চলতে না পারো রাস্তাঘাটে, তবে তোমাদের ধিক্কার। এরপর এমন হলে আমাদের হয়ত বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেতে হবে, একাই থেকো তখন বাড়িতে" - কথাগুলো বলে নানুভাই হাঁপাতে থাকেন।
তারিক মাথানিচু করে শুনছিলো সব৷ চোখ বিস্ফোরিত। নানুভাই কোনদিন কোন ব্যাপারে জোরগলায় তারিককে বলেননি কিছু। কিন্তু অন্যায়ের প্রশ্রয়ও দেননি। হাত-পা কাঁপছিলো ওর। 'বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন ' এত বড় কথাটা বললো। তাহলে অনেক কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই৷ ওরা ছাড়া কে আছে ওর আর৷
মাথা নিচু করেই ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো তারিক। নিথরের মত বিছানায় শুয়ে রইলো৷ ধীরে ধীরে মন শান্ত হয়ে এলো কিন্তু আতঙ্ক বাড়লো। লজ্জা পেল নিজের উপর৷ বিছানা থেকেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখলো একমনে। 'সত্যি কিসের এত অহংবোধ ওর নিজেকে নিয়ে? কিসের পাওয়ার ওর? কেনো সবসময় নিজেকে রাফ এন্ড টাফ দেখাতে চায়? অন্যদের অবজ্ঞা করে? ' একের পর এক প্রশ্ন জাগে মনে৷ ওর বাবা-দাদু যুদ্ধ করেছিলো এটা নিয়েও অহং কাজ করতো ওর। হ্যাঁ এটা নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত কিন্তু অহংকার না৷ তারিকের মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগলো৷ নিজের ভুলটা ধরার চেষ্টা করে গেলো!
রাতের খাবারের জন্য আজ কেউ ডাকলো না ওকে। বুয়া খাবার দিয়ে গেলো ঘরে৷ তারিকের মনে এখন ভয়ের দানা ধীরে ধীরে জন্মাতে শুরু করলো৷ এতদিন এই বেপরোয়া মনোভাবে সবসময় জানতো নানা-নানী পাশে আছেন৷ আজ সব আলাদা লাগছে। বালিশ মাথার উপরে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলো ও৷
#
#
তৃষা মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা বই-ই পড়ছিলো। 'জাহানারা ইমামের -একাত্তরের দিনগুলো '। এর আগেও অনেকটা পড়েছে ও৷ এবার শেষ করা দরকার। সেই গত মার্চে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রচনা প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলো৷ এতদিন হয়ে গেলো এখনো পড়া হয়ে উঠেনি পুরোটা। বইয়ের প্রতিটা লাইন অলক্ষ্যে কল্পনায় কখন যেনো একাত্তরকে চোখে ভাসায় বোঝাই যায়না। মনে হয় এখনি বুঝি ঘটছে এসব।
হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই দেখে ডলি দাঁড়িয়ে আছে। "কিরে ভিতরে আয় বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো। "
ডলি স্হির চোখে তাকিয়ে থাকে তৃষার দিকে৷
তৃষা বইটা রেখে উঠে আসে ডলির কাছে৷ হাত ধরে ঘরে টেনে এনে বসায়। 'কিছু হয়েছে? ' প্রশ্ন করে তৃষা।
কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে ডলি। তারপর বলে বাইরে ফুল নিয়ে আসার সময় বখাটেদের কুরুচি মন্তব্যের কথা। "তুই জানিস ছেলেগুলো কে ছিলো?
-
তারিকভাই আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা। আমি জাষ্ট বিশ্বাস করতে পারছি না তারিকভাই এমন? "
-
তারিকভাই আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা। আমি জাষ্ট বিশ্বাস করতে পারছি না তারিকভাই এমন? "
" কি বলছিস তুই? ফিসফিসিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে তৃষা। তারিক? ও এমন করেছে? তুই শিওর তো? "
"রোকসানাও ছিলো কিন্তু আমার সাথে৷ থাক বাদ দে! তোকে এসব বলে আর লাভ কি " বলেই ডলি উঠে চলে আসতে নেয়। তৃষা ওর হাত টেনে ধরে কিন্তু হাত ছাড়িয়ে ডলি দৌড়ে বের হয়ে চলে যায়।
তৃষা চুপ হয়ে বসে পড়লো বিছানায়। তারিকটা একটু গুন্ডা স্বভাবের কিন্তু মনের দিক দিয়ে অনেক ভালো জানতো। কিন্তু এখন এসবও করছে। ছিঃ। না জানি আরো কত কিবা করে ও৷ ছিঃ ছিঃ। এজন্য কি তাহলে তৃষাকে ফোন দেয় না ও। নানা চিন্তা মাথায় আসে৷ থাক ওর সাথে আর কথাই বলবে না ও। ঘটনাটা হলের সবাই জেনে যাবে। সবাই নিশ্চয় তৃষাকে নিয়ে পিছনে হাসাহাসি করবে। ওফ...... মাথা চেপে বসে থাকে তৃষা......।
#
ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তারিকের৷ ধচমচ করে বিছানায় ওঠে৷ জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঘরটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে৷ ভেসে আসছে "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো " গানের কলিগুলো৷ প্রভাতফেরি শুরু হয়ে গিয়েছে মনে হয়। মোবাইল চেক করে। ইস...একত্রিশটা মিসকল উঠে আছে৷ ভাইদের কল, কর্মীদের কল। ইস, সবাই কি যে ভাবলো। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি কিছুই মনে নেই৷ মোবাইলটাও সাইলেন্স করে রেখেছিলো। আহ! কি হয় হোক। জলদি হাতমুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে নেয় ও৷ বাইরে বের হতে দেখে নানুভাইদের ঘর খালি৷ সবাই সকালেই শহীদমিনারে গিয়েছে নিশ্চয়৷ বাইরে বের হতেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ছুটাছুটি করতে দেখা গেলো৷ বাইক নিয়ে কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকতেই অন্যরকম দৃশ্য। শত শত ছেলে মেয়ে ফুল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ কলেজে দুটো প্রাইমারি স্কুল থাকায় স্কুলের ছেলেমেয়েরাও আসছে৷ আশেপাশের মানুষজনও। সবাই খালি পায়ে এগিয়ে চলছে।
বাইকটা শহীদ মিনারের গেটের বাইরে রেখে ভেতরে ঢুকলো তারিক৷ পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হলো, চোখাচোখি হলো।লোকে লোকারণ্য চারদিক ৷ সব ডিপার্টমেন্টের আলাদা আলাদা ব্যানারে শিক্ষক-ছাত্ররা লাইন ধরে আছে। একে একে পুস্পস্তবক অর্পনে এগিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি হিসেবে আবার সেলফি-ছবি তুলছে। তারিক সবার পিছনে এক কোনায় চলে এলো৷ দেয়ালে হেলান দিলো। দিনটা যেনো একদম অন্যরকম। আজ আর অতটা অস্হির না ওর মনটা৷ শান্ত লাগছে নিজেকে, এজন্য আজ নিজেকে আরো তাজা লাগছে৷ চোখজোড়া নানু-নানীকে খুঁজতে লাগলো ভিড়ে। ওরা অবশ্য কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে গিয়েছে হয়ত! তৃষাও নেই কোথাও৷ কাল রাতে মেয়েটা সম্পর্কের ইতি টানার কথা বলেছে ম্যাসেজে৷ ওর ভুলটা ভাঙানো দরকার।
আজ সবার চোখে দেশের প্রতি, ভাষার প্রতি, ভাষা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গভীরতাটা বেশি বুঝতে পারছে তারিক, এমনটা এর আগে কখনো অনুভব করেনি ও হয়ত!
বুদ্ধিমানের অংহবোধ ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। তবুও একদিনে মানুষের আর কত পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু একদিনে মানুষের জীবনের দর্শন পরিবর্তন হতে পারে। তারিক চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। একদম নতুন ভাবে। নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার, পরিবর্তন ও হতে পারবে! একটা ফুল জোগাড় করে জুতো খুলে ও বেদীর দিকে এগিয়ে যায়। শতমানুষের ভীড়েও ওর গায়ে কাঁটা দেয়।
অমর একুশের চেতনার ঢেউ ছড়িয়ে যায় অন্তরে........
সুচিন্তিত মতামত দিন