জন্ম মফঃস্বলে।একটা পাড়া, এ বাড়ির তরকারি ওবাড়ি যাওয়া তখন খুব কমন একটা রীতি। গাছের ফল পাকলে পড়শিরাই হাজির হয়ে যেতো। বেশ সারল্য মাখা ছোটবেলা আমাদের। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই কোথাও আমি শিখছিলাম একটু একটু করে, এই পৃথিবী যতটা আমার ভাইয়ের, ততটা আমার নয়। নাহ্, ফরচুনেটলি, আমার পরিবারে কখনো ছেলে বলে আমার ভাইকে প্রেফারেন্স দেওয়া হয়নি, আমাকেও "বিয়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত" এই শিক্ষা দেওয়া হয়নি।শুধু এটুকু ( যা ভারতবর্ষের কোটি কোটি মেয়েরা পায়না ) পাওয়ার জন্যই হয়তো আমার জীবনভর কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ আমার পরিবারের প্রতি। আমার দাদুর খুব কঠোর শাসনে আমি বড় হলেও তিনি সর্বদা এই ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন যাতে আমি পড়াশোনা করি ও ভালো রেজাল্ট করি। আমার পরিবারের আমার প্রতি প্রেফারেন্স এর অন্যতম কারণ ছিল আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম ও তাদের ছোট থেকে ই মনে হয়েছিল এ মেয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। আমার শিষ্টতা যে তাদের মুখ উজ্জ্বল করার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি, তাইই যথেষ্ট। এবং সত্যিই আমার বহু বান্ধবীর ক্ষেত্রে গল্পটা বরাবর আলাদা ছিল। আমার খুব প্রিয় এক বান্ধবীর মা তার সমস্ত বইপত্র, জামাকাপড় তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতেন, মেয়ে কোন চিঠি লুকিয়ে রেখেছে কিনা, এটা যে এক প্রকারের অপমান তিনি আজ ও বোঝেন নি। ছেলেকে দিয়ে মেয়েকে শাসনের এত বহর আমি দেখেছি, যে ছোটবেলা থেকেই একটা ভয়ঙ্কর রাগ তৈরি হত। মেয়েদের জীবনটা তার কোনদিনই নয়, যে কেউ এসে খানা তল্লাশি চালাতে পারে। ঠিক যেমন পিরিয়ড হয়েছে কিনা দেখতে প্রিন্সিপাল প্যান্ট খুলে দেখাতে বলে। এই প্যারেড আর ওই বান্ধবীর মায়ের, ভাইয়ের তার সব জিনিসপত্র হাতড়ানো আসলে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। তার জীবনটা তার নিজের নয়, বারোয়ারি।
আমি যখন বিয়ে করে আসি এই বাড়িতে, আমার শাশুড়ি আমার মা এলে তার যাওয়ার সময় তার হাতের প্লাস্টিকের ব্যাগ (যেটায় আমি আমার বাড়ীর পুরোনো কাজের লোকের জন্য দু'টো পরা শাড়ি পাঠাচ্ছিলাম) প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চেক করেন এবং যেন চোর ধরা পড়েছে এমন এক উল্লাসে জেরা করতে শুরু করেন আর কী কী আমি বাপের বাড়ি পাচার করে দিই। হ্যাঁ। আমার সেদিন ওই প্যান্ট খুলতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের মতো অপমানিত বোধ হয়েছিল। হ্যাঁ।আমি ফেমিনিস্ট।
আমার বাবা অসম্ভব ইরেসপনসিবল ছিলেন। এবং যৌথ পরিবারের শর্ত হল যার বর কম পয়সা দিতে পারে,তার বৌকে গায়ে খেটে সেটা শোধ দিতে হয়। তাই আমার মা সারাজীবন তাদের দাসীবৃত্তি করেছেন অপরিসীম ধৈর্য্য নিয়ে। পেটের দায়, মহা দায়। দুই ছেলে মেয়েকে মানুষ করার জন্য আজীবনের কম্প্রোমাইজ। গানটুকু গাইতে বসলেই সবার তখনই "চা তেষ্টা" পাওয়া।একটা মানুষ কে তার সখ আহ্লাদ থেকে সবরকম ভাবে দূরে রাখার সামগ্রিক চক্রান্ত দেখে আমি বড় হয়েছি। তার গান গাওয়া যাতে জম্মের মতো ঘুচে যায়, তার ব্যবস্থা পাকাপাকি করাতেই বাকি লোকেদের বেঁচে থাকার সার্থকতা আমি দেখেছি।আমি দেখেছি বছরে একদিন ও ভুল করে যদি তার স্বামী তাকে নিয়ে বেড়াতে যায় তাহলে সব বাসন পারলে তাক থেকে নামিয়ে এঁটো করে ফেলে রাখা হতো , যাতে সে ফিরে এসে টের পায় এত নেচে বেড়ানোর কী ফলাফল। একটা দেওয়াল জোড়া কয়লার উনুন, রাক্ষুসে তার আগুন, তার সামনে একটা রোগা , ভীষণ রোগা মেয়ে লড়ে যাচ্ছে, দুটো ছেলে মেয়ে র ভরনপোষনের জন্য। তার দেওর খেতে বসে বলছে "বাড়িতে কতগুলো জানোয়ার বাস করে, ভাতটা একটু গরম ও থাকেনা।"
আমার প্রতিবাদ না করা, আমার আত্মসুখী সুবিধাবাদী বাবাকে আমি ঘৃণা করেছি মনে মনে। আমার কাকাকে ও। আমার বাসন ফেলে রাখা ঠাকুমা-দাদুকেও। হ্যাঁ। আমি ফেমিনিস্ট।
অনেকগুলো বছর পর আমি যখন বৌমা হয়ে গেলাম, তখন আমি বই পড়তে বসলেই সারা বাড়ির লোকের দরকার পড়ে যায়, বই ছেড়ে উঠে জবরদস্তি পারিবারিক তাস খেলায় অংশ নিতে হয়, তার ও অনেক বছর পরে লিখতে বসলেই বরের ঠিক তক্ষুনি খিদে পায়, অথচ পাঁচ মিনিট আগেও খাবার কথা জিজ্ঞেস করেছি ও তাতে "না " শুনেছি; সেইসব মুহূর্ত আমাকে ফেমিনিস্ট করেছে। হ্যাঁ। আমি ফেমিনিস্ট।
আমার বাবা আমাকে ইনসিকিরিটিতে রেখেছিল, বুদ্ধি, নিজের উপর আস্থা ও বয়স কম ছিল, তাই তড়িঘড়ি আমি বিয়ে করে ফেলি। আমার নিজের উপরে বিশ্বাস না থাকার রাগ থেকে আমি ফেমিনিস্ট।
পিরিয়ড একটা বিশেষ ইভেন্ট। বিয়ের রাতেই বর বলে দেয়, পিরিয়ড হলেই মা কে জানাতে। তারপর থেকে আমাকে জানাতে হয় নি। তিনিই কাউন্ট রাখতেন। আঠাশ দিনের পর থেকেই রোজ জিজ্ঞাসা পর্ব, " কী হল? হয়নি?" ওই খানা তল্লাশির অন্য ফর্ম আর কী। তিন তলার ছাতের ঘুলঘুলি তে কাপড় রাখতে হবে, যতই মাকড়সা হাঁটুক না কেন। আমার হেভি ফ্লো র কারণে প্যাড ছাড়াও কাপড় সাপোর্টে দিতে হত। সেই কাপড় মেলা নিয়ে বিস্তর ঝামেলা। পিরিয়ড চলাকালীন সোফা ,চেয়ার যাতে বসেছি, সব জল ন্যাকড়া দিয়ে মোছা। শ্বশুরের খাটে বৌমার বসা বারণ। বাসি কাপড়ে কিছু ধরা বারণ( ছেলের জন্য এ নিয়ম খাটেনা), এঁটো কাঁটা র একটু এদিক ওদিক হলে পুরো রান্নাঘরের বাসন ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেওয়া যাতে বৌ চোখের জলে , নাকের জলে হয়ে সেই সব বাসন মেজে মেজে তোলে। মাজা কড়াইটা নিয়ে সূর্যালোকে ঘুরিয়ে দেখা, ঝিলমিল করছে কিনা, ঝিলমিল করলেই পোড়া আছে , আবার মাজো। হ্যাঁ।আমি ফেমিনিস্ট।
শুধু মাত্র বরের সঙ্গে শোয়া নিয়ে বাড়ীর লোকের আক্রোশের শেষ নেই। যে কোন কারণে আমাদের ঘরে ঢুকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা, ছেলে হবার পরে তো ,"বাচ্চা কাঁদলে আমার ছেলের ঘুম হবেনা" বলে পুরোপুরি আলাদা করে দেওয়ার প্রচেষ্টা, আমি না থাকলে আমি ঠিক কতটা সেজে বেরিয়েছি সেটা ছেলেকে জানানো, উদ্দেশ্য কি আর খারাপ, এমনিই ইনোসেন্স এর সঙ্গেই জানানো। আমার বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য জনে জনে পারমিশন নেওয়া। আমার মা বা বাবাকে ফোন করতে হবে। শ্বশুর বলবেন, আমি কেউ নই, ওর মা যা বলবেন, শাশুড়ি বলবেন ওর বাবা যা বলবেন, এরকম পনেরো মিনিট ল্যাজে খেলানোর পর আসবে ছেলে যা বলবে তাই হবে, ছেলে পুনরায় বলবে,বাবা মা যা বলবে তাই হবে। আমি আমার বরের এই সুবিধাবাদী চরিত্র কে ঘৃণা করতে শিখেছি। হ্যাঁ।আমি ফেমিনিস্ট।
আমার চাকরি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।আমাকে দশটাকার জন্য একঘর ভর্তি লোকের সামনে তারপর অপমানও করা হয়েছে। যখন যখন বাড়িতে আমি তর্ক জুড়েছি, ওদের যুক্তিতে একটিই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে," তোকে বারণ করেছিলাম,m.sc first class fourth মেয়েকে বিয়ে করিস না, বেশি শিক্ষিত,না!আমার শিক্ষা কে যারা আমার অপরাধ মনে করেছে, তাদের জন্য আমি ফেমিনিস্ট।
আমাকে ট্রেনে-বাসে, অফিস পার্টিতে ছুঁয়ে যাওয়া প্রতিটি অবাঞ্ছিত হাতের জন্য আমি ফেমিনিস্ট। যে ছেলেটিকে আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম বলে সে আমার চরিত্র নিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল কিছু ফিসফাস ,তার সামনে পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমি ফেমিনিস্ট। অফিসে সব রকমের কাজ নিষ্ঠাভরে করার পর একটা ছুটি চাইলে ছেলে র অসুস্থতা র জন্য,যারা আমাকে শুনিয়েছে " এই জন্যই মেয়ে টিম মেম্বার নিতে চাইনা,হাজারটা ফ্যাচাঙ, তাদের মুখের উপর জবাব দিতে আমি ফেমিনিস্ট। জোনাল হেডের নোংরা ইঙ্গিত কে উপেক্ষা করে,চাকরিতে লাথি মারার সাহস রাখার জন্য আমি ফেমিনিস্ট।
কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে হলে এখন চলে যাই। ফোন অফ করে রাখি। এটা অর্জন করতে অনেক যুদ্ধ লড়তে হয়েছে আমাকে। মেয়েদের এক জীবন ভর্তি ভয়। সে এটা পর্যন্ত বলতে পারেনা" শাঁখা ভেঙেছে", বলতে হয় "বেড়ে গেছে।" তার শুধু একটা শব্দ উচ্চারণেই অনর্থ ঘটে যাবে এই সৃষ্টির। আমি নিজে হাতে ভেঙেছি এই সব শেকল। দুহাত ফাঁকা আমার। ইচ্ছে হলে ম্যাচ করে চুড়ি পরি। শুধু নিজেকে সব রকমের ইনহিবিশন ফ্রি করতে পারাই, আমার ফেমিনিজম। নিজের ভিতরের শক্তিকে চিনতে পারা আমার ফেমিনিজম। একটুও চিৎকার না করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা আমার ফেমিনিজম। নিজেকে প্রতিদিন যোগ্যতর করে তোলা আমার ফেমিনিজম। গয়নাগাটি,শাড়িতে নিজেকে আটকে না রাখা, অন্যের পরিমাপ না করা আমার ফেমিনিজম। একটা মেয়েকে অত্যাচারিত হতে দেখে পাশ কাটিয়ে না চলে যাওয়া আমার ফেমিনিজম। ভালো মেয়ে না হতে পারার সবরকমের গ্লানি মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা আমার ফেমিনিজম। কারো সঙ্গে তর্কে জেতা নয়, স্রেফ আমার যাপনের বিরুদ্ধের কোন তত্ত্ব কে পাত্তাই না দেওয়া আমার ফেমিনিজম।
আমার নিজের শর্তে বাঁচতে চাওয়া আমাকে একলা করেছে। আমি রেখে ঢেকে বলা কবেই বন্ধ করে দিয়েছি। আমার জিতে যাওয়া এখানেই। আমি ফেমিনিস্ট।
Tags:
সোজা সাপটা