মানবজীবনে ভাষা এমন এক বৈশিষ্ট্য যা মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে ।সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় মানুষ এই স্বাতন্ত্র অর্জন করেছে ।মানুষের জীবন, মনন,সমাজ ও সংস্কৃতির সর্বত্র ভাষার শিকড় প্রসারিত আর প্রতিটি দিক থেকেই সে রস সংগ্রহ করে বিকশিত হয় ।মানুষের জীবনের প্রয়োজনে ভাষার সৃষ্টি আবার মানুষের জীবনী শক্তিরও আধার সে ।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাংলা ভাষার জন্ম যেদিন, সেইদিন জন্ম বাঙালিরও । সেই দিনই আমাদের আত্ম পরিচয়ের সূচনা । সময়টা আনুমানিক একহাজার সাল । পরবর্তী সাতশো বছর বাঙালির জাতিস্বত্তার নির্মাণের ইতিহাস । ‘বাঙালি জাতিসত্বা’ নির্মাণের ইতিহাসের বৃত্তান্ত দেওয়া এই পরিসরে সম্ভব নয়, প্রাসঙ্গিকও নয় । শুধু এইটুকুই বলার যে, ভাষা পরিচয়েই ‘বাঙালি জাতিসত্বা’র প্রতীমা নির্মাণ যার প্রারম্ভিক সূত্রগুলি নিহিত আছে তার আঞ্চলিক সংস্কৃতির উদ্ভব ও পরিপুষ্টির মধ্যে । সপ্তদশ শতকের শেষপাদে পৌঁছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের অবয়ব স্পষ্ট হয়েছিল । ইতিহাসের প্রবহমান ধারায় গ্রহণ-বর্জন চলতেই থাকে, কিন্তু সংস্কৃতির মৌলিক লক্ষণগুলির প্রতি সার্বিক ও সমষ্টিগত আনুগত্যই আঞ্চলিক জাতিসত্বার স্থায়ী আশ্রয়, যার প্রধানতম উপাদান মাতৃভাষা । তবে কি সেই আনুগত্যের স্তম্ভেই চিড় ধরছে ? আর তাই জন্মের একহাজার বছর পরে বিচলিত আমরা জিজ্ঞাসা করছি ‘ভালো আছো তো বাংলা ভাষা – আমাদের মাতৃভাষা’ ? না,সে ভালো নেই ।
‘একুশে’ আমাদের বড় আবেগের দিন। আবার প্রশ্ন করার দিনও। এই দিনেই প্রশ্ন করবো ‘কেমন আছো তুমি, আমাদের মাতৃভাষা ? বাংলা ভাষার একহাজার বছরের পথচলায় আমাদের কোনদিন কি প্রশ্ন জেগেছে ‘বাংলা ভাষা হে, ভালো আছো তো ?’ না, জাগেনি। আর এ প্রশ্ন করতামও না, যদি না গত শতকের ৯০এর দশক থেকে বিশ্বায়ন নামক পাঁচ অক্ষরের এক দানবীয় বন্দোবস্ত বিশ্বের ভাষাগত বহুত্ববাদকে তছনছ করার কাজে প্রবল হয়ে উঠতো। নতুন সহস্রাব্দে পৌছে আরো স্পষ্ট হয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের বাঙালি মানসের সঙ্গে বাংলা ভাষার কি দুস্তর অনাত্মীয়তা ! এখন হাহাকার করছি বটে, কিন্ত এর সংকেত তো পেয়েছিলাম স্বাধীনতার পর থেকেই । বাংলার চিরশ্রেষ্ঠ সারস্বত সাধক আচার্য সুকুমার সেন তাঁর মৃত্যুর দুবছর পূর্বে প্রকাশিত তাঁর শেষ রচনা ‘কলিকাতা কাহিনী’ তে খেদ ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে “অতঃপর দেশ স্বাধীন হল এবং তাহার ফলে আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য সাধনার অগ্রগতি বানচাল হয়ে যায়” ।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ বাঙ্গালির সারস্বতভূমিকে নিঃস্ব করেছিল অনেকটাই ; তারও তিনবছর আগে চলে গিয়েছেন শরৎচন্দ্র, নজরুল বাকস্তব্ধ আগেই । বাংলা স্বাধীনতার মূল্য চুকালো তার অঙ্গচ্ছেদের বিনিময়ে, আর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাংলার প্রভাব প্রান্তিক হতে শুরু করলো । তবুও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে মুখ্যত সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রভাব বাঙালি মননে অনুভবের যে উর্বর ভূমি রচনা করেছিল, বাংলা ভাষা - সাহিত্য-সংস্কৃতি তার ফসল তুলেছিল । পঞ্চাশ ও ষাট - স্বাধীনতা পরবর্তী দুটি দশকে বাংলার নান্দনিক ক্ষেত্রটি ছিল সৃজন বৈভবে উজ্বল । সত্তরের দশকটা বাংলার সমাজজীবনের এক অস্থির সময়কাল । তখন, কবি বিমল ঘোষের কবিতার পংক্তির বর্ণনায় ‘সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি,তখন ‘বারুদগন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটেজ্যোৎস্না’ । ‘মৃত্যুর দশক’ হয়ে ওঠা সত্তর পেরিয়ে আশির দশকে পৌঁছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধোগমন দ্রুততর হল ।
একটা জাতিসত্বার আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে তার ভাষা ও সহিত্য সংস্কৃতির আশ্রয়ে । তার সাহিত্য-সংস্কৃতি যেমন পল্লবিত হয় তার ভাষার আশ্রয়ে তেমনই ভাষাও বেঁচে থাকে তার সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মধ্যে । সত্তর দশকের পর বাংলা সংস্কৃতির একদা গর্বের উপাদান - সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটকের অসীম শূন্যতা নিয়ে তর্কের যায়গা নেই । বাংলা চলচ্চিত্র যা একদা সারা ভারতের সমীহ আদায় করতো তা এখন তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দি ছায়াছবির অক্ষম অনুকরণে ক্লান্ত, আর ‘ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা’ ধরনের গান শুনে শিউরে উঠতে হয় । ভাষা না কিছু ‘শব্দের কঙ্কাল’ ! কেন ? জীবনানন্দকে সাক্ষি মেনে বলি -
“মানুষের ভাষা তবু অনুভূতি দেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া, বিশেষণ ; এলোমেলো নিরাশ্রয়
শব্দের কঙ্কাল” ।
তো এই খাঁ খাঁ শূন্যতা বুকে নিয়ে আমরা পৌছালাম নব্বইএ, পদানত হলাম বিশ্বায়ন নামক দানবের পদতলে । সে আমাদের সজত্নে লালিত জীবনচর্যা, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবেগ-উত্তাপ সবটাই লোপাট করে দেওয়া শুরু করলো । নতুন সহস্রাব্দে পৌছে স্পষ্ট হয়ে গেলো নতুন প্রজন্মের বাঙালি মানসের সঙ্গে তার মাতৃভাষার কী দুস্তর ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে । অদ্ভুত শব্দমালা ও বাক্যগঠনরীতি রপ্ত করেছে তারা । গণমাধ্যমে তারস্বর প্রচারিত ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনের দৌলতে ‘এ দিল মাঙ্গে মোর’, ‘ঠান্ডার নতুন ফান্ডা,‘ধমাকা’ বেশ সইয়ে নিলাম । কেন না আমাদের নাকি ‘ইন্ডিয়া কেয়ার করবে, ইন্ডিয়া শেয়ার করবে’ । স্বদেশ চেতনা, দেশপ্রেম ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাই আমাদের জাতীয়তাবোধের নির্মাণ করে আর জাতীয়তাবোধের নির্মাণের প্রধান উপাদান আমাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি । বিশ্বায়নের বেনোজল আমাদের জীবনচর্যার সযত্ন লালিত উপাদানগুলিই ধ্বংশ করে দিচ্ছে, মাতৃভাষার অবিসংবাদি ভিতটাকে করে দিচ্ছে নড়বড়ে ।
এ কথা ঠিকই যে ভাষাবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলা ভাষা এখনো ‘বিপন্ন ভাষা’র তালিকাভুক্ত হয়নি, হয়তো হবেও না আগামী একশো বছরে । কিন্তু বিকলাঙ্গ হয়ে তাকে টিকে থাকবে তাতে সংশয় নেই এবং তার লক্ষণ এখনই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে । ভাষা বিজ্ঞানীদের সূত্র অনুযায়ী কোন জনগোষ্ঠীর শিশুরা এবং নবীন প্রজন্ম তাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষার উচ্চারণ থেকে বিরত থাকেন এবং মাতৃভাষার উচ্চারণের দায় যদি প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তরিত না হয় তবে সেই ভাষার বিপন্নতা অনিবার্য । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষার প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্নতার লক্ষণ তো বেড়েই চলেছে । দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষায় কথা না বলার জন্য কত শব্দ যে লোপ পেয়ে যাচ্ছে তার হিসাব হয়তো এখন করছি না, হয়তো পঞ্চাশ বছর পরের প্রজন্ম দেখবে অনেক বাংলা শব্দই হারিয়ে গেছে, লুপ্ত হয়ে গেছে । ‘সারিবদ্ধ’ – এই বাংলা শব্দটা কি আর বলি কদাচ ? বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ছাত্রদের বলেন ‘লাইন’ দিয়ে দাঁড়াও । ‘চুড়ান্ত’ এমনই আর একটা শব্দ প্রায় হারিয়ে গেছে ‘ফাইনাল’কে যায়গা ছেড়ে দিয়ে । কোন উজ্বল তরুণের কাছে ‘বিপনী’ শব্দটা অচেনা । সে চিনেছে ‘শপিং মল’ ।
কয়েকদিন আগে এক তরুণের মন্তব্য দেখলাম ‘ফেসবুক’এ । লিখেছেন মাতৃভাষার বর্ণমালার ব্যবহার বা শুদ্ধতা নিয়ে ভাববেন যারা সাহিত্য লিখছেন তারা, মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে ইংরাজি বর্ণমালার ব্যবহারে ক্ষতি কি ? তার মতে সংযোগ সাধন করাটাই মূল কথা । তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশই এমন মনে করে । এমনটাই বিশ্বায়নের দর্শন, আর এই দর্শনে ভর করেই তারা তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠীগুলির মাতৃভাষা, তাদের সংস্কৃতি লোপাট করে দেওয়ার প্রতিরোধহীন কাজে নেমেছে ।
কি ভয়াবহ ছবি উঠে এসছে বিশ্বের ভাষাবিজ্ঞানী ও নৃতাত্বিকদের গবেষণায়! সারা বিশ্বে ছয় হাজার মাতৃভাষার বিলুপ্তি ঘটবে এই শতাব্দীর মধ্যে, যদি না ভাষা বিলুপ্তির প্রবণতাকে ঠেকানো যায়। এখন বিশ্বে চালু ৭৩৫৮টি ভাষার অস্তিত্ব আছে, যার ৯০ শতাংশের বিলোপ ঘটবে ২০৫০ সালের মধ্যে। ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী ভারতে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে ২৪২টি আঞ্চলিক ভাষা। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪শতাংশ মানুষ এই মৃত্যুপথযাত্রী আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে কথা বলে আর ৯৬শতাংশ মানুষ মাত্র ৪ শতাংশ প্রধান ভারতীয় ভাষায় কথা বলে।এখন সারা বিশ্বে ৫১টি ভাষায় মাত্র ১জন করে কথা বলার লোক আছে। সেই শেষতম মানুষটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জনগোষ্ঠীগুলি তাদের ভাষাপরিচয় হারিয়ে ফেলবে।পরের প্রজন্ম জানবেও না তাদের পূর্বজদের ভাষা কেমন ছিল, কেমন গান তারা গাইতো।
মাতৃভাষার সার্বিক বিপন্নতার এই আবহে পালন করছি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ । প্রতি বছর এক অসামান্য প্রতিজ্ঞা এবং সাহসের আগ্নেয়গিরির প্রতীক হয়ে ‘একুশে’ আসে, চলেও যায় । ঘটা করে ভাষাশহিদ দিবস পালন করি, শহিদবেদিতে ফুলমালা চড়াই, কবিতা লিখি । কিন্তু যাদের কাছে ‘ভাষা দিবস’এর তাৎপর্য পৌছানো অতি প্রয়োজন তারা অধরা থেকে যায় । হয়তো কোন মা তাঁর বালক পুত্রকে শুধোলেন হ্যাঁরে, স্কুলে আজ ভাষাদিবসে তোর গান কেমন হ’ল ? পুত্র উত্তর দিল ‘ফ্যান্টাসটিক মাম্মি’, ‘সলিড গান গেয়েছি’ ! মা তাকে ধমক দেবেন না মোটেই । বরং গর্বিত হবেন, এটাই এখনকার বাস্তব ছবি ! বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কিংবা রাষ্ট্র সঙ্ঘ দ্বারা এই ভাষাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষা স্বীকৃতিদানে এপারের বাঙালিরাও গর্বিত নিশ্চিতভাবেই, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের দৈনন্দিন চর্যায় সেই আবেগের কোন তাপ-উত্তাপ দেখা যায় না । এটা নির্মম সত্য ।
আমাদের একটা আত্মপ্রসাদ আছে বটে যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র আছে,আর ভাবি, যে ভাষায় এমন কালজয়ী সাহিত্যসম্পদ আছে সে ভাষা বিপন্ন হতে পারে না কোনদিন । হ্যাঁ পারে, এমন নজির অনেক আছে । কোন ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য থাকা বা না থাকা সেই ভাষার বেঁচে থাকার একমাত্র শর্ত নয়, জরুরিও নয় । ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য এসেছে অনেক পরে । মৌখিক ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সম্পদ অনেক বেশি । মানুষের স্মৃতিসম্পদ বা সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডারের খুব সামান্য অংশই ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্যে থাকে এটাই সত্য ।
‘একুশে’ পালনের আবহে একটা কথাই বলতে চাই । আমাদের মাতৃভাষার বিপন্নতার রোধ আমাদের শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের চর্যায়, সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুশীলনে আরো বেশি মাতৃভাষার উচ্চারণ আর সেই দায়কে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর করার মধ্য দিয়েই করতে হবে । আর কোন বিকল্প হতে পারে না । কদিন আগেই নাকি পেরিয়ে এলাম ‘ভালোবাসার দিন’ । আমার মাতৃভাষাটাকেও না হয় একটু ভালোবাসি। এই ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় অম্লান দত্তর একটি উক্তি মনে পড়ে গেলো – “সব ভালোবাসারই দুঃখ আছে; ভাষাকে ভালোবাসার দুঃখ কম নয়, ভাষাকে যে ভালোবাসে না, এ দুঃখ সে বুঝবে না” ।
সুচিন্তিত মতামত দিন