বর্তমান সময়টা যেন কেমন। ওই কেমন বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়, চলে যাওয়া যায় নিজের কাজে, কিন্তু সেখানেও কি স্বস্তি আছে ? বর্তমান সময় নিয়ে এমন ভাবনা নতুন নয় বরং যথেষ্ট প্রাচীন। কেউ কোন কালেই তার সময়টাকে সঠিক বলে যায়নি। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও চিন্তায় বর্তমানের থেকে এগিয়ে থাকার সক্ষমতা ও প্রবণতা তাকে বর্তমান নিয়ে তুষ্ট থাকতে দেয়না। এতো গেল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির এক দিক। এই বুদ্ধিবৃত্তি তাকে আর সব রকম প্রাণীদের থেকে আলাদা করেছে, সভ্যতার চাকায় দিয়েছে গতি।
প্রয়োজনে মানুষ সমগ্র পৃথিবীকে তাদের পরিবেশগত বাসস্থানের ভিত্তিতে ভাগ করেছে বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক সীমানায়। আবার তাকেও টুকরো করেছে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে। যা কখনও ধর্ম, কখনও মতাদর্শ, গোষ্ঠীতন্ত্র, কখনও বর্ণ হয়ে উঠেছে ভিন্নতার কারণ। ইতিহাস দেখিয়েছে এর কোনটাই স্থায়ী সূচক হয়ে থাকেনি দীর্ঘদিন। সর্বকালেই একটি ধর্ম বা একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ অপর ধর্ম বা মতাদর্শের বিরোধীতা করেছে, দেখিয়েছে অসহিষ্ণুতা, এবং কোনো একসময় একটিদল চরম অসহিষ্ণু হয়ে অপর পক্ষকে ধ্বংস করে দিতে সচেষ্ট হয়েছে। চরম দুর্গতির শিকার হয়েছে অধিক সংখ্যায় সাধারণ জন যারা কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করে, দেশের ভাল-মন্দ ভাববার তাদের উদ্বৃত্ত সময়টুকুও থাকেনা, শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের মতো প্রাথমিক ও খুব জরুরী কর্মে তার দিনরাত খরচ হয়ে যায়। তবু অবাক হতে হয় যখন এই পর্যায়ের কিছু মানুষ হয়ে ওঠে চরমপন্থি। তার একমাত্র কারণ দারিদ্র। শিক্ষার অভাব এর কারণ হতে পারেনা, বরং কর্মের অভাব এর বড় এবং অতিবড় কারণ।
জনসংখ্যা যেখানে অনেক বেশী। প্রাকৃতিক সম্পদ যেখানে অসমভাবে বন্টিত আর লোভের হাতছানি যেখানে উপস্থিত সেখানে কোন শুভশক্তি কি সক্ষম হবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চরমপন্থাকে ঠেকাতে ? উদ্দেশ্য যদি রাজনীতি হয় তবে তা অবশ্যই গণতন্ত্রকে জাগিয়ে তুলবে না, বরং তাকে চিরতরে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে প্রথমে দলগত একনায়কতন্ত্র ও পরে কোন এক পাগল একনায়কের খেয়াল-খুশির আখড়ায় পরিনত করবে দেশকে। গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, লোকতন্ত্র ইত্যাদি গালভরা যে নামেই ডাকা হোক না কেন আসলে সাধারণ জন বোঝে তার ভোট দেবার অধিকার। ওখানেই সে সমান মনে করতে পারে নিজেকে আর একজন মেধাবী পণ্ডিত মানুষের সাথে। ভিখারী ভোটদাতা সমান ভাবতে পারে নিজেকে লক্ষ-কোটিপতি শিল্পপতির সঙ্গে। আর সবাই জানে চাতুরীটুকু ওখানেই। কোথাও মিথ্যা আশ্বাসের স্তোক, কোথাও বলপ্রয়োগ আবার কোথাও বা উৎকোচ গণতন্ত্রের কাঠামোয় ঘুণপোকা হয়ে ঢুকে তাকে পঙ্গু করে দেয়, ধ্বসিয়ে দেয় ভিতর থেকে। গণতন্ত্রের কাণ্ডারীরা কি সে সব জানে না ? সবাই সব জানে অথচ টিকে আছে গণতন্ত্র। হয়তো নামেই, তবু নির্বাচন হয় দেশের জনগণের ট্যাক্সের লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয়ে। তারপর চলে কুস্তির লড়াই, তাল ঠোকাঠুকি, জন্তু বেচাকেনার মতো জিতে আসা প্রার্থীদের উৎকোচ দিয়ে কিনে ফেলা হয়। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোটে কেউ জিতলেন সে সব বিসর্জন দিয়ে অন্যকোন সংখ্যা গরিষ্ঠতাকাঙ্খী দলের কাছে তিনি নিজেকে বিক্রি করে অসততার চরম নিদর্শন রাখলেন। চুলোয় গেল তাঁকে জেতানো জনগণ যারা চেয়েছিল তাঁর উপর নির্ভর করতে। এভাবে যে করে হোক নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে একদিন শেষ অবধি রাজনীতির দীর্ঘ কুৎসিত হাত পৌঁছে যায় সংবিধানের পাতায়। ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রথম প্রথম নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করে ফেলে ও অন্তিমে সংবিধান সংশোধন করার চেষ্টায় দ্বিধাহীন হয়ে ওঠে ।
প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। দেশবাসী ভোট কেন দেয় ? সহজ উত্তর, তাদের প্রয়োজন সঠিক পথে মেটানোর জন্য। তাহলে প্রয়োজন কি কি ? একথায় সেই পুরোনো এবং সবার জানা কথাই আওড়াতে হয়, আহার-আবাস-আচ্ছাদন-নিরাপত্তা-স্বাস্থ্য-শিক্ষা। স্বাধীনতা পাবার পর সাতটি দশক পার করেও কি দেশে মানুষের এই প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি যথাযথ ভাবে মিটেছে ? এককথায় মেটেনি। বরং দিন দিন অবস্থা এবং ব্যবস্থা খারাপ হয়েছে, বিভিন্ন সূচক অন্তত তাই বলছে। দেশের মানুষের সামনে এই মুহূর্তে কোন আদর্শ নেই, নেই কোন আদর্শ মানুষ, যাকে নির্দ্বিধায় সাধারণ জননেতা বলে মেনে নিতে পারে। নেতা শব্দটি এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চতুর ধান্ধাবাজ পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গা মানুষকে গালাগাল দিতে ব্যবহৃত হয়। তবু মানুষ নেতার অপেক্ষায় থাকে। যে তাদের পথ দেখাবে। উত্তরণের পথ। ভোট তো তারা নেতাকেই দেয়। কিন্তু কি প্রসব হয় ভোট শেষ হলে ? মানুষ আজ বিশ্বাস হারিয়েছে। তাই ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে তারা দলাদলি করে। পাশাপাশি দীর্ঘকাল জীবনযাপন করেও বাইরের সংকীর্ণ রাজনৈতিক উস্কানিতে কিম্বা গুজবে মেতে প্রতিবেশীর ঘরে আগুন দিতে, তার বাড়ির মহিলার প্রতি অশালীন আচরণ করতে কুণ্ঠা বোধ করে না। সমস্যা পর্বতপ্রমাণ। সে সবের থেকে সাধারণ জনের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখার আয়োজন করতেই আমদানি করতে হচ্ছে উৎকট স্বদেশপ্রেম, ধর্মের মৌলবাদ, পরিধেয় বস্ত্রের দ্বারা ও খাদ্যের উপকরণ দ্বারা মানুষ চিহ্নিতকরণ। আশঙ্কাজনক, আতঙ্ককর অথচ কোন কোন গোষ্ঠীর কাছে মজার খেলায় পরিনত এই সব নির্বোধ সমীকরণ। কবে ফুটবে চোখ। দেশের আত্মা আজ চিৎকার করে কাঁদছে, শুনছে ক’জন ?
বিদ্বজ্জনেরা কিন্তু তাও একবারও বলেননি প্রয়োজন নেই আমাদের রাজনৈতিক দলের। যেখানে সবাই দেখছেন রাজনৈতিক অর্থ রাজ-অনৈতিক। অনৈতিকতার রাজ। কেউ তো প্রস্তাব দিতেই পারতেন, সমস্ত দেশ মিলে একজন সক্ষম বিবেকবান রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করুক। রাষ্ট্রপতি দেশ চালাবেন উপযুক্ত আমলার সাহায্যে। গ্রাম এবং শহরগুলি তাদের মন্ত্রীর কাছে নয়, নির্দিষ্ট আমলার কাছে দরবার করবে। তাদের সবার উপরে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকবে বিচারবিভাগ অর্থাৎ কোর্ট। হয়তো রাজনীতির নরকদর্শন সম্পূর্ণ হলে সেই প্রকার কোন প্রস্তাব আসতে পারে। বিবেচনা যেখানে প্রধান হবে। শিক্ষা গুরুত্ব পাবে অধিক। লোভের একটু উপরে উঠতে পারবে মানুষ প্রজাতিটি। গুরুকবির স্বপ্নদর্শনের ভাষায় আমরাও বলতে পারবো, “ওই মহামানব আসে”।
স্বপন পাল
দুর্গাপুর
দুর্গাপুর
Tags:
সম্পাদকীয়