ফাল্গুন এসে গেল। শীত এখনও মুখোশ পরে জাগবে কিছুদিন। ধাত্রীশহরের গায়ে গোপন অক্ষরের মতো লেগে থাকবে তার রেশ। সন্ধ্যার বেভুল বাতাসে অথবা যখন বাড়তে থাকবে রাতের মায়া, গুপ্তঘাতকের মতো আবার হানা দেবে অভ্যস্ত ভঙ্গিমায়। এইসব প্রকৃতির লীলা। প্রকৃতিকে আমি এক আশ্চর্যময়ীর গভীরে গিয়ে জানি। যোজন-দূরত্ব থেকে সে আমার নিবিড়ে এসেছে যতবার, ততবারই লিখিত হয়েছে রমণীয় ইতিহাস। চিরকালীন ঘ্রাণের মূর্ছনা থেকে গেছে তারপর। সিপিয়া রঙের ছবি ধরে রেখেছে আবহমান। এখন স্তিমিত উত্তরের হাওয়া কখনও ভুল করে আনমনা করে দিলে, কিছু-কিছু রঙ স্থায়ী হয়ে যায়। অতএব, চেন্নাই এক্সপ্রেস। সে এক নিরালা দক্ষিণায়ন। অথচ সেখানেও সময়ের তুলিতে মনের ভার এঁকে রাখছে সান্ধ্যভাষ। কোথাও লিপিবদ্ধ রেখে দিচ্ছি সেইসব অন্তহীন। ফিরে দেখছি ফেলে আসা শীতের স্বগতকথন।
২।
রাস্তা ছেড়ে খুব সন্তর্পণে মাঠে নামছিলাম। যেন ব্যথা পাবে ঘাসের শরীর! ওখানে ইতিউতি ক্রিকেট। এলোমেলো কিছু জটলা। সদ্যোজাত ব্যারিকেডে তখন ছাব্বিশের প্রস্তুতি। একরাশ শীতার্ত হাওয়া। একআকাশ অমল-ধবল আলো। সে ছিল এক মায়াময় রোদ। রোদের গায়েও কি বিষাদ লেগে থাকে? কেন যে তেমনটা মনে হয়! অথচ প্রকৃতিও কখনো-কখনো নির্লিপ্তির শিক্ষক। দূরে কোথাও ভালো-মন্দ গুছিয়ে নিচ্ছে কেউ। পাহাড়ের পাদদেশে আবার নতুন উল্লাসের হাতছানি। আর নিভৃতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিপাঠ! এইটুকুই যা মনকেমন।
এরকম সময়ে চা-তেষ্টা পায়। জিন্সের পকেটে গরম হয়ে উঠছে সোনালি তামাক। রাজকুমারের চা-দোকান এখান থেকে কিছুটা আবছা। রাজকুমার অসম্ভব ভালো লাল-চা বানায়। পরিমিত চিনি, দুর্দান্ত ফ্লেভার। ওকে বহুবছর আগে বলেছিলাম, 'তোর ডানহাতটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা উচিত, রাজু!' সে কি শুধুই কথার কথা? আবেগে কোনো ভেজাল থাকে না। আবেগ অনেকটা প্রকৃত প্রেমের মতো। নির্ভেজাল বলেই যে-প্রেম শুধু সত্যভাষ জানে। এবং প্রায়শই অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। সে যেন রক্তমুখী নীলা! সকলের সহ্য হয় না। কেন-না, সত্যের চেয়ে বেশি কঠিন আর কী আছে! এইটুকু হাহাকার আছে হাওয়ায়। ব্যবহৃত হয়ে যাওয়া মানুষের বিষাদ। সেখান থেকে মনকে সরিয়ে আনতে হলে নাকি দেশের কথা ভাবতে হয়! দশের কথাও।
৩।
দিনের বয়স বাড়লে বৃষ্টিক্ষত মুছে নিয়েছিল ধাত্রীশহর। তারপর এখানে রোদ, তবু হাওয়ায় আশ্চর্য হিম। রোদ উঠলেই তখন মনে হতো, কতদিন বহুতলের ছাদে যাইনি! অথচ তার দিনকয়েক আগেই মেখে এসেছি বছরশেষের আলো। স্বভাবত নক্টার্নাল হলেও, আমি রোদ ভালোবাসি। এবং শীত। সরীসৃপের জীবন ঘৃণা করি খুব। এই শীতও একদিন চলে যাবে ভেবে বিমর্ষ হচ্ছিলাম। অথচ মেহেরপুর থেকে আমার জন্য পৌঁছে গিয়েছে ঝাল-মিষ্টি আমের আচার। মনমোহিনীর কাছ থেকে নিয়ে এসেছি নতুন উষ্ণতা। তার উপরে নির্ভর করে নেতাজি রোডের সন্ধ্যায় আরও উত্তরে হেঁটে যাওয়া চলে।
একচক্ষু হরিণে আমার আর বিশ্বাস নেই বহুদিন। আরোপিত সবকিছুতেই ফাঁকি বুঝতে পারি আজকাল। সেকথাই ফিরে-ফিরে আসছিল ফরেস্ট অফিসের মুখোমুখি, সকালের আড্ডায়। ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেইসব। ডায়েরিতে মিথ্যা লিখতে নেই। দিনলিপি লেখা মানেই আয়নার সামনে দাঁড়ানো। আয়নাকে ফাঁকি দেওয়া চলে না। সেই আরশিনগর মনে আছে, ঘরবাড়ি? অথবা হলুদ-কালো পাখিরালয়। আগ্নেয় লালে ঝলসে ওঠা ত্রিনয়ন। সবুজ-সাদা প্রশ্রয়ে অবাধ আশ্লেষ। অকারণ স্মৃতিতে সব রাখা আছে। একটা রাস্তার নাম রাধিকামোহন। তেমন এক মধ্যবিত্ত সঞ্চয়।
নতুন বছরের কাছে খুব করে বিষক্ষয় চাইছে নেটিজেন-সমাজ। যেহেতু ঘটনাচক্রে তার চলতি নাম হয়েছে বিশ-বিশ! এইসব দেখে আমরা অনেক হেসেছি। বিষের দাপট যে কমবে না, আমরা জানতাম। টি-টোয়েন্টির এই ধুমধাড়াক্কা গড়ানোর অনেক আগেই লিখে রেখেছি সেকথা। পুরোনো সলিলোকি উল্টে দেখলাম। একজনের কাছে যা বিষ, অন্যের কাছে তা অমৃত হতে পারে। এবং উল্টোটাও সত্যি। এইটুকু বুঝে নেওয়া ভালো। এই বাস্তব। এইসব আপেক্ষিকতা। আমি তাই ধ্রুপদীর অনুরাগী। আক্ষরিক অর্থেই যার নাম টেস্ট। অথবা, নিদেনপক্ষে পঞ্চাশ ওভারের এক-একটা ইনিংস। প্রতিপক্ষ হোক বা আততায়ী, তাকে একটু জেনে-বুঝে নেওয়া যায়।
৪।
এইভাবে শীতের যাবতীয় পাতা ঝরে যায়। অজস্র নতুন পাতার জন্ম দেবে বসন্ত। তবু বসন্ত বড়ো প্রতারক। তার মুুুখোশ আমি চিনি, মুখও। তার থেকে গ্রীষ্মের প্রখরতা ভালো। অথবা শ্রাবণের অথই। সোজাসাপটা। মুখোশহীন। চিরকাল আমি এই সারল্যের পূজারী। এক-একটি বসন্ত আমার থেকে হরণ করেছে অনেক। নড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বাসের ভিত। তবুও হেমন্তের মেয়ে, তোমার কাছে আমার একটা চিঠি হয়তো কোনো এক বসন্তেই পৌঁছবে। পোস্টে না ইথারে, কাগজে না হাওয়ায়, এখনও জানি না। মুদ্রিত না হস্তাক্ষরিত, তাও জানি না। বিমূর্তও হতে পারে! কিন্তু পৌঁছবে। যাকে আমার আত্মমুগ্ধতা ভাবো, তা আসলে অনতিক্রম্য অভিমান। তাকে পাশে রেখেই পৌঁছবে। তাকে চিনে নিতে পারো আর না-পারো, চিঠিটাকে যেন চিনতে ভুল কোরো না আবার!