ইন্দ্রাণী সমাদ্দার

 বাংলা ও বাঙালি
এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন থেকে দুপুর দুটো তিপ্পান্নর এসি রেকে উঠলাম। উঠেই বসার জায়গা পেয়ে যাই। ট্রেনের দুলুনিতে একটা ঘুমঘুম ভাব। ঠিক ঘুম নয়। মাথার ভিতর বাইরের সব শব্দ অথবা শব্দ সমষ্টির প্রবেশ অর্থাৎ অনুপ্রবেশ চলছে। কিন্তু মাথার ভিতর যেন অঘোষিত বনধ।। পার্কস্ট্রীট তারপর ময়দান মেট্রো স্টেশনে আশেপাশের কিছু মানুষের আলাপচারিতা কানে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশণে সব ঘুম পালিয়ে যায়, একসঙ্গে বহু খুদে থেকে মাঝারি বয়সের স্কুল পড়ুয়া ও তাদের অভিভাবিকাদের আগমনে। বাচ্চারা ট্রেনের ভিতরে হুটোপুটি করছে। অভিভাবিকারা পিঠে ব্যগের বোঝা নিয়ে অধিকাংশই দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ বসার জন্য সিট পেয়েছেন। অভিভাবিকারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্থায় ব্যস্ত। যদিও আলোচনার বিষয় বাচ্চার পাড়াশুনো। তাদের আলোচনা হচ্ছে স্কুলে বাচ্চাদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নাকি হিন্দি হওয়া উচিৎ। স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা শেখার ক্ষেত্রে অধিকাংশ অভিভাবক হিন্দী নেওয়ার পক্ষপাতী। তাদের বক্তব্য কী হবে বাংলা শিখে! পড়াশুনো শিখে অধিকাংশ ছেলে- মেয়ে বড় হয়ে কলকাতা বা পশ্চিম বাংলার বাইরেই থাকবে। সেখানে বাংলা কোন কাজে আসবে? আমি অবাক হলাম যারা এই বক্তব্য পেশ করলেন তাঁরা সবাই বাঙালি। হিন্দী জানা থাকলেই বাচ্চাদের নাকি বেশী সুবিধা হবে। বাংলা ভাষা নাকি বাচ্চারা বাড়িতে শুনেই শিখে যাবে। যে ভাষার নাকি ভবিষ্যৎ নেই সে ভাষা শিখে কী হবে।

সবাই নিশ্চয়ই নন কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি বোধ হয় একমাত্র জাতি যে জাতি নিজের মাতৃভাষার অমর্যাদা করেন। সদা অন্য ভাষা, অন্য জাতির আদব -কায়দা, রীতিনীতি কে গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত। মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তর ভাষা। সেই ভাষার ঐতিহ্য, ইতিহাস না জেনেই সেই ভাষা নিয়ে নানা মন্তব্যে বাঙালি আজ ব্যস্ত। কলকাতার মধ্যেই বাংলা ভাষা-ভাষি মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। বাঙালি হয়েও অন্য ভাষায় কথা বলার প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে। আবার বাংলায় কথা বললেও এক অদ্ভুত বাংলা -হিন্দী -ইংরেজীর এক জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। যে ভাষা প্রকৃত বাংলা ভাষার থেকে বিচ্যুত হয়েছে। রাস্তা- ঘাট থেকে স্কুল কলেজ, মেট্রো স্টেশণ থেকে এফেম রেডিও সর্বত্র এই খিচুরি বাংলা ভাষা শোনা যায় যার শব্দ ভাণ্ডারে নতুন নতুন শব্দের আমদানি ঘটেছে। বাঙালি জাতি তার স্বকীয়তা থেকে দিনে দিনে বিচ্যুত হচ্ছে। তাকে যেমন শেখানো হচ্ছে বাঙালি তেমন শিখে নিচ্ছে। যেন মগজে কারফিউ হয়েছে।

প্রত্যেক বাড়িতে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা এমনকি মাঝবয়সী মানুষজন যে বাংলা ধারাবাহিক দেখেন সেটা কী আদৌ দেখার যোগ্য? দেখার যোগ্য কিনা জানিনা তবে সুস্থ রুচি-বিরুদ্ধ। যা দেখানো হচ্ছে সেটা কী কোনওভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ। বাংলা সিরিয়াল ‘তেরোপার্বন’ আজ ইতিহাস। আমি বয়স্ক মানুষজনকে জিজ্ঞেস করেছি তাঁরা এই সব ধারাবাহিক দেখেন কি করে? উত্তর আসে সময় কাটাতে হবে তাই ভালো না লাগলেও দেখা। ভালো না লাগলেও দেখতে হবে। নিজের অজান্তে মনের কোনে জমা হচ্ছে কত কিছু। নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। নতুন ধারাবাদিক নতুন ভাবনায় ভাবাচ্ছে। তবে ব্যতিক্রম আছে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েগুলো বইমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাঁরা বাংলা বই কিনছে, বাংলায় লিখছে। এদের হাত ধরে বাংলা ভাষা এগিয়ে চলবে। 

Previous Post Next Post