এখানে সন্ধ্যা নামে স্বমহিমায়।ফিকে হয়ে আসা আলোর গেলাসে আস্তে আস্তে মিশিয়ে দেয় অন্ধকারের কুচি। এখানে ত্রিফলা আলো রাতের বসন ছিঁড়ে আব্রু হরণ করেনা।পর্ণমোচীর ফলকে জেগে ওঠা জোনাকির ডানায় অরণ্য চিঠি লেখে প্রিয় নদীটিকে। এখানে দূরদেশি পরিযায়ী কোন পাখি উড়ে যেতে যেতে নরম ওমমাখা ডানা থেকে খসিয়ে দেয় দু একটি পালক। সে ওম বুক পেতে নেয় কোন এক পাহাড়ি ঝরনা। বক্সা পাহাড় মৌনতার সেলাই মেশিনে গোধূলি-জরিন সুতোয় জুড়ে নেয় লাজবন্তী মেঘ আর উড়নচন্ডী হাওয়ার গল্প।
রাত নেমে এলে সে সব গল্পেরা আমার বিছানার পাশে এসে বসে।নীলাভ আলোয় আমার ঘরের দেয়ালজুড়ে আঁকা হয় বহুমাত্রিক কোলাজ। আমি তাদের চন্দনপিঁড়ি পেতে বসতে দিই।দেখতে দেখতে আমার ঘর হয়ে ওঠে প্রকান্ড গোল্লাছুটের মাঠ। সেই মাঠ বরাবর রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে চারবছর। চকোদাদুর শিরাওঠা লোমশ আঙুলের প্রান্তভূমি থেকে। যে আঙুল বিষনখে চিরে দিয়েছে অস্ফুট সতীচ্ছদ। চারবছর দৌড়চ্ছে নিজের থেকে, দৌড়চ্ছে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা অগণিত প্রশ্নাতুর চোখের থেকে। সংখ্যাতীত ফিসফাস থেকে।
চারবছরের পাশে এসে বসে আরো এক মুখ। বলিরেখা ওঠা সে মুখের সামনে আয়না ধরে স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। তেরোবছর বয়স থেকে আজ অবধি কেবলই ছুটছে সে। একটা অনাশ্রয়ী লন্ঠনের আলো থেকে, ভূগোল শেখাতে আসা স্যরের পর্বত চেনানোর নামে পিষ্ট হওয়া অনিচ্ছুক স্তনকুঁড়ি থেকে। উপত্যকা, গিরিখাত চেনানোর নামে দুর্বিষহ যোনিপথ হতে। পালাতে চাইলেই কি আর পালানো যায়। অ্যাসিডপোড়া কোঁচকানো চামড়া তাড়া করে বেড়ায় তাকে।এখনো। বেঁচে থাকবে আরো যতো কাল।
শিউলির গন্ধ, ঢাকের বাদ্যি, আগমনীর সুর, পেঁজা তুলোর মতো ভাসিয়ে নিতো যে কিশোরী মনটাকে। সেও গল্পের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ভিন্নরঙে, পৃথক রেখায়। মৌলবী সাহেব কোরাণ পাঠের তালিম দিচ্ছেন। তখন মেয়েটির মন ইচ্ছেঘুড়ি। তখন কোচড় ভরা শিউলি। মন তখন '' শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।"
অর্থ না জানা বিদেশি ভাষার কালো কালো অক্ষরগুলো বড়ো বেজান লাগে।চোখের ভাষায় শঙ্কিত প্রশ্নচিহ্ন "মৌলবী সাহেব, "সিরাতুল মুস্তাকীম' মানে কি?" এগারো বছরের বালিকার সরল প্রশ্নের উত্তরে পিঠে কালসিটে এঁকে দেন কাঠমোল্লা। অক্ষম আক্রোশে।মেয়েমানুষের এতো প্রশ্ন কেন? মোল্লারই কি আর জানা ছিলো কি অতশত মানে ? তবু তো প্রশ্নহীন কাটিয়ে গেছেন এযাবৎকাল! এগারো বছরের সরল প্রশ্নে তাই ঔদ্ধত্বের তকমা লেগে যায়।অমীমাংসিত, অগম্য থেকে যায় "সিরাতুল মুস্তাকীম।"
নিরক্ষরা অভাবী মায়ের সোমত্থ যুবতী আমার গল্পের কোলাজে ভেসে ওঠে চেনামুখ নিয়ে। গাঁয়ের মাতব্বরের ঘরে এসেছেন সম্মানীয় হুজুর সাহেব। বাড়িময় লোকে লোকাকার।ভক্তের বান। ঐশী ক্ষমতাবান হুজুরের এক ফুঁয়ে নাকি সেরে যায় দুরারোগ্য রোগ। বন্ধ্যা রমণীর কোলে ফেরেস্তা এসে বসে হুজুরের পলকসম্পাতে। পূর্ণ হয় মনোবাঞ্ছা তাঁর এক ইশারায়।
জ্বর পুড়িয়ে দিচ্ছে উঠতি শরীর। দুরুদুরু পায়ে হুজুরের পায়ের কাছে এসে বসে পঞ্চদশী চাঁদ। অশীতিপর, মেহেদিরঞ্জিত পক্বকেশ হুজুর সাহেবের আঙুল তখন থার্মোমিটার স্কেল।বন্ধ দরজার আড়ালে সন্ধ্যা জানলো কপাল নয়, গলা নয়, জ্বর মাপতে হয় এসবের আরোও বেশ কিছুটা নীচে অন্তর্বাসের গভীরে, স্তনবৃন্তে।মেয়েটির কপাল পুড়ছে অসহ্য জ্বরে। অসহ দহনে আজও পুড়িয়ে দিচ্ছে একটি অপমানিত সন্ধ্যাকাল।
সন্তানের মুখে ধরে চুমো খাবার স্বপ্ন দেখা বধূটির দশবছরের রুখাসুখা দাম্পত্য। অধরা স্বপ্নটা তবু আগলে রাখে পেলব আঁচলে, অন্তর্বাসের ওমে। যজ্ঞ করছেন সিদ্ধপুরুষ। ধূপে,ধোঁয়ায় অগুরুচন্দনে এক অপার্থিব নির্জন মধ্যযাম। যজ্ঞান্তে সাধকের খর চোখে ঝিকিয়ে উঠলো তলোয়ার। ছোপলাগা হলদে দাঁত। গেরুয়া ফুঁড়ে বেরোনো লোমশ হাত অন্তর্বাসের হুকে। ক্রমে বুক নাভি, নিতম্ব এবং আরো গভীরে।বাইরে তখন চ্যালাদের হাতে তীব্রস্বরে বেজে চলেছে ঢাক। কান্নার গোঙানিটা ঢাকা পড়ে যায় অনায়াসে।
প্রাকবিবাহ যুবককে দাম্পত্যের সহজপাঠ শিখিয়েছেন গাঁয়ের মোল্লা "স্ত্রীলোক শস্যক্ষেত্রস্বরূপ।" অতএব রাতভর চলে সে ভূমি কর্ষণ। ভালোবাসাহীন,পরিচর্যাহীন রমণ প্রতিরাত! একবার নয়, বহুবার। নারী তো কেবল শরীর। স্বামীকে তুষ্ট করাই যার একমাত্র কাজ! অতএব.....পরিচর্যা নয়,সোনার ফসলের সাধনা নয়, কেবল কর্ষণ!মোল্লাসাহেবও যে 'অশ্বত্থামা হত'টুকুই জানেন। তাই রক্তাক্ত চাদরের প্রান্ত ছেড়ে,অসহায় সমর্পণ সীমা ছেড়ে ছুটছে মেয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ পথ।'সোনার ফসল' 'সোনার পাথরবাটি' হয়ে থেকে যায় চিরটাকাল।
চার্চের প্রার্থনা শেষে বিয়ের ঠিক আগের রাতে পাদরী ডেকে নিলেন যে মেয়েটিকে নিজের কক্ষে। ভার্জিনিটি পরীক্ষা দিতে গিয়ে এইভাবে অসহায় সমর্পণের গল্পগুলোও এসে মিশে যায় গল্পের কোলাজে।
আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন খ্যাতিমান মৌলবী। একঘন্টা বক্তৃতার মূল্য নগদ পনেরো হাজার।আবেগ চুঁয়ে পড়ছে স্বরের ওঠানামায়,"স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত।" তাই স্বামীর বাধ্য থাকা প্রতিটি নারীর অবশ্য কর্তব্যের বিধান দ্যান গমগমা গলায়। এর অন্যথায় জাহান্নামের আগুনে অনন্তবাস নিশ্চিত।
গল্পের ক্যানভাস হতে বেরিয়ে আসছে ঘোমটা খসা নারী।পায়ের তলায় শিশিরভেজা গোল্লাছুটের মাঠ। চোখের তারায় হাজার জন্মের জমে থাকা ক্ষোভ আর ক্রোধের আগুন দাউদাউ।
কথায় কথায় জান্নাতের লোভ দেখিয়ে,জাহান্নমের আগুনের ভয় দেখিয়ে যে ধর্ম শুষে নিয়েছে নারীর ইজ্জত।যে ধর্ম বলে স্ত্রীলোকেরা নরকের দ্বারস্বরূপ। সেই ধর্মের ষাঁড়েরা বলতে পারেন কোন দ্বার দিয়ে জগৎ দেখেছেন তারা? আচ্ছা, এই যে জান্নাতের অসূর্যস্পর্শা,সেক্স আইকন বাহাত্তর হুর পরী সবুজ গালচেয় হেলান দিয়ে অপেক্ষা করে আছে সন্তুষ্ট করার জন্য, সে তো পুরুষদেরকেই! জান্নাতেও যৌনতার চাষ!
মেয়েদের জন্য তবে কি ব্যবস্থা রেখেছে জান্নাত ! নারী বলে ইহলোক,পরলোক সবখানে শূন্যহাত! আর পুরুষেরা গাছেরটাও খাবেন, তলারটাও কুড়োবেন।জান্নাতি নারীর জন্য কেন কোন টল ডার্ক হ্যান্ডসাম নেই? নেই কোন লোমশ বুক ?চওড়া কাঁধ! ধর্মে তাই আমায় আমায় পাবেনা। চাইনা আমার এমন জান্নাত। এমন ঈশ্বরলাভে আমার বিন্দুমাত্র আকাঙ্খা নেই। আমার জাহান্নমের কোন ভয় নেই।আমার জান্নাতের কোন লোভ নেই। আমি সুখের জন্য ছড়িয়ে রেখেছি মাধুর্য, ভালোবাসার জন্য পেতে রেখেছি চন্দনপিঁড়ি, প্রেমের জন্য দুচোখে জ্বেলেছি অমর্ত্য আগুন। ভালোবেসে ছুঁয়ে দেখো,ভালোবাসা ছুঁয়ে দিলে পুরুষ প্রেমিক হয় নারীরা হয়ে ওঠে ঈশ্বরী ।
Tags:
মুক্ত গদ্য