নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত
নিন্দা, প্রতিনিন্দা,আবার নিন্দা… এটা এখন সংস্কৃতি। আমরা আর কোন ভদ্র,শান্ত নীতিতে বিশ্বাসী নই। আমরা এখন নিয়ম করে নিন্দে করি, মিথ্যা অপবাদ দিই, তার উত্তরে আবার মিথ্যা দিয়ে আঘাত করি। নিন্দে করি, কুৎসার পাহাড় জমা করি। আমরা এই দিয়ে উগ্র,বোধবুদ্ধি হীন হিংসা তৈরি করে চলেছি। দলগত ভাবে হিংসা করি অন্য দল কে। আমি যদি দলে থাকতে চাই...তবে অবশ্যই আমাদের বিপক্ষের দল কে প্রভূত পরিমাণে ঘৃণা করতে হবে। নইলে আমি ‘গ্রহণ যোগ্য’ নই। টিভি আমাদের সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসিয়ে ‘আন সোশ্যাল’ করেছিল। আর ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ আমাদের ‘অ্যান্টি-সোশাল’ তৈরি করেছে।আমরা যাকে খুশি,যখন খুশি,যেভাবে খুশি আঘাত করতে পারি। আমরা আর কিছু তৈরি করি না... আমরা কিছু রেখে যাব না...আমরা ঘৃণা আর নিন্দায় অতি খাঁটি ভাবে পারদর্শী হয়ে উঠছি। 

নিন্দার শেকড় আমাদের গুরুতর রকম প্রাচীন। কলহ প্রবণতা আমাদের উত্তরাধিকার। যে কোন আড্ডা তে নিন্দা হল সবচেয়ে মধুর বিষয়।তাড়াতাড়ি জমিয়ে দেয়।যেমন নতুন বউয়ের দাঁতের পাটি পায়ের গড়ন, হাঁটার আওয়াজ,বাপের বাড়ির শিক্ষা----, অফিসে নতুন আসা নভিস কলিগ, বেশী সুন্দরী হোস্টেল মেট ---তার পেছনে কি পরিমাণে নিন্দে হয় ... টক, ঝাল,মিষ্টি পরিপূর্ণ উপকরণ। কিন্তু কোথায় তার একটা সীমারেখা ছিল, আড়াল ছিল। সোশাল মিডিয়াতে ট্রোল করার যে অত্যাধুনিক সংস্কৃতি তার ব্যাপকতা ভয়ানক। সম্প্রতি একজন প্রবীণা সাহিত্যিকের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত একটি মাঝারি নিউজ পোর্টালে বার হয়। তার নীচে যে কমেন্ট দেয় সোশাল মানুষ জন তা দেখে চমকে যেতে হয়। অনেকে তাঁকে চেনেন না... তবু আক্রমণ। কুৎসিত এবং অকারণ।নাসিরুদ্দিন শাহ আর অনুপম খের এর উতপ্ত বাক্য বিনিময় দেখে কষ্ট পেলাম। কারণ দুজনকেই বড্ড ভালোবাসি। আর তার পরে সেই খবরের নীচে লাগাতার চলল ঘৃনাবাক্য বিনিময়। অবান্তর আর কুৎসিত। তারও কিছুদিন আগে প্রেমে আঘাত পেয়ে প্রেমিকা কে প্রেমিক মেরে ফেলে। প্রচুর লোক খবর টি তে হাসির ইমোজি তে লাইক দেয়।যেন সবাই দল বেঁধে বলল, “বেশ হয়েছে। এমনি করে মেরে ফেলা উচিৎ।” এমন কি অ্যাসিড অ্যাটাকের বিরুদ্ধে একটা লেখায় একজন এসে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার ইতিবাচক যুক্তি দিচ্ছে যে, ‘এটা স্বাভাবিক’ এটা হতেই পারে কারণ প্রত্যাখান হয়ে তার ‘মন খারাপ’ হয়ে ছিল। আগে হলে বিশ্বাস করতাম না। এখন করছি ।কারণ প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির ভয়াবহ ঘটনাটি র পর ৮৪ লক্ষ বার ‘রেপ ভিডিও’ গুগুল সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজা হয়েছিল।কি করছি আমরা? এটা সভ্যতা? সুস্থ অবস্থা? 

অক্ষর পরিচয় মানে শিক্ষিত এটা ভাবা আর উচিৎ নয়। ফর্সা জামা কাপড় পরা, আধুনিক গ্যজেট ব্যবহারে দক্ষ মানে মানসিক সুস্থ... না তা নয়। সংবেদনশীলতা হীন, আত্ম কেন্দ্রিক এক অদ্ভুত ভাবে নিজেদের গড়ে তুললাম আমরা। মানসিক ভাবে বদ্ধ একটা পরিস্থতি।এটা সামাজিক ও মানসিক ভাবে বদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিফলন। শিশুকাল থেকেই দেখেছি। ‘বিধবা’ হয়ে যাওয়া মানুষটার স্বাভাবিক জীবন যাপন অনেকের সহ্য হয় না। বাড়ির কাজের লোকের সন্তান দেখতে ভাল,বুদ্ধিমান,লেখাপড়ায় ভালো হলে অনেকেই মানসিক অসুস্থতা বোধ করেন। নিচু জাতের ছেলের হাতের লেখা ভালো করলে উঁচু জাতের শিক্ষক তাকে ছাগল চরাতে যাবার পরামর্শ দেন। এই অকারণ অবান্তর মানুষ কে কুৎসিত কথা বলে যাওয়া, আঘাত করার মধ্যেও আমার মনে হয় সেই একই অসুস্থতা আছে। অবশ্য এক স্নেহভাজনের কাছে শুনলাম এটা আজকাল টাকা দিয়ে কিছু মানুষকে দিয়ে করানো হয়। ‘বিষ’ পরিবেশন করানো হয়।

এখনো ভাববেন আমরা মানসিক ভাবে,সামাজিক ভাবে সুস্থ পরিবেশে আছি! আগে দিকপালদের জন্মদিন পালনের সময় শ্রদ্ধা,বানী, ফুল মালা, প্রতিযোগিতা, স্পোর্টস, পিকনিক, গানের অনুষ্ঠান হতো। এখন সেটা রূপ বদলে হয়ে গেছে।এখন যেটা আমরা সোশাল মিডিয়া তে উৎযাপন করে থাকি সেটা হল,

- তার কুৎসা,

- তিনি কিভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন,

-তিনি কাকে কাকে ঠকিয়েছিলেন, 

-কার রিসার্চ পেপার চুরি করেছিলেন, 

-তিনি কার কার সাথে শুয়েছিলেন, 

-তার বাবার কটা স্ত্রী ছিল,

- তিনি কাকে কাকে অপছন্দ করতেন

সেই সব খবর গুলোতে এক ফোঁটা সত্যির সাথে তিন ফোঁটা মিথ্যে মিশিয়ে প্রচার চলবে। আর এর চর্চা যারা যারা করবেন তারা আদৌ খুব একটা কিছু জানেন না...(যেমন আমি)

উফ্‌... এটা সংস্কৃতি। এটা চলছে । এটা নিয়ে আমরা ভাববো না! 

কুমারসম্ভবে কালিদাস লিখছেন, 

“আলোকসামান্যমচিন্তাহেতুকম্‌

নিন্দন্তি মন্দাশ্চরিতং মহাত্মাম” 

যার অর্থ হল,মন্দ বুদ্ধি মানুষেরা মহাত্মাদের কাজের নিন্দা করে থাকে।কারন সে কাজগুলো অসাধারণ এবং তাদের কারণ ও লোকে ভেবে স্থির করতে পারে না। যারা আগে কাজ করে গেছেন তাঁদের নিন্দাবাদ বন্ধ হোক।যারা আধুনিক সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব মতামত দেবেন তাঁদের সেটা দেবার জায়গা সুদৃঢ় হোক। নিন্দা নয়। ‘আমি আপনার মতের সাথে এক মত পোষণ করতে পারছি না’ সেটা বলা হোক। কিন্তু খিস্তি হয়।কাউকে খারাপ বলে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলে নিজের মত প্রতিষ্ঠা পায় না। 

একবার চেষ্টা করে দেখা দরকার, ভাবা দরকার। সত্য পরায়ণতা,সংবেদনশীলতা, যুক্তিবোধ, উদারতা বইএর পাতা থেকে নেমে আসুক... ভালো ভাবে কথা বলাটা একটা খুব ভালো গুণ... আমরা ভালো হবো না? 

যাকগে জর্জ ইলিয়ট বলে গিয়েছেন, “People are almost always better than their neighbors think they are.”। আশা করি আমরা সবাই আবার ভালো হব। নিন্দা ছাড়া আরও অনেক কাজ আছে সে গুলো পালন করবো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.