স্বাতী চ্যাটার্জী

ক্লাইম্যাক্সে বাজিমাত করলেন সৃজিত (রিভিউ)
ক্লাইম্যাক্সে বাজিমাত করলেন সৃজিত (রিভিউ)
ছবি : দ্বিতীয় পুরুষ
নির্দেশনা : সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে : পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, গৌরব চক্রবর্তী, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, রাইমা সেন, ঋদ্ধিমা চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অনিন্দ্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

'বাইশে শ্রাবণ' এ ছিল ডাল ভাত আর বিরিয়ানি। ৯ বছর পর ছবির স্পিন অফে মিলল চিকেন চাউমিন আর চিলি ফিশ। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় যে ভোজন রসিক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর নতুন থ্রিলার ছবি 'দ্বিতীয় পুরুষ'কে যতই সিক্যুয়েল বলা হোক না কেন আসলে একে স্পিন অফ ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না। যেখানে চরিত্রগুলো এক রয়ে গেছে (মাত্র তিনটি), বাকি গল্প আনকোরা নতুন। সিক্যুয়েল হলে দুটি গল্পের মধ্যে কিছু যোগসূত্র থাকতো। সেটা যেটুকু আছে তা একরকম জোর করেই রাখা। বরং সম্পূর্ণ আলাদা একটা থ্রিলার হিসেবে দেখালেও ছবিটির বাণিজ্যে কোন সমস্যা হতো না বলেই মনে হলো। 

কেন না শেষ কবে বাংলা ছবি দেখতে বসে প্লটের মোচড়ে এভাবে ছিটকে গেছি মনে পড়েনা। প্রায় দম বন্ধ করে ছবির শেষটা দেখে ও তারপরে কয়েকঘন্টা ধরে সেই ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দেবার পর যেটা মনে হচ্ছে সেটা জানাতেই এই লেখার অবতারণা। নাহ, গল্প বলে দেবার কোন অভিসন্ধি আমার নেই। বলে দিইও না কোন রিভিউতেই। তবে আলোচনা তো চলতেই পারে। 

'বাইশে শ্রাবণ'এর প্রবীর রায়চৌধুরী এই ছবিতে প্রায় কোথাওই নেই দু-একটা এলোমেলো ফ্ল্যাশব্যাক সিন ছাড়া। বরং আছেন তার দাদা প্রণব রায়চৌধুরী(বাবুল)। গল্পটা একেবারেই অভিজিৎ পাকরাশির (পরমব্রত) নিজস্ব। অভিজিতের সঙ্গে এই ছবিতে যাকে দেখার জন্য দর্শক উদগ্রীব হয়ে ছিলেন তিনি খোকা (অনির্বাণ)। দুজনেই জমিয়ে ডুয়েল লড়েছেন পর্দায়। ছবিতেও এবং অভিনয়েও। গল্পের একটু ভূমিকা করে নেয়া যেতেই পারে। 

প্রবীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর প্রায় আঠারো বছর আগে এ গল্পের শুরু। যদিও আসল শুরু তারও অনেক আগে। খোকার শৈশব কেমন ছিল তা ছবিতে দেখানো হয়নি। ছবির শুরু কলকাতার চায়না টাউনের প্রেক্ষাপটে। ১৯৯৩ সালে কিশোর বয়সী খোকার (ঋতব্রত) গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও এলাকা দখলের লড়াইতে পরপর তিনটি খুন করে। তার স্বভাবই হলো খুন করে তার শিকারের কপালে ছোরা দিয়ে নিজের নাম খোদাই করে রাখা। যদিও একটি পনেরো ষোল বছরের ছেলে এত নিষ্ঠুরভাবে খুন কেন করে তার কোন কারণ ছবিতে দেখানো হয়নি। কিন্তু দুঁদে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার প্রণব রায়চৌধুরীর (বাবুল) হাতে ধরা দিতে হয় খোকাকে। তারপর জেলের অন্ধকারে কেটে যায় খোকার জীবনের পঁচিশটা বছর। এর মধ্যে অভিজিতের সঙ্গে ঘটে গেছে প্রবীর রায়চৌধুরীর ঘটনা। বর্তমান অবস্থায় খোকা জেল থেকে পালায় এবং পালিয়েই সে আগের কায়দায় খুন করে পুলিশের নজরে আসে। কেস গিয়ে পড়ে সিরিয়াল কিলার স্পেশালিস্ট অভিজিতের আওতায়। কেসের সমাধান করতে সঙ্গে পাওয়া গেল রজতকে (গৌরব)। কিন্তু খোকার করা একের পর এক খুনের কোন কুলকিনারা করতে পারে না দুজনে মিলে। যদিও খুনি রাতের অন্ধকারে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল চায়না টাউনের চেনা রাস্তায়। পুলিশ একটু চেষ্টা করলেই ধরতে পারতো। তবে ওই চেষ্টাটাই ক্লাইম্যাক্স কিনা, তাই এসব মেনে নিতেই হয় দর্শককে। এদিকে অভিজিতের দাম্পত্যের অবস্থাও টালমাটাল। স্ত্রী অন্তরা তার উদাসীনতায় তিতিবিরক্ত। সে ডিভোর্সের কথা ভাবছে। এমনকি পুরোনো বন্ধু সূর্যকে (আবীর) ডেকে দুঃখের কথাও জানাতে দ্বিধা করছে না। অভিজিৎ এই সবকিছুর মাঝে পড়ে কিছুটা অসহায় বোধ করে। রজত আর অঙ্কিতার (ঋদ্ধিমা) প্রেম তাকে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ছবির এই অংশ বেশ একটু জোলো লাগে। থ্রিলার আঁটোসাঁটো বাঁধুনির মধ্যে রাইমা ও আবীরের সহানুভূতির খেলা ঠিক জমলো না। জমতে পারতো, যদি অভিনয়টা জোরালো হতো। কিন্তু উক্ত দুই ও হিনেতা নিজেদের ক্লিশে হয়ে যাওয়া অভিনয়ের ধাঁচ পাল্টাবেন না বলে ধনুকভাঙা পণ করেছেন। যাই হোক আসল গল্পে আসি।

এর মধ্যে খোকার খুনের প্যাটার্ন যেন বার বার অভিজিৎকে চ্যালেঞ্জ জানায়। কিছু একটা যেন সে বোঝাতে চাইছে, একটা কিছু বক্তব্য আছে তার। অভিজিতের সঙ্গে দর্শকও খুঁজে চলে খুনের মোটিভ। খোকার চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে ঠিক রাস্তাতেই এগোয় অভিজিত। কিন্তু বড় দেরি হয়ে যায়। অনেক বড় মাশুল গুনতে হয় তাকে। এবার যেন সে আহত বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। এতদিন সে সবরকম চেষ্টা করছিল খোকাকে ধরার। তবু কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছিল যেন। প্রিয় সহকর্মী রজতকে হারিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে খোকাকে ধরতে চায় সে। কিন্তু কেন রজতের মতো একজন উজ্জ্বল ও বুদ্ধিমান অফিসার হঠাৎ একটা ফোন পেয়ে খোকার ফাঁদে পা দিল তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। রজতের মৃত্যুতে অঙ্কিতার হাসিকান্নার অভিনয় বড্ড সাজানো লেগেছে। 

অবশেষে ছবির শেষভাগে মুখোমুখি হয় খোকা ও অভিজিৎ। আর তারপরেই বিদ্যুতের মতো চমক। শেষের ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে দর্শকাশনে পিন পতনের নৈঃশব্দ্য বলে দেয় কি সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে সকলে। এতটা ধাক্কা অতি বড় থ্রিলার বোদ্ধাও কল্পনা করতে পারবে না। তবে ধাক্কাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে তা হজম করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে দর্শকের। পরে ভেবে দেখলে কিছুটা যেন অবাস্তবও লাগে। এক ধাক্কায় দর্শককে কাঁপিয়ে দেবার জন্য পরিচালক লজিকের তোয়াক্কা করলেন না। কী করে একজন মানুষ মাত্র ১৮ বছরে আমূল পাল্টে যায়, তাও আবার সমস্ত কিছু মনে রেখে! এভাবে স্বভাব পাল্টানো যায়? তাহলে তো পুলিশের কাজটাই সহজ হয়ে যেত। এই নিয়ে ব্যাখ্যায় যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ তাহলে গল্প বলা হয়ে যায়। শেষের চমক বা চমকগুলোর জন্যই ছবিটা হলে গিয়ে দেখা যায়, এটুকু বলতে পারি। 

বাংলা ছবিতে এমন থ্রিলার আগে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে কিনা সন্দেহ। বাংলা ছবি প্রকৃত অর্থে সাহসী ও পরিণত হচ্ছে এ কথাও বলা যায় নির্দ্বিধায়। তাই এ ছবির ক্লাইম্যাক্সের প্রশংসা করতেই হবে। সংলাপের মধ্যে দিয়ে সিরিয়াল কিলারের বিশেষত্ব বর্ণনা ভাল লেগেছে। ভাল লাগে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের 'দারোগার দপ্তর' থেকে নিয়ে উইলিয়াম জেমস হার্শেলের উল্লেখ, যা অবধারিতভাবে ফেলুদাকে মনে পড়ায়। আর সেই সঙ্গে অবাঙালি টানে কথা বলা বংদেরকেও ঠুকতে ভোলেননি পরিচালক। ছবির শেষ কথা তাই তর্কপ্রিয় সোশাল মিডিয়া পন্ডিত বাঙালিদের শিখিয়ে দিয়ে যায় 'faw' বলে কোন উচ্চারণ বাংলায় নেই। যেটা আছে সেটা হলো 'phaw'। 

অভিনয়ে অনির্বাণ ও পরমব্রত কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেননি। দুজনেই যে যার জায়গায় অসামান্য। একদিকে যেমন খোকার মতো এক নিষ্ঠুর নির্মম খুনির চরিত্রকে কাল্ট করে তুললেন অনির্বাণ, তেমনই সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পুলিশ অফিসারের গন্ডিতে থেকেও কীভাবে জ্বলে ওঠে যায় তা দেখালেন পরমব্রত। অবাক হতে হয় ঋতব্রতকে দেখেও। অল্পবয়স্ক খোকার চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয় করলেন তিনি। বাস্তবে এখনো তাঁকে এতটা পরিণত দেখায় না যতটা পর্দায় মনে হলো। প্রণবের চরিত্রের বাবুল বেশ মানিয়ে গেছেন।

ছবিটি হুডানইট গোত্রের হলেও বহু দর্শক ওই ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যটি ভাল করে বোঝার জন্যই দ্বিতীবার ছবিটি দেখতে যাবেন। থ্রিলার ছবিতে নিজের হাতযশ আরও একবার প্রমাণ করলেন সৃজিত এ কথা চোখ বুজেই বলা যায়। সঙ্গে এটাও প্রমাণ করলেন বিরিয়ানির চেয়েও কখনো কখনো 'চিকেন চাউমিন আর চিলি ফিশ'টাই বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে। কেন তা জানতে গেলে হলে গিয়ে 'দ্বিতীয় পুরুষ' দেখে আসতে হবে। 



Previous Post Next Post