নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

খোলাম কুচি দর্শন-
আমরা সভ্য।আমি আপনি পরিষ্কার-পরিছন্নতার দাবী করি। তার মানে পরিস্কার পরিছন্নতার কাজ গুলো খুব গুরুত্ব পূর্ণ কাজ-তাই তো? তাহলে যারা এই কাজ করেন তাদের জীবন এতো কষ্টদায়ক কেন। একদিকে ভয়ানক  কাজ, অন্য দিকে সামাজিক অবমাননা।আমাদের যে নোংরা দেখে গা গুলিয়ে ওঠে,মুখে রুমাল চাপা দিতে হয়, সেটা নিজের হাতে পরিস্কার করে যারা তারা ‘মানুষ’। আমাদের মত তারাও হাত পা ওয়ালা মানুষ,ধুক পুক হৃদয় আছে তাদেরও… । আমরা সভ্য? আমরা কি কি ডাস্টবিনে দিচ্ছি রোজ? সব্জির খোসা, মাছ-মাংসের অদরকারী অংশ, উছিস্ট, বাচ্চার ডায়পার ( বাড়িতে খুব অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ডায়পার ), স্যানিটারি ন্যাপকিন, ভাঙ্গা যন্ত্রাংশ, এক গাদা প্ল্যাস্টিক… আরো কত কি! বিপুল পরিমাণ জঞ্জাল বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার যে সিস্টেম টা আছে, সেটা যদি বন্ধ হয়ে যায়। ভাবতে গেলে গা গুলিয়ে উঠছে।

খুব ছোটবেলায় আমাদের ওই ছোট শহরে ‘খাটা পায়খানা’ ছিল।আমার বাড়ির পাকা পায়খানা ছিল। পাড়ায় অনেকের  খাটা পায়খানা ছিল। মল জমা হত একটা বড় মাটির পাত্রে। ভর্তি হলে একজন এসে সেই মল হাতে করে আরও বড় পাত্রে জমা করত। তারপর মাথায় করে নিয়ে যেত। মেথর। হ্যাঁ, যিনি এই ভয়াবহ কাজ টি করতেন তিনি মেথর। একজন বেশ রোগা ধবধবে মহিলা অতি উগ্র গোলাপি কাপড় পরে এই কাজ করতেন।মল ঢেলে নেবার আগে, তর্জনীতে তামাক পাতা নিয়ে মুখে থুসে দিত। সে চলে গেলে তার ছুঁয়ে যাওয়া পথে জল ঢেলে ‘শুদ্ধ’ করা  হত। গঙ্গা জল ছেটানো হত।আইন করে কবে বন্ধ হল মনে নেই।

কলকাতায় প্রথম সংসার করতে এসে বাঁশি বাজিয়ে ময়লা নেওয়া জানলাম।নিতে আসত আমাদের ভাড়া বাড়ির ফ্ল্যাটের নিচে শক্ত পোক্ত লোক। তার সাথে উপজাতি চেহারার সদ্য তরুণ। অস্বস্তি হত কারো হাতে ওভাবে দিতে।‘উপজাতি চেহারার সদ্য তরুণ’ টির পরিবারের মানুষ জন কেও ধীরে ধীরে চিনতে শুরু করলাম।ওর মা ছিল না, মাসি ছিল।সেই মাসি মাঝে মাঝে আসতেন, অত নোংরা কাজ করা স্বত্তেও হাতের নখ পায়ের নখ পরিস্কার ছিল। বাহুতে উল্কি আঁকা। ওড়িয়া উপজাতি।তাঁর নিজের যে ছেলেটি সেও তরুণ। শক্ত পোক্ত ব্যায়াম করা শরীর। সাপ্তাহিক সিঁড়ি ধোয়ার দিন তাকে দেখতাম।এখন খোঁজ নিয়ে জেনেছি নেশা করে দুজন।সুন্দর মানুষ হবার সম্ভবনা ছিল।কোথায় একটা সুতো ছিঁড়ে যায়। 

নিজের দু কামরা হল,আমার সাথে দ্যাখা হল একটা ছোট ছেলের আবু নাকি আব্দুল। নরম নরম হাত পা। সে ময়লা নিতে প্রথম যেদিন এল আমি চমকে গেছি। পাশের ফ্ল্যাটের নতুন পড়শি বউদি রাগ করে বলেই ফেল্লেন, এবার হামাগুড়ি দিয়ে কেউ আসবে। পেছন থেকে একটি লোক এসে বলে, “ওড় হাতে ময়লা দিয়ে দ্যান। ও আমার খোকা আছে।”  ডায়ানেস্টিক -উত্তরাধিকার।আব্দুল ময়লা নিয়ে যেত। টুকটাক কথা বলে জেনেছি ওর মা দেশে থাকে।মার জন্যে মন খারাপ হত। চেহারা মলিন, সারল্য হীন হয়ে গেল। কে ভালো লোক, কে খারাপ সে বুঝতে শিখে গেল। ছাদে আমার গোলাপ গাছ দেখে আনন্দ করে বলল ‘হেব্বি ফুল ত,সিনেমার মতন’। ওর পুচকে ভাই এলো। নাম আরাফাত। আমি বললাম ‘আরাফাত খুব বড় লিডার’। পরে একদিন জানতে চেয়েছিল, আব্দুল নামের কোন লিডার আছে কিনা।এখন অনেক টাকা ‘আয়’ করে।বিয়ে হয়েছিল। বউএর বাবা এতো জনের রান্না মেয়েকে করতে হচ্ছে বলে বাড়ি নিয়ে চলে গেছে। কদিন আব্দুল মনমরা হয়ে কাজ করল।‘অর শ্বউরের ইচ্ছা’ বউ নিয়ে আব্দুল একার সংসার করে।আব্দুলের মা এখন কলকাতা এসেছে শরীর খারাপ। কে রান্না করবে? মা কে ছেড়ে আব্দুল যাবে না। বউ এর সাথে আব্দুলের কোন ঝগড়া ঝামেলা হয় নি। আব্দুলের কথা শুনে মন টা খারাপ হল। অনেক দিন দেখিনি কেমন আছে কে জানে? 

ছোট বেলায় আমাদের ‘হাগু ট্যাঙ্ক’ যখন উপচে গেল,সামুয়া বলে একজন তখন দড়ি বালতি নিয়ে এসেছিল। সে কাজ করে চলে গেলে সবাই তার কর্ম কান্ড নিয়ে বলছিল। আমি ঘুমিয়ে থাকায় অনেক কিছু দেখতে পাইনি। সবাই আপসোস করছিল। বাড়ির লোক মানে বাবা, মা, জেঠু, জেঠিমা, ছাড়াও অনেকে থাকত।গ্রাম থেকে আসা কাজের মেয়েরা, পাড়ার হাফ প্যান্ট পরা বন্ধুরা---সবাই জানাচ্ছিল কালো নোংরা জলে ডুব দিয়ে সে ওই জলেই কুলকুচি করছিল।ঘেন্না পাচ্ছে না। জানেন আজো এই কাজ টা একদল মানুষ করে চলেছে। খুব ছোট্ট  গর্ত দিয়ে ওই বিষাক্ত, কালো জলে নেমে জমে থাকা প্ল্যাসিক আরও নানান নোংরা হাতে করে তুলে আনে।জল গিলে ফেলে। মাথায় চুলে চাপ হয়ে ঢুকে যায় সেই ময়লা।কানে ঢুকে যায় বিষাক্ত জল। মারা গেছেন অনেকে এই বিষাক্ত গ্যাসের জন্যে। পরিসংখ্যান রেখে কি লাভ। যদি এর কোন সুরাহা না হয়।

এতো প্রযুক্তি বার হচ্ছে। হাতে হাতে ভিডিও কলিং এর সুবিধা যুক্ত মেসিন, ‘টিউমার বৃদ্ধি পাচ্ছে কত গতিতে’ তা মাপার মেসিনে ভয়ানক অসুখ কে শাসন করতে শুরু করেছি আমরা,কাপড় কাচা-রুটি বানাণো-মশলা পেশাই করার মেসিন আছে… আর আন্ডার গ্রাউন্ড নোংরা জলের পাইপ জ্যাম হয়ে গেলে তার জন্যে প্রযুক্তি নেই! নাকি ওটা একদল মানুষ করে যাবে… এটাই স্বাভাবিক… আমার মনে হয় এর প্রযুক্তি আসুক। সুরক্ষা আসুক। জলে যদি নামতে হয় তাহলে তার জন্যে বিশেষ সুরক্ষাযুক্ত  পোশাক এর দরকার। দেশের  সৈনিক, ডাক্তার,ফায়ার ব্রিগেটের কর্মী, খনির কর্মী, পুলিশরা যেমন জীবনের  ঝুঁকি নিয়ে দেশের জন্যে কাজ করে এরাও তো সেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। পরিস্কার –পরিছন্ন রাখার কাজ করে যারা তাদের আমরা এতো অবহেলার মধ্যে রাখি কেন? উত্তরাধিকার সুত্রে তারা এই কাজ করে। অপরিসীম দারিদ্রে মানুষ এই কাজ করে। প্রখ্যাত কার্ত্তিক দাস বাউল দুটো খাবার জন্যে রেল লাইনে পরে থাকা মল পরিস্কার করেছেন। আমরা সভ্য? “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে টানিবে যে নীচে”। স্বামী বিবেকানন্দের বানী ফেসবুকে সাঁটিয়ে, হোয়াটস্ আপ পোস্ট দিয়ে কি জাহির করি আমি… সবচেয়ে খারাপ খিস্তি টা আমার নিজের জন্যে।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.