পর্ব – ১১
সুহাসিনী বহুদিন পর কোন কারণ ছাড়া এ বাড়িতে এলেন, শেষ এসেছিলেন বাবিনের চলে যাবার সময়। ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিলো সব কিছু, অতিথি, মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, শোকের আবহে এদের আনাগোণা সামলাবার কেউ ছিলো না। নীরার মা মেয়ে সামলাতে ব্যাস্ত ছিলেন। অনি নিজেও ভেঙ্গে পড়েছিলো। তাই নীরার বাবা আর সুহাসিনীই সামাল দিয়েছিলেন বাইরের দিকটা। অথচ কাজ মিটে গেলে আর একবারও আসা হয়নি এই দেড় বছরে। নীরার খোঁজ অনির কাছে দুর্গাপুজোয় পেতেম। সংসারের শৃংখলে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সুহাসিনী আর বেশি কিছু করতে পারেনি। অথচ করা উচিৎ ছিলো। আজ সারা দুপুর দেখে তাই মনে হয়েছিলো। বাবিনের ছবির সাথে গল্প করে ওকে খাইয়েই সারা দুপুর কাটিয়ে দেয়। মণি বলছিলো। আজ সুহাসিনী এসেও দেখেছেন সেসব চলছে। পরী আসতে পরীকে কোলে বসিয়ে নিয়েছিলো নীরা। বাবিনের ছবিকে খাওয়ানো বন্ধ হয়নি। সুহাসিনী হাল ধরলেন। “নীরা – -“। নীরা চমকে ওঠে, “কাকিমণি সুহাসিনী বকাবকির রাস্তায় যাননি। “শুধু ছেলেকে খাওয়ালেই হবে? নিজেও খেতে হবে ত”। “আর একটু - - “ । “না, অনেক হয়েছে। চলো, এবার খাবে”। “নীচে?” “না, এখানেই। মণি এনেছে। তুমি হাত ধুয়ে এসো”, “পরী খাবে তো”। “খাবো। ও খেয়ে এসেছে। অল্পকিছু খাবে। তুমি খাবে আগে। নীরা পরীকে বলে, “পরী একটু ওঠো, জেঠিমনি হাত ধুয়ে আসুক”। পরী উঠে পড়ে। নীরা হাত ধুয়ে আসে। “বসো”। নীরাকে বলেন সুহাসিনী। নীরা পরীকে কোলে বসায়। সুহাসিনী মণির থেকে থালা নিয়ে নেন নিজের হাতে। সামনের টেবিলে রাখেন। “এবার ভালো মেয়ের মতো পুরোটা খেয়ে নেবে”। “কাকিমণি. . আমি খেয়ে নিচ্ছি”। সুহাসিনী কড়া চোখে তাকিয়ে ছিলেন নীরার দিকে। নীরা আর কিছু বলেনি। সুহাসিনী নিজে হাতে করে খাইয়ে দিয়েছিলেন নীরাকে। পরিপাটি করে। “মণি – খাবার নাকি নষ্ট করে – এই ত দিব্যি খেয়ে নিলো সব”। “সে তো তোমার ভয়ে ছোটবৌদি”। সুহাসিনী মনে মনে হেসে ফেললেও মুখেগাম্ভীর্যধরে রাখেন। “ভয় না, মেয়ে মা’কে ভয় পাবে কেন? ব্লো যত্ন করে খাওয়ালে ঠিক খেয়ে নেয়”। “তমার এত বড় মেয়েকে যত্ন করে তুমি খাইয়ে যেও তবে এবার থেকে রোজ”। সুহাসিনী হাসেন। “রোজ না হলেও যাবো, আর বাকি দিন খোঁজ নেবো, পরীতো আসেই। “ঠাম্মা – জেঠুমণি খাইয়ে দিলেও জেঠুমণি খোঁজ নেয় ঠিকঠাক”। ণিরা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে জেলো। “চুপ, পাকা বুড়ি। না, না কাকিমনী ..? সুহাসিনী হাসলেন, অনি খাইয়ে দিলে খুব ভালো করে। আমি বলে দেব যাতে রোজ খাইয়ে দেয়। কিন্তু ণিরা তোমাকেও নিজের যত্ন নিতে হবে ভালো করে। মা নিজে ভালো না থাকলে ছেলেমেয়েকে কী করে ভালো রাখবে?” নীরা কথা দিয়েছিলো, রাখবে। পরীর সাথে নীরাকে দেখে খুশি হয়ে ছিলেন সুহাসিনী। নিজে অযত্নে থাকলেও পরীর কোন অযত্ন করে না নীরা। দুপুরে ওষুধের জন্য যখন ঘুম আসে একপাশে পাশবালিশ মাঝে বাবিন, অন্যপাশে পরীকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। পরী দিব্যি নীরাকে জড়িয়ে ধরে শোয়, ঘুমোয়। ঘুম থেকে উঠে পরীকে হাত মুখ ধুইয়ে, চুল বেঁধে, সাজিয়ে দেয় নীরা। পরী নীচের লনে খেলতে যায়। নীরা দক্ষিণ দোতলায় বারান্দায় বসে নজরদারি করে। সুহাসিনী পাশে বসেছিলেন, “পরীটা খুব টরটরে”। “হ্যাঁ, কাকিমণি, তবেবাবিনেরথেকেকমদূরন্ত। বাবিন তো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতেই পারে না, সবসময় ছুটছে”। “বাবিনকে তো তুমি বকোই না”। সুহাসিনী ইচ্ছা করেই বর্তমানে ছিলেন। বাবিনকে আপনার ছেলে শাসন করে। বাপিকে ভয় পায় খুব”। “অনিদের ছেলে বেলাতেও ওদের তিনভাইকে আমিই শাসন করতাম। তোমার শাশুড়ী মায়ের ত সংসারে খুব একটা মন – কোন বলেই ছিলো না”। “হ্যাঁ, গল্প করেছে অনি”। বলেই নীরা বুঝলো কাকিমণির সামনে নাম করে ফেলেছে, “মানে আপনার ছেলে”। “অনি-ই ঠিক আছে। তোমরা আধুনিক মেয়ে। কী বলে যে, ছেলে বেলা নিয়ে?” “সবই বলেছে, আপনার কড়া অনুশাসন, নিয়ম না থাকলে এত ভালো রেজাল্ট হতো না বা মরাল ক্যারাক্টারটাও এভাবে তৈরী হতো না – বলে সবসময়। “অনি পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো”। এর জন্য শুরুতেই ব্যাবসা আমি চাইনি, ছট দুটোতো কোন ক্রমে গ্রাজুয়েশন – তার পরপরই ব্যাবসা – কিন্তু অনি যখন বিলেতে পড়তে যেতে চাইলো ওর বাবা মায়ের অমত থাকলেও আমি বলেছিলাম পড়ে আসুক। ব্যাবসা নিয়েই তো পড়া। পড়ে এলে বাবসাটা আরো ভালো বুঝবে। ফলতো দেখতেই পাচ্ছো”। “আপনাকে খুব মানে”। “জানি, ছট থেকেই ওর মা, বাবা, কাকা সবাই অনি যা কিছুই করুক কাকিমণিকে বলে দেব বলে বড় করেছে তো, নাচাবেন ওনারা, ছেলেকে স্কুল কামাই করে ঘুরতে নিয়ে যেবেন অনারা, পড়াশুনার খেয়াল রাখবেন না ওনারা – এদিকে ছেলের রেজেল্ট একটু খারাপ হলেই ছোট কি ছট বৌমা কি ছোট গিন্নি – অনিটার এমন হলো কেন দেখোতো। ছেলেকে পাহাড় থেকে ঘুরিয়ে এনে নিউমোনিয়া করলো তোমার শাশুড়ী সেটাও ওর কাকার বাবার আর মায়ের মতে সুহাসিনীর দেখার বিষয়।
নীরা হেসে ফেললো, সুহাসিনীর কথা বলার ভঙ্গিতে। “আপনার কথার বাইরে যেতই না সে – বলেছে আমায়”। “এখনো বাইরে যায় না। ওর কাকার আর ব্যাবসায় নজরদারিটা অনি আতকেছে – কার কথাতে এটা নিশ্চয় বলেছে তোমায়”। “হ্যাঁ, কাকিমণি। আমাকে পছন্দটাও ত আপনি ই করেছিলেন”। “অথচ গত পাঁচ সাত বছরে ওদিকের করে এদিক নজরটাই দেওয়া হয়নি আমার, নিরা, এত মানা, এত নিষেধ, এত কর্তব্যের বাঁধন। আজ এসে দেখলাম। দেরি করে ফেললেও খুব দেরি হয়নি মনে হয়”। পরী এরই মধ্যে মাঠে পড়ে গেলো একবার। “নিধুকাকা,পড়েগেলোযে ...” নীরা বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, “নীরা, বাচ্চারা একটু পড়েই। খেলে আসুক। কাটলে ছিঁড়লে ডেটল লাগিয়ে দিব। এখানে তো তাও খেলতে পারছে। ও বাড়িতে পায় না”। “কেন? মাঠ আছে তো”। “থাকলেও স্কুল, পড়া, আঁকা – এখন আবার তার মা নাচেও দিয়েছে .... চলছে সারাদিন”। “এইটুকু বাচ্চার উপর এত চাপ?” “তাহলেই বোঝ” “বাবিনকে তো পড়াশুনার বাইরে এখনো কিছুই দেওয়া হয়নি। ওর বাপি বলে অ নিজে বুঝুক কন্টা ভালো লাগে, তাহলে সেটাতেই দেব”। সুহাসিনী বুঝলেন বাবিন প্রসঙ্গ আসতেই থাকবে। “পরী এখানে থাকলে, ভালো থাকে”। “তাই, কাকিমণি? আমিও খুব ভাল থাকি ও এলে। অনি বলছিলো এই তো মেয়ে চাইতে না – আমি বললাম এমন মিষ্টি মেয়ে হলে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায়? পরীকে রেখে দেবো এমনও বলেছি ওকে। আনিও রাজি। বাবিন এলেই বাবিন চাইলে পরীকে রেখে দেব, বলেছে অনি”। সুহাসিনী বুখলেন অচ্যুত, অতীনের পরিকল্পনার একমাত্র বাঁধা বাবিন এলে – এই শব্দটা। “তবে অতীনরা ছাড়ায় কিনা ...” “অতীনবাজিনাকেউইপরীকেমানুষ করেনি নীরা। আটকালে আমিই আটকাবো। তবে তোমাকে আর পড়িকে ভালোরাখার জন্য এইটুকু আমি করতেই পারি”। “পরি ঠাম্মার কথা খুব বলে”। “এখানে থাকলে অল্পতেই ছুতে আসতে হবে – সবসময়, ওর ধ্যান”। “শুধু ওর টানে কাকিমণি? আর আপনার এখানকার ছেলে মেয়ের? “সুহাসিনী নীরার হাতে হাত রাখলেন, “সেই টান মানলে তো আমাকে চলে আসতে হয়”। নীরা খুশি হলো, “আসবেন? শাশুড়ি থাকলে কত ভালো হয় আর না থাকলে কত কষ্ট আমি বুঝি”। “এই যে বললে মেয়ে আমার – তাহলে শাশুড়ি কেন?” নীরা আর সুহাসিনী একসাথে হেসে ফেললেন সুহাসিনীর কথায়।
পর্ব-১২
“ডাক্তারকাকা”
অনিরুদ্ধ ডাক্তার ব্যানার্জিকে ডাকল।
“হ্যাঁঅনি,এসো এসো”
“কাকিমণি এসেছেন”
ডাক্তার ব্যানার্জি আস্ফুটে বললেন।“সুহাসিনী!এখানে?”
সুহাসিনী ঢুকে এসেছিল ততক্ষনে।
“বসতে পারি,রুদ্র?”
কাকিমণি আর ডাক্তারকাকা স্কুলের বন্ধু।একসাথে পড়েছেন।আর এর বাইরেও কানাঘুষোশুনেছে কাকিমণি আর ডাক্তারকাকার কৈশোরের প্রেম আর কাকিমণির বাড়ির অমতের জন্য তড়িঘড়ি কাকার সাথে বিয়ে হয়ে যাবার গল্প। তারপরেও বহুবার অনিদের বাড়িতেই একে অপরকে মুখোমুখি দেখেছেন ওনারা।ডাক্তারকাকার বাবা মুখার্জিদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ছিলেন। ওনার পর ডাক্তার কাকা হয়েছেন। কাকিমণির মুখোমুখি হলে ডাক্তারকাকা অস্বস্তিতে পড়েন এটা বোঝে অনিরুদ্ধ। কাকিমণির জন্য বিয়েও করেননি। ডাক্তারকাকার চেম্বারে কাকিমণিকে আনবে বলে অনিরুদ্ধ নিজেই ইতস্তত করছিল।সুহাসিনিই প্রশ্ন করেছেম।
সো, প্রশ্ন করছ কেন?কি নেবে বল, ব্ল্যাক কফি এখনঅ চামচ চিনি?
সুহাসিনী মুগ্ধ চোখেতাকালেন-মনে রেখেছ?
রাখব না বলছ? এই রে তোমার ছেলের সামনে এসব-
সুহাসিনী হাসলেন- অনি সব জানে- অকে গাড়িতে আসতে আসতে বলেছি সবটা। কার না কার থেকে কি না কি শুনে রেখেছিলো। তার থেকে নিজে বলে দেওয়া ভালো ।
রুদ্র মাথা নাড়লেন- তা ঠিক, অচ্যুত আসতে দিচ্ছে তোমাকে? আনিদের গাড়ি, আনির সাথে বাইরে—
দিচ্ছে আর কই, আমিই শুনছি না-
চারটে নাতি নাতনী হয়ে সাহস জন্মেছে তবে-
সাহস নয়-ইচ্ছা, আর চার নয় পাঁচ, বাবিন আমার সবচেয়ে বড় নাতি ছিল
জানি-বস।আমাদের বহুদিন পর এভাবে একান্তে মুখোমুখি দেখা।তাই আর কি-অনিরদ্ধ বসল ।খুব যাচ্ছে- নীরার কাছে শুনেছি-
মুখার্জি বাড়ীর সব খবরই পৌঁছায় তোমার কাছে দেখছি—
পৌঁছবে না? খোঁজ তো রাখতেই হবে সুহাসিনি। তুমি আছো যে, আর অনিটাও, বড়দার সন্তান। দেবতুল্য মানুষটার আনেক উপকার আছে তো—
তোমার দয়িতাকে নিজের ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়াটাকে উপকার বল?
অনিরুদ্ধ চমকাল। বাবাও ছিলেন এর মধ্যে? তাহলে তো কাকিমণির বাবার প্রতি যথেসট ক্ষোভ আছে আথচ আনিকে সেসব সত্বেও কীভাবে যত্ন করেছেন, মানুষ করেছেন।
বড়দা সুহাসিনী।
অচ্যুতের লোভ, ইচ্ছা, জেদ, অবসেসন তোমার প্রতি- তোমার মা বাবার বোকামো। তোমাদের দুই পরিবারের বানিজ্যিক সম্পর্ক আর অনির ঠাকুমা ঠাকুরদার সাম্রাজ্য বাড়াবার লোভ। তোমার মা বাবার একমাত্র মেয়ে তুমি। শিক্ষিতা, সুন্দরী এটাই স্বাভাবিক। আর ডাক্তারি করে ক পয়সাই বা হয় বল? তোমায় এতো সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে দিতে পারতাম না। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আমি প্রত্যাশী। মনে হয় তোমার?
সুহাসিনীর কথায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে। রুদ্রদেব হাসেন।
ভালো হয়েছে এ জন্য বলিনি। তুমি ও বাড়ি গেছো বলেই বাবিনটা বেঁচেছে। নাহলে অর আগের বাচ্চাটার মত—
অনিরুদ্ধ চমকা্ল। সুহাসিনী চোখের ইশারায় থামতে বললেন। অনিরুদ্ধ এসবের কিছুই জানে না।
আগের বাচ্চাটা বলতে কাকিমণি?
কিছু না অনি-পরে বলবো তোকে। তোর ডাক্তার কাকাও কি না কি বলে ফেলে, বুড়ো হয়েছে তো। এবার বলতো বাবিনকে আনার কি প্লান তোমার?
রুদ্র মুখ ফসকেই সামলে নিয়েছিলেন।
আগে বল নাতনীটাকে অনিকে দেবে অচ্যুত?
অনিরা চাইলে তার কোন অমত নেই।
আর তোমার?
ছিল—কিন্তু পরীকে অনির সাথে নীরার সাথে দেখে আর নেই।
তাহলে তো হয়েই গেলো
কিছু হয়নি রুদ্র, বাবিনকে ফেরত চাই নীরার। সেটা না হলে সব শেষ।
তাহলে ডাক্তার চক্রবর্তির প্ল্যানটাই কাজে লাগাতে হবে।
একরকম দেখতে বাচ্চা?
বয়সটাও এক হতে হবে।
পাবো কোথায়?
খুঁজতে হবে,অবিকল এক না হলেও ধরনটা—
বুঝলাম, নীরা মানবে?
আগে বল তুমি মানবে তো? অনি তোমাকে যখন নিয়ে এসেছে আর কাউকে না এনে- তোমার মানাটা সবচাইতে জরুরী।
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করার অভ্যাস তোমার গেলো না রুদ্র। আমি অনি,নীরার ভালোর জন্য সবই মানবো। মানবো বলেই সবটুকু জানার জন্য এখানে এসেছি। কিন্ত আমার শর্ত হল যে বাচ্চাটাকে আনা হবে তার সাথে যেন অন্যায় করা না হয় কোনোমতেই । নীরা না মানলেও অনিকে তার দায় নিতে হবে।
নীরা মানা না মানাটা আমরা কতোটা ভালো অভিনয় করব তার উপর নির্ভর করছে। আর বাচ্চাটা এলে তোমারও দায়িত্ব বাড়বে সুহাসিনী। অনিকে যেভাবে আগলে রাখতে সেভাবেই আগলে রাখবে ওকে।
নীরাকে ওর মা হয়ে ওঠাতে হবে রুদ্র—তাহলেই হবে।
হবে। নীরা তোমারই মতো অনেকটা। ঠিক পারবে। তুমি ওকে শেখাবে মা হওয়াটা। বিয়ে করেই যেমন শিখে নিয়েছিলে- পায়ের আলতা শুখাতে না শুখাতে অনির মা হয়ে গিয়েছিলে ।
সুহাসিনী অনির দিকে তাকালেন।
শিখতে হয়েছিল। বড় গিন্নী তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। নিজের সাজগোজ, বাণ্ঢবীড়া, ঘোড়াফেড়া, নিজের জগত। শ্বাশুরির বয়স হয়েছিলো। অযত্ন দেখে কি করব বল?
অনি, মনে পরে সেসব?
ডাক্তার কাকার কথায় অনিরুদ্ধ হাসল।
পরবে না? বাড়ি ব্যবসা ভাগ হবার আগে অব্দি তো সবসময় কাকিমণির কাছেই থাকতাম। ভাগ হবার বছর খানেকের মধ্যেই বিলেতে চলে গেলাম। ফিরে এসে...
কাকিমণি কিন্তু পরীকে নীরার কাছে যেতে দিচ্ছে তোমাকে ভরসা করেই।
জানি ডাক্তার কাকা। তাছাড়া নীরা আর পরীও মিলেছে ভালোই।
তোমরা যাকে আনতে চাইছ সে এলে পরীর কদর কমে যাবে না তো?
সুহাসিনী শঙ্কিত হলেন।
বাড়তেও পারে, নীরার মনটা তো স্থির নয়, কেমন রি-অ্যাক্ট করে দেখি আগে
বাবিনের জায়গায় যাকে আনবে, তাকে আইনত যেন আনা হয় রুদ্র
সুহাসিনীর কথায় রুদ্রদেব উঠে দাঁড়ালেন-
স্মোক করতে পারি?
এসি ঘর- একদম না-
অনি শুধু তোকেই না তোর ডাক্তার কাকাকেও কেমন শাসন করে দেখেছিস?
অনিরুদ্ধ লজ্জা পেল
মাঝে ক’বছর করেনি । এটা আমার দুর্ভাগ্য
সুহাসিনী অনিরুদ্ধর পিঠে নিজের হাত রাখলেন
করার উপায় ছিল না । আমি দুরত্ব চেয়েছিলাম। কারন চাইনি তোমার ঐ কাঁচা বয়সে তোমার কাকা তোমার ব্যবসায় ঢুকুক- আর ঠকিয়ে দিক। এখন আর সে ভয় নেই। তাই কাছে আসছি আবার।
বাবিনকে আনলে এই আসাটাতে ছেদ পরতে পারে সুহাসিনী । জাত, কুল, ধর্মের দোহাই দিয়ে অচ্যুত তোমায় আটকাবে-
শুধু সে কেন? ছেলে-বউমারাও । কেবল ছোট- বৌ ছাড়া, ওর মনটা সরল, প্যাঁচ নেই। কিন্তু ওরা আটকালেই বা- শুনবে কে? পরীকে দেখতে ওর ঠাম্মা আসতেই পারে।
অনিরুদ্ধ বলল
পরীকে এতো সহজে দেবে? আর দিলেও তখন নিয়ে যাবে না তো?
সুহাসিনী সত্যিটা লুকোলেন
নেবে না- তবে পরীকে তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে হবে তোমাকে – অনি
অনিরুদ্ধ বুঝলকাকিমণি চান পরী এ বাড়ীতে মানুষ হোক- নীরার অসুস্থতা দেখেও চান, কেন?
অযত্ন শব্দ টা কানে বাজলো অনিরুদ্ধর । পরীরও তা হয় না ত ওখানে ?
আচ্ছা কাকিমণি , আমি আজই অতীন কে বলছি ।
বাবিন যতদিন না আসে ততদিন পরীটা থাকলে নীরার অবসাদ কম থাকবে।
রুদ্রদেব বললেন।
পরী তারপরেও থাকবে –ডাক্তার কাকা থাকবে তো, আর তুমি পরীকে খুব ভালবেসে ফেলেছ বুঝি তো, আমিও তো এভাবে কাউকে সন্তানের মতোই ভালবাসি ।
কে?
অনিরুদ্ধ প্রশ্নটা করেই বসলো ।
সুহাসিনী – তোমার অনি এই বুদ্ধি নিয়ে এতোগুলো দোকান চালায় ?
সুহাসিনী হাসলেন
অত ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না আমার অনি
তা ঠিক, বুঝলে অতীন অনুপমের ছেলেবেলার দোষ গুলো ঘাড়ে পড়ে যেতো ওর রোজ রোজ
অনিরুদ্ধ বুঝল ডাক্তার কাকা তার ছেলেবেলার কথা বলছে
ওরা মিথ্যা কথা বলত ঠাকুমাকে মাকে- আমি পারতাম না
তোর কাকিমণি অবশ্য বুঝে যেতো কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা
সুহাসিনী হাসল
অনিকে একলা ঘরে নিয়ে গিয়ে জিগ্যাস করলেই স-ব বলে দিতো ।অথচ ঠাকুমা মা বাবাকে বলতো না কিছুই।
ওরা শুনতে চাইত? তুমিই তো শুনতে। আর তখন যার দোষ তাকে শাসন করতে। ওরা তো খালি অনি বড়- অনি দেখে রাখেনি- অনি এটা- অনি সেটা---
অনিরুদ্ধ ছেলেবেলার কথা ওঠায় প্রগলভ হয়ে উঠেছিলো
রুদ্রদেব সুহাসিনী হেসে ফেললেন ।
তবে আমিও অনেক মার খেয়েছি- তোমার কাছে
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম- সেটা বল
রুদ্রদেব বললেন
তা ঠিক, তবে আমাকে যেদিন ধরত কাকিমণি – সেদিন শেষ। যারা নালিশ করে করে কাকিমণিকে রাগিয়ে দিত সেই মা, বাবা, কাকা-ই শেষে কাকিমণির হাতে পায়ে ধরে নাক কান মুলে ছাড়াত।
নিজেরা কোনোদিন আদর করেছে যে শাসন করবে? তাই দুটো ব্যাপারেই সুহাসিনী ভরসা ।
সুহাসিনী বললেন—
ভাগ্যিস তুমি শাসন করেছিলে । নাহলে আমি মানুষ হতাম নাকি?
তোকেই তো পেরেছি অনি । বাকি দুজনকে পারলাম কই? তাদের একজন বাপের ধাত পেয়ে গেল । আর বড়জন শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা ।
অনিরুদ্ধ কাকিমণির হাত ধরল।
একজন তো একদম তোমার মতই হয়েছে ।তাই না, ডাক্তার কাকা ?
কোন উত্তর পেল না ।
সুহাসিনী আর রুদ্রদেব দুজনের চোখেই জল দেখল । আনন্দের অশ্রু। অনিরুদ্ধ বুঝল।
পর্ব- ১৩
অনি এসেছে।
বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতেই সুহাসিনী কথাটা বললেন ।
অচ্যুত তাকালেন ।
অনির সাথেই ছিলে এতক্ষণ?
হ্যাঁ, অন্যরকম কিছু কি মনে হচ্ছে তোমার, এই বয়সেও?
সুহাসিনীর কথার দৃঢ়তায় অচ্যুত আর কথা বাড়ালেন না।
অনি, আয় বাবু-বস ।
অনিরুদ্ধ অবাক হল । বিস্মৃত কাল পরে কাকা তাকে বাবু বলে ডাকল। তাহলে কাকিমণির কথাই সত্যি । খুব একটা কাঠ খড় পোড়াতে হবে না পরীকে পেতে , মনে হচ্ছে ।
অতিন কই?
বড় খোকা এই ফিরল ।কেন, ওর সাথে দরকার ?
পরীর ব্যাপারে কথা তো—
তাতে কি? আমি আছি । তোর কাকিমণি আছে। পরী তো আমাদের কাছেই মানুষ । রাতে তো আমাদের সাথেই ঘুমায় সে । তোর ছেলেবেলার মতোই ।তাই না ছোট গিন্নী ?
অনিরুদ্ধ রাতে কাকিমণির কাছেই ঘুমাত । কাকা একই ঘরে অন্য খাটে । অতিন অনুপম হলে তিন ভাইয়েই কাকিমণির কাছে ঘুমিয়েছে । অনেক বড় অব্দি । কাকিমণি অনিরুদ্ধকে একলা শোয়াত না ।ঠাম্মা মা বললেও এড়িয়ে গেছে । কাকিমণি কি অনিরুদ্ধর সুরক্ষা নিয়ে ভয় পেত? তাই নিজের কাছে রাখতে চাইত সবসময় ?
ছোটো, এত বড় ছেলে—এখনও আঁচলে বেঁধে রাখবি ?
মায়ের বলা কথা মনে পড়ে অনিরুদ্ধর । কাকিমণি এড়িয়ে যেত ।
বড় কোথায় ? বড় হলে নিজেই শুতে চাইবে না এখানে । আলাদা ঘর চাইবে ।
অনিরুদ্ধ আগে অতিন অনুপমরা আলাদা ঘরের জন্য ছটপট করেছে। সব ভাইরা বড় হলে তবেই কাকিমণি আলাদা ঘরে যেতে দিয়েছিল অনিরুদ্ধকে । এতদিন ব্যাপারটাকে স্নেহ মনে করত অনিরুদ্ধ । আজ ডাক্তার কাকার মুখ ফস্কে বলা কথাটা শুনে মনে হচ্ছে—সতর্কতা।
কাকিমণিকে জানতে চাওয়া হল না তার আগের বাচ্চাটার গল্প । কে ছিল সে, ছেলে না মেয়ে, কি হল তার—
অনি, কি এত ভাবছিস?
ছোটবেলার কথা কাকা-
অচ্যুত হাসলেন
সে একদিন ছিল। তোর কাকিমণি তো তোকে চোখে হারাত। কারোর কোলে চাপতে দিত না। বিশেষত বাবা, কাকার কলে। মা তো নিতই না। কিন্তু ওদের কোলে অনি গেলেই কাকিমণি নিয়ে নিত। ভয় পেত যদি ফেলে দেয় ওরা।
পরীকে নিয়ে কি ভাবনা বল।
নীরা আর পরীর ভালোই মিলেছে ।
বাহ- আর তোর তো খুব ন্যাওটা মেয়েটা ।
ছোট্ট থেকেই। তাই ভাবছি নীরার ফাঁকা কোলে যদি পরীকে তোমরা দাও—
বলেই কাকিমণির দিকে তাকাল অনি। চোখের ইশারায় জানালেন বলাটা ঠিক হয়েছে।
নিবি ? ওর ঠাম্মা থাকতে পারবে তো ?
কাকিমণির তো ওটাও বাড়ি কাকা।কাকিমণিও যাবে, থাকবে।
অচ্যুত মাথা নাড়লেন
তা বেশ। নীরার বর্তমান পরিস্থিতির কথা যা শুনলাম বেয়াইএর কাছে এটা ভালো সমাধান। কি বল ছোটো গিন্নি ?
হ্যাঁ, নীরা পরীকে পেয়ে জীবনে ফিরতে পারছে যখন—
ঠিক- আর নীরাকে বাদ দিয়ে তুই যখন ভাববি না—মানে আর একটা বিয়ে—
না না কাকা সেটা সম্ভব নয় ।
অতিন আর বৌমাকে বলি তাহলে ।
আজই বলে যাই ?
বেশ, লিখে পড়ে নিবি তো? নাহলে নীরা জীবনে ফিরে এসে আর একটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এলে পরীকে ফেরত দিয়ে যাবি?
বলেই হেসে উঠলেন অচ্যুত। অনিরুদ্ধর কান লাল হয়ে গিয়েছিল। কাকা এরকম বাজে ইয়ার্কি করেন। কিন্তু অনিরদ্ধ এসবে অভস্ত্য নয়।
আহ- কি সব বলছ- ছেলের সামনে ।
তাও ঠিক। তবে পরীর সাথে অন্যায় যেন না হয় অনি ।
পরীকে আমি খুব ভালোবাসি কাকা । কোন অন্যায় হবে না—নিস্তিন্ত থেকো ।
বেশ- আমরাও যেন মেয়েটাকে দেখতে টেকতে পাই—তোর কাকিমণি তো না দেখে থাকতে পারবে না মনে হয় ।
কাকিমণি যাবে রোজ ।ওটাও কাকিমণিরই বাড়ি।
বেশ- অতিনকে ডাকছি তাহলে ।
ডাকো ।
অচ্যুত ভিতরে যেতেই অনিরুদ্ধ চাপা গলায় বলল—
কাকা তো সহজেই রাজি হয়ে গেল কাকিমণি?
জানতাম হবে ।
পরীর কি অযত্ন হয় এখানে , তাই তুমিও চাইছ—
তোদের কাছে বেশি ভালো থাকবে – জানি ।
মেয়ে বলেই কি –
সুহাসিনী হাসলেন
সব প্রশ্নের জবাব হয় ?অনি ?
তোমার আগের বাচ্চাটা কি ছিল কাকিমণি ? ছেলে না মেয়ে ? কি হল তার? এর কথা আগে বলোনি তো আমাকে !!
সুহাসিনী ভীষণ চমকে উঠলেন ।
থাক ওসব ।
না বল ।
পরে বলব ।
তোমার বিয়ের আগেই ?
অনি- পরে বলব বললাম তো ।
সুহাসিনী থামালেন ।অতীনকে নিয়ে অচ্যুত চলে এসেছিলেন ।
তোর দাদাভাই বলছে পরীকে নেবে।
অচ্যুত কথাটা তোলার ভান করলেন ।
দাদাভাই নেবে ? তা বেশ তো । বৌদিমনির মনটা ভালো যদি থাকে এতে আমার কোন আপত্তি নেই ।
এত সহজে অতীনের রাজি হওয়াতে অনিরুদ্ধ সারকথাটি বুঝল । ছেলেবেলায় নিজের পছন্দের খেলনা অব্দি নিতে দিত না যে ছেলে—এত সহজে নিজের সন্তান দিয়ে দিচ্ছে মানে সম্পত্তির হিসাব মাথায় রয়েছে ।
বৌমার মত কি রে বল
তোমার বউমা যথেষ্ট সমজদার ।তোমাদের কষ্টটা বোঝে। অরাজি হবে না ।
অনিরুদ্ধ বুঝল এরা রাজিই ।দেরি করা আর উচিত হবে বলে মনে হল না ।
পর্ব – ১৪
নীরার দিনগুলো এখন আগের থেকে ভালো কাটে । কয়েকদিন হল পরীকে এনেছে অনি । নীরা আপত্তি করেনি । বাবিনকে তো খুঁজে আনবেই বলেছে লোকটা । চেষ্টাও করে । দেখেই বোঝা যায় । পরী এখন নীরাদের কাছেই থাকে । ভারী শান্ত মেয়ে । বাবিন দাদার সব গল্প চুপটি করে শোনে । সকালে প্লে-স্কুলে যায় দশটাতে । আবার দুটো নাগাদ ফিরেও আসে । পরীর জন্য কাকিমণি রোজ আসছেন । পরীর মা জিনাও আসে মাঝে মধ্যেই । অতীন ঠাকুরপোও এসেছিল উইক এন্ডে । পরীর ডাক বদলায়নি অনি-নীরা । জেঠুমনি-জেঠিমনিই থাক । বদলানোর দরকার নেই । পরীকে স্নান করানো , খাওয়ানো সব ঝক্কি কাকিমণিই নেন ।নীরার কাজ কেবল বাবিনকে খাওয়ানো আর নিজে খাওয়া । ও হ্যাঁ , পরীকে পাশে নিয়ে ঘুমানোও কাজের মধ্যে পরে ওর । পরীর পড়াশুনা সব অনি দেখে । অফিস থেকে ফিরে । নীরা তখন বাবিনের সাথে একান্তে থাকে । গল্প করে । রাতে বাবিন আর পরী দুজনকে দুদিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে নীরা । অনি কোন কোন দিন আসে । পরীর পাশে শোয় । বাবিনকে সরিয়ে নীরার পাশেও । পরীকে পেয়ে ভীষণ খুশী – দেখেই বোঝা যায় । এতে আবার বাবিনকে আনতে ভুলে যাবে না তো? নীরা পাশ ফেরে ।
জেগে ?
অনিরুদ্ধ তাকায়
হ্যাঁ বল ।
বাবিনকে পেলে ?
খুঁজছি সোনা ।
আর কতদিন ?
অল্প কিছুদিন ।
সত্যি ?
হ্যাঁ , তুমি ওষুধ খেয়েছ তো ? রাতের ?
হ্যাঁ খেয়েছি ।
তবে ভালো মেয়ের মতো ঘুমাও ।
নীরা ওপাশে ফিরে পরীকে জড়িয়ে ধরে ।
মাঝে নেব ? পরীকে?
হ্যাঁ বাবিনটা ওদিকে ঘুমাচ্ছে । ঘুমোক ।
অনিরুদ্ধ খুশী হয় ।
নাও ।
নীরা সন্তপর্নে পরীকে মাঝে নেয় ।
পড়ে কেমন ?
বেশ ভালো । শান্ত হবার জন্য আর সুবিধা ।
বাবিনটা যা ছটফটে –
ঐ জন্যই বকুনি খায় ।
অনিরুদ্ধ পরীকে জড়িয়ে ধরে ।
পরী ঘুমের ঘোরে নীরার গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে । নীরা হাসে।
ঠাম্মার মতো করে জড়িয়ে ধরেছে ।
ঠাম্মার কাছেই তো ঘুমাত ।
কাকিমণি আমাকে সব বলেছেন ।
অনি , বাবিনের জায়গায় মেয়ে হলে তুমি তো নয়ই আমিও কি অযত্ন করতাম – বল ?
অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে –
একদম না ।
অথচ--
বাদ দাও । এখন তো অযত্ন হচ্ছে না ।
বাবিন এলেও হবে না । কথা দিলাম ।
অনিরুদ্ধ চুমু খায় নীরাকে ।
জানি – নীরা যে পরীরও মা । নামেই জেঠিমনি ।
যেমন কাকিমণি তোমার ।
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে ।
আমি তবে দুটো মা ফিরে পেয়েছি একসাথে – কি বলো ?
ঠিক , আর কাকিমণিও তোমাকে ফিরে পেয়ে খুব খুশি অনি ।
অনি জানে । কিন্তু তবুও কাকিমণিকে প্রশ্নটা করতেই হবে ।ওর আগে এ বাড়িতে কোন বাচ্চা ছিল । আর তার কি হয়েছিল ?কেন সে জিনিষটা লুকানো হয়েছে এই প্রজন্মের থেকে ? জানতেই হবে ।
বিকালে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছিল অনিরুদ্ধ । কাকিমণির সাথে দেখা করবে বলে । এসে দেখে ডাক্তার কাকাও এসেছেন ।
পরী নীচের মাঠে খেলছিল । অনিরুদ্ধ আসবার সময় কলে করে নিয়ে এসেছে উপরে ।
খেলা শেষ ?
সুহাসিনী বললেন ।
জেঠুমনি নিয়ে এল যে ।
অনেক খেলেছ পরী । এবার হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসব আমরা ।
আচ্ছা – জেঠিমনির কাছে যাও তবে ।
পরী ছুটে চলে গেল ।
কি খাবি ?
সুহাসিনী বললেন ।
মনি পিসিকে বলে দিচ্ছি । তুমি ব্যস্ত হয়ো না ।
রুদ্রদেব বললেন
তুই বস আগে , খেটেখুটে এলি ।
অনিরুদ্ধ বসলো । দুজনেই আছে । কথাটা পারার এর থেকে ভালো সময় হয় না ।
ডাক্তার কাকা আমার আগের বাচ্চাটার কথা বললেন না তো ।
সুহাসিনী ধমকালেন
আবার এক কথা !
জানতে হবে তো ,কাকিমণি ।
সুহাসিনী বলে দাও । লুকিয়ে কেনইবা রাখবে ?
এত পুরানো কথা –
তাও জানতে হবে কাকিমণি । আমার দাদা না দিদি ?
দাদা --
রুদ্রদেব বললেন ।
মারা গেছে ?
হ্যাঁ –
এমা ! কবে কিকরে ? মা বাবা কেউ বলেনি তো আমায় !
সুহাসিনী অনিরুদ্ধর অস্থিরতা বুঝলেন ।
তর তখন মাস দ’শেক । যখন সে মারা যায় । আমার বিয়ের দু মাস আগে ।তারপরই বড় গিন্নী আরও সংসার বিমুখ হয়ে যায় ।
মারা গেল কি করে ?
যতদূর শুনেছি ভেদবমি –
রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন
না , রক্তবমি – শুধু রক্তবমিই নয় – চারিদিক থেকে রক্ত—
অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল
বাবিন –বাবিন ও তো –
হ্যাঁ , দুটো কেসে আনফানি সিমিলারিটী আছে , অতা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা । তার বয়সও চার – সাড়ে চার ছিল তখন ।
কি ? তার কোনও ছবি নেই ?
আমি এসে থেকে ছবি দেখিনি । দু মাসেই সব সরানো হয়ে গিয়েছিলো । এক গুরুদেবের আদেশে । তোর ঠাকুরদা ঠাকুমা খুব মানতেন ওনাকে ।তন্ত্র মন্ত্রের জেরে কারো শত্রুতায় এই অপমৃত্যু এতা মানতেন ওঁরা ।
সে কি ? ঠাকুরদা তো শিক্ষিত মুক্তমনা ছিলেন জানি ।
বাবিনের মৃত্যুটাকেও হয়তো এখন ওনারা থাকলে সেভাবেই মানতে হতো । তন্ত্র মন্ত্রে খুব বিশ্বাসী ছিলেন দুজনেই তো । গুণিন ডাকা হতো । ঝাড় ফুঁক করা হতো ।
রুদ্রদেব হাসলেন ।
তবে সুহাসিনী বিয়ে করে এসে সবটুকু জানে এবং জেনেই জানিনা হয়ত সংস্কারবশত তোকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করত না ।
সংস্কার কিনা জানি না । তবে ওকে কাছ ছাড়া করতে ভয় হতো আমার । মনে হতো আবার কিছু খারাপ ঘটবে ।
রুদ্রদেব বললেন
হয়ত পুরোটাই সমাপতন । তবুও দুই জেনারেশনেই ফার্স্ট বর্ণ মেল চাইল্ড – অবাক লাগে –
অনিরুদ্ধ চিন্তিত হল
কিসের জন্য
সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন । তারপর বললেন –
অনেক স্পে্কুলেশনই তো করা যায় অনি ।
রক্তবমি বিষ প্রয়োগেও তো হতে পারে ডাক্তার কাকা !
পারে । সুহাসিনী তাই মনে হয় নিজে না চেখে তোকে কিছুই খাওয়াত না ।
নিজের রান্না ছাড়াও খাওয়াতাম না ।
বাবিন ও কি তবে এভাবেই—
না না --- ওর তো ডেঙ্গু ছিল ।
সুহাসিনী ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন ।
কে ? কে ওখানে ?
পর্দার ওপাশ থেকে ছায়াটা সরে গেল যেন ।
অনিরুদ্ধ ছুটে গিয়ে দেখতে গেল । কিন্তু কেউ নেই ।
কে ছিল ?
কাকিমণি মুখটা কঠিন করলেন ।
জানি না । তবে যা জানলে সেটা আর কাউকে বলবে না , অনি।ভাইদের নয়, নীরাকেও নয়।
অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকল । ও যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে এ তো মস্ত ষড়যন্ত্র ! এই জাল ওকে কাটতে হবে । কাটতেই হবে ।
পর্ব – ১৫
আজ টাইম হবে ?
শাঁওল এর ফোন পেয়ে ঘড়ি দেখল অনিরুদ্ধ।আজ অফিসে কোন মীটিং নেই বা কোন শ-রুম ভিজিটে যাওয়ারও নেই ।
হতে পারে । তোর স্কুলে ঢুঁ মারব একবার ।
কখন আসবে ?
ফোন করব ।
টিফিনে এলে ভালোভাবে কথা হবে ।
আচ্ছা ।
অনিরুদ্ধ ভাবল পরীকে নিয়ে যাবে । ওকে তো তেমন ঘুরতেও নিয়ে যাওয়া হয় নি । ওখানেও ছোট বাচ্চারা আছে । ওর ভালো লাগবে ।
পরীকে নিয়ে যাবে ?
হ্যাঁ , একটা বাচ্চাদের স্কুল দেখতে যাচ্ছি , গেস্ট হিসাবে – ভালো লাগবে ওর ।
সে তো লাগবেই । তবে বেশী দেরী করো না ।
নীরা বলল ।
পরীকে চোখে হারাচ্ছে জেঠীমনি ।
অনিরুদ্ধ ইচ্ছা করেই বলল ।
নীরা পরীকে আদর করলো ।
হারাবে না ? আমার সোনা মেয়ে বলে কথা ।
তাহলে আজ স্কুল যাবো না জেঠিমনি । বেড়াতে যাবো ?
অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নিলো ।
একদিন বেড়াতে যাই ? পরীমনি কি বলছে ?
ইসস – পরীমনি কে ?
পরীমনি মানে পরী । এই যে জেঠুমনি জেঠিমনি – তাই পরীমনি পরী কি বলছে – স্কুল যাবে ? কামাই করবে না?
পরী একটু ভাবল ।
কামাই করা খারাপ । কিন্তু বেরুও ভাল । জেঠিমনি যাবে না ?
নীরা অবাক হল ।
জেঠিমনির এত খেয়াল মেয়ের ?
অনিরুদ্ধ বলল
চলো নীরা , তুমিও চলো ।
না, সবাই গেলে হবে অনি ? বাবিন এলে ?
অনিরুদ্ধ কথা বাড়াল না ।
আচ্ছা আমরাই যাই তবে । জেঠূমনি আর পরী । মেয়েকে রেডি করিয়ে দেবে?
পরীর চোখের অবাক ভাব ঢাকতেই বলল অনিরুদ্ধ ।
দিচ্ছি । পরী – চল মা । স্নান করিয়ে , খাইয়ে রেডি করিয়ে দিই ।
তোমার কষ্ট হবে জেঠিমনি । ঠাম্মাকে ডাকো।
নীরা হেসে ফেলে । পরীকে কোলে নেয় ।
কিছু কষ্ট হবে না । বাবিন দাদাকে সব কে করায় ? জেঠিমনিই তো ।
পরী কিছু বলে না আর । জেঠিমনিকে বাবিন দাদা নিয়ে কিছু বলতে মানা করেছে ঠাম্মা ।
গাড়িতে যেতে যেতে জেঠুমনিকে প্রশ্নটা করেই ফেলল পরী ।
জেঠুমনি বাবিন দাদা তো নেইই । তাহলে জেঠিমনি কেন এখনো –
অনিরুদ্ধ প্রশ্নটা বোঝে ।
জেঠীমনি বাবিন দাদাকে খোঁজে আজ—তাই ।
বাবিন দাদা ফিরবে আবার ?
অনিরুদ্ধ ঘুরিয়েই উত্তর দিল ।
খুঁজে দেখি –
বাবিন দাদা ফিরলে খুব ভাল হবে জেঠুমনি ।
অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নেয় । দুগালে চুমু খায় ।
কেন , পরী ?
ও বাড়িতে দুটো দাদা ছিল তো । খেলা যেত । এখানে শুধু একা একা খেলা ।
বাবিন দাদাকে মনে আছে তোর ?
পরী ঘাড় নাড়ায় ।
হ্যাঁ ।
অমনি হ্যাঁ ? কতোটুকু ছিলি সে সময় ?
বাবিন দাদা সবসময় ছুটে বেড়াত । বসত না কোথাও । সবসময় সবাই ছুটছে ওর পিছনে ।
এগুলো তো গল্প শুনেছিস ।
না না – মনে আছে ।
অনিরুদ্ধ হাসল ।
বাবিন দাদাকে দেখলে চিনতে পারবি ?
হ্যাঁ – আমাকেও নাও তোমার সাথে । বাবিন দাদাকে খুঁজবো ।
টরটরে মেয়ে আমার ।
অনিরুদ্ধ পরীকে আরও আদর করে দিলো ।
জেঠিমনিও এটা বলে যখন আদর করে ।
আমাদেরই তো মেয়ে ।
ওখানে ঠাম্মা ছাড়া কেউ আদর করত না ।
বলেই চুপ করে যায় পরী ।
বাবা-মা এলে বলে দিও না যেন ।
কাকিমণির তাড়ার কারণ বুঝতে পারল অনিরুদ্ধ ।
বলবো না , পরী এখানে এসে খুশী ?
খু-উ-ব , জেঠিমনি বাবিন দাদাকে পেলেই হাসি খুশি থাকবে সবসময় । তখন আরও ভালো হবে ।
জেঠিমনির দিকে খুব নজর পরীর ?
কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমায় যে ।
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।
চল – চলে এসেছে স্কুল ।
শাঁওল খুব খুশি ছিল অনিদাকে দেখে । কোলে পরীকে দেখে বলল –
কে গো অনিদা ?
আমার মেয়ে ।
মেয়ে আছে তোমার ? দাদাভাই বলেনি তো ।
আরে প্রতীক জানে না ।তবে পোশাকি ভাবে ভাইঝি ।কাজিনের মেয়ে । কিন্তু এখন আমাদের কাছেই থাকে ।
ওমা ! কি মিষ্টি ! কি নাম তোমার ?
পরী ।
পরী বলে উঠলো ।
স্কুল যায় ?
প্লে – স্কুল ।
সামনের বার এখানেই দিয়ে দাও ।
দেবো । তুই আছিস যখন ।
তুমি কে ?
শাঁওল হেসে ফেলে ।
আমি একটা আনটি । অনি দাদার বন্ধুর বোন ।
ও – তাহলে পিসি । তাই না জেঠুমনি ?
অনিরুদ্ধ দুষ্টু হাসি হেসে ফেলে ।
পিসি – তাই তো হয় হিসাব মতো ।
একদম নয় , আনটি ।
শাঁওল চোখ মারে ।
চলো , ফাদারের ঘরে বসবে ।
অনিরুদ্ধ বলল
চল—
ফাদার আগাস্তিনের ঘরে বসে কথা বলছিল অনিরুদ্ধ । মুখার্জি অ্যান্ড সন্স এর মালিক – এটা ফাদার শাঁওলের থেকে আগেই জেনে গেছেন । তাই আলাদা খাতির পাচ্ছিল অনিরুদ্ধ । শুধু স্কুল নয় এটা ।সাথে একটা বয়েজ অরফ্যানেজ ও আছে ।অরফ্যান ছেলেরাও এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় । প্রতি ক্লাসে পাঁচজন । ওয়ান থেকে টুয়েলভ । নার্সারি থেকে কেজি আরফ্যানেজেই পড়ান হয় । সেখান থেকে প্রথম পাঁচজন এই স্কুলে পড়ে । আর বাকিরা একটু দুরের আর একটা স্কুলে । সেটা বেশ কম এক্সপেন্সিভ আর কম দামীও । আরফ্যানেজ পুরোটাই চ্যারিটি বেসড । এই স্কুলের স্টুডেন্টদের ডোনেসনের উপর ।কিছু এনজিও ট্রাষ্টের সরকারের এবং ব্যাক্তিগত ডোনেসনের উপর চলে । বিদেশ থেকেও কিছু ফান্ড আসে ।অনিরুদ্ধ মুখার্জির কাছ থেকেও কিছু আশা করেন – সেটা বিনম্র ভাবে জানিয়ে দিলেন ফাদার আগাস্তিন ।অনিরুদ্ধর না দেবার কিছু নেই । বিশেষত আরফ্যানেজের জন্য ও দেবে । মা – বাবা হারা ছোট ছোট ছেলেরা থাকে ওখানে । বাবিনের বয়সী ছেলেরাও থাকে । পকেট থেকে চেক – বুক বার করতে যাচ্ছিলো অনিরুদ্ধ । হঠাৎই—
মে আই কাম ইন , ফাদার ?
ছোট্ট বাচ্চার গলা শুনে ও তাকাল ।এমন অবাক ও জীবনে হয়নি ।কাকে দেখছে ও সামনে ?কাকে ! অনিরুদ্ধ কিছু বলার আগেই পরী বলে উঠলো –
জেঠুমনি ! বাবিন দাদা !
শাঁওল অবাক হল –
বাবিন কে ? ও তো অনিকেত । ওয়ানে পড়ে । আরফ্যানেজের বাচ্চা ।
ফাদার আগাস্তিন পরীকে প্রশ্ন করলেন
বাবিন দাদা ? তুমি চেনো একে ?
বাবিন দাদা ! বাবিন দাদা ! জেঠুমনির ছেলে , জ্জেঠূমনি –
অনিরুদ্ধ নিজেকে সামলে নিয়েছিলো ততক্ষণে । বাবিনের মতই দেখতে । খুব খুঁটিয়ে দেখলে ফারাক করা সম্ভবনয় । বছর ছয়েক বয়স ।
অনিকেত এস – কি বলবে ?
অনিকেত এসব কথায় ঘাবড়ে গিয়েছিল ।
ফাদার , পরে আসব ?
না , না , এসো ।
ফাদার বলেন ।
অনিরুদ্ধ বাবু , অনিকেত কিন্তু খুব ইনটেলিজেন্ট । ওই স্কুল থেকে এই স্কুল এ এসেও কিন্তু ফার্স্টই হয় ।
বাহ , খুব দুষ্টু , তাই না ? অনিকেত খেলতে চায় ?
শাঁওল হাসে ।
না না , ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে । মনিটর ও , ওর ক্লাসের ।
অনিরুদ্ধ বুঝল দেখতে সদৃশ হলেও স্বভাবে অনেক ফারাক তবে ।
বাবিন দাদা শান্ত হয়ে গেছে জেঠুমনি – জেঠিমনিকে বল –
অনিরুদ্ধ পরীকে থামাল ।
বলবো পরী , একটু দাঁড়াও ।
কাকিমণিকে ডাকতে হবে এখানে । এখনই । ডাক্তার কাকাকেও ।
ফাদার , হি রিসাম্বলস মাই সন ।
রিয়েলি ! আপনার ছেলে –
অনিরুদ্ধ চাপা দিয়ে বলে
হি ইজ ন মোর ।
ওহ –
আমি কি বাড়ির বড়দের ডাকতে পারি ?
এখানে ? ডাকুন না । অনিকেতকে দেখাবেন তো ?
হ্যাঁ—
ডাকুন ।
অনিকেত বুঝতে পারছিল না এটা কি হচ্ছে ? ওকে ফাদারের ঘরের পাশের ঘরে বসিয়ে রেখেছে । ওই স্যুটেট বুটেট লোকটা কে ? আর বাচ্চা মেয়েটাই বা কে ? এর মধ্যেই বার কয়েক এসে দেখে গেছে অনিকেতকে ।
বাবিন দাদা – আমি পরী – তোমার বোন ।
পরীকে কোনোদিন দেখেনি অনিকেত । কিন্তু পরী তাকে দেখেছে ।ওর বোন বলছে । তাহলে কি পরী জানে ওর মা বাবা কোথায় ? নাকি ওই মস্ত বড় লোকটা জানে ? অনিকেত দেখেছে অনেক বন্ধু ওর চেয়ে ছোট এমনকি বড়দেরও তাদের মা বাবা এসে নিয়ে যায় । অথচ অনিকেতকে কেউ নিয়ে যায়নি কোনোদিন । তাহলে কি ওরও মা বাবা আসবে ? নিয়ে যাবে ? আরও দুজন এসেছে ।গ্র্যান্ডপা গ্র্যান্ডমার মত বয়সের । তারাও দেখেছে অনিকেতকে । সবাই অবাক । এত অবাকই বা হচ্ছে কেন ? সবাই তাকে বাবিন বলছে । বাবিন কে সে তো নিজেই জানে না । তাহলে ও বাবিন হবে কি করে ? কথায় ধাঁধা লাগছে অনিকেতের । ছোট মাথাটায় কিছু ঢুকছিল না ।
ফাদার – ছেলেটি সত্যিই আমার নাতি বাবিনের মত দেখতে ।
সুহাসিনী বললেন ।
অনিরুদ্ধ পরীকে নিয়ে বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ।শাঁওলও ।
সে তো বুঝলাম । অবাকও হলাম ।
বাবিন তো দেড় বছর আগে –
হ্যাঁ , তাই তো শুনছি । সত্যিই ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ ।
অনিকেত কি জন্ম থেকেই এখানে ?
হ্যাঁ –ঠিক জন্ম থেকে না হলেও জন্মের দিন দু তিনেকের মধ্যেই – কেউ ফেলে গিয়েছিল । আরফ্যানেজের বারান্দার দোলনায় ।
রুদ্রদেব বললেন
দেখে তো ভালো ঘরেরই মনে হচ্ছে ।
আমরা ঘর দেখি না , ডাক্তার বাবু ।ছেলে দেখি । ছেলেটি খুব ভালো । ক্লাসে প্রথম হয় ।
রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন ।
আমরা যদি ওকে নিতে চাই – আই মিন –
আডপ্সন ?
হ্যাঁ--
অনিরুদ্ধ বাবু নেবেন ?
হ্যাঁ , অনিই ।
তা বেশ । ওনার স্ত্রীকে নিয়ে আসুন ।কথা বলি আমরা ।
সুহাসিনী বুঝলেন এভাবে হবে না ।
ফাদার , নীরা অসুস্থ । পুত্রশোক সামলাতে পারেনি । ওকে আনাটা –
কিন্তু তার মতামত ?
বাবিনকে না পেলে সে মতামত জানাতে পারবে না ফাদার ।
রুদ্রদেব বললেন ।
ওহ । এই মানসিক অবস্থায় অনিকেতকে সামলাবেন কি করে ?
বাবিন ফিরে এলেই তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে নীরা ।
অনিকেত তো বাবিন নয় । এটা অন্য যে কারোর থেকে নীরা দেবী ভালো বুঝবেন । মানবেন কি ?
আমরা আছি তো । আমরা মানাবো ।
চাপিয়ে দেবেন ?
তা কেন ? বোঝাবো ।
সুহাসিনী বললেন ।
যদি না মানে তবে অনিকেতের ভবিষ্যৎ ?না , না , এভাবে হয় না ।
অনিরুদ্ধ পরীকে বাইরে রেখে ঘরে এল তখনি ।
ভবিষ্যৎ ভাবনা আমার , ফাদার । ওকে নিজের বাবিন হিসেবেই নিয়ে যাবো । সেভাবেই যাতে বড় হয় , মানুষ হয় –সবটা আমিই দেখবো ।
তাছাড়া পরীকেও তো নীরা মানুষ করছে এখন ।
সুহাসিনী জোর দিলেন ।
লিগ্যাল প্রসিডিওর কিন্তু বজায় রাখতে হবে ।
অবশ্যই –
রুদ্রদেব বললেন । এই জুয়াটা ওদের খেলতেই হবে ।
প্রথম দু – মাস আমরা নজর রাখবো ।শাঁওল যাবে আসবে নিয়মিত । তেমন দেখলে –
রাজি আমরা –
সুহাসিনী বললেন । এই সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না ।না খুঁজতেই বাবিনের মত বাচ্চার খোঁজ পাওয়া গেছে ।নীরাকে অবসাদ থেকে তুলে আনার শেষ খড়তকুটো ।একে ঈশ্বরের ইচ্ছা মনে করছেন সুহাসিনী । অদ্ভুত সমাপতন । একে আঁকড়ে রাখতে চান সুহাসিনী ।ছাড়তে চান না ।
মুখার্জিরা আপনাদের আরফ্যানেজটা ভবিষ্যৎ এ নিয়মিত দেখভাল ও করতে পারে ফাদার ।
অনিরুদ্ধ ব্যবসার লাইন এ খেলল ।ফাদার এবার নরম হলেন ।
বলছেন ?
সুহাসিনী অনির বুদ্ধিতে খুশী হলেন ।
হ্যাঁ অনির তাতে কন আপত্তি নেই । আমাদেরও ।
বেশ যাকে নিয়ে যাবেন --- তাকে কি বলবেন ?
সে চিন্তাটাও আমাদের ফাদার । সে যে বাবিন সেটাই বলা হবে তাকে । আপনারা কেউ দ্বিমত করবেন না – তাহলেই হবে ।
রুদ্রদেব বললেন ।
ভালো , তবে অনিকেত বুদ্ধিমান আর সেনসিটিভ ছেলে । অভিনয়ে যেন ফাঁক না পড়ে ।
পড়বে না । শুধু অনিই নয় , আমরাও আছি তো ।
সুহাসিনী বললেন ।
হ্যাঁ আপনারা গ্র্যান্ডফাদার গ্র্যান্ডমাদার , দুজনেই এসেছেন । আপনাদের বিচক্ষণতার উপর ভরসা আছে ।
রুদ্রদেব ভুলটা শুধরাতে যাচ্ছিলেন । সুহাসিনী আটকে দিলেন । অভিজ্ঞ চোখ ভুল করে না।যে ভুলটা ঠিক – পৃথিবীর সবথেকে ঠিক—তাকে অন্য কেউ চিনে না নিলেও ফাদার নিতে পেরেছেন ।সুহাসিনী সেই ঠিকটাকে ভুল করবেন না আবার ।
পর্ব – ১৬
অনিদা এটা ঠিক করছ তো ?
শাঁওলের কথায় তাকায় অনিরুদ্ধ ।
ভুল করছি কেন মনে হল তোর ?
অনিকেত তো বাবিন নয় , বৌদি যদি না মানে ?
আমি মানাবো । আর আমরা সবাই তো মানছি ।
তাও – অ্যাডপ্সনটা –
অনিরুদ্ধ হাসল ।
এখানকার অরফ্যানেজ খারাপ বলছিস ?
তা কেন?
আর ও তো তোর সবথেকে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র—ফাদার বললেন ।
আরফ্যান তো –
ওহ , তাই বল । এই ট্যাবু নিয়ে তুই স্কুল এ পড়াস , পাগলি ?
স্কুলে পড়ান আলাদা আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া আলাদা - অনিদা ।
আমি মন থেকে মেনেই নিয়ে যাচ্ছি ।
শাঁওলের হাত ধরল অনিরুদ্ধ ।
তোর খারাপ লাগাটা বুঝছি ।তোর এখানে এসেছি ।তোর স্কুলেই অনিকেতকে পেলাম । দায়টা তোর উপর না পড়ে । এটাই ভাবনা । তাই তো ?
শাঁওল মাথা নিচু করল ।
কেউ দায় দেবে না ।
ও বাড়ি যেতেও তো আমাকে—
তোর বৌদিকে বুঝতে দিবি না কেন এসেছিস ।তাহলেই হবে । বাবিন পরীর টিউটর হয়ে আসবি না হয় ।
শাঁওলের চোখে জল দেখল অনিরুদ্ধ । ওর হাতে হাত রাখল । শাঁওল হঠাত জড়িয়ে ধরল অনিরুদ্ধকে , জোরে । অনিরুদ্ধ আটকাল না । গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আস্তে আস্তে । শান্ত করল ওকে ।
সই সাবুদে নীরার সই লাগবে না তো ?
সুহাসিনী বললেন ।
না , আপাতত সুপারভাইজারি আডপ্সন হচ্ছে ।ফাদার নিজের দায়িত্বে ছাড়ছেন অনিকেতকে ।
আমাদের সাথে ।
অনিরুদ্ধ চশমা ঠিক করল ।
ট্রাস্টিদের বলে নিলেন – কিছুক্ষণ আগে ।
দু মাস তাহলে নজরদারি সত্যিই চলবে ?
হ্যাঁ , শাঁওলই যাবে ।
ও যদি নেগেটিভ রিপোর্ট দেয় ।
দেবে না । ও আমার খুব কাছের বন্ধুর বোন ।আর আমরা সবাই আছি কাকিমণি ।নেগেটিভ রিপোর্ট হবে কেন ?
নীরাকে নিয়েই চিন্তা আমার অনি ।
তুমি দেখে রাখবে ।
এই আনাটা নিয়ে তোর কাকা ও চুপ করে থাকবেন না ।
আটকে দেবে তোমাকে ?
সুহাসিনী অনির হাত ধরলেন ।
আটকাতে পারবেন না ।
ঝগড়া আশান্তি ?
সে ভয় করেছি কোনোদিন ? কেবল আলাদা হওয়াটাই ঠেকাতে পারলাম না ।বাকি তিনজনই এত চাইছিল ।
তোমার আলাদা হবার একটুও ইচ্ছা ছিল না – বল ।
একেবারেই না । তোর কাকা চাইল । আমার বাপের বাড়িরও যে মদত ছিল না তা নয় । তারা বলল আলাদা হলে ব্যবসা জমবে ।
এখন তো আমার বাবার অ্যাকসিডেন্টটাকেও প্লানড মনে হয় আমার ।
অনিরুদ্ধ স্পষ্ট করল ।
বিশেষত আমার আগের বাচ্চাটার কথা জেনে –
সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন ।
তোমার এ ব্যাপারে কি মনে হয় কাকিমণি ?
অনিরুদ্ধ জিগ্যাসা করে আবার ।
আমার মনে হওয়াতে কি কিছু বদলাবে ?
তাহলেও –
দেখো অনি – আমি এই মুহূর্তে নীরার সুস্থতা আর পরীর সুরক্ষা চাই ।সাথে এই বাচ্চাটারও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা । এটা তুমিই আমাকে দিতে পারো । কারণ তুমি যোগ্য ।
যোগ্য আর কই? বাবিনকে তো হারিয়ে ফেললাম কাকিমণি ।
একে যাতে না হারাও তার জন্য সব সময় সতর্ক থাকবে ।
কিভাবে ?
নিজের ছোটবেলা মনে কর অনি । আমি যেভাবে সতর্ক থাকতাম ।
অনিরুদ্ধ বুঝল ।
চোখের আড়াল করবো না ওকে । অথচ আমি তো অফিসে থাকবো ।
সেইসময়টার অনেকটা অবশ্য অনিকেতও স্কুলে থাকবে । ও স্কুল থেকে ফিরলে তুমি না আসা অব্দি আমি থাকব ।
এতো ভয় কেন কাকিমণি ?
জানি না , জানতেও চাই না । বিশ্বাস অবিশ্বাস সব নিজের ব্যাপার । কিন্তু আমি যা বলছি সব মেনে চলবে । বিশেষত বাবিনের অমনটা হবার পর থেকে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে ।
কারোর সাথে ছাড়ব না বলছ ?
ঠিক , আর কারো হাতে খাওয়াবেও না । নীরা , তুমি , আমি – এ বাদে আর কেউ না ।
বাবিনকে মনিপিসিও খাওয়াত ।কাকিমণি কি তবে মনিপিসিকেও – প্রশ্ন করার আগেই ডাক্তার কাকা এলেন ।
হল , মায়ে – পোয়ে কথা ?
হল –
তাহলে চলো – নাতিকে নিয়ে বাড়ি যাই ?
তোমরা যাও – আমি পরে যাবো , একা ।
অচ্যুতকে কোথায় আছো বলেছ ?
হিন্দুস্থান পার্ক , রুমেলিদের বাড়ি ।
ওখানে গোয়েন্দাগিরি করবে না তো ?
রুমেলিকে বলা আছে । আমার থেকে তোমার ভয় বেশি দেখছি , রুদ্র ।
রুদ্রদেব অপ্রস্তুত হলেন ।
জানলে তোমার বিপদ হবে যে ।
আমার বিপদের চিন্তা তুমি কর ?
রুদ্রদেব আহত হলেন ।
এতদিন পর সেটা মনে হয় তোমার , যে করিনা ?
করলে চৌত্রিশ বছর আগের বিপদটা থেকে বাঁচাতে আমায় রুদ্র ।
ডাক্তার কাকা চুপ করে গেলেন ।
একটা তেইশ বছরের ডাক্তারি পড়ুয়া ছেলের কতটা ক্ষমতা থাকে সুহাসিনী ?
তোমার ক্ষমতা না থাকলেও তোমার বাবাকে বুঝিয়ে---
সুহাসিনীর গলায় উষ্মা ঝরে পড়ে ।
অবশ্য তার তখন অনেক স্বপ্ন । ছেলে বড়ো ডাক্তার হবে । বিলাতে যাবে ।হয়েছেন বড়ো ডাক্তার ।বিলাত ফেরত ডাক্তার রুদ্রদেব ব্যানার্জি । এম ডি , এম আর সি পি । কলকাতার সেরা তিনজনের একজন । কত ফিজ যেন রুদ্র , দুই না তিন হাজার ?
রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাত চেপে ধরেন ।
সু , থাক না । বাদ দাও । ছেলে শুনছে সব । তোমার যা আভিমান আমাকে একান্তে বোলো শুনবো ।
অনিরুদ্ধ উঠতে গেলো । সুহাসিনী ওকে হাত ধরে বসালেন ।
ছেলে বড় হয়েছে । সব জানুক । আর বাদ ? দেবো তো বটেই । বাদ তো আমিই পড়ে গেছি তোমার জীবন থেকে । সেই কবেই ।
কাকিমণি শান্ত হও । ডাক্তার কাকার কষ্ট হচ্ছে ।উনি তো আজও তোমাকে ভালোবেসেই বেঁচে আছেন ।আর কাউকে আনেননি ।
কেন আনল না ? আনত তাহলে আমি বেঁচে যেতাম এত লোকের এত কথা এত সন্দেহের হাত থেকে ।
রুদ্রদেব এগিয়ে এলেন । সুহাসিনীর মাথায় , গায়ে , পিঠে হাত রাখলেন ।
সু , ছেলে সব দেখলে সমস্যা নেই তো ? আমি আর কাউকে আনলে আমার আটকে না রাখতে পারার অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্তটা পূর্ণ হোতো সুহাসিনী ? এই যে চৌত্রিশ বছর পরেও তোমার এত কাছে মাথা উঁচু করে আসতে পারছি , সেটাও পারতাম ?
সুহাসিনী অবাক চোখে তাকালেন ।রুদ্রদেব সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলেন । অনিরুদ্ধর চোখে অজান্তেই জল এলো । নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে পূর্ণ হতে দেখলে চোখে জল আসাটাই স্বাভাবিক । সুহাসিনী কেঁপে উঠলেন যেন ।
ভুল করলাম ?
রুদ্রদেব আশঙ্কিত হলেন ।
একদম না । বিস্মৃতকাল পরে কেউ ভালবাসল তো –
রুদ্রদেব আর অনিরুদ্ধর চোখ চাওয়া চাওয়ি হোল ।
এতোটা অসুখ পূর্ণ রাখো কাকিমণি ?
অনিরুদ্ধ সুহাসিনীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল ।
কি করবো তবে ?
চলে যাও কাকাবাবুর সাথে –
অনিরুদ্ধ মন থেকেই বলল ।
ধুর পাগল ছেলে । তা হয় ? সংসার আছে না ? আর এখন তো বাবিনের দায়িত্বও নিতে হবে।
সুহাসিনী আসবে অনি । আমার কাছে একদিন না একদিন আসতেই হবে ।
রুদ্রদেব হাসলেন ।
এই বিশ্বাসেই তো বাঁচছি ।সু , তোমার ছেলে কাকাবাবু বলেছে আমায় , শুনলে ? অচ্যুতকে কিন্তু বলে না ।
রুদ্রদেবের চোখের খুশী পড়তে পারল অনিরুদ্ধ ।
তুমিই কাকিমণির যোগ্য যে । তাই বাবুটারও যোগ্য । সুহাসিনীর চোখেও একই খুশির ঝলক দেখতে পেল অনিরুদ্ধ ।
৬ থেকে ১০ পর্বগুলো পড়ুন
সুহাসিনী বহুদিন পর কোন কারণ ছাড়া এ বাড়িতে এলেন, শেষ এসেছিলেন বাবিনের চলে যাবার সময়। ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিলো সব কিছু, অতিথি, মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, শোকের আবহে এদের আনাগোণা সামলাবার কেউ ছিলো না। নীরার মা মেয়ে সামলাতে ব্যাস্ত ছিলেন। অনি নিজেও ভেঙ্গে পড়েছিলো। তাই নীরার বাবা আর সুহাসিনীই সামাল দিয়েছিলেন বাইরের দিকটা। অথচ কাজ মিটে গেলে আর একবারও আসা হয়নি এই দেড় বছরে। নীরার খোঁজ অনির কাছে দুর্গাপুজোয় পেতেম। সংসারের শৃংখলে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সুহাসিনী আর বেশি কিছু করতে পারেনি। অথচ করা উচিৎ ছিলো। আজ সারা দুপুর দেখে তাই মনে হয়েছিলো। বাবিনের ছবির সাথে গল্প করে ওকে খাইয়েই সারা দুপুর কাটিয়ে দেয়। মণি বলছিলো। আজ সুহাসিনী এসেও দেখেছেন সেসব চলছে। পরী আসতে পরীকে কোলে বসিয়ে নিয়েছিলো নীরা। বাবিনের ছবিকে খাওয়ানো বন্ধ হয়নি। সুহাসিনী হাল ধরলেন। “নীরা – -“। নীরা চমকে ওঠে, “কাকিমণি সুহাসিনী বকাবকির রাস্তায় যাননি। “শুধু ছেলেকে খাওয়ালেই হবে? নিজেও খেতে হবে ত”। “আর একটু - - “ । “না, অনেক হয়েছে। চলো, এবার খাবে”। “নীচে?” “না, এখানেই। মণি এনেছে। তুমি হাত ধুয়ে এসো”, “পরী খাবে তো”। “খাবো। ও খেয়ে এসেছে। অল্পকিছু খাবে। তুমি খাবে আগে। নীরা পরীকে বলে, “পরী একটু ওঠো, জেঠিমনি হাত ধুয়ে আসুক”। পরী উঠে পড়ে। নীরা হাত ধুয়ে আসে। “বসো”। নীরাকে বলেন সুহাসিনী। নীরা পরীকে কোলে বসায়। সুহাসিনী মণির থেকে থালা নিয়ে নেন নিজের হাতে। সামনের টেবিলে রাখেন। “এবার ভালো মেয়ের মতো পুরোটা খেয়ে নেবে”। “কাকিমণি. . আমি খেয়ে নিচ্ছি”। সুহাসিনী কড়া চোখে তাকিয়ে ছিলেন নীরার দিকে। নীরা আর কিছু বলেনি। সুহাসিনী নিজে হাতে করে খাইয়ে দিয়েছিলেন নীরাকে। পরিপাটি করে। “মণি – খাবার নাকি নষ্ট করে – এই ত দিব্যি খেয়ে নিলো সব”। “সে তো তোমার ভয়ে ছোটবৌদি”। সুহাসিনী মনে মনে হেসে ফেললেও মুখেগাম্ভীর্যধরে রাখেন। “ভয় না, মেয়ে মা’কে ভয় পাবে কেন? ব্লো যত্ন করে খাওয়ালে ঠিক খেয়ে নেয়”। “তমার এত বড় মেয়েকে যত্ন করে তুমি খাইয়ে যেও তবে এবার থেকে রোজ”। সুহাসিনী হাসেন। “রোজ না হলেও যাবো, আর বাকি দিন খোঁজ নেবো, পরীতো আসেই। “ঠাম্মা – জেঠুমণি খাইয়ে দিলেও জেঠুমণি খোঁজ নেয় ঠিকঠাক”। ণিরা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে জেলো। “চুপ, পাকা বুড়ি। না, না কাকিমনী ..? সুহাসিনী হাসলেন, অনি খাইয়ে দিলে খুব ভালো করে। আমি বলে দেব যাতে রোজ খাইয়ে দেয়। কিন্তু ণিরা তোমাকেও নিজের যত্ন নিতে হবে ভালো করে। মা নিজে ভালো না থাকলে ছেলেমেয়েকে কী করে ভালো রাখবে?” নীরা কথা দিয়েছিলো, রাখবে। পরীর সাথে নীরাকে দেখে খুশি হয়ে ছিলেন সুহাসিনী। নিজে অযত্নে থাকলেও পরীর কোন অযত্ন করে না নীরা। দুপুরে ওষুধের জন্য যখন ঘুম আসে একপাশে পাশবালিশ মাঝে বাবিন, অন্যপাশে পরীকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। পরী দিব্যি নীরাকে জড়িয়ে ধরে শোয়, ঘুমোয়। ঘুম থেকে উঠে পরীকে হাত মুখ ধুইয়ে, চুল বেঁধে, সাজিয়ে দেয় নীরা। পরী নীচের লনে খেলতে যায়। নীরা দক্ষিণ দোতলায় বারান্দায় বসে নজরদারি করে। সুহাসিনী পাশে বসেছিলেন, “পরীটা খুব টরটরে”। “হ্যাঁ, কাকিমণি, তবেবাবিনেরথেকেকমদূরন্ত। বাবিন তো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতেই পারে না, সবসময় ছুটছে”। “বাবিনকে তো তুমি বকোই না”। সুহাসিনী ইচ্ছা করেই বর্তমানে ছিলেন। বাবিনকে আপনার ছেলে শাসন করে। বাপিকে ভয় পায় খুব”। “অনিদের ছেলে বেলাতেও ওদের তিনভাইকে আমিই শাসন করতাম। তোমার শাশুড়ী মায়ের ত সংসারে খুব একটা মন – কোন বলেই ছিলো না”। “হ্যাঁ, গল্প করেছে অনি”। বলেই নীরা বুঝলো কাকিমণির সামনে নাম করে ফেলেছে, “মানে আপনার ছেলে”। “অনি-ই ঠিক আছে। তোমরা আধুনিক মেয়ে। কী বলে যে, ছেলে বেলা নিয়ে?” “সবই বলেছে, আপনার কড়া অনুশাসন, নিয়ম না থাকলে এত ভালো রেজাল্ট হতো না বা মরাল ক্যারাক্টারটাও এভাবে তৈরী হতো না – বলে সবসময়। “অনি পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো”। এর জন্য শুরুতেই ব্যাবসা আমি চাইনি, ছট দুটোতো কোন ক্রমে গ্রাজুয়েশন – তার পরপরই ব্যাবসা – কিন্তু অনি যখন বিলেতে পড়তে যেতে চাইলো ওর বাবা মায়ের অমত থাকলেও আমি বলেছিলাম পড়ে আসুক। ব্যাবসা নিয়েই তো পড়া। পড়ে এলে বাবসাটা আরো ভালো বুঝবে। ফলতো দেখতেই পাচ্ছো”। “আপনাকে খুব মানে”। “জানি, ছট থেকেই ওর মা, বাবা, কাকা সবাই অনি যা কিছুই করুক কাকিমণিকে বলে দেব বলে বড় করেছে তো, নাচাবেন ওনারা, ছেলেকে স্কুল কামাই করে ঘুরতে নিয়ে যেবেন অনারা, পড়াশুনার খেয়াল রাখবেন না ওনারা – এদিকে ছেলের রেজেল্ট একটু খারাপ হলেই ছোট কি ছট বৌমা কি ছোট গিন্নি – অনিটার এমন হলো কেন দেখোতো। ছেলেকে পাহাড় থেকে ঘুরিয়ে এনে নিউমোনিয়া করলো তোমার শাশুড়ী সেটাও ওর কাকার বাবার আর মায়ের মতে সুহাসিনীর দেখার বিষয়।
নীরা হেসে ফেললো, সুহাসিনীর কথা বলার ভঙ্গিতে। “আপনার কথার বাইরে যেতই না সে – বলেছে আমায়”। “এখনো বাইরে যায় না। ওর কাকার আর ব্যাবসায় নজরদারিটা অনি আতকেছে – কার কথাতে এটা নিশ্চয় বলেছে তোমায়”। “হ্যাঁ, কাকিমণি। আমাকে পছন্দটাও ত আপনি ই করেছিলেন”। “অথচ গত পাঁচ সাত বছরে ওদিকের করে এদিক নজরটাই দেওয়া হয়নি আমার, নিরা, এত মানা, এত নিষেধ, এত কর্তব্যের বাঁধন। আজ এসে দেখলাম। দেরি করে ফেললেও খুব দেরি হয়নি মনে হয়”। পরী এরই মধ্যে মাঠে পড়ে গেলো একবার। “নিধুকাকা,পড়েগেলোযে ...” নীরা বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, “নীরা, বাচ্চারা একটু পড়েই। খেলে আসুক। কাটলে ছিঁড়লে ডেটল লাগিয়ে দিব। এখানে তো তাও খেলতে পারছে। ও বাড়িতে পায় না”। “কেন? মাঠ আছে তো”। “থাকলেও স্কুল, পড়া, আঁকা – এখন আবার তার মা নাচেও দিয়েছে .... চলছে সারাদিন”। “এইটুকু বাচ্চার উপর এত চাপ?” “তাহলেই বোঝ” “বাবিনকে তো পড়াশুনার বাইরে এখনো কিছুই দেওয়া হয়নি। ওর বাপি বলে অ নিজে বুঝুক কন্টা ভালো লাগে, তাহলে সেটাতেই দেব”। সুহাসিনী বুঝলেন বাবিন প্রসঙ্গ আসতেই থাকবে। “পরী এখানে থাকলে, ভালো থাকে”। “তাই, কাকিমণি? আমিও খুব ভাল থাকি ও এলে। অনি বলছিলো এই তো মেয়ে চাইতে না – আমি বললাম এমন মিষ্টি মেয়ে হলে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায়? পরীকে রেখে দেবো এমনও বলেছি ওকে। আনিও রাজি। বাবিন এলেই বাবিন চাইলে পরীকে রেখে দেব, বলেছে অনি”। সুহাসিনী বুখলেন অচ্যুত, অতীনের পরিকল্পনার একমাত্র বাঁধা বাবিন এলে – এই শব্দটা। “তবে অতীনরা ছাড়ায় কিনা ...” “অতীনবাজিনাকেউইপরীকেমানুষ করেনি নীরা। আটকালে আমিই আটকাবো। তবে তোমাকে আর পড়িকে ভালোরাখার জন্য এইটুকু আমি করতেই পারি”। “পরি ঠাম্মার কথা খুব বলে”। “এখানে থাকলে অল্পতেই ছুতে আসতে হবে – সবসময়, ওর ধ্যান”। “শুধু ওর টানে কাকিমণি? আর আপনার এখানকার ছেলে মেয়ের? “সুহাসিনী নীরার হাতে হাত রাখলেন, “সেই টান মানলে তো আমাকে চলে আসতে হয়”। নীরা খুশি হলো, “আসবেন? শাশুড়ি থাকলে কত ভালো হয় আর না থাকলে কত কষ্ট আমি বুঝি”। “এই যে বললে মেয়ে আমার – তাহলে শাশুড়ি কেন?” নীরা আর সুহাসিনী একসাথে হেসে ফেললেন সুহাসিনীর কথায়।
পর্ব-১২
“ডাক্তারকাকা”
অনিরুদ্ধ ডাক্তার ব্যানার্জিকে ডাকল।
“হ্যাঁঅনি,এসো এসো”
“কাকিমণি এসেছেন”
ডাক্তার ব্যানার্জি আস্ফুটে বললেন।“সুহাসিনী!এখানে?”
সুহাসিনী ঢুকে এসেছিল ততক্ষনে।
“বসতে পারি,রুদ্র?”
কাকিমণি আর ডাক্তারকাকা স্কুলের বন্ধু।একসাথে পড়েছেন।আর এর বাইরেও কানাঘুষোশুনেছে কাকিমণি আর ডাক্তারকাকার কৈশোরের প্রেম আর কাকিমণির বাড়ির অমতের জন্য তড়িঘড়ি কাকার সাথে বিয়ে হয়ে যাবার গল্প। তারপরেও বহুবার অনিদের বাড়িতেই একে অপরকে মুখোমুখি দেখেছেন ওনারা।ডাক্তারকাকার বাবা মুখার্জিদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ছিলেন। ওনার পর ডাক্তার কাকা হয়েছেন। কাকিমণির মুখোমুখি হলে ডাক্তারকাকা অস্বস্তিতে পড়েন এটা বোঝে অনিরুদ্ধ। কাকিমণির জন্য বিয়েও করেননি। ডাক্তারকাকার চেম্বারে কাকিমণিকে আনবে বলে অনিরুদ্ধ নিজেই ইতস্তত করছিল।সুহাসিনিই প্রশ্ন করেছেম।
সো, প্রশ্ন করছ কেন?কি নেবে বল, ব্ল্যাক কফি এখনঅ চামচ চিনি?
সুহাসিনী মুগ্ধ চোখেতাকালেন-মনে রেখেছ?
রাখব না বলছ? এই রে তোমার ছেলের সামনে এসব-
সুহাসিনী হাসলেন- অনি সব জানে- অকে গাড়িতে আসতে আসতে বলেছি সবটা। কার না কার থেকে কি না কি শুনে রেখেছিলো। তার থেকে নিজে বলে দেওয়া ভালো ।
রুদ্র মাথা নাড়লেন- তা ঠিক, অচ্যুত আসতে দিচ্ছে তোমাকে? আনিদের গাড়ি, আনির সাথে বাইরে—
দিচ্ছে আর কই, আমিই শুনছি না-
চারটে নাতি নাতনী হয়ে সাহস জন্মেছে তবে-
সাহস নয়-ইচ্ছা, আর চার নয় পাঁচ, বাবিন আমার সবচেয়ে বড় নাতি ছিল
জানি-বস।আমাদের বহুদিন পর এভাবে একান্তে মুখোমুখি দেখা।তাই আর কি-অনিরদ্ধ বসল ।খুব যাচ্ছে- নীরার কাছে শুনেছি-
মুখার্জি বাড়ীর সব খবরই পৌঁছায় তোমার কাছে দেখছি—
পৌঁছবে না? খোঁজ তো রাখতেই হবে সুহাসিনি। তুমি আছো যে, আর অনিটাও, বড়দার সন্তান। দেবতুল্য মানুষটার আনেক উপকার আছে তো—
তোমার দয়িতাকে নিজের ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়াটাকে উপকার বল?
অনিরুদ্ধ চমকাল। বাবাও ছিলেন এর মধ্যে? তাহলে তো কাকিমণির বাবার প্রতি যথেসট ক্ষোভ আছে আথচ আনিকে সেসব সত্বেও কীভাবে যত্ন করেছেন, মানুষ করেছেন।
বড়দা সুহাসিনী।
অচ্যুতের লোভ, ইচ্ছা, জেদ, অবসেসন তোমার প্রতি- তোমার মা বাবার বোকামো। তোমাদের দুই পরিবারের বানিজ্যিক সম্পর্ক আর অনির ঠাকুমা ঠাকুরদার সাম্রাজ্য বাড়াবার লোভ। তোমার মা বাবার একমাত্র মেয়ে তুমি। শিক্ষিতা, সুন্দরী এটাই স্বাভাবিক। আর ডাক্তারি করে ক পয়সাই বা হয় বল? তোমায় এতো সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে দিতে পারতাম না। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আমি প্রত্যাশী। মনে হয় তোমার?
সুহাসিনীর কথায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে। রুদ্রদেব হাসেন।
ভালো হয়েছে এ জন্য বলিনি। তুমি ও বাড়ি গেছো বলেই বাবিনটা বেঁচেছে। নাহলে অর আগের বাচ্চাটার মত—
অনিরুদ্ধ চমকা্ল। সুহাসিনী চোখের ইশারায় থামতে বললেন। অনিরুদ্ধ এসবের কিছুই জানে না।
আগের বাচ্চাটা বলতে কাকিমণি?
কিছু না অনি-পরে বলবো তোকে। তোর ডাক্তার কাকাও কি না কি বলে ফেলে, বুড়ো হয়েছে তো। এবার বলতো বাবিনকে আনার কি প্লান তোমার?
রুদ্র মুখ ফসকেই সামলে নিয়েছিলেন।
আগে বল নাতনীটাকে অনিকে দেবে অচ্যুত?
অনিরা চাইলে তার কোন অমত নেই।
আর তোমার?
ছিল—কিন্তু পরীকে অনির সাথে নীরার সাথে দেখে আর নেই।
তাহলে তো হয়েই গেলো
কিছু হয়নি রুদ্র, বাবিনকে ফেরত চাই নীরার। সেটা না হলে সব শেষ।
তাহলে ডাক্তার চক্রবর্তির প্ল্যানটাই কাজে লাগাতে হবে।
একরকম দেখতে বাচ্চা?
বয়সটাও এক হতে হবে।
পাবো কোথায়?
খুঁজতে হবে,অবিকল এক না হলেও ধরনটা—
বুঝলাম, নীরা মানবে?
আগে বল তুমি মানবে তো? অনি তোমাকে যখন নিয়ে এসেছে আর কাউকে না এনে- তোমার মানাটা সবচাইতে জরুরী।
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করার অভ্যাস তোমার গেলো না রুদ্র। আমি অনি,নীরার ভালোর জন্য সবই মানবো। মানবো বলেই সবটুকু জানার জন্য এখানে এসেছি। কিন্ত আমার শর্ত হল যে বাচ্চাটাকে আনা হবে তার সাথে যেন অন্যায় করা না হয় কোনোমতেই । নীরা না মানলেও অনিকে তার দায় নিতে হবে।
নীরা মানা না মানাটা আমরা কতোটা ভালো অভিনয় করব তার উপর নির্ভর করছে। আর বাচ্চাটা এলে তোমারও দায়িত্ব বাড়বে সুহাসিনী। অনিকে যেভাবে আগলে রাখতে সেভাবেই আগলে রাখবে ওকে।
নীরাকে ওর মা হয়ে ওঠাতে হবে রুদ্র—তাহলেই হবে।
হবে। নীরা তোমারই মতো অনেকটা। ঠিক পারবে। তুমি ওকে শেখাবে মা হওয়াটা। বিয়ে করেই যেমন শিখে নিয়েছিলে- পায়ের আলতা শুখাতে না শুখাতে অনির মা হয়ে গিয়েছিলে ।
সুহাসিনী অনির দিকে তাকালেন।
শিখতে হয়েছিল। বড় গিন্নী তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। নিজের সাজগোজ, বাণ্ঢবীড়া, ঘোড়াফেড়া, নিজের জগত। শ্বাশুরির বয়স হয়েছিলো। অযত্ন দেখে কি করব বল?
অনি, মনে পরে সেসব?
ডাক্তার কাকার কথায় অনিরুদ্ধ হাসল।
পরবে না? বাড়ি ব্যবসা ভাগ হবার আগে অব্দি তো সবসময় কাকিমণির কাছেই থাকতাম। ভাগ হবার বছর খানেকের মধ্যেই বিলেতে চলে গেলাম। ফিরে এসে...
কাকিমণি কিন্তু পরীকে নীরার কাছে যেতে দিচ্ছে তোমাকে ভরসা করেই।
জানি ডাক্তার কাকা। তাছাড়া নীরা আর পরীও মিলেছে ভালোই।
তোমরা যাকে আনতে চাইছ সে এলে পরীর কদর কমে যাবে না তো?
সুহাসিনী শঙ্কিত হলেন।
বাড়তেও পারে, নীরার মনটা তো স্থির নয়, কেমন রি-অ্যাক্ট করে দেখি আগে
বাবিনের জায়গায় যাকে আনবে, তাকে আইনত যেন আনা হয় রুদ্র
সুহাসিনীর কথায় রুদ্রদেব উঠে দাঁড়ালেন-
স্মোক করতে পারি?
এসি ঘর- একদম না-
অনি শুধু তোকেই না তোর ডাক্তার কাকাকেও কেমন শাসন করে দেখেছিস?
অনিরুদ্ধ লজ্জা পেল
মাঝে ক’বছর করেনি । এটা আমার দুর্ভাগ্য
সুহাসিনী অনিরুদ্ধর পিঠে নিজের হাত রাখলেন
করার উপায় ছিল না । আমি দুরত্ব চেয়েছিলাম। কারন চাইনি তোমার ঐ কাঁচা বয়সে তোমার কাকা তোমার ব্যবসায় ঢুকুক- আর ঠকিয়ে দিক। এখন আর সে ভয় নেই। তাই কাছে আসছি আবার।
বাবিনকে আনলে এই আসাটাতে ছেদ পরতে পারে সুহাসিনী । জাত, কুল, ধর্মের দোহাই দিয়ে অচ্যুত তোমায় আটকাবে-
শুধু সে কেন? ছেলে-বউমারাও । কেবল ছোট- বৌ ছাড়া, ওর মনটা সরল, প্যাঁচ নেই। কিন্তু ওরা আটকালেই বা- শুনবে কে? পরীকে দেখতে ওর ঠাম্মা আসতেই পারে।
অনিরুদ্ধ বলল
পরীকে এতো সহজে দেবে? আর দিলেও তখন নিয়ে যাবে না তো?
সুহাসিনী সত্যিটা লুকোলেন
নেবে না- তবে পরীকে তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে হবে তোমাকে – অনি
অনিরুদ্ধ বুঝলকাকিমণি চান পরী এ বাড়ীতে মানুষ হোক- নীরার অসুস্থতা দেখেও চান, কেন?
অযত্ন শব্দ টা কানে বাজলো অনিরুদ্ধর । পরীরও তা হয় না ত ওখানে ?
আচ্ছা কাকিমণি , আমি আজই অতীন কে বলছি ।
বাবিন যতদিন না আসে ততদিন পরীটা থাকলে নীরার অবসাদ কম থাকবে।
রুদ্রদেব বললেন।
পরী তারপরেও থাকবে –ডাক্তার কাকা থাকবে তো, আর তুমি পরীকে খুব ভালবেসে ফেলেছ বুঝি তো, আমিও তো এভাবে কাউকে সন্তানের মতোই ভালবাসি ।
কে?
অনিরুদ্ধ প্রশ্নটা করেই বসলো ।
সুহাসিনী – তোমার অনি এই বুদ্ধি নিয়ে এতোগুলো দোকান চালায় ?
সুহাসিনী হাসলেন
অত ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না আমার অনি
তা ঠিক, বুঝলে অতীন অনুপমের ছেলেবেলার দোষ গুলো ঘাড়ে পড়ে যেতো ওর রোজ রোজ
অনিরুদ্ধ বুঝল ডাক্তার কাকা তার ছেলেবেলার কথা বলছে
ওরা মিথ্যা কথা বলত ঠাকুমাকে মাকে- আমি পারতাম না
তোর কাকিমণি অবশ্য বুঝে যেতো কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা
সুহাসিনী হাসল
অনিকে একলা ঘরে নিয়ে গিয়ে জিগ্যাস করলেই স-ব বলে দিতো ।অথচ ঠাকুমা মা বাবাকে বলতো না কিছুই।
ওরা শুনতে চাইত? তুমিই তো শুনতে। আর তখন যার দোষ তাকে শাসন করতে। ওরা তো খালি অনি বড়- অনি দেখে রাখেনি- অনি এটা- অনি সেটা---
অনিরুদ্ধ ছেলেবেলার কথা ওঠায় প্রগলভ হয়ে উঠেছিলো
রুদ্রদেব সুহাসিনী হেসে ফেললেন ।
তবে আমিও অনেক মার খেয়েছি- তোমার কাছে
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম- সেটা বল
রুদ্রদেব বললেন
তা ঠিক, তবে আমাকে যেদিন ধরত কাকিমণি – সেদিন শেষ। যারা নালিশ করে করে কাকিমণিকে রাগিয়ে দিত সেই মা, বাবা, কাকা-ই শেষে কাকিমণির হাতে পায়ে ধরে নাক কান মুলে ছাড়াত।
নিজেরা কোনোদিন আদর করেছে যে শাসন করবে? তাই দুটো ব্যাপারেই সুহাসিনী ভরসা ।
সুহাসিনী বললেন—
ভাগ্যিস তুমি শাসন করেছিলে । নাহলে আমি মানুষ হতাম নাকি?
তোকেই তো পেরেছি অনি । বাকি দুজনকে পারলাম কই? তাদের একজন বাপের ধাত পেয়ে গেল । আর বড়জন শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা ।
অনিরুদ্ধ কাকিমণির হাত ধরল।
একজন তো একদম তোমার মতই হয়েছে ।তাই না, ডাক্তার কাকা ?
কোন উত্তর পেল না ।
সুহাসিনী আর রুদ্রদেব দুজনের চোখেই জল দেখল । আনন্দের অশ্রু। অনিরুদ্ধ বুঝল।
পর্ব- ১৩
অনি এসেছে।
বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতেই সুহাসিনী কথাটা বললেন ।
অচ্যুত তাকালেন ।
অনির সাথেই ছিলে এতক্ষণ?
হ্যাঁ, অন্যরকম কিছু কি মনে হচ্ছে তোমার, এই বয়সেও?
সুহাসিনীর কথার দৃঢ়তায় অচ্যুত আর কথা বাড়ালেন না।
অনি, আয় বাবু-বস ।
অনিরুদ্ধ অবাক হল । বিস্মৃত কাল পরে কাকা তাকে বাবু বলে ডাকল। তাহলে কাকিমণির কথাই সত্যি । খুব একটা কাঠ খড় পোড়াতে হবে না পরীকে পেতে , মনে হচ্ছে ।
অতিন কই?
বড় খোকা এই ফিরল ।কেন, ওর সাথে দরকার ?
পরীর ব্যাপারে কথা তো—
তাতে কি? আমি আছি । তোর কাকিমণি আছে। পরী তো আমাদের কাছেই মানুষ । রাতে তো আমাদের সাথেই ঘুমায় সে । তোর ছেলেবেলার মতোই ।তাই না ছোট গিন্নী ?
অনিরুদ্ধ রাতে কাকিমণির কাছেই ঘুমাত । কাকা একই ঘরে অন্য খাটে । অতিন অনুপম হলে তিন ভাইয়েই কাকিমণির কাছে ঘুমিয়েছে । অনেক বড় অব্দি । কাকিমণি অনিরুদ্ধকে একলা শোয়াত না ।ঠাম্মা মা বললেও এড়িয়ে গেছে । কাকিমণি কি অনিরুদ্ধর সুরক্ষা নিয়ে ভয় পেত? তাই নিজের কাছে রাখতে চাইত সবসময় ?
ছোটো, এত বড় ছেলে—এখনও আঁচলে বেঁধে রাখবি ?
মায়ের বলা কথা মনে পড়ে অনিরুদ্ধর । কাকিমণি এড়িয়ে যেত ।
বড় কোথায় ? বড় হলে নিজেই শুতে চাইবে না এখানে । আলাদা ঘর চাইবে ।
অনিরুদ্ধ আগে অতিন অনুপমরা আলাদা ঘরের জন্য ছটপট করেছে। সব ভাইরা বড় হলে তবেই কাকিমণি আলাদা ঘরে যেতে দিয়েছিল অনিরুদ্ধকে । এতদিন ব্যাপারটাকে স্নেহ মনে করত অনিরুদ্ধ । আজ ডাক্তার কাকার মুখ ফস্কে বলা কথাটা শুনে মনে হচ্ছে—সতর্কতা।
কাকিমণিকে জানতে চাওয়া হল না তার আগের বাচ্চাটার গল্প । কে ছিল সে, ছেলে না মেয়ে, কি হল তার—
অনি, কি এত ভাবছিস?
ছোটবেলার কথা কাকা-
অচ্যুত হাসলেন
সে একদিন ছিল। তোর কাকিমণি তো তোকে চোখে হারাত। কারোর কোলে চাপতে দিত না। বিশেষত বাবা, কাকার কলে। মা তো নিতই না। কিন্তু ওদের কোলে অনি গেলেই কাকিমণি নিয়ে নিত। ভয় পেত যদি ফেলে দেয় ওরা।
পরীকে নিয়ে কি ভাবনা বল।
নীরা আর পরীর ভালোই মিলেছে ।
বাহ- আর তোর তো খুব ন্যাওটা মেয়েটা ।
ছোট্ট থেকেই। তাই ভাবছি নীরার ফাঁকা কোলে যদি পরীকে তোমরা দাও—
বলেই কাকিমণির দিকে তাকাল অনি। চোখের ইশারায় জানালেন বলাটা ঠিক হয়েছে।
নিবি ? ওর ঠাম্মা থাকতে পারবে তো ?
কাকিমণির তো ওটাও বাড়ি কাকা।কাকিমণিও যাবে, থাকবে।
অচ্যুত মাথা নাড়লেন
তা বেশ। নীরার বর্তমান পরিস্থিতির কথা যা শুনলাম বেয়াইএর কাছে এটা ভালো সমাধান। কি বল ছোটো গিন্নি ?
হ্যাঁ, নীরা পরীকে পেয়ে জীবনে ফিরতে পারছে যখন—
ঠিক- আর নীরাকে বাদ দিয়ে তুই যখন ভাববি না—মানে আর একটা বিয়ে—
না না কাকা সেটা সম্ভব নয় ।
অতিন আর বৌমাকে বলি তাহলে ।
আজই বলে যাই ?
বেশ, লিখে পড়ে নিবি তো? নাহলে নীরা জীবনে ফিরে এসে আর একটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এলে পরীকে ফেরত দিয়ে যাবি?
বলেই হেসে উঠলেন অচ্যুত। অনিরুদ্ধর কান লাল হয়ে গিয়েছিল। কাকা এরকম বাজে ইয়ার্কি করেন। কিন্তু অনিরদ্ধ এসবে অভস্ত্য নয়।
আহ- কি সব বলছ- ছেলের সামনে ।
তাও ঠিক। তবে পরীর সাথে অন্যায় যেন না হয় অনি ।
পরীকে আমি খুব ভালোবাসি কাকা । কোন অন্যায় হবে না—নিস্তিন্ত থেকো ।
বেশ- আমরাও যেন মেয়েটাকে দেখতে টেকতে পাই—তোর কাকিমণি তো না দেখে থাকতে পারবে না মনে হয় ।
কাকিমণি যাবে রোজ ।ওটাও কাকিমণিরই বাড়ি।
বেশ- অতিনকে ডাকছি তাহলে ।
ডাকো ।
অচ্যুত ভিতরে যেতেই অনিরুদ্ধ চাপা গলায় বলল—
কাকা তো সহজেই রাজি হয়ে গেল কাকিমণি?
জানতাম হবে ।
পরীর কি অযত্ন হয় এখানে , তাই তুমিও চাইছ—
তোদের কাছে বেশি ভালো থাকবে – জানি ।
মেয়ে বলেই কি –
সুহাসিনী হাসলেন
সব প্রশ্নের জবাব হয় ?অনি ?
তোমার আগের বাচ্চাটা কি ছিল কাকিমণি ? ছেলে না মেয়ে ? কি হল তার? এর কথা আগে বলোনি তো আমাকে !!
সুহাসিনী ভীষণ চমকে উঠলেন ।
থাক ওসব ।
না বল ।
পরে বলব ।
তোমার বিয়ের আগেই ?
অনি- পরে বলব বললাম তো ।
সুহাসিনী থামালেন ।অতীনকে নিয়ে অচ্যুত চলে এসেছিলেন ।
তোর দাদাভাই বলছে পরীকে নেবে।
অচ্যুত কথাটা তোলার ভান করলেন ।
দাদাভাই নেবে ? তা বেশ তো । বৌদিমনির মনটা ভালো যদি থাকে এতে আমার কোন আপত্তি নেই ।
এত সহজে অতীনের রাজি হওয়াতে অনিরুদ্ধ সারকথাটি বুঝল । ছেলেবেলায় নিজের পছন্দের খেলনা অব্দি নিতে দিত না যে ছেলে—এত সহজে নিজের সন্তান দিয়ে দিচ্ছে মানে সম্পত্তির হিসাব মাথায় রয়েছে ।
বৌমার মত কি রে বল
তোমার বউমা যথেষ্ট সমজদার ।তোমাদের কষ্টটা বোঝে। অরাজি হবে না ।
অনিরুদ্ধ বুঝল এরা রাজিই ।দেরি করা আর উচিত হবে বলে মনে হল না ।
পর্ব – ১৪
নীরার দিনগুলো এখন আগের থেকে ভালো কাটে । কয়েকদিন হল পরীকে এনেছে অনি । নীরা আপত্তি করেনি । বাবিনকে তো খুঁজে আনবেই বলেছে লোকটা । চেষ্টাও করে । দেখেই বোঝা যায় । পরী এখন নীরাদের কাছেই থাকে । ভারী শান্ত মেয়ে । বাবিন দাদার সব গল্প চুপটি করে শোনে । সকালে প্লে-স্কুলে যায় দশটাতে । আবার দুটো নাগাদ ফিরেও আসে । পরীর জন্য কাকিমণি রোজ আসছেন । পরীর মা জিনাও আসে মাঝে মধ্যেই । অতীন ঠাকুরপোও এসেছিল উইক এন্ডে । পরীর ডাক বদলায়নি অনি-নীরা । জেঠুমনি-জেঠিমনিই থাক । বদলানোর দরকার নেই । পরীকে স্নান করানো , খাওয়ানো সব ঝক্কি কাকিমণিই নেন ।নীরার কাজ কেবল বাবিনকে খাওয়ানো আর নিজে খাওয়া । ও হ্যাঁ , পরীকে পাশে নিয়ে ঘুমানোও কাজের মধ্যে পরে ওর । পরীর পড়াশুনা সব অনি দেখে । অফিস থেকে ফিরে । নীরা তখন বাবিনের সাথে একান্তে থাকে । গল্প করে । রাতে বাবিন আর পরী দুজনকে দুদিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে নীরা । অনি কোন কোন দিন আসে । পরীর পাশে শোয় । বাবিনকে সরিয়ে নীরার পাশেও । পরীকে পেয়ে ভীষণ খুশী – দেখেই বোঝা যায় । এতে আবার বাবিনকে আনতে ভুলে যাবে না তো? নীরা পাশ ফেরে ।
জেগে ?
অনিরুদ্ধ তাকায়
হ্যাঁ বল ।
বাবিনকে পেলে ?
খুঁজছি সোনা ।
আর কতদিন ?
অল্প কিছুদিন ।
সত্যি ?
হ্যাঁ , তুমি ওষুধ খেয়েছ তো ? রাতের ?
হ্যাঁ খেয়েছি ।
তবে ভালো মেয়ের মতো ঘুমাও ।
নীরা ওপাশে ফিরে পরীকে জড়িয়ে ধরে ।
মাঝে নেব ? পরীকে?
হ্যাঁ বাবিনটা ওদিকে ঘুমাচ্ছে । ঘুমোক ।
অনিরুদ্ধ খুশী হয় ।
নাও ।
নীরা সন্তপর্নে পরীকে মাঝে নেয় ।
পড়ে কেমন ?
বেশ ভালো । শান্ত হবার জন্য আর সুবিধা ।
বাবিনটা যা ছটফটে –
ঐ জন্যই বকুনি খায় ।
অনিরুদ্ধ পরীকে জড়িয়ে ধরে ।
পরী ঘুমের ঘোরে নীরার গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে । নীরা হাসে।
ঠাম্মার মতো করে জড়িয়ে ধরেছে ।
ঠাম্মার কাছেই তো ঘুমাত ।
কাকিমণি আমাকে সব বলেছেন ।
অনি , বাবিনের জায়গায় মেয়ে হলে তুমি তো নয়ই আমিও কি অযত্ন করতাম – বল ?
অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে –
একদম না ।
অথচ--
বাদ দাও । এখন তো অযত্ন হচ্ছে না ।
বাবিন এলেও হবে না । কথা দিলাম ।
অনিরুদ্ধ চুমু খায় নীরাকে ।
জানি – নীরা যে পরীরও মা । নামেই জেঠিমনি ।
যেমন কাকিমণি তোমার ।
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে ।
আমি তবে দুটো মা ফিরে পেয়েছি একসাথে – কি বলো ?
ঠিক , আর কাকিমণিও তোমাকে ফিরে পেয়ে খুব খুশি অনি ।
অনি জানে । কিন্তু তবুও কাকিমণিকে প্রশ্নটা করতেই হবে ।ওর আগে এ বাড়িতে কোন বাচ্চা ছিল । আর তার কি হয়েছিল ?কেন সে জিনিষটা লুকানো হয়েছে এই প্রজন্মের থেকে ? জানতেই হবে ।
বিকালে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছিল অনিরুদ্ধ । কাকিমণির সাথে দেখা করবে বলে । এসে দেখে ডাক্তার কাকাও এসেছেন ।
পরী নীচের মাঠে খেলছিল । অনিরুদ্ধ আসবার সময় কলে করে নিয়ে এসেছে উপরে ।
খেলা শেষ ?
সুহাসিনী বললেন ।
জেঠুমনি নিয়ে এল যে ।
অনেক খেলেছ পরী । এবার হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসব আমরা ।
আচ্ছা – জেঠিমনির কাছে যাও তবে ।
পরী ছুটে চলে গেল ।
কি খাবি ?
সুহাসিনী বললেন ।
মনি পিসিকে বলে দিচ্ছি । তুমি ব্যস্ত হয়ো না ।
রুদ্রদেব বললেন
তুই বস আগে , খেটেখুটে এলি ।
অনিরুদ্ধ বসলো । দুজনেই আছে । কথাটা পারার এর থেকে ভালো সময় হয় না ।
ডাক্তার কাকা আমার আগের বাচ্চাটার কথা বললেন না তো ।
সুহাসিনী ধমকালেন
আবার এক কথা !
জানতে হবে তো ,কাকিমণি ।
সুহাসিনী বলে দাও । লুকিয়ে কেনইবা রাখবে ?
এত পুরানো কথা –
তাও জানতে হবে কাকিমণি । আমার দাদা না দিদি ?
দাদা --
রুদ্রদেব বললেন ।
মারা গেছে ?
হ্যাঁ –
এমা ! কবে কিকরে ? মা বাবা কেউ বলেনি তো আমায় !
সুহাসিনী অনিরুদ্ধর অস্থিরতা বুঝলেন ।
তর তখন মাস দ’শেক । যখন সে মারা যায় । আমার বিয়ের দু মাস আগে ।তারপরই বড় গিন্নী আরও সংসার বিমুখ হয়ে যায় ।
মারা গেল কি করে ?
যতদূর শুনেছি ভেদবমি –
রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন
না , রক্তবমি – শুধু রক্তবমিই নয় – চারিদিক থেকে রক্ত—
অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল
বাবিন –বাবিন ও তো –
হ্যাঁ , দুটো কেসে আনফানি সিমিলারিটী আছে , অতা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা । তার বয়সও চার – সাড়ে চার ছিল তখন ।
কি ? তার কোনও ছবি নেই ?
আমি এসে থেকে ছবি দেখিনি । দু মাসেই সব সরানো হয়ে গিয়েছিলো । এক গুরুদেবের আদেশে । তোর ঠাকুরদা ঠাকুমা খুব মানতেন ওনাকে ।তন্ত্র মন্ত্রের জেরে কারো শত্রুতায় এই অপমৃত্যু এতা মানতেন ওঁরা ।
সে কি ? ঠাকুরদা তো শিক্ষিত মুক্তমনা ছিলেন জানি ।
বাবিনের মৃত্যুটাকেও হয়তো এখন ওনারা থাকলে সেভাবেই মানতে হতো । তন্ত্র মন্ত্রে খুব বিশ্বাসী ছিলেন দুজনেই তো । গুণিন ডাকা হতো । ঝাড় ফুঁক করা হতো ।
রুদ্রদেব হাসলেন ।
তবে সুহাসিনী বিয়ে করে এসে সবটুকু জানে এবং জেনেই জানিনা হয়ত সংস্কারবশত তোকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করত না ।
সংস্কার কিনা জানি না । তবে ওকে কাছ ছাড়া করতে ভয় হতো আমার । মনে হতো আবার কিছু খারাপ ঘটবে ।
রুদ্রদেব বললেন
হয়ত পুরোটাই সমাপতন । তবুও দুই জেনারেশনেই ফার্স্ট বর্ণ মেল চাইল্ড – অবাক লাগে –
অনিরুদ্ধ চিন্তিত হল
কিসের জন্য
সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন । তারপর বললেন –
অনেক স্পে্কুলেশনই তো করা যায় অনি ।
রক্তবমি বিষ প্রয়োগেও তো হতে পারে ডাক্তার কাকা !
পারে । সুহাসিনী তাই মনে হয় নিজে না চেখে তোকে কিছুই খাওয়াত না ।
নিজের রান্না ছাড়াও খাওয়াতাম না ।
বাবিন ও কি তবে এভাবেই—
না না --- ওর তো ডেঙ্গু ছিল ।
সুহাসিনী ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন ।
কে ? কে ওখানে ?
পর্দার ওপাশ থেকে ছায়াটা সরে গেল যেন ।
অনিরুদ্ধ ছুটে গিয়ে দেখতে গেল । কিন্তু কেউ নেই ।
কে ছিল ?
কাকিমণি মুখটা কঠিন করলেন ।
জানি না । তবে যা জানলে সেটা আর কাউকে বলবে না , অনি।ভাইদের নয়, নীরাকেও নয়।
অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকল । ও যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে এ তো মস্ত ষড়যন্ত্র ! এই জাল ওকে কাটতে হবে । কাটতেই হবে ।
পর্ব – ১৫
আজ টাইম হবে ?
শাঁওল এর ফোন পেয়ে ঘড়ি দেখল অনিরুদ্ধ।আজ অফিসে কোন মীটিং নেই বা কোন শ-রুম ভিজিটে যাওয়ারও নেই ।
হতে পারে । তোর স্কুলে ঢুঁ মারব একবার ।
কখন আসবে ?
ফোন করব ।
টিফিনে এলে ভালোভাবে কথা হবে ।
আচ্ছা ।
অনিরুদ্ধ ভাবল পরীকে নিয়ে যাবে । ওকে তো তেমন ঘুরতেও নিয়ে যাওয়া হয় নি । ওখানেও ছোট বাচ্চারা আছে । ওর ভালো লাগবে ।
পরীকে নিয়ে যাবে ?
হ্যাঁ , একটা বাচ্চাদের স্কুল দেখতে যাচ্ছি , গেস্ট হিসাবে – ভালো লাগবে ওর ।
সে তো লাগবেই । তবে বেশী দেরী করো না ।
নীরা বলল ।
পরীকে চোখে হারাচ্ছে জেঠীমনি ।
অনিরুদ্ধ ইচ্ছা করেই বলল ।
নীরা পরীকে আদর করলো ।
হারাবে না ? আমার সোনা মেয়ে বলে কথা ।
তাহলে আজ স্কুল যাবো না জেঠিমনি । বেড়াতে যাবো ?
অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নিলো ।
একদিন বেড়াতে যাই ? পরীমনি কি বলছে ?
ইসস – পরীমনি কে ?
পরীমনি মানে পরী । এই যে জেঠুমনি জেঠিমনি – তাই পরীমনি পরী কি বলছে – স্কুল যাবে ? কামাই করবে না?
পরী একটু ভাবল ।
কামাই করা খারাপ । কিন্তু বেরুও ভাল । জেঠিমনি যাবে না ?
নীরা অবাক হল ।
জেঠিমনির এত খেয়াল মেয়ের ?
অনিরুদ্ধ বলল
চলো নীরা , তুমিও চলো ।
না, সবাই গেলে হবে অনি ? বাবিন এলে ?
অনিরুদ্ধ কথা বাড়াল না ।
আচ্ছা আমরাই যাই তবে । জেঠূমনি আর পরী । মেয়েকে রেডি করিয়ে দেবে?
পরীর চোখের অবাক ভাব ঢাকতেই বলল অনিরুদ্ধ ।
দিচ্ছি । পরী – চল মা । স্নান করিয়ে , খাইয়ে রেডি করিয়ে দিই ।
তোমার কষ্ট হবে জেঠিমনি । ঠাম্মাকে ডাকো।
নীরা হেসে ফেলে । পরীকে কোলে নেয় ।
কিছু কষ্ট হবে না । বাবিন দাদাকে সব কে করায় ? জেঠিমনিই তো ।
পরী কিছু বলে না আর । জেঠিমনিকে বাবিন দাদা নিয়ে কিছু বলতে মানা করেছে ঠাম্মা ।
গাড়িতে যেতে যেতে জেঠুমনিকে প্রশ্নটা করেই ফেলল পরী ।
জেঠুমনি বাবিন দাদা তো নেইই । তাহলে জেঠিমনি কেন এখনো –
অনিরুদ্ধ প্রশ্নটা বোঝে ।
জেঠীমনি বাবিন দাদাকে খোঁজে আজ—তাই ।
বাবিন দাদা ফিরবে আবার ?
অনিরুদ্ধ ঘুরিয়েই উত্তর দিল ।
খুঁজে দেখি –
বাবিন দাদা ফিরলে খুব ভাল হবে জেঠুমনি ।
অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নেয় । দুগালে চুমু খায় ।
কেন , পরী ?
ও বাড়িতে দুটো দাদা ছিল তো । খেলা যেত । এখানে শুধু একা একা খেলা ।
বাবিন দাদাকে মনে আছে তোর ?
পরী ঘাড় নাড়ায় ।
হ্যাঁ ।
অমনি হ্যাঁ ? কতোটুকু ছিলি সে সময় ?
বাবিন দাদা সবসময় ছুটে বেড়াত । বসত না কোথাও । সবসময় সবাই ছুটছে ওর পিছনে ।
এগুলো তো গল্প শুনেছিস ।
না না – মনে আছে ।
অনিরুদ্ধ হাসল ।
বাবিন দাদাকে দেখলে চিনতে পারবি ?
হ্যাঁ – আমাকেও নাও তোমার সাথে । বাবিন দাদাকে খুঁজবো ।
টরটরে মেয়ে আমার ।
অনিরুদ্ধ পরীকে আরও আদর করে দিলো ।
জেঠিমনিও এটা বলে যখন আদর করে ।
আমাদেরই তো মেয়ে ।
ওখানে ঠাম্মা ছাড়া কেউ আদর করত না ।
বলেই চুপ করে যায় পরী ।
বাবা-মা এলে বলে দিও না যেন ।
কাকিমণির তাড়ার কারণ বুঝতে পারল অনিরুদ্ধ ।
বলবো না , পরী এখানে এসে খুশী ?
খু-উ-ব , জেঠিমনি বাবিন দাদাকে পেলেই হাসি খুশি থাকবে সবসময় । তখন আরও ভালো হবে ।
জেঠিমনির দিকে খুব নজর পরীর ?
কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমায় যে ।
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।
চল – চলে এসেছে স্কুল ।
শাঁওল খুব খুশি ছিল অনিদাকে দেখে । কোলে পরীকে দেখে বলল –
কে গো অনিদা ?
আমার মেয়ে ।
মেয়ে আছে তোমার ? দাদাভাই বলেনি তো ।
আরে প্রতীক জানে না ।তবে পোশাকি ভাবে ভাইঝি ।কাজিনের মেয়ে । কিন্তু এখন আমাদের কাছেই থাকে ।
ওমা ! কি মিষ্টি ! কি নাম তোমার ?
পরী ।
পরী বলে উঠলো ।
স্কুল যায় ?
প্লে – স্কুল ।
সামনের বার এখানেই দিয়ে দাও ।
দেবো । তুই আছিস যখন ।
তুমি কে ?
শাঁওল হেসে ফেলে ।
আমি একটা আনটি । অনি দাদার বন্ধুর বোন ।
ও – তাহলে পিসি । তাই না জেঠুমনি ?
অনিরুদ্ধ দুষ্টু হাসি হেসে ফেলে ।
পিসি – তাই তো হয় হিসাব মতো ।
একদম নয় , আনটি ।
শাঁওল চোখ মারে ।
চলো , ফাদারের ঘরে বসবে ।
অনিরুদ্ধ বলল
চল—
ফাদার আগাস্তিনের ঘরে বসে কথা বলছিল অনিরুদ্ধ । মুখার্জি অ্যান্ড সন্স এর মালিক – এটা ফাদার শাঁওলের থেকে আগেই জেনে গেছেন । তাই আলাদা খাতির পাচ্ছিল অনিরুদ্ধ । শুধু স্কুল নয় এটা ।সাথে একটা বয়েজ অরফ্যানেজ ও আছে ।অরফ্যান ছেলেরাও এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় । প্রতি ক্লাসে পাঁচজন । ওয়ান থেকে টুয়েলভ । নার্সারি থেকে কেজি আরফ্যানেজেই পড়ান হয় । সেখান থেকে প্রথম পাঁচজন এই স্কুলে পড়ে । আর বাকিরা একটু দুরের আর একটা স্কুলে । সেটা বেশ কম এক্সপেন্সিভ আর কম দামীও । আরফ্যানেজ পুরোটাই চ্যারিটি বেসড । এই স্কুলের স্টুডেন্টদের ডোনেসনের উপর ।কিছু এনজিও ট্রাষ্টের সরকারের এবং ব্যাক্তিগত ডোনেসনের উপর চলে । বিদেশ থেকেও কিছু ফান্ড আসে ।অনিরুদ্ধ মুখার্জির কাছ থেকেও কিছু আশা করেন – সেটা বিনম্র ভাবে জানিয়ে দিলেন ফাদার আগাস্তিন ।অনিরুদ্ধর না দেবার কিছু নেই । বিশেষত আরফ্যানেজের জন্য ও দেবে । মা – বাবা হারা ছোট ছোট ছেলেরা থাকে ওখানে । বাবিনের বয়সী ছেলেরাও থাকে । পকেট থেকে চেক – বুক বার করতে যাচ্ছিলো অনিরুদ্ধ । হঠাৎই—
মে আই কাম ইন , ফাদার ?
ছোট্ট বাচ্চার গলা শুনে ও তাকাল ।এমন অবাক ও জীবনে হয়নি ।কাকে দেখছে ও সামনে ?কাকে ! অনিরুদ্ধ কিছু বলার আগেই পরী বলে উঠলো –
জেঠুমনি ! বাবিন দাদা !
শাঁওল অবাক হল –
বাবিন কে ? ও তো অনিকেত । ওয়ানে পড়ে । আরফ্যানেজের বাচ্চা ।
ফাদার আগাস্তিন পরীকে প্রশ্ন করলেন
বাবিন দাদা ? তুমি চেনো একে ?
বাবিন দাদা ! বাবিন দাদা ! জেঠুমনির ছেলে , জ্জেঠূমনি –
অনিরুদ্ধ নিজেকে সামলে নিয়েছিলো ততক্ষণে । বাবিনের মতই দেখতে । খুব খুঁটিয়ে দেখলে ফারাক করা সম্ভবনয় । বছর ছয়েক বয়স ।
অনিকেত এস – কি বলবে ?
অনিকেত এসব কথায় ঘাবড়ে গিয়েছিল ।
ফাদার , পরে আসব ?
না , না , এসো ।
ফাদার বলেন ।
অনিরুদ্ধ বাবু , অনিকেত কিন্তু খুব ইনটেলিজেন্ট । ওই স্কুল থেকে এই স্কুল এ এসেও কিন্তু ফার্স্টই হয় ।
বাহ , খুব দুষ্টু , তাই না ? অনিকেত খেলতে চায় ?
শাঁওল হাসে ।
না না , ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে । মনিটর ও , ওর ক্লাসের ।
অনিরুদ্ধ বুঝল দেখতে সদৃশ হলেও স্বভাবে অনেক ফারাক তবে ।
বাবিন দাদা শান্ত হয়ে গেছে জেঠুমনি – জেঠিমনিকে বল –
অনিরুদ্ধ পরীকে থামাল ।
বলবো পরী , একটু দাঁড়াও ।
কাকিমণিকে ডাকতে হবে এখানে । এখনই । ডাক্তার কাকাকেও ।
ফাদার , হি রিসাম্বলস মাই সন ।
রিয়েলি ! আপনার ছেলে –
অনিরুদ্ধ চাপা দিয়ে বলে
হি ইজ ন মোর ।
ওহ –
আমি কি বাড়ির বড়দের ডাকতে পারি ?
এখানে ? ডাকুন না । অনিকেতকে দেখাবেন তো ?
হ্যাঁ—
ডাকুন ।
অনিকেত বুঝতে পারছিল না এটা কি হচ্ছে ? ওকে ফাদারের ঘরের পাশের ঘরে বসিয়ে রেখেছে । ওই স্যুটেট বুটেট লোকটা কে ? আর বাচ্চা মেয়েটাই বা কে ? এর মধ্যেই বার কয়েক এসে দেখে গেছে অনিকেতকে ।
বাবিন দাদা – আমি পরী – তোমার বোন ।
পরীকে কোনোদিন দেখেনি অনিকেত । কিন্তু পরী তাকে দেখেছে ।ওর বোন বলছে । তাহলে কি পরী জানে ওর মা বাবা কোথায় ? নাকি ওই মস্ত বড় লোকটা জানে ? অনিকেত দেখেছে অনেক বন্ধু ওর চেয়ে ছোট এমনকি বড়দেরও তাদের মা বাবা এসে নিয়ে যায় । অথচ অনিকেতকে কেউ নিয়ে যায়নি কোনোদিন । তাহলে কি ওরও মা বাবা আসবে ? নিয়ে যাবে ? আরও দুজন এসেছে ।গ্র্যান্ডপা গ্র্যান্ডমার মত বয়সের । তারাও দেখেছে অনিকেতকে । সবাই অবাক । এত অবাকই বা হচ্ছে কেন ? সবাই তাকে বাবিন বলছে । বাবিন কে সে তো নিজেই জানে না । তাহলে ও বাবিন হবে কি করে ? কথায় ধাঁধা লাগছে অনিকেতের । ছোট মাথাটায় কিছু ঢুকছিল না ।
ফাদার – ছেলেটি সত্যিই আমার নাতি বাবিনের মত দেখতে ।
সুহাসিনী বললেন ।
অনিরুদ্ধ পরীকে নিয়ে বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ।শাঁওলও ।
সে তো বুঝলাম । অবাকও হলাম ।
বাবিন তো দেড় বছর আগে –
হ্যাঁ , তাই তো শুনছি । সত্যিই ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ ।
অনিকেত কি জন্ম থেকেই এখানে ?
হ্যাঁ –ঠিক জন্ম থেকে না হলেও জন্মের দিন দু তিনেকের মধ্যেই – কেউ ফেলে গিয়েছিল । আরফ্যানেজের বারান্দার দোলনায় ।
রুদ্রদেব বললেন
দেখে তো ভালো ঘরেরই মনে হচ্ছে ।
আমরা ঘর দেখি না , ডাক্তার বাবু ।ছেলে দেখি । ছেলেটি খুব ভালো । ক্লাসে প্রথম হয় ।
রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন ।
আমরা যদি ওকে নিতে চাই – আই মিন –
আডপ্সন ?
হ্যাঁ--
অনিরুদ্ধ বাবু নেবেন ?
হ্যাঁ , অনিই ।
তা বেশ । ওনার স্ত্রীকে নিয়ে আসুন ।কথা বলি আমরা ।
সুহাসিনী বুঝলেন এভাবে হবে না ।
ফাদার , নীরা অসুস্থ । পুত্রশোক সামলাতে পারেনি । ওকে আনাটা –
কিন্তু তার মতামত ?
বাবিনকে না পেলে সে মতামত জানাতে পারবে না ফাদার ।
রুদ্রদেব বললেন ।
ওহ । এই মানসিক অবস্থায় অনিকেতকে সামলাবেন কি করে ?
বাবিন ফিরে এলেই তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে নীরা ।
অনিকেত তো বাবিন নয় । এটা অন্য যে কারোর থেকে নীরা দেবী ভালো বুঝবেন । মানবেন কি ?
আমরা আছি তো । আমরা মানাবো ।
চাপিয়ে দেবেন ?
তা কেন ? বোঝাবো ।
সুহাসিনী বললেন ।
যদি না মানে তবে অনিকেতের ভবিষ্যৎ ?না , না , এভাবে হয় না ।
অনিরুদ্ধ পরীকে বাইরে রেখে ঘরে এল তখনি ।
ভবিষ্যৎ ভাবনা আমার , ফাদার । ওকে নিজের বাবিন হিসেবেই নিয়ে যাবো । সেভাবেই যাতে বড় হয় , মানুষ হয় –সবটা আমিই দেখবো ।
তাছাড়া পরীকেও তো নীরা মানুষ করছে এখন ।
সুহাসিনী জোর দিলেন ।
লিগ্যাল প্রসিডিওর কিন্তু বজায় রাখতে হবে ।
অবশ্যই –
রুদ্রদেব বললেন । এই জুয়াটা ওদের খেলতেই হবে ।
প্রথম দু – মাস আমরা নজর রাখবো ।শাঁওল যাবে আসবে নিয়মিত । তেমন দেখলে –
রাজি আমরা –
সুহাসিনী বললেন । এই সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না ।না খুঁজতেই বাবিনের মত বাচ্চার খোঁজ পাওয়া গেছে ।নীরাকে অবসাদ থেকে তুলে আনার শেষ খড়তকুটো ।একে ঈশ্বরের ইচ্ছা মনে করছেন সুহাসিনী । অদ্ভুত সমাপতন । একে আঁকড়ে রাখতে চান সুহাসিনী ।ছাড়তে চান না ।
মুখার্জিরা আপনাদের আরফ্যানেজটা ভবিষ্যৎ এ নিয়মিত দেখভাল ও করতে পারে ফাদার ।
অনিরুদ্ধ ব্যবসার লাইন এ খেলল ।ফাদার এবার নরম হলেন ।
বলছেন ?
সুহাসিনী অনির বুদ্ধিতে খুশী হলেন ।
হ্যাঁ অনির তাতে কন আপত্তি নেই । আমাদেরও ।
বেশ যাকে নিয়ে যাবেন --- তাকে কি বলবেন ?
সে চিন্তাটাও আমাদের ফাদার । সে যে বাবিন সেটাই বলা হবে তাকে । আপনারা কেউ দ্বিমত করবেন না – তাহলেই হবে ।
রুদ্রদেব বললেন ।
ভালো , তবে অনিকেত বুদ্ধিমান আর সেনসিটিভ ছেলে । অভিনয়ে যেন ফাঁক না পড়ে ।
পড়বে না । শুধু অনিই নয় , আমরাও আছি তো ।
সুহাসিনী বললেন ।
হ্যাঁ আপনারা গ্র্যান্ডফাদার গ্র্যান্ডমাদার , দুজনেই এসেছেন । আপনাদের বিচক্ষণতার উপর ভরসা আছে ।
রুদ্রদেব ভুলটা শুধরাতে যাচ্ছিলেন । সুহাসিনী আটকে দিলেন । অভিজ্ঞ চোখ ভুল করে না।যে ভুলটা ঠিক – পৃথিবীর সবথেকে ঠিক—তাকে অন্য কেউ চিনে না নিলেও ফাদার নিতে পেরেছেন ।সুহাসিনী সেই ঠিকটাকে ভুল করবেন না আবার ।
পর্ব – ১৬
অনিদা এটা ঠিক করছ তো ?
শাঁওলের কথায় তাকায় অনিরুদ্ধ ।
ভুল করছি কেন মনে হল তোর ?
অনিকেত তো বাবিন নয় , বৌদি যদি না মানে ?
আমি মানাবো । আর আমরা সবাই তো মানছি ।
তাও – অ্যাডপ্সনটা –
অনিরুদ্ধ হাসল ।
এখানকার অরফ্যানেজ খারাপ বলছিস ?
তা কেন?
আর ও তো তোর সবথেকে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র—ফাদার বললেন ।
আরফ্যান তো –
ওহ , তাই বল । এই ট্যাবু নিয়ে তুই স্কুল এ পড়াস , পাগলি ?
স্কুলে পড়ান আলাদা আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া আলাদা - অনিদা ।
আমি মন থেকে মেনেই নিয়ে যাচ্ছি ।
শাঁওলের হাত ধরল অনিরুদ্ধ ।
তোর খারাপ লাগাটা বুঝছি ।তোর এখানে এসেছি ।তোর স্কুলেই অনিকেতকে পেলাম । দায়টা তোর উপর না পড়ে । এটাই ভাবনা । তাই তো ?
শাঁওল মাথা নিচু করল ।
কেউ দায় দেবে না ।
ও বাড়ি যেতেও তো আমাকে—
তোর বৌদিকে বুঝতে দিবি না কেন এসেছিস ।তাহলেই হবে । বাবিন পরীর টিউটর হয়ে আসবি না হয় ।
শাঁওলের চোখে জল দেখল অনিরুদ্ধ । ওর হাতে হাত রাখল । শাঁওল হঠাত জড়িয়ে ধরল অনিরুদ্ধকে , জোরে । অনিরুদ্ধ আটকাল না । গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আস্তে আস্তে । শান্ত করল ওকে ।
সই সাবুদে নীরার সই লাগবে না তো ?
সুহাসিনী বললেন ।
না , আপাতত সুপারভাইজারি আডপ্সন হচ্ছে ।ফাদার নিজের দায়িত্বে ছাড়ছেন অনিকেতকে ।
আমাদের সাথে ।
অনিরুদ্ধ চশমা ঠিক করল ।
ট্রাস্টিদের বলে নিলেন – কিছুক্ষণ আগে ।
দু মাস তাহলে নজরদারি সত্যিই চলবে ?
হ্যাঁ , শাঁওলই যাবে ।
ও যদি নেগেটিভ রিপোর্ট দেয় ।
দেবে না । ও আমার খুব কাছের বন্ধুর বোন ।আর আমরা সবাই আছি কাকিমণি ।নেগেটিভ রিপোর্ট হবে কেন ?
নীরাকে নিয়েই চিন্তা আমার অনি ।
তুমি দেখে রাখবে ।
এই আনাটা নিয়ে তোর কাকা ও চুপ করে থাকবেন না ।
আটকে দেবে তোমাকে ?
সুহাসিনী অনির হাত ধরলেন ।
আটকাতে পারবেন না ।
ঝগড়া আশান্তি ?
সে ভয় করেছি কোনোদিন ? কেবল আলাদা হওয়াটাই ঠেকাতে পারলাম না ।বাকি তিনজনই এত চাইছিল ।
তোমার আলাদা হবার একটুও ইচ্ছা ছিল না – বল ।
একেবারেই না । তোর কাকা চাইল । আমার বাপের বাড়িরও যে মদত ছিল না তা নয় । তারা বলল আলাদা হলে ব্যবসা জমবে ।
এখন তো আমার বাবার অ্যাকসিডেন্টটাকেও প্লানড মনে হয় আমার ।
অনিরুদ্ধ স্পষ্ট করল ।
বিশেষত আমার আগের বাচ্চাটার কথা জেনে –
সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন ।
তোমার এ ব্যাপারে কি মনে হয় কাকিমণি ?
অনিরুদ্ধ জিগ্যাসা করে আবার ।
আমার মনে হওয়াতে কি কিছু বদলাবে ?
তাহলেও –
দেখো অনি – আমি এই মুহূর্তে নীরার সুস্থতা আর পরীর সুরক্ষা চাই ।সাথে এই বাচ্চাটারও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা । এটা তুমিই আমাকে দিতে পারো । কারণ তুমি যোগ্য ।
যোগ্য আর কই? বাবিনকে তো হারিয়ে ফেললাম কাকিমণি ।
একে যাতে না হারাও তার জন্য সব সময় সতর্ক থাকবে ।
কিভাবে ?
নিজের ছোটবেলা মনে কর অনি । আমি যেভাবে সতর্ক থাকতাম ।
অনিরুদ্ধ বুঝল ।
চোখের আড়াল করবো না ওকে । অথচ আমি তো অফিসে থাকবো ।
সেইসময়টার অনেকটা অবশ্য অনিকেতও স্কুলে থাকবে । ও স্কুল থেকে ফিরলে তুমি না আসা অব্দি আমি থাকব ।
এতো ভয় কেন কাকিমণি ?
জানি না , জানতেও চাই না । বিশ্বাস অবিশ্বাস সব নিজের ব্যাপার । কিন্তু আমি যা বলছি সব মেনে চলবে । বিশেষত বাবিনের অমনটা হবার পর থেকে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে ।
কারোর সাথে ছাড়ব না বলছ ?
ঠিক , আর কারো হাতে খাওয়াবেও না । নীরা , তুমি , আমি – এ বাদে আর কেউ না ।
বাবিনকে মনিপিসিও খাওয়াত ।কাকিমণি কি তবে মনিপিসিকেও – প্রশ্ন করার আগেই ডাক্তার কাকা এলেন ।
হল , মায়ে – পোয়ে কথা ?
হল –
তাহলে চলো – নাতিকে নিয়ে বাড়ি যাই ?
তোমরা যাও – আমি পরে যাবো , একা ।
অচ্যুতকে কোথায় আছো বলেছ ?
হিন্দুস্থান পার্ক , রুমেলিদের বাড়ি ।
ওখানে গোয়েন্দাগিরি করবে না তো ?
রুমেলিকে বলা আছে । আমার থেকে তোমার ভয় বেশি দেখছি , রুদ্র ।
রুদ্রদেব অপ্রস্তুত হলেন ।
জানলে তোমার বিপদ হবে যে ।
আমার বিপদের চিন্তা তুমি কর ?
রুদ্রদেব আহত হলেন ।
এতদিন পর সেটা মনে হয় তোমার , যে করিনা ?
করলে চৌত্রিশ বছর আগের বিপদটা থেকে বাঁচাতে আমায় রুদ্র ।
ডাক্তার কাকা চুপ করে গেলেন ।
একটা তেইশ বছরের ডাক্তারি পড়ুয়া ছেলের কতটা ক্ষমতা থাকে সুহাসিনী ?
তোমার ক্ষমতা না থাকলেও তোমার বাবাকে বুঝিয়ে---
সুহাসিনীর গলায় উষ্মা ঝরে পড়ে ।
অবশ্য তার তখন অনেক স্বপ্ন । ছেলে বড়ো ডাক্তার হবে । বিলাতে যাবে ।হয়েছেন বড়ো ডাক্তার ।বিলাত ফেরত ডাক্তার রুদ্রদেব ব্যানার্জি । এম ডি , এম আর সি পি । কলকাতার সেরা তিনজনের একজন । কত ফিজ যেন রুদ্র , দুই না তিন হাজার ?
রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাত চেপে ধরেন ।
সু , থাক না । বাদ দাও । ছেলে শুনছে সব । তোমার যা আভিমান আমাকে একান্তে বোলো শুনবো ।
অনিরুদ্ধ উঠতে গেলো । সুহাসিনী ওকে হাত ধরে বসালেন ।
ছেলে বড় হয়েছে । সব জানুক । আর বাদ ? দেবো তো বটেই । বাদ তো আমিই পড়ে গেছি তোমার জীবন থেকে । সেই কবেই ।
কাকিমণি শান্ত হও । ডাক্তার কাকার কষ্ট হচ্ছে ।উনি তো আজও তোমাকে ভালোবেসেই বেঁচে আছেন ।আর কাউকে আনেননি ।
কেন আনল না ? আনত তাহলে আমি বেঁচে যেতাম এত লোকের এত কথা এত সন্দেহের হাত থেকে ।
রুদ্রদেব এগিয়ে এলেন । সুহাসিনীর মাথায় , গায়ে , পিঠে হাত রাখলেন ।
সু , ছেলে সব দেখলে সমস্যা নেই তো ? আমি আর কাউকে আনলে আমার আটকে না রাখতে পারার অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্তটা পূর্ণ হোতো সুহাসিনী ? এই যে চৌত্রিশ বছর পরেও তোমার এত কাছে মাথা উঁচু করে আসতে পারছি , সেটাও পারতাম ?
সুহাসিনী অবাক চোখে তাকালেন ।রুদ্রদেব সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলেন । অনিরুদ্ধর চোখে অজান্তেই জল এলো । নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে পূর্ণ হতে দেখলে চোখে জল আসাটাই স্বাভাবিক । সুহাসিনী কেঁপে উঠলেন যেন ।
ভুল করলাম ?
রুদ্রদেব আশঙ্কিত হলেন ।
একদম না । বিস্মৃতকাল পরে কেউ ভালবাসল তো –
রুদ্রদেব আর অনিরুদ্ধর চোখ চাওয়া চাওয়ি হোল ।
এতোটা অসুখ পূর্ণ রাখো কাকিমণি ?
অনিরুদ্ধ সুহাসিনীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল ।
কি করবো তবে ?
চলে যাও কাকাবাবুর সাথে –
অনিরুদ্ধ মন থেকেই বলল ।
ধুর পাগল ছেলে । তা হয় ? সংসার আছে না ? আর এখন তো বাবিনের দায়িত্বও নিতে হবে।
সুহাসিনী আসবে অনি । আমার কাছে একদিন না একদিন আসতেই হবে ।
রুদ্রদেব হাসলেন ।
এই বিশ্বাসেই তো বাঁচছি ।সু , তোমার ছেলে কাকাবাবু বলেছে আমায় , শুনলে ? অচ্যুতকে কিন্তু বলে না ।
রুদ্রদেবের চোখের খুশী পড়তে পারল অনিরুদ্ধ ।
তুমিই কাকিমণির যোগ্য যে । তাই বাবুটারও যোগ্য । সুহাসিনীর চোখেও একই খুশির ঝলক দেখতে পেল অনিরুদ্ধ ।
৬ থেকে ১০ পর্বগুলো পড়ুন
সুচিন্তিত মতামত দিন